ভোর আপুর পোস্ট দেখে অনুপ্রানীত হয়ে আমিও ভাবলাম বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে কিছু মিছু একটা লিখি কিন্তু অনেক ভেবে চিন্তেও আমি বাচ্চাদের সম্পর্কে তাদের ক্রিয়াকলাপের বর্ণনা দেবার মত কোনো শিরোনামের ভাষা খুঁজে পেলাম না। আসলে বাচ্চাগুলোর কান্ড দেখে আমি মাঝে মাঝে বাকহরা হয়ে যাই। তাদের কর্মকান্ডের উপযুক্ত সঠিক কোনো শব্দ মনে হয় পৃথিবীতে এখনও কেউ আবিষ্কার করতে পারেনি অথবা করলেও তা আমার জানা নেই। তবে মাঝে মধ্যে আমার শিশুকাল সম্পর্কে আমার মায়ের বয়ানগুলো শুনে ভাবি ওরা মনে হয় আমার চাইতে ভালো মানে অনেক অনেক ভালো। আরেকজনের চাইতে তো অবশ্যই ভালো, সে হলো আমাদের তামিম ভাইয়া।
যাইহোক এই বছরের আমার নতুন ক্লাসের বাচ্চাদেরকে দেখে আমি বরাবরের মত প্রথমেই মুগ্ধ হলাম। মুগ্ধ হবার কারণ মনে হল একঝাঁক দেবশিশু নেমে এসেছে মাটিতে।
পড়াশুনাপ্রিয় গিয়ানী তুলতুলে এক পরীকন্যা। পড়ুয়া পরীকন্যাটার পেন্সিলটা খুব দুষ্টু, শুধুই হাত ফসকে উড়াল দেয় বার বার
এখন বলি ভুল করে মর্ত্যে নেমে আসা পরীমেয়েটার কথা। সে খুব ভালো করেই জানে সে যে ভুল করে এই ধরায় নেমে এসেছে তাই সবাই অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে তাই কাউকে পাত্তা দেয়না সহজে।
কিন্তু সে রাইমস খুব লাইক করে, যেমন সে প্রথম দিন কিছুতেই গান শুনালোনা কিন্তু পরের দিন নিজেই খুশী হয়ে দৌড়ে এলো আমার কাছে যখন আমরা সব্বাই মজা করে রাইমস করছিলাম একসাথে। ও বললো ও একটা রাইম শুনাবে, এটা তার আব্বু শিখিয়েছে। তারপর শুরু করলো,
টুইংকেল টুইংকেল লিত্তিল থার, হাউ আই ওন্ডাল হয়াত ইউ আল ( আধো আধো বোল খুব ভালো লাগছিলো শুনতে)
তারপর যখন পরের লাইন গাইলো,
আব্ দা বাপ্ দা ওয়াল থো হাই, লাইক আ দিমন ইন দাস্কাই। তখন আমি আপ দা বাপ দা শুনে .........
যাইহোক,এর পর গান শুনালো তুলতুল পড়ুয়া বাবুটা
উই শ্যাল ওভারকাম , উই শ্যাল ওভারকাম (সূরটা একদম পারফেক্ট, উচ্চারনও)
উই শ্যাল ওভার কাম সানডে.... সানডে? বলে কি? ভালো করে কান পেতে শুনলাম । হ্যা ও সানডেই বলছে।
এইবার সবাই মিলে সমবেত এ্যলফাবেট রাইম।
এ, বি, সি, ডি , ই, এফ, জি
এইচ , আই, জে, কে, এল, এম এন ও পি
একটা বাবু শুধুই এল এম এন ও পি এর বদলে তারস্বরে চেঁচিয়ে বলছিলো এলোমেলো পি.... মানে ও বলছিলো এইচ , আই, জে, কে, এলোমেলো পি
এইবার বলি একটা বাংলা ছড়াগানের কথা,( যেটার অবশ্য ইংলিশও আছে,)যা আমাদের ক্লাসের সবচাইতে স্মার্ট বাবুটা গাইলো,
কাগজের টুকরা, কাগজের টুকরা পড়ে আছে ঐ
জায়গা করে নোংরা, জায়গা করে নোংরা
তুলে খাও( তুলে নাও না বলে ও খেতে চাইলো কেনো? ও কাকে কাগজের টুকরা খেতে দেখেছে?)
আরেকটা কথা বলে রাখি এসব কিন্তু আমি শিখাইনি। ( কেউ যেন আবার না বলে তুমি পন্ডিৎ টিচার হলে বাচ্চারা তো এসবই শিখবে)এসব ওদের প্রথমদিনের গান। কাজেই অন্যকেউ যারা শিখিয়েছে বাচ্চাগুলো ভুলভাল আবোলতাবোল কি বললো না বললো খেয়ালই করেনি। সব তাদের দোষ।
( যদিও আমার শুনতে মজাই লেগেছিলো খুব খুব। তাইতো চুপিচুপি সবাইকে বলে দিলাম। )
এই যে আমার একটা কাঁদুনী জান্টুস। আমার কলিগের মেয়ে
এটা আরেকটা জান্টুস মান্টুস। অপ্সরী খালার স্কুলে পড়ছে।
ওদের একটা গ্রুপ কার্পেটে বসে ব্লকস নিয়ে খেলছিলো, আরেকটা গ্রুপ ডলহাউজে পাপেট আর ডলস নিয়ে। হঠাৎ দেখি একজন তার জুতা খুলে মোজাটা পায়ের বদলে হাতে পরে বসে আছে। যতই বলি হাতে পরার মোজা আর পায়ে পরার মোজা আলাদা , সে কিছুতেই শুনবেনা।
আর ওদিকে আরেকটা মেয়েবাবু উনি ততক্ষণে ডলহাউজটার মধ্যে নিজেই উঠে বসেছেন ও মানুষডল সহ ডলহাউজটার সামনের দিকে ধীরে ধীরে পপাৎ ধরনীতল দেখতে পেয়ে আমি চিল্লিয়ে উঠলাম ও আমার চোখ অটোমেটিক বন্ধ হয়ে গেলো আর তারপর চোখ খুলে দেখি মানুষ ডল ও ডলহাউজ দুটোই ধরাশায়ী। ভাগ্যিস আমাদের মেঝেটা বেশী শক্ত না।
কম্পিউটার ক্লাসে বসে ওরা গেমস খেলছে হঠাৎ এসি রুমের বন্ধ দরজা খুলে দৌড় দিলো পিচ্চিটা।
আমরা দুদুটো টিচার ঘটনার আকস্মিকতায় কি করনীয় বুঝে উঠবার আগেই সে অদৃশ্য হয়ে গেলো। অনুমান করে ওর পিছু পিছু আমরা দুজনই দৌড়ালাম আমাদের পিছে আরো দুতিনজন আয়া। ততক্ষণে তিনি প্রিন্সিপ্যালের রুমের দরজা ঠেলে সোজা তার গদীআটা চেয়ারে উঠে বেশ আরাম করে বসে রয়েছেন।
ফুটফুটে দুষ্টু বেবিটা হঠাৎ ক্লাসে ঢুকেই খুবি উত্তেজিত ভঙ্গীতে বলতে লাগলো তার ব্যালে ডান্স শেখার কাহিনী।
আমি বললাম,"শিঘ্রী দেখাও আমাকে তোমার ডান্স। ও তাড়াতাড়ি করে এক পাক ঘুরে এক হাতে এক পা উচু করে ধরতে গিয়ে পড়ি পড়ি মরি মরি করেও ঠিকি এক হাতে এক পা ধরে দাঁড়িয়ে গেলো আর মুখে পরম কৃতিত্বের ভাব ফুটিয়ে তুলতে না তুলতেই পাশে রাখা দুতিনটা চেয়ার,পাঁচ ছজন বন্ধুবান্ধবী ও তারও পাশে রাখা ছোট প্লাস্টিকের র্যাক সহ ঠাস করে পড়ে গেলো।
এবার বলি মিসবেবি ও কিসবেবিদের কথা
এই যে আমার কিসবেবিটা
এই বেবিটা গুটুম গাটুম দেখতে একদম একটা বাবুপুতুল। এর কাজ সকালবেলা প্রথমেই দৌড়ে এসেই মিসকে একটা কিস দেবে। তারপর কথায় কথায় যখন তখন উঠতে বসতে চলতে ফিরতে ওর কাজ মিসকে কিস করা।
বাড়ী যাবার সময় সে দুই হাতে গালে কিস তার ফুরোতেই চায়না। এই কিস বেবিটার জন্য আমার আর ইদানিং গালে পাউডার লাগিয়ে লাভ হয়না।
তবে সবচেয়ে আমার আক্কেল গুড়ুম হল তখন, যখন ও পাশে বসা একটা ছেলে বাবুকে কিস করলো আর ছেলেটা গম্ভীর ভাবে জবাব দিলো , "মেয়েদের ছেলেদেরকে কিস দিতে হয়না। " কিসবেবি খুব কৌতুহলে প্রশ্ন করলো আর ছেলেদের? ছেলেদের কি মেয়েদেরকে কিস দিতে হয়? মহাপন্ডিতের উত্তর রেডী। " না ছেলেদেরকেও না।
শুধু বড় হলে দিতে হয়। "
মাই গড!!! বলে কি পন্ডিৎ!!!
মিস বেবী
এই বেবিটার কান্না থামেনা। শুধুই স্কুলে এসে সে মাকে মিস করে। এর দিকে একটু এক্সট্রা এ্যটেনশন দিতেই হলো। তারফলে কি হলো সেই ভোর আপুর সমস্যা।
সমস্যার নাম "আঁচল ধরা" ওড়না বা কামিজের এক প্রান্ত সদা ও সর্বদা মুষ্ঠিবদ্ধ। আমি ম্যাটে বসলে ও ম্যাটে আমি চেয়ারে বসলে ও আমার কোলে আর আমি হাটলে ও আমার সাথে সাথে। টিফিনের সময় না খাইয়ে দিলে খাবেনা। এমনকি মাঝে মাঝে আয়ার বদলে আমাকেই তাকে টয়লেটেও নিয়ে যেতে হবে। এত ভালোবাসার মধ্যেও একদিন একটা বাচ্চা একটু অসুস্থ্য হয়ে পড়ায় ওর দিকে মনোযোগ দিতে হলো আর আমার মিসবেবীর হাতটা জোর করে ওড়না থেকে ছাড়িয়ে আমি চলে গেলাম ডক্টরস রুমে।
অনেকটা সময় পরে এসে আমি একটু ব্যাস্ততার কারণে ওর দিকে খেয়াল করিনি। দূরে দাড়িয়ে রিপোর্ট লিখছিলাম সিক বাচ্চাটার জন্য । একটু পরে হঠাৎ মিস বেবিটার দিকে চোখ পড়তেই দেখি টিফিন বক্স সামনে খোলা পড়ে আছে। দূর থেকে সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, চোখদুটো ছলোছলো। ঠোট দুটো অভিমানে ফুঁলে আছে।
এক ফোঁটা কিছুই খায়নি। আমার কাছে দৌড়ে এসেও ওড়না ধরেনি। কিছু আগে নিষ্ঠুরের মত ওর মুষ্ঠিবদ্ধ হাত থেকে ওড়না ছাড়িয়ে চলে গেছিলাম তাই অনেক অভিমানে সে দূরেই রয়ে গেছে।
দৌড়ে গেলাম ওর কাছে তারপর আমার মিসবেবিটার জন্য নিজেই হয়ে গেলাম কিসবেবি।
মাঝে মাঝে ভাবি হায়রে বেবিগুলো আর তাদের ছোট্ট ছোট্ট বেবিবেবি মন গুলো !!! কে বাসবে ওদের চাইতে বেশী ভালো আর আমাকে !!! এমন নিস্বার্থ ভালোবাসা একমাত্র শিশুরাই হয়ত বাসতে পারে।
ভালোই আছি ওদেরকে নিয়ে।
সোনালীডানার কথাটা মনে ধরায় ওদের পিঠে পরীপাখা লাগানো একটা ছবি দিলাম।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।