আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রিকশার জন্য শোকগাথা



কয়েক বছর আগে টিভি চ্যানেলে দেখানো হয়েছিল ‘রেকুইয়েম ফর গ্রানাডা’! এই সিরিয়ালটিতে তুলে ধরা হয়েছিল স্পেনের গ্রানাডায় মুরদের রাজত্ব অবসানের শেষ দিকের করুণ চিত্র। মুররা স্পেন দখল করে শাসন কায়েম করেছিল ৮ম শতাব্দে। রাজধানী ঢাকা এখনও রিকশার শহর। কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তÑ যানজট কমাতে মহানগরী থেকে ক্রমান্বয়ে রিকশা তুলে দেওয়া হবে। ঢাকা হবে রিকশামুক্ত নগরী।

এই প্রক্রিয়া এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে। ভবিষ্যৎ রিকশামুক্ত ঢাকার মানুষের অবস্থা ১০ বা ১৫ বছর পরে কী হতে পারে তা ভেবেই এই রেকুইয়েম বা শোকগাথাটি আগাম রচনা করেছেন য়পূর্ণ রুবেল ফুটপাথে জায়গা কম। যেটুক আছে সেটুকুও হকারের দখলে। যেটুক বাকি আছে সেখান দিয়ে গাদাগাদি করে মানুষ হাঁটে। প্রতিদিন।

তবে ফুটপাথের পাশ দিয়ে যে রাস্তা চলে গেছে সেখানে অসংখ্য গাড়ি। বেশিরভাগই প্রাইভেটকার। কিন্তু সেগুলো দাঁড়িয়ে আছে। সামনে এগোনোর মতো পরিস্থিতি নেই। ট্রাফিক সিগন্যাল গাড়ির লাইনটাকে লম্বা করেছে।

আর দীর্ঘস্থায়ী জ্যাম তৈরি হয়েছে প্রতিটি রাস্তায়। অসহায়ের মতো ট্রাফিক পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। আর শহরবাসী হলেও গাড়ি কেনার সামর্থ্য যাদের নেই তারা ফুটপাথ দখল করে হাঁটছে। হেঁটে অফিসে যাচ্ছে। বাজারে যাচ্ছে।

বাজার করে ফিরছে। হেঁটে হেঁটেই বাচ্চাকে স্কুলে দিয়ে যাচ্ছেন গাড়ি কিনতে না পারা কোনও মা। আর ভাবছেন ঠিক সময়ে স্কুলে না পৌঁছতে পারলে আজও বাচ্চাটার জন্য লেট ফি গুনতে হবে। যে মানুষটা প্রতিদিন অফিসে দেরি করে আসার জন্য বসের গালমন্দ খায় সে এখন কাকে দোষ দেবে। নিজেকে? অসম্ভব।

ঠিক টাইমে বের হয়েও প্রতিদিন দেরি হয় তার। যে বাসের আধাকিলোমিটার রাস্তা যেতে ১ ঘণ্টা সময় লাগে সেই বাসের যাত্রীর লাইন যদি আবার আধা কিলোমিটারজুড়ে হয় তাহলে দোষটা কার? আর কত ভোরে ঘুম থেকে উঠবে সে! সকালে কিংবা বিকালে কোনও মানুষকে আর পার্কে দেখা যায় না দৌড়াতে কিংবা হাঁটতে। যে বৃদ্ধরা ডায়াবেটিস কন্ট্রোল করতে নিয়মিত হাঁটতেন তাদের এখনও হাঁটতে হয়। তবে পার্কে বা নিদির্ষ্ট কোনও জায়গায় নয়। কোনও কাজে বেরুলে যে পরিমাণ তাকে হাঁটতে হয় কিংবা বাসের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় তাতে আর আলাদা করে হাঁটার প্রয়োজন হয় না।

এ শহর এমনই। ঘণ্টার পর ঘণ্টাা দাঁড়িয়ে থেকেও যখন অটোরিকশা এবং ক্যাব পাওয়া যায় না তখন হাঁটা ছাড়া তো আর কোনও গতি নেই। এই শহরের মানুষগুলোর মধ্যে একটা রোগ বেড়েছে প্রকটভাবে। তা হলো শ্বাসকষ্টের রোগ। বাড়বে না কেন? যে হারে বাতাস দূষিত হচ্ছে তাতে করে রোগ না বেড়ে কী উপায় আছে! তবে রোগ হলে বা কেউ অসুস্থ হলে দ্রুত কোনও হাসপাতালে রোগীকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা নেই।

কারণ এক সময়ের বড় আপন যে বাহন রিকশা তা এখন আর নেই। তাই অপো অটোরিকশা, ট্যাক্সিক্যাব অথবা অ্যাম্বুলেন্সের জন্য। কিন্তু সেগুলো পেতে পেতে বা আসতে আসতে যদি রোগী মারা যায় তখন? যাক। তাতে কার কী? এই শহর থেকে রিকশা নামক তিন চাকার যানটা তো দূর হয়েছে। এখন বাসা থেকে বের হয়ে মেইন রোডে আসতে হয় হেঁটে।

যে মেয়েটি বা ছেলেটি কলেজে যাওয়ার সময় রিকশা নিয়ে যেত তাকে এখনও কলেজে যেতে হয়। তবে মূল রাস্তায় হেঁটে এসে তাকে নির্দিষ্ট বাস ধরতে হচ্ছে। মহিলাদের বাসে উঠতে হচ্ছে ঠেলাঠেলি করে। কারণ অটোরিকশা বা ক্যাব নিলে খরচ হবে দ্বিগুণ। শুধু কী তাই, এ-পাড়া থেকে ও-পাড়ায় অথবা কাছেই আত্মীয় বাড়ি এখন যেতে হয় হেঁটে।

অল্প দূরত্বে কি কোনও ক্যাব বা অটোরিকশা যাবে? যাবে কি ৫২ সিটের বাস? এই শহরে কোনও ফাঁকা জায়গা নেই। কারণ যে ফাঁকা জায়গাগুলোতে আগে রিকশার গ্যারেজ ছিল সেগুলো এখন আর নেই। সেখানে এখন বড় বড় অ্যাপার্টমেন্ট। নিচে দুই-তিনটা বেজমেন্টজুড়ে থাকে অ্যাপার্টমেন্টে থাকা মানুষের গাড়ি। ঠিক রিকশার গ্যারেজের মতোই পার্ক করে রাখা।

কিন্তু আগে রিকশা ছিল সবার জন্য আর এখন এই প্রাইভেট গাড়িগুলো নির্দিষ্ট ব্যক্তির। রিকশা নেই বলে এই শহরে জটলা কমেনি। রিকশার ভিড়ের বদলে এখন প্রাইভেট গাড়ির ভিড়। যানজটে সয়লাব রাজধানী ঢাকা। আগে অনেক অপরাধী পালিয়ে ঢাকায় এসে রিকশা চালাত।

তারা আর এখন নেই। নেই রিকশাকে ঘিরে বাঁচতে থাকা মানুষগুলোও। রিকশা নেই বলে ট্রাফিক পুলিশের আয়ও কমে গেছে। কিন্তু কে বলেছে রিকশা নেই? আছে। রিকশা দেখতে হলে কষ্ট করে যেতে হবে জাতীয় জাদুঘরে।

এখানে শিশুপার্কের ট্রেনের মতো করে রিকশায়ও ঘুরিয়ে আনা হয় নির্দিষ্ট টাকার বিনিময়ে। মাঝে মাঝে পুরনো স্বাদ নিতে যে কেউ চলে আসতে পারেন এখানে। মহিলা, শিশু এবং বৃদ্ধদের অগ্রাধিকার। (লেখাটি সাপ্তাহিক ২০০০ এর চলতি সংখ্যায় প্রকাশিত)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.