কুষ্টিয়ায় একে-৪৭সহ গ্রেপ্তার হওয়া আওয়ামী লীগ নেত্রী তাসলিমা খান আখিসহ ৪ জনের ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের ইনস্পেক্টর মিজানুর রহমান গতকাল দুপুরে আসামীদের কুষ্টিয়ার আমলী আদালত-১ এ হাজির করে তাদের ৭দিনের রিমান্ড প্রার্থনা করেন। আদালতের বিচারক ম্যাজিষ্ট্রেট আব্দুল আজিজ মন্ডল তাদের ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। ডিবির এসআই নওশাদ বাদী হয়ে মঙ্গলবার আখিসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে কুষ্টিয়া থানায় অস্ত্র আইনের ১৯-ক ধারায় মামলা করেন। এদিকে গতকাল দুপুরেই আরো এক নারী চরমপন্থিকে আটক করেছে ডিবি পুলিশ।
আখিসহ ৪ জন ৫ দিনের রিমান্ডে
সোমবার রাত পৌনে ১১ টায় একটি একে ফোরটি সেভেন, একটি শর্টগান ও ৮২ রাউন্ড গুলিসহ পুলিশের হাতে ধরা পড়েন কুষ্টিয়া শহর মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদিকা তাসলিমা খান আখি। কুষ্টিয়া-পাবনা মহাসড়কের ত্রিমোহনী নামক স্থানে পুলিশ চেক পোষ্টে তাদের বহনকারি সাদা রঙের মাইক্রোবাস তল্লাশ করলে আখির কোমরে গুঁজে রাখা অবস্থায় এ অস্ত্র পাওয়া যায়। এ সময় ওই গাড়িতে থাকা আরো ৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃত অন্য তিনজন হলো পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত কুষ্টিয়া শহরের হাউজিং সি/২ এলাকার চরমপন্থী গুড় সোহেলের স্ত্রী রানী খাতুন (২২), কালিশংকরপুরের জামাল উদ্দিনের ছেলে রাজ্জাক (৩৫) ও মাইক্রোবাসের চালক ইবি থানার মহিষডাঙ্গা গ্রামের উমেদ আলীর ছেলে শাহীন (৩২)। পুলিশ গ্রেফতারকৃতদের স্বীকারোক্তি মোতাবেক তাদের সাথে নিয়ে রাতেই অভিযান চালিয়ে দৌলতপুরের ডাংমড়কা গ্রামের নিজ বাড়ি থেকে এসব অস্ত্রের সরবরাহকারি আক্কাস আলী (৪৫)কে গ্রেফতার করে।
সোমবার রাতে এদের গ্রেফতার করা হলেও জিজ্ঞাসাবাদ ও অভিযান অব্যাহত থাকায় মঙ্গলবার তাদের থানায় সোপর্দ করা হয়। এইদিন আখিসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে কুষ্টিয়া থানায় অস্ত্র আইনের ১৯-ক ধারায় মামলা করা। মামলা নং-৩। এদের মধ্যে ড্রাইভার শাহীনকে বাদ রেখে বাকী চারজনকে ৭ দিনের রিমান্ড চেয়ে গতকাল বুধবার আদালতে তোলেন মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা। এদিকে রিমান্ড না চাওয়া ড্রাইভার শাহীনকে গতকাল সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আকরাম হোসেনের আদালতে হাজির করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়েছে।
মামলায় যা বলা হয়েছে
ডিবির পুলিশের এসআই নওশাদ বাদী হয়ে মঙ্গলবার সকাল পৌনে ১০ টায় কুষ্টিয়া থানায় মামলাটি দায়ের করেন। এতে বলা হয়, হাইচ মাইক্রোবাসে করে আসামীরা কুষ্টিয়ার উদ্দেশ্যে যাচ্ছিল। সোমবার রাত সাড়ে ১০ টায় সিগনাল লাইটের মাধ্যমে মাইক্রোবাসটি থামানো হয়। মাইক্রো থেকে নেমে তাসলিমা খান আখি কোমরে হাত দিতে গেলে মহিলা কনষ্টেবল ডলি খাতুন ও সালেহা খাতুন তাকে জাপটে ধরেন। পরে তার কোমরের ডান পাশ থেকে একটি একে ৪৭ রাইফেল (এসএমজি) ও বাম পাশ থেকে একটি শর্টগান বের করা হয়।
তার ০১৮১৬৫৯২৫৩৭ নাম্বারের মোবাইল ফোনও জব্দ করা হয়। গাড়ীতে থাকা রানীর ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে মোট ৬৫ রাউন্ড তাজা ও ১ রাউন্ড গুলির খোসা উদ্ধার করা হয়। রানীর যে মোবাইল ফোনটি জব্দ করা হয়েছে তার নাম্বার ০১৯২৫৬৮৬৭৫৬। গাড়ীতে থাকা অপরজন আব্দুর রাজ্জাকের গেঞ্জির নীচ থেকে দুটি ম্যাকজিন পাওয়া যায়। তার কাছ থেকে একটি নকিয়া ও অপরটি সিটিসেলের মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়।
মামলায় উল্লেখ করা হয় আখি গত ৮/৯ বছর ধরে চরমপন্থি সংগঠন গণমুক্তিফৌজের হয়ে কাজ করছে। অন্য আসামীরা একই দলের হয়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে তথ্য ও অস্ত্র আদান প্রদান করে থাকে।
আরেকজন মহিলা চরমপন্থি গ্রেপ্তার
পুলিশ জানায়, বুধবার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে কুষ্টিয়া শহরের মজমপুর এলাকার একটি মোবাইল ফোনের দোকান থেকে বৈশাখী রহমান ওরফে চুমকি (২৪) নামের আরেক মহিলা চরমপন্থীকে আটক করা হয়েছে। চুমকি শহরের আড়–য়াপাড়া এলাকার আব্দুর রশীদের মেয়ে। কুষ্টিয়া সহকারী পুলিশ সুপার (সদর দপ্তর) আলমগীর হোসেন জানান, চুমকি দীর্ঘদিন ধরে চরমপন্থী দলের হযে বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকান্ড ঘটিয়ে আসছে।
সে চরমপন্থী সংগঠন গণমুক্তিফৌজের কিলিং মিশনের অন্যতম সদস্য। চরমপন্থী সংগঠনের হয়ে প্রতিপক্ষ গ্র“পের ক্যাডারদের প্রেমের ফাঁদে ফেলে বিয়ের পর তাকে হত্যা করে আসছে। তিনমাস আগে ঘটে যাওয়া সবুজ হত্যাকান্ডসহ অপহরন, মোটর সাইকেল ছিনতাই ও মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত সে। চুমকি পুলিশকে জানায়, কয়েক বছর আগে মানিকগঞ্জে মামুন নামে একজনকে বিয়ে করে সে। মামুন ষ্ট্রোক করে মারা যাওয়ার পর কুষ্টিয়ায় এসে আমলার সবুজ নামে আরেকজনকে বিয়ে করে।
পুলিশ জানায়, গণমুক্তিফৌজ নামের চরমপন্থী সংগঠনের হয়ে সে সবুজকে প্রেমের ফাদে ফেলে। পরে সন্ত্রাসীদের গুলিতে মিরপুর উপজেলার আমলা বাজারে সবুজ নিহত হয়। এরপর সে নতুন শিকার হিসেবে বেছে নেয় শহরের চৌড়হাসের রিমন নামে এক যুবককে। বর্তমানে সে তার সঙ্গে শহরে বসবাস করছিলো বলে পুলিশ জানিয়েছে। এছাড়া সে ভেড়ামারা শহরে আনোয়ার নামের এক যুবককে অপহরণ করে তার মটর সাইকেল ছিনিয়ে নেয় বলে পুলিশ জানিয়েছে।
চরমপন্থি দলে ২৫ নারী সদস্য
সহকারী পুলিশ সুপার (সদর দপ্তর) আলমগীর হোসেন আরো জানান, কুষ্টিয়ায় সন্ত্রাস বিরোধী অভিযান জোরালো করার পর চরমপন্থীরা অস্ত্রপাচার এবং অন্যান্য অপরাধ কর্মকান্ডের জন্য নারী সদস্যদের বেছে নেয়। গনমুক্তিফৌজ, জনযুদ্ধ ও গণবাহিনীসহ বিভিন্ন চরমপন্থী সংগঠনের সঙ্গে কুষ্টিয়ার অন্ততঃ ২৫ জন নারী সম্পৃক্ত রয়েছে বলে পুলিশের ধারণা। তবে এ সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। এরমধ্যে পুলিশের নিকট ১২ জনের তালিকা রয়েছে। যার মধ্যে ৫জন হলো নিহত চরমপন্থির স্ত্রী।
এসকল নারীরা বিভিন্ন ব্যাক্তির ছত্রছায়ায় থেকে অপরাধমূলক বিভিন্ন কাজ করে আসছে। আওয়ামীলীগ নেত্রী আঁখি গ্রেফতার হওয়ার পরে নারী সদস্যদের গ্রেফতারে পুলিশ বিশেষ অভিযান শুরু করেছে। তিনি বলেন, কৌশল পাল্টেও শেষ রক্ষা হবে না চরমপন্থী সংগঠনগুলোর। ক্রসফায়ার আর পুলিশের সাড়াশি অভিযানে কোনঠাসা হয়ে পড়া চরমপন্থী সংগঠন গণমুক্তিফৌজের নারী সদস্যদের দিয়ে নাশকতা সৃষ্টি করার যে মাষ্টার প্লান করেছিল তা শুরুতেই ভেঙে দিতে পেরেছে কুষ্টিয়া পুলিশ। সর্বশেষ গ্রেপ্তার হওয়া চুমকি তার সহযোগি শহরের আমলাপাড়ার দুই বোন নাসরিন ও চম্পার নাম বলেছে।
চুমকির দাবি এরা দুজনও গনমুক্তিফৌজের সদস্য।
আখির যাত্রা শুরু যে ভাবে
আখির ভাই নিপু কুষ্টিয়া পলিটেকনিক কলেজে অধ্যয়নের সময় বর্তমান এক শীর্ষ চরমপন্থি নেতার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। সেই সময় থেকেই তার সাথে আখির পরিচয় হয়। পরে ওই কলেজ ছাত্র যখন শীর্ষ চরমপন্থি নেতাতে পরিণত হন তখন আখি তাদের হয়ে কাজ শুরু করেন। গতকাল আদালতে যখন আখিকে হাজির করা হয় তখন নিপুকে হন্তদন্ত হয়ে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়।
দিনে ব্যবসায়ী রাতে চরমপন্থি
এলুমিনিয়াম, মেলামাইন ও কাসা-পিতল সামগ্রীর দোকানী আব্দুর রাজ্জাক। কুষ্টিয়া শহরের রক্সিগলির আলিয়া মাদ্রাসা মার্কেটে আরফা ট্রেডার্স নামে তার এ দোকান। পাশেই ভাই রাজুর দোকান। নয় বছর মালেশিয়া থেকে এসে সে এ ব্যবসা শুরু করেছিল। এদের পূর্ব পূরুষেরা একই ব্যবসায় নিয়োজিত ছিল।
সোমবার একে-৪৭সহ গ্রেপ্তার হওয়া আখির সহযোগি হিসেবে সেও গ্রেপ্তার হয়েছে। তার কোমর থেকেও দুটি ম্যাগজিন উদ্ধার করা হয়। পুলিশ বলছে, সে দিনে ব্যবসা করে লোক দেখানোর জন্য। আর রাতে চরমপন্থিদের হয়ে কাজ করে। স্থানীয়রা বলছেন, প্রায় প্রায়ই রাজ্জাক দুই একদিনের জন্য দোকান বন্ধ করে কোথায় যেন হারিয়ে যেত।
সদালাপী এই ব্যবসায়ীর আড়ালে যে চরমপন্থী লুকিয়ে ছিল তা ওই এলাকার ব্যবসায়ীরা কখনই বুঝতে পারেনি। তবে মেয়ে মানুষের প্রতি তার আসক্তির কথা অনেকেই জানে। পুলিশ বলছে সম্প্রতি সে গণমুক্তিফৌজের সিরিয়াস কিলার হিসেবে নাম লিখিয়েছে। ব্যবসায়ী সাইনবোর্ড থাকার কারনে এতোদিন তা ধরা পড়েনি। তবে গ্রেপ্তারের পর পুলিশ অনুসন্ধান করে এসব তথ্যই পেয়েছে।
আখির বহিস্কার নিয়ে হাস্যরস
একে-৪৭ রাইফেল, শর্টগান এবং বিপুল পরিমান গুলি সহ গ্রেপ্তারের পর শহর মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক তাসলিমা খান আখিকে দল থেকে বহিস্কার করা হয়েছে। কুষ্টিয়া জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদিকা শাহানারা বেগম স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ ব্যাপারে বলা হযেছে, দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও বেআইনী কর্মকান্ডের কারনে আখিকে শহর কমিটির সাধারন সম্পাদিকার পদ ও দলীয় সদস্যপদ থেকে স্থায়ীভাবে বহিস্কার করা হয়েছে। মঙ্গলবার বেলা ১১টায় জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের এক জরুরী সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। নিয়ম না মেনে মহিলা আওয়ামী লীগ দায়ভার এড়াতে তড়িঘড়ি করে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে হাস্যরসের সৃষ্টি হয়েছে।
আওয়ামী লীগের নেতারাই নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, শহর কমিটির সাধারন সম্পাদককে জেলা কমিটি বহিস্কার করার এখতিয়ার রাখেনা। তাছাড়াও এ সভায় জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী বেগম নুরজাহান মীনা সভাপতিত্ব করার কথা বলা হলেও তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন আমি ঢাকাই অবস্থান করছি। তিনি বলেন, কুষ্টিয়া ফিরে মিটিং এর মাধ্যমে তাকে বহিস্কার করার প্রস্তাব কেন্দ্রে পাঠানো হবে।
ফেসে যাচ্ছেন দুই কমিশনার
আখি গ্রেপ্তারের পর বেরিয়ে আসছে থলের বিড়াল। চরমপন্থি কানেকশনের দায়ে ফেসে যাচ্ছেন দুই পৌর কমিশনার।
একজন সাবেক। তিনি আখির স্বামী ওমর হায়দার খান কোহিনুর। কোহিনুর ৮নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি। অপরজন বর্তমান কমিশনার। তিনিও আওয়ামী লীগের নেতা।
চরমপন্থিদের হয়ে চাদাবাজি ও টেন্ডারবাজির অভিযোগ উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে। আখি ধরা পড়ার পর থেকে এদের দুজনকে শহরে দেখা যাচ্ছেনা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।