আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাচ্চা ভয়ংকর কাচ্চা ভয়ংকর-৬



এ বছরের বাচ্চাদের নিয়ে নতুন একটা পোষ্ট দিতে অনেকদিন থেকেই চাইছিলাম কিন্তু লিখতে গেলেই দেখছি সেই একই ধরনেরই লেখা হয়ে যাচ্ছে। সেই একই দুস্টুমি, একই দুরন্তপনা, একই ভালবাসা ঠিক গত বছরের বেবিদের মত। এ বছরও আমার ক্লাসরুমটিতে যে রাজপুত্র আর রাজকন্যারা বিচরণ করছে তাদের মাঝে রয়েছে কিছু দার্শনিক যারা অধিকাংশ সময় গালে হাত দিয়ে জানালা দিয়ে মাঠে বিচরণ করা কুকুরগুলোর দিকে তাকিয়ে তাকিয়েই গোটা সময় টুকু পার করে দেয়, কিছু রয়েছে সংগীত বিদ্বেষী সিডি তে রাইমস ছাড়া মাত্রই যাদের তার স্বর চিৎকারে কান পাতা দায় আবার কিছু রয়েছে পাকনা বুড়ো যাদের পাকা পাকা কথা শুনলে আমার নিজের ছোট খাট হার্ট এ্যাটাক হয়ে যায় কয়েক বার। এমনই এক পাকনা বুড়ো কে প্রথম দিন ওর নাম জিজ্ঞেস করলাম। ও গম্ভীর কন্ঠে ওর নাম বল্ল।

ভুলো মন আমার। তাছাড়া প্রথম দিনেই তো সবার নাম মুখস্ত হয়না। তাই কিছুক্ষন পর যেই আবার ওর নাম জিজ্ঞেস করতে গিয়েছি, দেখি ও গালে হাত দিয়ে চুপচাপ বসে আছে। নামটা আরেকবার জিজ্ঞেস করতেই ও ভুরু কুচকে আমার দিকে তাকাল। অতঃপর একরাশ বিরক্তি নিয়ে তার উত্তর- "বাবা, এরই মধ্য ভুলে গেছ? এখুনি না বল্লাম!" তিন বছরের এক পিচকির মুখে এমন স্পস্ট ভাষা শুনে তো আমার ভিমরী খাবার দশা।

যাই হোক নিতান্তই অনিচ্ছাসত্বে সে তার নাম দ্বিতীয়বার উচ্চারণ করল। আমিও তাবিজ পড়ার মত তার নাম মনে মনে আওরিয়ে একদম মুখস্ত করে ফেল্লাম। কারণ আর একবার ওর নাম জিজ্ঞেস করার মত মনের জোর আমার ছিলনা। কিছুক্ষন পর দেখি ও ওর সিটে বসে হাত নেড়ে আমাকে ডাকছে। আমি কাছে গেলাম।

ও জিজ্ঞেস করল-"তুমি তো আমার টিচার?" আমি ভয়ে ভয়ে মাথা নাড়লাম। "তুমি জান, আমার বাবা সবাই কে বলদ বলে ডাকে?" "কি??" আর্তনাদ বের হল আমার গলা দিয়ে। "হুমম আমার বাবা কারও উপর রাগ হলেই বলে, এই বলদ যা। " আমি কি বলব বুঝতে না পেরে শুকনো মুখ নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি ওর সামনে। না জানি কখন সে তার বাবার কাছ থেকে শেখা বিশেষণ আমার উপর প্রয়োগ করে বসে।

অতঃপর আরেক বাচ্চা ডাকতেই সে যাত্রা রেহাই পেলাম। সেই থেকে এই পাকনা বুড়োটার পাকা পাকা কথার শুরু। মাঝে মাঝে ওর কথার তোড়ে আমি নিজেই খেই হারিয়ে ফেলি আর মনে মনে ভাবি সত্যিই এর বয়স তিন তো? তিন তিরিশে নব্বই না তো? এবার আরেক রাজপুত্রের গল্প বলি। বাবা আর মামনির চোখের মণি সে। বাবা সেনাবাহিনীর বড় কর্মকর্তা তাই দেশের বাইরে গিয়েছেন মিশণে।

মামনিটাও অনেক ব্যস্ত। তাই একা বাসায় তার সারাটা দিন কাটে টিভিতে নিক চ্যানেলে কার্টুন দেখে। কিন্তু যেহেতু ভার্চুয়াল চরিত্রগুলো ওর কাছে কোনও রেসপন্স আশা করেনা তাই ও কারো ডাকে যে সাড়া দিতে হয় এই ব্যাপারটা শিখে উঠেনি। ও শুধু ওর মতই কথা বলে যায় কিন্তু কেউ তাকে হাজার বার ডাকলেও সে কোনও সাড়া দেয়না। ও যে শুনতে পারেনা এমন কিন্তু না।

সর্বনাশের চুড়ান্ত হল তখন যখন ওর মা একদিন অবাক হয়ে দেখলেন যে ও ওর মা কে জিজ্ঞেস করছে,"মাম্মি বারিশ হো রহিহে কেয়া?" সারাদিন নিক চ্যানেল দেখে দেখে সে বাংলার সাথে হিন্দী মিশিয়ে এক জগাখিচুরী ভাষা শিখে ফেলেছে। এই বাচ্চাটি আমার ক্লাসে যেদিন প্রথম এল সেদিন এক যোগে চার পাঁচটি বাচ্চা গলা ফাটিয়ে চিৎকার শুরু করে দিল। কারণ আর কিছুই না, তার বিপুল স্বাস্হ্য। আমি নিজেও যে একটু ভয় পাইনি তা না কারণ আমার স্কুলের প্রথম দিনের সেই মোটুর ঘুসির স্মৃতি তখনো মন থেকে মুছে যায়নি। কিছুদিন লক্ষ্য করে দেখলাম বাচ্চাটির স্বাস্হ্যটাই যা একটু বেশি কিন্তু এমনিতে সে খুবই নিরীহ।

কাউকেই কখনো সে মারেনা। বরং উল্টো সবাই কে সেই ভয় পায়। বয়স অন্য বাচ্চাদের চেয়ে একটু বেশিই কিন্তু ম্যচিউরিটি অন্যেদের চেয়ে কম। সবচেয়ে মায়াকাড়া তার চেহারাটা। কিন্তু সমস্যা তার সাথে কথা বলতে গেলে।

আমি যা বলব ও সেটাই বলতে থাকবে। আমি যদি ওর নাম ধরে ডাকি ও ওর নামটাই ডাকবে। আমি যদি বলি "এদিকে এস" ও উল্টো বলবে "এদিকে আছো"। তবে টিফিন পিরিয়ডে ওর একদিনও ভুল হবেনা । টিফিন বক্সটা হাতে নিয়েই সে আমার খোঁজ করবে।

আমাকে দেখতে পেলেই তার পাশে সে আরেকটা চেয়ার টেনে নিয়ে আমাকে ডেকে বলবে,"মিছ আছো, ম্যাগী নুডুস"। অর্থাৎ আমাকে এখন তার পাশে বসে তাকে ওর টিফিন খাইয়ে দিতে হবে। আমি যদি জিজ্ঞেস করি" আমি খাইয়ে দিব?" ও তখন এক গাল হেসে উত্তর দিবে ,"আমি থাইয়ে দিব"। এখন আমার যুদ্ধ চলছে একে নিয়েই। দেখা যাক ওকে অন্যর সাথে কমিউনিকেট করা শেখানো যায় কিনা।

এভাবেই চলছে আমার ছোট্ট তরী ছোট্ট ছোট্ট যাত্রীদের নিয়ে। জানিনা কতদিন চালাতে পারব। তরী তো চলবে তার আপন গতিতেই শুধু কান্ডারী হয়ত পরিবর্তন হবে এই যা। পৃথিবীর কোনওকিছুই কি কারও জন্য থেমে থাকে কখনও?

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.