আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিশ্বব্যাঙ্ক ও আইএমএফ - গ্লোবাল অর্থনীতি (৪)



তৃতীয় পর্বের জন্য: Click This Link দ্বিতীয় পর্বের জন্য: Click This Link প্রথম পর্বের জন্য: Click This Link চতুর্থ পর্ব: এই পর্বে আইএমএফ জন্মের পূর্ব-পরিস্হতিতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও মুদ্রা ব্যবস্হা কেমন ছিল যেটা আইএমএফ গড়ার তাগিদ সৃষ্টি করেছিল - সেদিকে আলোকপাত করব। তবে এনিয়ে কথা শুরুর আগে প্রস্তুতিমূলক কিছু কথা বলে নিব; বিশেষত মুদ্রা, আন্তর্জাতিক মুদ্রা প্রসঙ্গে। প্রস্তুতিমূলক এই আগাম ধারণা আমাদের আইএমএফকে বুঝতে সাহায্য করবে। আইএমএফ ও বিশ্বব্যাঙ্ক - এদুটো প্রতিষ্ঠানের মধ্যে তুলনা করলে প্রাইম প্রতিষ্ঠান হলো আইএমএফ। অর্থাৎ উদ্যোক্তারা আইএমএফ প্রতিষ্ঠানটার জন্ম দিতে একমত হওয়াতে একই সাথে পরিপূরক প্রতিষ্ঠান হিসাবে জন্ম নেয় বিশ্বব্যাঙ্ক।

একটা সাধারণ নিয়ম উল্লেখ করব। কোনও দেশের বিশ্বব্যাঙ্কের সদস্যপদ লাভের পূর্বশর্ত হলো আইএমএফের সদস্যপদ থাকা। এছাড়া কেন পরিপূরক বললাম সেকথার বিস্তারিত ব্যাখ্যায় ক্রমশ আমরা আসব। আপাতত সংক্ষেপে একটা ধারণা দিব, আইএমএফ জন্ম নেয়ার আগে কী পরিস্হতি ছিল যা এর জন্মের কারণ, কোন সমস্যা উত্তরণের উপায় হিসাবে একে ভাবা হয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৮) শুরু থেকেই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, লেনদেন ব্যবস্হা পুরানো যতটুকু বিকশিত ছিল তা ভেঙ্গে পড়া শুরু হয়।

বাণিজ্য, লেনদেন ব্যবস্হার প্রাণ হলো সবার কাছে একটা গ্রহণযোগ্য মুদ্রা - বাণিজ্যের জন্য একটা আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্হা । পন্ডিতরা বলে থাকেন, ঐ মুদ্রার মাণ ঠিক থাকা (effective mechanism for adjusting), সর্ব-গ্রহণযোগ্যতাও আস্হা (confidence) ও প্রাপ্যতা (sufficient supply) -ঠিক না থাকলে তা আন্তর্জাতিক মুদ্রা হতে পারে না; ফলে একটা আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্হাও তৈরি হবে না। যদিও জন্ম থেকেই "মুদ্রা" ও দেশ সমাজে ছড়িয়ে এর যে ব্যবস্হাপনা - এর মধ্যে কিছু আজন্ম সঙ্কট, জন্মদোষ (inherent crisis) আছে যা পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন সংঘটন ব্যবস্হা আজও সমাধান বের করতে পারেনি - তাতে এরকম কোন মুদ্রা ও ব্যবস্হাপনা আদৌও কোনদিন সম্ভব কী না সে প্রশ্ন খুবই গুরুত্ত্বপূর্ণ। মুদ্রার এই সঙ্কটগুলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে ঘিরে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ভেঙ্গে পড়ার সময় আবারও মাথা চারা দিয়ে সঙ্কটকে আরও গভীর করে তুলেছিল। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, লেনদেন ব্যবস্হা ভেঙ্গে পরার মূল কারণ গ্রহণযোগ্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা ও মুদ্রা ব্যবস্হা কার্যকর না থাকা।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের থেকে শুরু হওয়া এই সঙ্কট ২৫ বছর পরে আর এক (দ্বিতীয়) বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-৪৫) পর্যন্ত গড়িয়ে এর সমাপ্তির মধ্যে একটা আপাত সমাধার পথ বের করেছিল। ততদিনে বিশ্ব-শক্তি বা গ্লোবাল অর্থনীতির মধ্যে ব্যাপক উলটপালটও ঘটে গিয়েছিল। নতুন একটা Economic order তা বয়ে এনেছিল বটে কিন্তু এর কেন্দ্র আর ইউরোপ নয় - আমেরিকা। আর ব্যাপক আলাপ আলোচনা, দেনদরবার নিগোশিয়েশনের মধ্য দিয়ে, অনেকে নিরুপায় হয়ে নতুন আন্তর্জাতিক মুদ্রা ও মুদ্রা ব্যবস্হা গড়তে যা দাঁড় করিয়েছিল এরই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ হলো আইএমএফ (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল) ও তার পরিপূরক বিশ্বব্যাঙ্ক। নতুন এই বিশ্ব-পরিস্হিতির সাথে আগের একটা যদি তুলনা করি তাহলে এর তাৎপর্যপূর্ণ বৈশিষ্টসূচক দিক হলো - ইউরোপের কলোনী মাষ্টারদের হাতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, সীমিত লেনদেন পুরানো ব্যবস্হা যতটুকু বিকশিত হতে পেরেছিল - সেই কলোনী-বৈশিষ্টের বাণিজ্য ও মুদ্রা ব্যবস্হার যুগের সমাপ্তি ঘটে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে।

বিপরীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে শুরু হচ্ছে নতুন Economic order, নতুন মুদ্রা ব্যবস্হা ফলে নতুন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য লেনদেন ব্যবস্হা; আগের কলোনী-বৈশিষ্টের বদলে এই আন্তর্জাতিক ব্যবস্হা শুরু হচ্ছে এক প্রাতিষ্ঠানিকতায় - আইএমএফ-বিশ্বব্যাঙ্কে - এর আগে যা অনুপস্হিত; আগের কেন্দ্র ইউরোপীয় কলোনী প্রভু রাষ্ট্রের বদলে নতুন কেন্দ্র এখন আমেরিকা; কলোনী-সাম্রাজ্যের সূর্য না কী কখনও ডুবে না - এই ভ্যানিটি ত্যাগ করে বৃটিশসহ নিরুপায় সকলে নতুন আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসাবে আমেরিকার ন্যাশন্যাল মুদ্রা ডলারকে মেনে নিয়েছিল। ডলারকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা মেনে নিয়ে দাড়ান নতুন আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্হা ফলে, বাণিজ্য ব্যবস্হা গড়ে তোলার প্রতিষ্ঠান - আইএমএফকে বুঝতে তাই "মুদ্রা" প্রসঙ্গটা গুরুত্ত্বপূর্ণ। ফলে কিছু আগাম প্রাথমিক ধারণা দিয়ে নিয়ে এরপর আবার মূল আলোচনায় ফিরব। মুদ্রা (money বা currency): মুদ্রা, মানে বিনিময় মুদ্রা কী কাজে লাগে - এট উত্তরে সকলে প্রথমে বলবে মুদ্রা - পণ্য বিনিময় করতে কাজে লাগে। উৎপাদিত পণ্য কে একটা সংখ্যায় প্রকাশ করে (quantify), দাম বলতে কাজে লাগে।

কার সংখ্যা? সমাজে দেশে চালু আছে এমন মুদ্রার সংখ্যা, টাকার সংখ্যা - যেমন কত টাকা। দাম কত? এখানে আলোচনা কমুনিকেটিং বা সহজ করার জন্য আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে মুদ্রার বদলে অনেক সময় টাকা বলব, আমাদের মুদ্রার নাম টাকা। ফলে আমরা যখন জিজ্ঞাসা করি, দাম কত? এর মানে আসলে আমরা জিজ্ঞাসা করছি, ঐ পণ্যকে আমাদের মুদ্রা টাকার সংখ্যায় quantify করে প্রকাশ করলে সেটা কত হবে। হাতবদল, কেনাবেচা হবার আগে পণ্যকে একটা মুদ্রার তুল্য সমান পরিমাণে রূপান্তরিত করে নিতে হয়। তাই মুদ্রার ভুমিকা পণ্যের হাতবদলে গুরুত্ত্বপূর্ণ ।

উৎপাদিত পণ্য আসল ভোক্তার কাছে পৌছানোর আগে দোকানদার, মহাজন ব্যবসায়ী ইত্যাদির বহু হাত ঘুরতে হয়। আসল ভোক্তা - মানে যে পণ্য কিনে একমাত্র ভোগ করা বা খাওয়া ব্যবহারের জন্য। পণ্য ভোক্তার কাছে পৌছানোর আগে এই হাত বদল কত লম্বা হবে এএক এলাহি অবস্হা। গ্রামের পণ্য গ্রামে ব্যবহার, না শহরে, না রাজধানীতে, না বিদেশে না কী অন্য পণ্য তৈরির কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহার এরপর আবার পণ্য হয়ে শহর, রাজধানী বিদেশ - এক বিরাট হাত বদলের কায়কারবার। তবে ঘটনা যতই লম্বাই হোক মূল কথা হলো, পণ্য আসল ভোক্তার কাছে পৌছানো; আর এই পুরা রাস্তার রাজত্ত্ব মুদ্রার।

পণ্যের মুদ্রায় রূপান্তরিত একটা মূল্যমান, মুদ্রা বা টাকায় নির্ধারণ করেই এই পুরা হাতবদলের রাস্তায় পণ্য চলাচল করতে পারে। পণ্যের প্রত্যেকটা হাতবদল ঘটে মুদ্রার বিনিময়ে, নতুন একটা পরিমাণ মূদ্রা-মূল্য যোগ করে চলতে থাকে যতক্ষণ না আসল ভোক্তার কাছে পৌছায়। একই পণ্য বারবার নতুন নতুন মুল্য যোগ করে রাজত্ত্ব করে চলে মুদ্রা। ভোক্তা পর্যন্ত পণ্যের বিচলনে (circulation), পণ্যকে ছড়িয়ে পড়তে মুদ্রার এই ভুমিকাটা আপাতত আমরা মনে রাখব। পুরনো দিনের গল্প উপন্যাসে স্বর্ণমুদ্রা বা আরব্য গল্পে মোহরের কথা আমরা শুনেছি।

মোহর মানে ছাপ দেওয়া; রাজার নামাঙ্কিত করে স্বর্ণমুদ্রায় একটা সীলমোহর, ছাপ লাগিয়ে দেওয়া। তার মানে বিনিময় মুদ্রা তখন ছিল স্বর্ণের মুদ্রা। স্বর্ণ বা সোনা নিজেও একটা পণ্য, সব যুগেই বাজারে কেনা বেচার পণ্য। তাহলে স্বর্ণমুদ্রায় বিনিময় ছিল আসলে মূলত পণ্যের সাথে সরাসরি অন্য একটা পণ্যের (স্বর্ণমুদ্রার) বিনিময়; এমন একটা হ্যান্ডি পণ্য যা - ছোট্ট সাইজ, সহজেই পকেটে, কোমড়ে বা ট্যাঁকে গুজে নিয়ে রওনা হওয়া যায়। রাস্তা পথে অন্য যেকোন পণ্য দরকার হলে বদলে সে পণ্য পাওয়া যায়; সকল পণ্য পসারির কাছে এর গ্রহণযোগ্যতা আছে, কেউ নিতে আপত্তি করে না, আস্হা আছে।

তাই সহজেই অন্যে পণ্য দিয়ে দেয়, কেনা বেচা চলে। আবার অন্য এক রাজার রাজ্যে রাজত্ত্বে গেলেও কোন অসুবিধা নাই। কারণ স্বর্ণমুদ্রাতে রাজার ছাপ থাকুক আর না থাকুক আদতে তা সোনা, সঞ্চিত (accumulated and concentrated) ছোট্ট একটা পণ্য। তাহলে সার কথায় দাঁড়াল, স্বর্ণমুদ্রার বিশেষ গুণ হলো, এটা একই সঙ্গে একটা বিনিময় মুদ্রা এবং ছোট্ট একটা পণ্য; সোনা হিসাবে পণ্য-গুণও তার সমান বহাল, আবার সে মুদ্রাও। তাহলে টাকা, কাগুজে টাকা এলো কোথা থেকে।

কাগুজে টাকা তো কেবল মুদ্রা। এর মুদ্রা-গুণ আছে কিন্তু কাগজ হিসাবে নিজে কোন পণ্য নয়। সারা দুনিয়ায় উৎপাদিত সব পণ্যের মূল্যকে স্বর্ণমুদ্রায় ধারণ (উপস্হিত বাজার দরে) করতে পারা সম্ভব তখনই যখন এর জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ সোনা পৃথিবীতে আবিস্কৃত ও মজুদ আছে; পাওয়া যায়। উনিশ-শতকের (১৮০০-১৮৯৯) প্রথম দিকে এই সমস্যা প্রকট হয়েছিল ফলে অন্যান্য ধাতু রূপা বা তামা মুদ্রা হিসাবে ব্যবহার শুরু হয়েছিল। এদিয়ে কোনমতে কাজ চালিয়ে নেয়া গিয়েছিল।

তবে ঐ শতকেরই দ্বিতীয়ার্ধে আমেরিকা, অষ্ট্রেলিয়া ও বিশেষত দক্ষিণ আফ্রিকায় নতুন এক ঝাঁক সোনার খনি আবিস্কার সমস্যা মিটাতে সাহায্য করে। তবু তার আগেই বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে যুদ্ধবিগ্রহ ইত্যাদি কারণে স্বর্ণের অভাব সঙ্কট মোকাবিলায় কাগুজে নোট চালু হয়ে যায়। কাগুজে নোট: নোট মানে একটা চিরকুট। কীসের চিরকুট? প্রতিশ্রুতির। সোনা বা স্বর্ণমুদ্রা দিচ্ছি না তবে এর বদলে তা দিব, দিতে বাধ্য থাকব বলে একটা প্রতিশ্রুতি - কবুল করে লিখা নোট।

এর মানে হলো, আগে যেকথা বলছিলাম - কাগুজে নোটের মুদ্রা-গুণ আছে হয়ত কিন্তু কাগজ হিসাবে নিজে কোন পণ্য নয় - এই সমস্যার সমাধান ভাবা হয়েছিল নোট লিখে। নোটে উল্লেখিত মুদ্রার অর্থাৎ একশ ডলারের নোট হলে একশ ডলারের, সমপরিমাণ সোনা দিতে নোট প্রদানকারী বাধ্য থাকবে। এখন নোট প্রদানকারী কে? প্রত্যেক দেশের একটা সরকারী কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক থাকে, যেমন বাংলাদেশ ব্যাঙ্ক। অনেক দেশের এই কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের নামের সাথে Reserve বলে একটা শব্দ জুড়ে দেয়া থাকতে দেখা যায়, যেমন আমেরিকান ফেডারল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। এই রিজার্ভ শব্দের উৎস বা মানে হলো, আগে টাকা ছাপতে ও বাজারে ছাড়ার আগে প্রতিটা টাকার সমপরিমাণ মুল্যের সোনা ব্যাঙ্কের নগদ মজুদ (Reserve) রেখে তারপর ঐ টাকা বা মুদ্রা বাজারে ছাড়া হত; এই অর্থে যে সোনা রিজার্ভ, ভারাড়ে মজুদ রেখে নোট বা প্রতিশ্রুতি দেয় - সেই "রিজার্ভ" ব্যাঙ্ক।

কাজেই নোট প্রদানকারী বা প্রতিশ্রুতিদানকারী প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে সে এই মুদ্রা নোটের সমপরিমাণ সোনা তার কাছে গচ্ছিত (Reserve) মজুদ রাখা আছে। যে কেউ নোটের বিনিময়ে সোনা চাইলে সে তা দিতে বাধ্য থাকবে। ব্যাঙ্ক নোট ইস্যু করে ব্যাঙ্ক ব্যবস্হার কাগুজে নোটের শুরু হয়েছিল এভাবে। সেই লিগ্যাসীতে এখনও বাংলাদেশের যেকোন নোটে (ধরা যাক একশ টাকার নোটে) "চাহিবামাত্র ইহার বাহককে একশত টাকা দিতে বাধ্য থাকিব - গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার" এই কথাটা মুদ্রিত থাকে; তাতে বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের ভারাড়ে সোনা থাক আর না থাক। যে মুদ্রা ছাপা হয়েছে সমপরিমাণ মুল্যের সোনা জমা, ভল্টে মজুদ রেখে সেই মুদ্রাই Gold Standard মুদ্রা।

তাহলে যে মুদ্রা Gold Standard নয় সে মুদ্রা তার মানে দাঁড়িয়ে আছে ফাঁকা রাষ্ট্রীয় বা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রতিশ্রুতির উপর। অর্থনৈতিক পরিভাষায় fiat money বলে; অর্থাৎ স্রেফ রাষ্ট্রীয় ডিক্রি জারির মাধ্যমে যে মুদ্রা দাঁড়িয়ে থাকে। কেন সে মুদ্রা, আসলে সে মূল্য ধারণ করে কী না, সমপরিমাণ সোনা তার মজুদে আছে কী না - এর উত্তর তার কাছে নাই। গায়ের জোড়ে সে মুদ্রা। আজকের দিনে প্রায় সব মুদ্রাই fiat money বলে; অর্থাৎ স্রেফ রাষ্ট্রীয় ডিক্রি জারির ক্ষমতাগুণে সে মুদ্রা।

এখন সমপরিমাণ সোনা মজুদ না রেখে টাকা বা মুদ্রা ছাপানোর নীট মানে টা কী দাঁড়ায়? মানে হলো এই মুদ্রা কোন পণ্যমুল্য, পণ্য গুণাগুণ নাই। ফলে এর সাথে বিনিময়ে কোন সত্যিকার উৎপাদিত পণ্যের লেনদেন - হাওয়াই প্রতিশ্রুতির সাথে বিনিময় করা। ধরা যাক, বাংলাদেশের ১০০ ডলার মুল্যমানের কোন পণ্য আমেরিকার বাজারে বিক্রি-বিনিময়ের পর দেশে ফিরে কেউ ভাবছে ভালই বেচাকেনা হলো, ভাল লাভ থাকবে। পরে ঐ নগদ ১০০ ডলার দিয়ে নিজের পণ্যের কাঁচামাল কিনতে গিয়ে সে টের পাচ্ছে এবার সে কম পণ্য পাচ্ছে। যা পাচ্ছে তা আগের হিসাবে ধরাযাক ৮৫ ডলার মুল্যমানের সমান।

তাড়াতাড়ি এবার ফিরে হিসাব করে দেখে ১০০ ডলারে পণ্য বিক্রিতে লাভ তো হয়ই নাই সে দুরের কথা, বরং আসল নিয়ে টানাটানি লেগে গেছে। পত্রিকা পড়ে খবর নিয়ে দেখে ওর রিজার্ভ ব্যাঙ্ক মজুদ সোনার চেয়ে ডলার বেশি ছেপেছে। fiat money তে সব ভরপুর। কেন করেছে? না আমেরিকা যুদ্ধে জড়িয়ে আছে, প্রচুর খরচ। ঐ রাষ্ট্রের আয়ব্যয়ের ভারসাম্য নাই, সব এলোমেলো।

তাই সহজ টোটকা উপায় বের করেছে - ডলার ছাপানো। আর এর সোজা মানেটা হলো, আমেরিকার যুদ্ধের খরচের দায় অন্যেরা মিটাচ্ছে। অন্যের ঘাড় থেকে তা উঠে আসছে। কিন্তু তারপরের অন্যেরা উপায়হীন এই দায় নিচ্ছে। কেন? সে প্রশ্নের ছোট্ট উত্তর হলো, মুনাফা কম করে এমনকি শুণ্যের কোঠায় না লাভ না লোকসান, এমনকি কম লোকসান করে হলেও যদি নিজের উৎপাদন সক্ষমতা মেশিনপত্র নিয়ে বেচেবর্তে টিকে থাকা যায়, খারাপ সময়টা পার করা যায় - এটা সেই উপায়হীন মুদ্রার ফাঁদে আটকানো অবস্হা।

এর চেয়ে বেশি উত্তরে এখন যাব না। ফিরে আসব। পাঠককে আপাতত প্রশ্নটা মনে রাখতে বলব। কোন দেশের মুদ্রা ব্যবস্হা স্বর্ণমুদ্রা থেকে ভুতুড়ে কাগুজে মুদ্রায় রূপান্তরিত হবার পিছনে ছোটখাট অনেক কারণ আছে, যেমন, স্বর্ণালঙ্কার বা মুল্যবান জিনিষ সযন্তে, সুরক্ষায় ধরে রাখার বিনিময়ে স্বর্ণকার বা ভল্ট ব্যবসায়ী এক চিলতে কাগজে একটা স্বীকারোক্তি-পত্র দিত - এই কাগজ আবার কারও কাছে সে কারও পাওনা মিটাতে ব্যবহার করত। এভাবে তা কাগুজে নোট (supported back with gold) হয়ে হাতবদলে সুযোগ করে দেয় বলে - এতে এক নতুন ব্যবসার জন্ম নেয়।

এটা ১৫শ শতকের ইংল্যান্ডে এক জমজমাট ব্যবসা ছিল। কিন্তু স্বর্ণমুদ্রা ব্যবস্হাকে কাগুজে করে এলোমেলো করে দেবার পিছনে বড় হোতা অন্য কেউ; মূলত শিল্প বিকাশের সাথে সাথে বিভিন্ন সাম্রাজ্য বা নগর-রাষ্ট্রের উত্থান ঘটে; সেই রাষ্ট্র এর হোতা। রাষ্ট্র কাগুজে বন্ড ছেড়েছিল। সাম্রাজ্যে-রাষ্ট্রের ক্ষমতা বলে নগর-রাষ্ট্র চালানোর খরচ যোগাতে রাজক্ষমতা বলে রাষ্ট্রীয় কাগুজে বন্ড ছাড়া হয়েছিল। এই কাগুজে বন্ড আবার হাতবদল করে কেনাবেচা চলতে এক বাজার সৃষ্টি হয়।

এটা এক অদ্ভুত বাজার। এই বাজারে বিক্রি হত কাগুজে বন্ড যার কোন পণ্যগুণাগুণ নাই আছে স্রেফ নগর-পিতার প্রতিশ্রুতি। বিনিময়ে নগর-রাষ্ট্র বাজার থেকে টাকা তুলে নিজের খরচ, আরাম আয়েস মিটাত। কাগুজে বন্ড নিজে কোন পণ্য নয়, হতেই পারে না। কিন্তু এক ভুতুড়ে পণ্য রূপ সে জোগাড় করে ফেলেছে।

কারণ ভুতুড়ে বন্ডের প্রতিশ্রুতি আবার কেনাবেচার এক বাজার চালু করে ফেলতে পেরেছে। ফলে পণ্যের খবর নাই অথচ টাকা দিয়ে টাকা কেনাবেচা চলে; টাকা কেনাবেচার এই বাজারই আজকের ভদ্রনাম ক্যাপিটাল মার্কেট বা শেয়ার বাজার। একজন শিল্প মালিকের চোখে তাঁর কষ্টকর উৎপাদনের পথ, বাজার ধরা পণ্যের গুনাগুণ ঠিক রাখার এতসব হেপা দায়ের পথ ছেড়ে সহজে টাকা মুনাফা কামানো, বাড়ানোর এএক সহজ উপায় - এর চেয়ে ভাল আর কী হতে পারে! শিল্প পণ্য উৎপাদনের সাথে তুলনায় বন্ড, যার কোন পণ্যগুণ নাই অথচ পণ্যের সাথে বিনিময়যোগ্য গুণ পেয়ে বসেছে। ফলে একটা বড় অংশের বিনিয়োগ শিল্প ছেড়ে এই কাগুজে টাকা বা বন্ডের বাজারে আকৃষ্ট হতে পেরেছিল। বন্ড - এই ভুতুড়ে (fake)পণ্যকে বিনিময়যোগ্য গুণ লাভ করে মুদ্রা ব্যবস্হায় এক কাগুজে মুদ্রা হিসাবে জায়গা করে নেয়।

মুদ্রা ব্যবস্হায় এটা আর এক আজন্ম সঙ্কট, জন্মদোষ (inherent crisis)। উপরের আলোচনার একটা সার করে নেই। কোন দেশের জাতীয় অর্থনীতির মুদ্রাকে (যেমন ডলার) যদি একই সাথে আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্হায় বিনিময়ের আন্তর্জাতিক মুদ্রা গণ্য করা হয় তবে ঐ দেশের (আমেরিকার) জাতীয় অর্থনীতির উত্থান-পতন (এবং উত্থান-পতনের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের) সাথে সারা দুনিয়ার সব দেশের অর্থনীতি একই খাঁচায় বন্দি হয়ে যায়। সেই সাথে সেই মুদ্রা ডলার যদি Gold Standard মুদ্রা না রাখা হয়, কাগুজে বন্ড কেনাবেচার বাজার নিজেই মুদ্রার সমতুল্য হিসাবে জায়গা করে নেয় - তাহলে এটা গোদের উপর বিষ ফোড়া। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যবস্হা বা আরও স্পষ্ট করে বললে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্হার বা মুদ্রার আজন্ম সঙ্কট, জন্মদোষ (inherent crisis) এটা।

Gold Standard মুদ্রা কথায় ফেরত যাব। সেই পথে ধরে এই পর্বের মূল প্রসঙ্গে ফেরত আসার চেষ্টা করব। বিভিন্ন দেশের Gold Standard মুদ্রায় প্রবেশ এবং বেহিসাব খরচে টিকতে না পেরে প্রস্হান - সবার ক্ষেত্রেই ঘটেছে। কলোনিয়াল মাষ্টার বৃটেন প্রথম দেশ, কলোনীর রমরমা যুগে ১৮১৬ সালে Gold Standard মুদ্রায় গিয়েছিল। মোটামুটিভাবে ১৯০০ সালের মধ্যে প্রায় সকল ইউরোপীয় দেশ Gold Standard যুগে প্রবেশ করেছিল।

আমেরিকা ১৮৭৩ সালে Gold Standard মুদ্রায় প্রবেশ করে। এখানে একটা কথা বলে রাখা দরকার শিল্প বিপ্লবের ক্যাপিট্যালিজমের ঐ যুগে Gold Standard মুদ্রায় প্রবেশ ঘটেছিল এর মানে কেন্দ্রীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কগুলো সরকারি ছিল তা ধরে নেয়া ভুল হবে। ধারণাটা এখনকার সাথে মিলবে না। তখন সরকারি আয়ব্যয়ের জমা খরচ- ট্রেজারি হিসাবে কাজ করত প্রাইভেট ব্যাঙ্ক। সরকারের অনুমতি নিয়ে ব্যাঙ্ক ব্যবসার লাইসেন্স পাওয়া যেত (incorporate) এরপর স্বর্ণমজুদের সম পরিমাণ সরকারি বন্ড কেনার বিনিময়ে সমতুল্য মুল্যের নোট ছাপানের অনুমতিও মিলত।

ব্যঙ্কগুলোও বিশ্বাস ও আস্হা বেচে ব্যবসা করত। সময়ে দেউলিয়াও হত। Gold Standard আইন করার পিছনে বড় কারণ হলো ব্যাঙ্ক ব্যবসা ফেল করা বা দেউলিয়া হবার কারণ কমিয়ে আনা যাতে ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, টাকার মালিকেরা নির্বিঘ্নে থাকতে পারেন। J. P. Morgan's 'money trust' ব্যাঙ্ক আমেরিকান সরকারের হয়ে ব্যাঙ্ক ব্যবসার ক্রেডিট নিয়ন্ত্রণ করত। আমেরিকান ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক গঠিত হয় ১৯১৩ সালে।

ফলে সব ব্যাঙ্ক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, মুদ্রানীতি এরপর সরাসরি সরকারি নিয়ন্ত্রণে আসে। ইংল্যান্ডের ক্ষেত্রে Bank of England, UK সরকারের সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক হিসাবে কাজ করত সেই ১৬৯৪ সাল থেকে। সেই সাথে গুরুত্ত্বপূর্ণ আরও একজন ছিল। এক জর্মান ইহুদি মুদ্রা ব্যবসায়ী Amschel Mayer Rothschild (1773-1855) ও তাঁর পাঁচ ছেলে মিলে ইংল্যান্ডসহ ইউরোপের প্রায় সব বড় শহরে বসে House of Rothschild নামে এক পারিবারিক ব্যাঙ্ক ব্যবসা চালাত। প্রতিদিন সকালে ঠিক করে দিত বিভিন্ন মুদ্রার এক্সচেঞ্জ রেট ঐদিনের কত হবে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে কলোনী যুগের রমরমা অবস্হায় মুদ্রা ব্যবস্হাপনা ও বাণিজ্য এভাবেই ব্যক্তি উদ্যোগে চলত। এভাবে নানান বিনিয়োগ, শিল্প, ব্যবসার ব্যক্তি উদ্যোগগুলোর তৎপরতার ভিতর দিয়ে অপ্রত্যক্ষ ফলাফল হিসাবে ভাঙ্গা ভাঙ্গাভাবে গ্লোবাল পুঁজির স্বার্থ রক্ষিত হত। এর বিপরীতে রাষ্ট্র-দেশ-সীমানার উর্ধে গ্লোবাল পুঁজির সামগ্রিক স্বার্থ দেখাশুনার দেখার দিক থেকে ১৯৪৪ সাল থেকে আইএমএফ একটা আলাদা প্রতিষ্ঠান; আলাদা এই অর্থে যে এটা নিজে মুনাফা কামানোর লক্ষ্যে কোন ব্যবসা করে না। ফলে কোন একক বা সামগ্রিক ব্যবসা উদ্যোগের সে কোন প্রতিদ্বন্দ্বীই নয়। বরং রাষ্ট্র সীমানা তুচ্ছ জ্ঞান করে দুনিয়া জুড়ে মুনাফা কামানোর পুঁজির সব তৎপরতাগুলোর কারবার যাতে ভাল ভাবে বিকশিত হতে পারে তার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা, এর বিকাশের সব বাঁধা অপসারণ করা, সকলকে একটা নিয়মের মধ্যে আনা, পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠার সম্ভবনা কমানো ইত্যাদি।

রাষ্ট্র-দেশ-সীমানার উর্ধে নিজেই এক ক্ষমতা হয়ে উঠা একটা সমন্বিত উদ্যোগের গ্লোবাল পুঁজির সামগ্রিক স্বার্থ দেখা যার কাজ। পাঠক হয়ত খেয়াল করেছেন, প্রায় সময়ই আমি বলার চেষ্টা করেছি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভিতর দিয়ে কলোনী-পুঁজিতান্ত্রিক যুগের মুদ্রা ব্যবস্হা তথা কলোনী-বৈশিষ্ট সম্পন্ন সীমিত আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যবস্হার অবসান ঘটে; ফলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যবস্হার প্রথম পর্যায় শেষ হবার মাইলফলক। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যবস্হার শেষ নিভু নিভু বাতিও নিভে যায় ১৯২৯ সালের বিশ্বমন্দায়। বৃটেন ১৯৩১ সালে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে Gold Standard মুদ্রা ব্যবস্হা ত্যাগের ঘোষণা করেছিল। অন্যান্য ইউরোপীয় দেশ এর অনেক আগেই এই পথে যায়।

১৯৩৩ সালের এপ্রিলে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট সোনা রপ্তানী নিষিদ্ধ আইন করে Gold Standard থেকে ডলারকে বের করে আনে। এটাকে বলা যায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যবস্হার শেষ নিভু নিভু অবস্হার উপর শেষ পেরেক মারা। এরপর আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যবস্হা বলতে কিছুই আর কাজ করত না। ফলে নতুন একটা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যবস্হা তথা আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্হার বা মুদ্রার সঙ্কট নিয়ে কী করা যায় তা নিয়ে লম্বা বছরের পর বছর আলাপ আলোচনা শুরু হয়। এদিকে ১৯৩৯ সাল থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়।

একদিকে যুদ্ধও চলে অন্যদিকে মুদ্রা নিয়ে আলাপও চলতে থাকে। যুদ্ধে আমেরিকার নির্ধারক সহায়তায় হিটলার মুসোলিনির বিরুদ্ধে সারা ইউরোপ যুদ্ধে জেতে ঠিকই কিন্তু সকলে আমেরিকার কাছে দেউলিয়া হয়ে বন্ধক পরে থাকার অবস্হায় পৌছে যায়। এই পরিস্হিতির ভস্ম থেকে ১৯৪৪ সালে ডলারকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা মেনে নতুন Economic order শুরু হয়েছিল, যার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ আইএমএফ আর স্যাঙ্গাত বিশ্বব্যাঙ্ক। ১৯৩৩ সাল থেকে ১৯৪৪ সাল - এর আগামি দিনগুলোতে সারা দুনিয়া কেমন আকার নিবে তার জন্য খুবই গুরুত্ত্বপুর্ণ সময়। আগামি পর্বে সে নিয়ে কথা শুরু করব।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.