অলসদের দিয়ে কী আর হয়। আলসেমি ছাড়া!
[এবছরের মার্চ মাসে ডিজিটাল এক্সপোতে এই শিরোনামে একটি বক্তৃতা দেই। পরে সেটিকে একটা লিখিত রূপ দেওয়ার চেষ্টা করি। প্রথমে নিরিক্ষা নামে একটি পত্রিকার জন্য। পরে, আরো কিছু যোগ করে লেখাটাকে শেষ করার চেষ্টা করেছি।
লেখাটা প্রকাশিত হয়েছে পথরেখা পত্রিকায়। এখন পড়তে গিয়ে মনে হচ্ছে আরো কাজ আছে। সাধারণভাবে আমি মনে করি ডিজিটাল বাংলাদেশের জন্য প্রথমে দরকার সাশ্রয়ী সংযুক্তি, সবার জন্য। সেটা নিয়ে আমার যতো দৌড়বদৌড়ি!!]]
ডিজিটাল বাংলাদেশ শুরুতে মহাজোটের নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল। জনগণের ভোট পেয়ে মহাজোট এখন সরকারে।
ফলে ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন কোন একটি রাজনৈতিক দলের কর্মসূচী নয় এবং সরকারেরই অঙ্গীকার। ডিজিটাল বাংলাদেশের সাদামাটা ধারণা হলো এমন একটি দেশের যেখানে জনগণ তার দিনবদলের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে তথ্যপ্রযুক্তি, বলা ভাল, ডিজিটাল প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে। ডিজিটাল প্রযুক্তির সার্বজনীনতা ও বহুমুখীনতার কারণে, এর যথাযথ প্রয়োগ একটি সমাজকে উন্নত, স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক এবং উন্নত সংস্কৃতি সমৃদ্ধ সমাজে পরিণত করে। একটি মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার বাংলাদেশের যে আকাক্সক্ষা, সেটি তাই অনেকখানি সহজ হতে পারে এই প্রযুক্তির প্রয়োগে।
অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও সামাজিক বিকাশে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বা আইসিটির শক্তি এখন সর্বজনবিদিত।
এই নিয়ে বিতর্কের অবকাশও কম। সবার জন্য শিক্ষা কিংবা সবার জন্য স্বাস্থ্যের নিশ্চয়তা বিধানের ক্ষেত্রে আইসিটি যেমন বড়ো নিয়ামক তেমনি তা জনগণের মধ্যে সংযুক্তির ব্যাপারটিকেও করে ফেলে সহজ। ফলে, একটি সংযুক্ত জাতি হিসেবে একক স্বপ্ন ও উদ্দেশ্য নিয়ে এগিয়ে চলাটা সহজ হয়। অন্যদিকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতেও আইসিটির নানামুখী প্রয়োগ বাজারে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার আবহ তৈরি করে। তথ্যের সহজ প্রাপ্যতা এমনকী প্রান্তিক জনগোষ্ঠিকেও ক্ষমতাশালী করে।
মোবাইল ফোন কোম্পানির একটি বিজ্ঞাপনে আমরা এর একটি দৃশ্যকল্প দেখি যেখানে বাজারের সময়োপযোগী তথ্য জেলেকে তার মাছের সঠিক মূল্য পেতে সাহায্য করে। সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার মাধাইনগর ইউনিয়নে স্থাপিত একটি ই-তথ্যকেন্দ্রের তথ্য সেখানকার কৃষকদের ধানের নায্যমূল্য পেতে সহায়তা করেছে এমন অভিজ্ঞতাও আমাদের হয়েছে।
আইসিটির ব্যবহার প্রতিযোগিতার পাশাপাশি উদ্ভাবনশীলতাকে নিয়ে আসে একেবারে সাধারণ মানুষের কাছে। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে প্রিয়জনের কাছে টাকা পাঠানো যা এখন উত্তরবঙ্গে ‘মোবাইলগ্রাম’ নামে পরিচিত, তার উদ্ভাবন হয়েছে একজন গরিব দিনমজুরের মাধ্যমে। যেহেতু, যেকোন সেবাকে ভোক্তার দোড়গোড়ায় নিয়ে যাওয়া যায় সেহেতু ব্যবসায়িক লেনদেনের মূল্য অনেক কমে যায়।
উদ্ভাবনশীলতা, লেনদেনের মূল্য হ্রাস এবং সর্বোপরি প্রতিযোগিতার সুষ্ঠু পরিবেশ প্রকারান্তরে বেসরকারি বিনিয়োগকেই অনুপ্রাণিত করে। অন্যদিকে, এসবের জন্য সহায়ক নীতিমালা ও পরিবেশ গড়ে তোলাই হল সরকারের মূল কাজ। তথ্যপ্রযুক্তির প্রয়োগের ফলে এই কাজগুলো হয়ে পড়ে সহজ। ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহারে সরকারের কর্মদক্ষতা বাড়ে অনেকখানি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয় নাগরিক সেবা, ‘যেকোন সময়, যে কোন স্থান’ থেকে পাওয়ার সুযোগ।
বর্তমানে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেট ও ঢাকায় বিদ্যুৎ গ্রাহকেরা মোবাইল ফোনে তাদের বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে পারে। গ্রামের একজন কৃষক পুত্র স্থানীয় ই-সেন্টার থেকে পাসপোর্টের আবেদন ডাউনলোড করে সেটি ছাপিয়ে নিতে পারে। এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ একবারেই তা জমা দিতে পারে। এমনকী পাসপোর্টের আবেদন এখন পাসপোর্ট অফিস ছাড়াও নির্ধারিত জেলা প্রশাসকের কার্যালয় বা নির্ধারিত ডাকঘরে জমা দিয়ে সেখান থেকেই আবার তা গ্রহণ করা যায়। আর নিজের নিকটস্থ অফিসের খোঁজ পাওয়া যায় ইন্টানেটে।
বলা বাহুল্য যে, যে সকল উপাদান একটি সমাজের উন্নত সমাজে রূপান্তরের চালিকা শক্তি তার সবটাতেই আইসিটির ভূমিকা ধনাত্বক এবং তা দ্রুত ও কার্যকরী। আইসিটির মাধ্যমে একটি উন্নত দেশগড়ার কার্যক্রম তাই দিন শেষে সমাজের একটি ডিজিটাল রূপান্তর ঘটায়।
রূপকল্প ২০২১
যে কোন সমাজের কাক্সিক্ষত রূপান্তর শুরু হয় একটি রূপকল্প বা ভিশন থেকে। স্বভাবতই এই রূপকল্প হতে হয় দীর্ঘমেয়াদী পরিবর্তনের সূচক। ডিজিটাল বাংলাদেশের মূল অবকাঠামো হবে একটি বুদ্ধিমান তথ্য অবকাঠামো।
এটি এমন তথ্য প্যাটফরম হবে যা কী না জনগণ, সরকার ও ব্যবসায়ে একটি মূল লক্ষ্যভিত্তিতে সমন্বিত করবে। কাঠামোটি ‘বুদ্ধিমান’ হবে কারণ সেটি হবে রেসপন্সিভ, জবাবদিহিমূলক, দক্ষ এবং সর্বোপরি প্রযুক্তির বদলের সঙ্গে সঙ্গে সেটিও তার প্রযুক্তির প্যাটায়মকে বদলে ফেলতে পারে। এরকম একট অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শুরু হতে হলে একটি জাতির অবশ্যই একটি সুনির্দিষ্ট রূপকল্প লাগে। ডিজিটাল বাংলাদেশের এই রূপকল্প হলো রূপকল্প ২০২১-স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া।
রূপকল্প থেকে রূপান্তরিত সমাজের যে চেহারা আমাদের সামনে ভেসে উঠে তা হলো একটি সংযুক্ত জাতির দৃশ্যকল্প।
জাতি সংযুক্ত হয় তার কয়েকটি মৌল চাহিদার ভিত্তিতে। এর মধ্যে রয়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা কৃষির মতো মৌলিক চাহিদা পূরণ, সিদ্ধান্তগ্রহণ ও বাস্তবায়নে তথ্য প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে এমন একটি ডিজিটাল সরকার, সরকারের কাছ থেকে জনগণ সহজে তাদের নাগরিক সেবাগুলো পেতে পারে, উন্নয়নের চাবিকাঠি বিনিয়োগ ও ব্যবসা বান্ধব পরিবেশ এবং সর্বোপরি নিজেদের মধ্যে সংযুক্ত সম্প্রদায়গুলোÑবিভিন্ন সম্প্রদায় তাদের পেশার ভিত্তিতে কিংবা আঞ্চলিকতার ভিত্তিতে সংযুক্ত হয়।
ডিজিটাল সমাজের মূল উপকরণ
একটি ডিজিটাল সমাজের মূল ভিত্তি হলো জনগণের সংযুক্তি এবং সরকার, ব্যবসা ও জনগণের মিথস্ক্রিয়া। যেহেতু, এই সমাজের মূল হাতিয়ার তথ্যপ্রযুক্তি, সেহেতু এর খেলোয়াড়দের এই প্রযুক্তিতে যথেষ্ট দক্ষ হতে হয়। অর্থাৎ এই সমাজের দার্শনিক ভিত্তি হলো শিক্ষা।
কারণ, ডিজিটাল সমাজ হলো জ্ঞানভিত্তিক সমাজ। একুশ শতকে জ্ঞানের সকল শাখায় অবাধ বিচরণের জন্য প্রজš§ থেকে প্রজš§ান্তরে জ্ঞানের অবাধ প্রবাহ এবং জ্ঞান আহরণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। এই জন্য শিক্ষাখাতে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বিনিয়োগ এবং নজর দুটোই দরকার। আইসিটিকে শিক্ষাখাতে প্রয়োগের বেলায় অতীতে আমরা বেশ কিছু ভুল করেছি। কম্পিউটারের মাধ্যমে শিক্ষার পরিবর্তে বিষয় হিসেবে কম্পিউটার শিক্ষার প্রচলন করার চেষ্টা হয়েছে যা শেষ বিচারে শিক্ষার ডিজিটাল রূপান্তরের কাজটি করতে পারেনি।
কাজেই, আইসিটিকে শিক্ষা উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করার বিষয়টি জোর দিয়ে আমাদের শিক্ষাকে সাজিয়ে নেওয়া দরকার। শিক্ষাক্রম, শিক্ষা উপকরণ এবং শিক্ষকদের মান উন্নয়ন-সবই প্রয়োজন একটি মানসম্মত শিক্ষার জন্য। শিক্ষা উপকরণের সহজলভ্যতার মাধ্যমে শিক্ষার একটি গুণগত পরিবর্তনের সূচনা করা যায়।
আজকের বৈশ্বিক যোগাযোগের যুগে এই কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কম্পিউটার ও ইন্টারনেট তথা তথ্যপ্রযুক্তি একজন শিক্ষার্থীকে নানাভাবে এগিয়ে যাওয়ার রসদ জোগায়। গবেষণা, মূল্যায়ন ও পরস্পরের মধ্যে তথ্য বিনিময়ের জন্য এখন শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেটে প্রবেশাধিকার দরকার।
বছর কয়েক আগে, জেনেভা ও পরে তিউনিসিয়ায় বিশ্ব নেতৃত্বের তথ্য সম্মেলনে তাই ‘সব শিশুর জন্য ল্যাপটপ’ শিরোনামে একটি কর্মসূচি চালু হয়েছিল। সেই কর্মসূচির বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে কয়েকটি দেশে। তবে, আমাদের মতো দেশে যেখানে অর্থ একটি বড়ো সংকট আর রয়েছে অবকাঠামোর সমস্যা সেখানে এই প্রকল্প হয়তো এক্ষ“নি শুরু করা সম্ভব নয়।
একথা এখন স্বীকৃত যে, ইন্টারনেট সংযোগসহ একটি মাত্র কম্পিউটার একটি বিদ্যালয়ে পড়াশোনার পরিবেশের আমুল পরিবর্তন করে দিতে পারে। বিগত দিনগুলোতে আমাদের দেশে আমরা ‘কম্পিউটার শিক্ষা’ নিয়ে যতোটা ভেবেছি, শিক্ষার হাতিয়ার হিসাবে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে ততোটা ভাবিনি।
অথচ, কম্পিউটার শিক্ষায় পরিবর্তে কম্পিউটারের মাধ্যমে শিক্ষার বিষয়টিতেই আমাদের জোর দেওয়া দরকার অনেক বেশি। যে সব স্কুল/কলেজে সরকারিভাবে কম্পিউটার দেওয়া হয়েছে সেখানে সেগুলো ব্যবহার করা হয় কম্পিউটারে টাইপ করা বা হিসাব শেখানোর কাজে। অথচ এই কম্পিউটারগুলো ব্যবহƒত হতে পারতো বিজ্ঞান, গণিত কিংবা ইতিহাস শেখানোর কাজে!
আমাদের দেশের সকল স্কুল/কলেজ শিক্ষককে একটি করে ল্যাপটপ কম্পিউটার দেওয়া যায়। সেটি তারা ব্যবহার করবেন শিক্ষা উপকরণ হিসেবে। গণিতের শিক্ষক সেটি ব্যবহার করবেন নতুন বিষয় জানার জন্য, পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক সেটি দিয়ে শিক্ষার্থীদের পরমাণুর মডেল দেখাবেন।
পাশাপাশি, ইন্টারনেটের মাধ্যমে আমাদের সব শিক্ষক, দেশের শিক্ষকদের এক বড়ো নেটওয়ার্কে যুক্ত হবেন।
দেশের সকল শিক্ষককে ল্যাপটপ দেওয়ার এই প্রকল্পের ক্ষেত্রে আমরা ইউরোপের ছোট্ট দেশ পর্তুগালের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারি। বিশ্বের শীর্ষ প্রসেসর নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ইন্টেলের একটি কমদামী, কিন্তু উন্নত ল্যাপটপ রয়েছে যেটিকে বলা হয় ক্লাশমেট পিসি। পর্তুগাল সরকার তাদের সকল শিক্ষার্থীর জন্য (পর্তুগালের জনসংখ্যা কম) ল্যাপটপের ধারণাটি গ্রহণ করে কিন্তু দেশের বাইরে থেকে কম্পিউটার কিনে আনার পরিবর্তে পর্তুগাল সরকার সেটি নিজেরা বানানোর সিদ্ধান্ত নেয়। ইন্টেলের সহযোগিতায় পর্তুগালে গড়ে ওঠে ক্লাসমেট পিসি বানানোর কারখানা।
ফলে পর্তুগাল একদিকে কমদামে নিজেদের ল্যাপটপতো পাচ্ছে, একই সঙ্গে তাদের গড়ে উঠেছে একটি সমৃদ্ধ হার্ডওয়্যার শিল্প। পর্তুগাল এখন আশপাশের দেশের জন্য ক্লাশমেট কম্পিউটার বানানোর অর্ডারও পাচ্ছে! কাজেই বাংলাদেশও অনুরূপ একটি উদ্যোগ নিতে পারে। মাত্র ৪০০ কোটি টাকা এ খাতে বরাদ্দ দেওয়া যায়। ওর মধ্যে ৩০০ কোটি টাকা দিয়ে এক লাখ শিক্ষককে ল্যাপটপ দেওয়া হবে বাজার মূল্যে। আর বাকী ১০০ কোটি টাকা ব্যবহার করা হবে ল্যাপটপ কারখানা গড়ে তোলার কাজে।
পরবর্তী বছর থেকে শিক্ষকদের জন্য ল্যাপটপ ওই কারখানা থেকে উৎপাদিত হবে।
অনেকের ধারণা, এই বিপুল সংখ্যক শিক্ষককে কম্পিউটারের শিক্ষায় শিক্ষিত করতে বিশাল প্রশিক্ষক বাহিনী লাগবে। কিন্তু, আমি বলবো যেহেতু শিক্ষকরা ওই ল্যাপটপে তথাকথিত মাইক্রোসফট ওয়ার্ড বা এক্সেল ব্যবহার করতে যাবেন না, সেহেতু তাদেরকে ব্যাপকভাবে তথাকথিত কম্পিউটার প্রশিক্ষণও দিতে হবে না। প্রতিটি ল্যাপটপের সঙ্গে বাংলাভাষায় ব্যবহার নির্দেশিকা দেওয়া থাকবে যাতে ইন্টারনেটসহ সিডি, মাল্টিমিডিয়া চালানোর পদ্ধতি উলেখ থাকবে। সরকারি উদ্যোগে গড়ে তোলা হবে একটি ‘হেল্পডেস্ক’ যেখানে শিক্ষকরা ফোন করে সহায়তা পাবেন।
যখন শিক্ষকরা তাদের এই ল্যাপটপ শিক্ষার কাজে ব্যবহার করবেন, তখন স্থানীয় সম্প্রদায় তাদের বিদ্যালয়গুলোতে আরো কম্পিউটার দেওয়া শুরু করবেন। প্রথম ২০ হাজার সেকেন্ডারি স্কুলের প্রতিটিতে ইন্টারনেটসহ একটি করে ল্যাপটপ কম্পিউটার মাত্র ১ বছরের মধ্যেই স্কুলের শিক্ষার্থী-অভিভাবক ও স্থানীয় জনগোষ্ঠী পৌছে দিতে পারবেন।
আর সরকার ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঝাপিয়ে পড়তে হবে ইন্টারনেট ও তথ্যপ্রযুক্তির নানা মিডিয়া ব্যবহার করে শিক্ষার রসদ তৈরি করার কাজে। শুরুর দিকে, শিক্ষকরা বিশ্বখ্যাত এমআইটির মুক্ত শিক্ষাসম্পদসহ ইন্টারনেটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রসদ ব্যবহার করতে পারবেন। অচিরেই সেই সম্পদে যোগ হবে বাংলাভাষার শিক্ষা উপকরণ।
ডিজিটাল সমাজের ভিত্তি যেহেতু সংযুক্তি সেজন্য তার দরকার সবার জন্য উচ্চগতির সংযুক্তিÑব্রডব্যান্ড সংযুক্তি। সর্বোপরি তথ্য প্রযুক্তির প্রশাসন ও সার্ভিস বা ডিজিটাল সরকার। এই সমাজে তথ্যের প্রবেশাধিকারের জন্য যে সকল উপকরণ দরকার, যেমন কম্পিউটার, মোবাইল, পিডিএ, রেডিও, টিভি ইত্যাদির প্রাপ্যতা সুলভ হতে হয়। অন্যদিকে সরকারি ও বেসরকারি সেবাকে জনগণের দোড়গোড়ায় নেওয়ার জন্য এই সকল কাজের নীতি, প্রক্রিয়াকে সহজতর করারও প্রয়োজন পড়ে। বিদ্যুৎ বিল পরিশোধের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ আমলের প্রবর্তিত রাজস্ব টিকেট লাগানোর ব্যাপারটিকে উড়িয়ে দিলে তা যেমন ভোক্তাকে মোবাইল ফোন থেকে বিল পরিশোধে উৎসাহিত করে তেমনি তা সরকারের রাজস্ব টিকেট ছাপানোর খরচটা ও সময় দুটোরই সাশ্রয় করে।
ব্রডব্যান্ড চক্র
যেকোন ধরনের নতুন প্রযুক্তি ও সেবা চালুর ক্ষেত্রে একটি চক্র দেখা যায়। ব্রডব্যান্ডের বেলায়ও এটি সমান সত্য। সাধারণভাবে চাহিদা বাড়লে ব্রডব্যান্ডের বিনিযোগ বাড়ে। আবার নতুন নতুন এপিকেশন হলে তা চাহিদা বাড়ায়। অর্থাৎ চক্রটি নিজের মধ্যে ফিরে আসে।
এই চক্রের দুটো ক্ষেত্রে ইন্টারভেনশনের সুযোগ আছে। প্রথমত সরকার এখানে বিনিয়োগ করতে পারে যা প্রকারান্তরে চাহিদা বাড়াবে। অন্যদিকে উদ্ভাবনী প্রকৌশলীরা নতুন নতুন এপিকেশন তৈরি করতে পারেন। এই ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এগিয়ে আসতে পারে সহজেই।
সংযুক্তির নানা ধাপ
জনগণের সংযুক্তির জন্য প্রথমে দরকার সবার জন্য ব্রডব্যান্ড।
এর জন্য দরকার জনগণমুখী নীতিমালা। বর্তমানে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক ব্রান্ডউয়িডথ এর মূল্য মেগাবিট প্রতি ৮৪ হাজার থেকে কমে ১৮ হাজার হলেও তার সুফল কিন্তু গ্রাহক পর্যায়ে পৌছেনি। সুষ্ঠু নীতিমালা ও তার প্রয়োগ না থাকায় এই ঘটনা ঘটেছে। পাশাপাশি বাজারে শক্তিশালী প্রতিযোগিতার আবহ তৈরি করতে হবে। সায়শ্রী মূল্যে সবার কাছে ব্রডব্যান্ড পৌছাতে না পারলে ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নপূরণ হবে না।
কেবল আন্তর্জাতিক ব্রান্ড উয়িডথের দাম কমালেই হবে না। দেশের মধ্যে একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে হবে যাতে থাকবে বেশি গতির ইন্টারনেট, সব ধরনের একসেস প্রযুক্তির প্রাপ্যতা, থাকবে সাশ্রয়ী একসেস উপকরণ। তবে, কেবল প্রযুক্তির সংযুক্তির ব্যবস্থা করলে হবে না, ওই প্রযুক্তি দিয়ে কী করা হবে তাও নিশ্চিত করতে হবে। এই জন্য স্থানীয় তথ্য ভান্ডায়, দেশজ তথ্য ভান্ডার এবং সর্বোপরি নাগরিক সেবা সমূহ যাতে ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে পাওয়া যায় তা নিশ্চিত করতে হবে। কোন প্রযুক্তির ব্যবহার সহজ ও সাবলীল হয় যদি সেটির ব্যবহার সহজবোধ্য হয়।
আমাদের সংস্কৃতির একটি বড়ো দোষ হলো আমরা প্রযুক্তি পণ্যের ম্যানুয়ালগুলি পড়ি না। ফলে, ম্যানুয়ালগুলো কোন ভাষাতে আছে তাও দেখা হয় না। অথচ, আপনি কোন একজন ব্রিটিশকে দেখবেন না যিনি ম্যানুয়াল না পড়ে কোন পণ্য ব্যবহার শুরু করেন! প্রযুক্তি পণ্যের যথাযথ ব্যবহার বাড়াতে হলে আমাদের এর সকল গুণাগুণ জানতে হবে। এই লেখা যারা পড়ছেন, তাদের সবার মোবাইল ফোন থাকার কথা। কিন্তু আমি জোর গলায় বলতে পারি, আমার পাঠকের ৫০ শতাংশও তার মোবাইলটির সর্বোচ্চ ব্যবহার করেন না।
এই সংস্কৃতির রূপান্তর ঘটানোর জন্য আমাদের দরকার ম্যানুয়ালগুলোকে বাংলা ভাষায় প্রকাশের ব্যবস্থা করা। যেহেতু, আমাদের দেশ এখন প্রযুক্তি পণ্যের বড়ো বাজার, কাজেই প্রস্তুতকারী সংস্থা এই কাজ করতে মোটেই দ্বিধান্বিত হবে না।
উপকরণের ব্যবহার বাড়বে যদি সেগুলো সাশ্রয়ী হয়। কম বেশি দেড় হাজার টাকায় মোবাইল পাওয়া যায় বলে এর গ্রাহক সাড়ে চার কোটি। অন্যদিকে ২০-২৫ হাজার টাকায় কম্পিউটার পাওয়া গেলেও এর জন্য দরকারি স্বত্বাধিকারী সফটওয়্যারগুলোর দাম পড়ে যায় ৪০-৪২ হাজার টাকা।
এই অবস্থার পরিবর্তণ করা যাবে যদি আমরা ওপেন সোর্স সফটওয়্যার ব্যবহার করি। এগুলো বিনামূল্যে পাওয়া যায় এবং এর ব্যবহার প্রযুক্তির স্বাধীনতাকে রক্ষা করে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো এই সব উপকরণের মাধ্যমে যে সফল সেবা পাওয়া যাবে সেগুলোকে হতে হবে কজের এবং মাধ্যম হবে বাংলা ভাষা। ইন্টারনেটের একটি বড়ো ঝামেলা হলো এর ৯০ শতাংশ কন্টেক্ট ইংরেজিতে। আমাদেরকে নিজেদের ভাষায় এই তথ্য ভান্ডার গড়ে তুলতে হবে।
মনে রাখা দরকার ওয়েলকাম টিউন আর কম্পিউটার গেমিং দিয়ে বৃহত্তর জনগোষ্ঠিকে সংযুক্ত করা যায় না।
সংযুক্তির শেষ ধাপ হলো শেয়ারিং। এলাকা ভিত্তিক গণ কেন্দ্রÑসাধারণ একসেস পয়েন্ট। যেখান থেকে জনগণ ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই সেবা দিতে পারবে।
# কী চাই
ওপরের আলোচনা থেকে আমরা এখন আমাদের কর্মপন্থা বা দাবী-দাওয়ার একটি তালিকা বানাতে পারি।
সাশ্রয়ী সংযুক্তি
* ব্যান্ডউয়িডথ মূল্য কমিয়ে সেটিকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌছে দেওয়া
* ব্রডব্যান্ড, মোবাইল ফোনের সংযুক্তি মূল্য হ্রাস, মোবাইল সিমকার্ডের উপর কর প্রত্যাহার।
* তৃতীয় প্রজš§সহ নতুন নতুন একসেস প্রযুক্তির দ্বার উšে§াচন
* ইন্টারনেট সেবার ওপর ১৫ শতাংশ মুসক প্রত্যাহার
* নেটওয়ার্ক সামগ্রীর ওপর কর হ্রাস
* ব্রডব্যান্ড নীতিমালায় উলিখিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বিশেষ উদ্যোগ
* শিক্ষাকে ডিজিটাল শিক্ষায় রূপান্তর
* বহু সংযুক্তির কেন্দ্র গড়ে তোলা
* পাবলিক ডোমেইনের সফল জ্ঞান উপকরণকে ডিজিটাইজ করা
* মোবাইল ও ইন্টারনেটে সরকারী ও বেসরকারি সেবা
* বাংলা ভাষায় সকল সরকারী ওয়েবসাইট প্রকাশ
* বাংলা ভাষায় সফল ফরম জমা দেওয়ার ব্যবস্থা করা
* ডিজিটাল স্বাক্ষর ও পেমেন্ট গেটওয়ে
সর্বোপরি দরকার একটি নতুন জ্ঞান ভিত্তিক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটানো। শুরুতে বলেছি একটি সমাজের রূপান্তর শুর হয় একটি রূপকল্প দিয়ে। ভিশন-২০২১ আমাদের সেটি দিয়েছে। এখন দরকার এটির মিশন আর কর্মকান্ডগুলো নির্ধারণ করে কাজে নেমে পড়া।
এখানে সরকারের জন্য অপেক্ষা করার যেমন অবকাশ নেই, তেমনি জনগনই সব করে ফেলবে এমন ধারণা পোষন করারও উপায় নেই। কারণ, নানামূখী উদ্যোগে কেবল এই স্বপ্ন পূরণ হবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।