রাজনীতির ভারসাম্য ও রাষ্ট্রীয় নীতির প্রতি মানুষের ভরসা
ফকির ইলিয়াস
========================================
প্রকারান্তরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যটি ক্রসফায়ারের পক্ষেই গেল। জাতিসংঘ অধিবেশনে এসে নিউইয়র্কে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলেন তিনি। ক্রসফায়ার সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বললেন, 'সন্ত্রাসী ধরতে গেলে যদি সন্ত্রাসীরা একশনে যায় তবে সরকারি বাহিনী কি বসে থাকবে? ওরা মারবে, আর সরকারি শান্তি রক্ষাকারী বাহিনী তো মার খেতে পারে না। মরতে পারে না। আমরা কি লিল্লাহতে ছেড়ে দেবো?'
প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যটি টিভিতে প্রচারিত হয়েছে।
দেশবাসী শুনেছে। দেখেছে। প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর ক্রসফায়ারের পালে বেশ হাওয়া লেগেছে বাংলাদেশে। এ পর্যন্ত, নবম জাতীয় সংসদের সরকারের সময়ে কতজন ক্রসফায়ারের শিকার হয়েছে তার সুষ্ঠু কোন পরিসংখ্যান নেই।
'ক্রসফায়ার' নিয়ে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে কম বিতর্ক হয়নি।
এর প্রকৃত শানে নজুল এবং রহস্য কি, তা কারোরই অজানা নয়। যে ক'টি ক্রসফায়ার হয়েছে এবং হচ্ছে তার সবক'টির ধরন একই। শান্তি রক্ষাকারী বাহিনী শীর্ষ সন্ত্রাসীটিকে নিয়ে অস্ত্র খুঁজতে অথবা আরও সন্ত্রাসী ধরতে কোন স্থানে যায়। সেই স্থানে ওঁৎ পেতে থাকেন ওই শীর্ষ সন্ত্রাসীর দোসররা। ওরা গুলি করে।
পাল্টা গুলি চালিয়ে শান্তি রক্ষাকারী বাহিনী। এই ক্রসফায়ারের বলি হয় সেই চিহ্নিত সন্ত্রাসীটি। মোটামুটি এটাই হচ্ছে ঘটনার ছক।
'ক্রসফায়ার' সম্পর্কে রাষ্ট্রের তৃণমূল পর্যায়ে একটি বদ্ধমূল ধারণা আছে। ধারণাটি হচ্ছে এই, রাষ্ট্রপক্ষ আইনি প্রক্রিয়ার শীর্ষ সন্ত্রাসীদের বিচারের মুখোমুখি করতে ব্যর্থ হচ্ছে।
আর সেই ব্যর্থতা পুষিয়ে নিতেই এক ধরনের নীরব, বিচার-বর্জিত হত্যাকান্ডের প্রশ্রয় দিচ্ছে রাষ্ট্রপক্ষ।
আগেই বলেছি, কেন ক্রসফায়ার নামক ব্যবস্থাটি বাংলাদেশের রাষ্ট্রনীতিতে নতুনভাবে আলোচিত হচ্ছে তা কারোরই অজানা নয়। চারদলীয় জোট সরকারই ক্রসফায়ারের করেছিল। আর বর্তমান সরকার এর পক্ষে কথা বলছে সরাসরি।
একটি রাষ্ট্রে অপরাধী যত ক্ষমতাবানই হোক না কেন, রাষ্ট্রীয় আইনে তার বিচার হবে-সেটাই প্রত্যাশিত বিষয়।
কিন্তু আমরা দেখছি, খুন, ধর্ষণ, বোমাবাজি প্রভৃতির মতো জঘন্য অপরাধের সঙ্গে যুক্ত সন্ত্রাসীরা পার পেয়ে যাচ্ছে, জামিনে বেরিয়ে আসছে, মদদ পাচ্ছে দেশের কিছু রাজনীতিকেরও।
বাংলাদেশে প্রচলিত আইন এবং বিচার বিভাগীয় দীর্ঘসূত্রতার কারণে এ রকম অনেক মারাত্মক অপরাধী বেরিয়ে যায় আইনের ফাঁকফোকরের মধ্যদিয়ে। তাদের আটকানো যায় না। কেন যায় না? এই ব্যর্থতাটি কাদের এবং কেন? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা দরকার।
দুই.
বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা ভারসাম্য রক্ষার মহড়া আমরা সবসময়ই লক্ষ্য করা যায়।
বড় বড় দলে, সরকারেও নেপথ্যে সবসময় এ রকম একটি প্রচেষ্টা থাকে। এর একটি অতি-সম্প্রতি উদাহরণ দেয়া যাক। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমানে উপদেষ্টাম-লীর সদস্য আবদুল জলিল, আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের বিরুদ্ধে নানা ধরনের আপত্তিকর কথা বলেছেন সম্প্রতি যুক্তরাজ্যে গিয়ে। তা ফলাও করে দেশে-বিদেশে প্রচারিত হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে দলে তীব্র প্রতিক্রিয়াও হয়েছে।
চাপের মুখে জলিল 'দুঃখিত' বলে একটি বিবৃতিও দিয়েছেন।
৩ অক্টোবর ২০০৯ শনিবার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নতুন কার্যকরী কমিটির প্রথম যৌথসভা হলো। দেখা গেল, সে সভা আবদুল জলিলের বিরুদ্ধে কোন সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়নি। বর্তমান সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, আবদুল জলিলকে একজন 'মানসিক ভারসাম্যহীন' ব্যক্তি বলেই চালাতে চেয়েছেন। প্রশ্নটি হচ্ছে_ জলিল কি আসলে মানসিক ভারসাম্যহীন? যিনি শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিষয়ে এমন নগ্ন আপত্তিকর কথা বললেন, তাকে মানসিক ভারসাম্যহীন বলা হবে? না কি ষড়যন্ত্রকারী খোন্দকার মোশ্তাকের প্রেতাত্মা বলা হবে?
দলে অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, মাহমুদুর রহমান মান্না, সুলতান মোহম্মদ মনসুর- এমন অনেক সিনিয়র নেতা আছেন যারা এমপিও হতে পারেননি।
তারা তো দলের চেইন অফ কমান্ডকে এমন চ্যালেঞ্জ করছেন না। কিংবা করেননি। আবদুল জলিল এমন ধৃষ্টতা দেখাবার সাহস পেলেন কোথা থেকে?
এ নিয়ে বিতর্ক যে শেষ হয়ে গিয়েছে তা কিন্তু নয়। সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম তাকে 'মানসিক ভারসাম্যহীন' বলার যুক্তি থেকে সরে গিয়ে এখন বলছেন, আবদুল জলিল নিজেই নিজেকে 'ভারসাম্যহীন' বলেছেন। একজন মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তি একটি রাষ্ট্রের সাংসদ হতে পারেন কি না, তাও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে নানা মহলে।
সব মিলিয়ে সরকার বেশ বিতর্কের মুখেই পড়েছে। নির্বাচন কমিশন বলেছে, তিনি ভারসাম্যহীন কি না তা আদালতই বলতে পারবে। কথা আসতে পারে তার ডাক্তারি পরীক্ষা বিষয়েও। কারণ মানসিকভাবে কেউ আক্রান্ত হয়ে কথা বললে, তার পক্ষে-বিপক্ষে ডাক্তারি তর্ক-বিতর্ক চলার রেওয়াজও রাজনৈতিকভাবে রয়েছে।
এসব বিতর্ক যতই বাড়ছে, রাষ্ট্রনীতির প্রতি মানুষের ভরসা কমছে ততটাই।
কারণ একটি নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের ভেতরের দলীয় কোন্দলের কাহিনী শুনতে এই প্রজন্ম প্রস্তুত নয় মোটেও। সরকার রাষ্ট্রের মানুষের মৌলিক চাহিদা মেটাতে পারবে না, আর নিজেদের মাঝে কলহ করে বিভ্রান্ত সৃষ্টি করবে তা কখনই প্রত্যাশিত নয়। রাষ্ট্রের মানুষ স্বপ্নের আলো চোখে নিয়ে একটি পরিবর্তন আশা করছে। প্রত্যাশা করছে, একটি নতুন অধ্যায়ের। যে অধ্যায়ের জমিনে শক্তিশালী হয়ে দাঁড়ানোর সাহস পাবে এই প্রজন্ম।
আওয়ামী লীগের ক্ষমতাবঞ্চিত আর ক্ষমতাভোগীদের নিত্য কলহ দেখার জন্য তারা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা কাউকে দেয়নি। আজ আবদুল জলিল বলছেন। এই প্রথা বন্ধ না হলে কাল অন্যরাও নানা বিভ্রান্তি ছড়াতে সচেষ্ট হবে। অনেক দরকারি কাজ বাকি রেখে ক্ষমতাসীনদের এই কলহ মানুষকে ধৈর্যহারা করে তুলতে পারে। আর সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারে সরকারের প্রতিপক্ষ।
লেখাটি যখন শেষ করব ভাবছিলাম তখনই টিভি'র পর্দায় সংবাদ এলো সংসদীয় বাণিজ্যবিষয়ক স্থায়ী কমিটির সভাপতির পদ থেকে বাদ দেয়া হয়েছে আবদুল জলিলকে। নতুন সভাপতি হয়েছেন সাংসদ লুৎফুল হাই।
এই ঘটনাটি অপ্রত্যাশিত ছিল না। কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেছেন, সরকারের বিরুদ্ধে কারা ষড়যন্ত্র করছে তাদের খুঁজে বের করা হবে।
কারা এই ষড়যন্ত্রকারী? কেন ষড়যন্ত্র করছে? তা জানার অধিকার জনগণেরও রয়েছে।
সরকারের ভেতরে এবং সরকারের বাইরে যারা রাষ্ট্র, মানুষ এবং সব মননশীলতায় বিরোধিতা করছে তাদের চিহ্নিত করা দরকার গণতন্ত্রের স্বার্থেই।
আগেই বলেছি, একজন আবদুল জলিল কখনই একটি বৃহৎ দলের জন্য চ্যালেঞ্জের কারণ নয়- হতে পারেন না। এর নেপথ্যে যারা কলকাঠি নাড়েছে তাদের শিকড় খুঁজে না দেখলে সরকার আরও বিপন্ন হতে পারে।
নিউইয়র্ক , ৭ অক্টোবর ২০০৯
------------------------------------------------------------------
দৈনিক সংবাদ। ঢাকা।
৯ অক্টোবর ২০০৯ শুক্রবার প্রকাশিত
ছবি- কাঝ ওয়াট
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।