আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমাজনের মৃত্যুদূত--২



আগের পর্বে দিয়েছিলাম আমাজনের জলের মৃত্যুদূতদের কথা, কিন্তু ডাঙাতেও বিপদ কম নেই সেখানে। একটু দেখে নেয়া যাক সেখানে জলের কিনারাতেও কতশত যম ফাঁদ পেতে বসে আছে। টারান্টুলা এই মাকড়সার নাম শোনেনি এমন লোক পাওয়া মুশকিল। যাদের মাকড়সা ভীতি আছে, তাদের না দেখাই ভাল, নিজে খানিকটা মাকড়সা ভয় পাই বলেই বলছি, রোমশ আর বিশাল আকারের এই প্রাণীটার মত বীভৎস কিছু আমার জীবনে খুব বেশি দেখিনি। ছোটখাটো কীটপতঙ্গ থেকে শুরু করে ব্যাঙ, এমনকি ইঁদুর পর্যন্ত সাবড়ে দেয় জাল না বোনা এই মাকড়সা, ঘাপটি মেরে থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে সামনের দু'টো দাঁত দিয়ে বিষ ঢেলে--যদিও মানুষের জন্য সেটা খুব বিপজ্জনক নয়-- আস্তে আস্তে সাবাড় করে শিকারকে।

বড় আকারের একটা টারান্টুলার ব্যাস ৩০ সেন্টিমিটার বা ১ ফুট পর্যন্তও হতে পারে। ব্রাজিল ওয়ান্ডারার্স স্পাইডার আকারে টারান্টুলার অর্ধেক হলেও মানুষের জন্য এই মাকড়সা অনেক বেশি ভয়ংকর, কারণ টারান্টুলার বিষ নেই, ওয়ান্ডারার্সের আছে। যাযাবরের মতই ঘুরে বেড়ায় বলে এর এই নাম, কখনোই বাসা বাঁধে না কোথাও, শিকারকে কাবু করে বিষ দিয়ে, চিকিৎসা দিতে দেরি হলে যাতে মানুষেরও মৃত্যু হতে পারে। দেখতে যদিও অতটা ভয়ংকর নয়, তারপরেও ব্রাজিল থেকে আমদানী করা কলা আর ফলমূলের বাক্স খোলার সময় যথেষ্ট সাবধান থাকে লোকজন, যেকোন সময় একটা ওয়ান্ডারার্স বেড়িয়ে এসে কামড়ে দিলে স্পাইডারম্যান হবার বদলে ডেডম্যান হয়ে যাবার সম্ভাবনাই বেশি কিনা! ল্যান্সহেড ভাইপার বিষের কথাই যদি আসে, তো সর্পদেবকে আনতেই হবে। আর আমাজনের বিষাক্ত সাপগুলোর মাঝে উপরের দিকে থাকবে ল্যান্সহেড ভাইপার।

ভাইপারের অন্যান্য সব প্রজাতির মতই অত্যন্ত বিষাক্ত, হিংস্র এবং বদমেজাজী। লম্বায় ৭৫ থেকে ১২৫ সেন্টিমিটার, অর্থাৎ ৫ ফিট পর্যন্তও হতে পারে। বাদামী, ডোরাকাটা, ব্রোন্ঞ্জ বা সোনালী রঙেরও হয়। যদিও মাটিতেই থাকে, তবে দরকারে গাছেও উঠতে পারে,পানিতেও ভাল সাঁতারু। নিশাচর হলেও খাদ্যের সন্ধানে দিনেও বের হয়।

ছোটখাটো ইঁদুর জাতীয় প্রাণী এদের খাবার, এগুলোর সন্ধানে ঘুরে বেড়ায় কফির বা কলার বাগানে, বোঝাই যায় না কোথায় ঘাপটি মেরে আছে। সামান্য বিরক্ত হলেই কামড়ে দেয়, মাত্র ৬২ মিলিগ্রাম বিষই যথেষ্ট মানুষের মৃত্যুর জন্য। প্রথমে আক্রান্ত স্থানের টিস্যুগুলোকে মেরে ফেলে এই বিষ, রক্তবাহী শিরার মাধ্যমে দ্রুতই ফুসফুসে পৌঁছে গিয়ে শ্বাস নেয়া বন্ধ করে দেয়। যদিও চিকিৎসা আছে, তবে সেটা করতে হয় দ্রুত, আমাজনের মত জায়গায় সেটা খুব তাড়াতাড়ি পাওয়া যায় না বলে দক্ষিন আমেরিকার অন্য যেকোন সরিসৃপের তুলনায় এর আক্রমণে মানুষের মৃত্যুর হার বেশি। বুশমাস্টার বিষের দিক থেকে বুশমাস্টারও কম যায় না।

বাদামী-কালো এই সাপটি ভাইপার গোত্রের বৃহত্তম, এবং একই সাথে পশ্চিম গোলার্ধেরও দীর্ঘতম বিষধর সাপ। লম্বায় হয় সাধারণত ৬.৫ থেকে ৮.২৫ ফিট, তবে ১০ ফিট পর্যন্তও দেখা গেছে। কুণ্ডলি পাকিয়ে পড়ে থাকা এই সাপ বেশ খানিকটা দূর থেকেই ছোবল মেরে বসে, একেকবারে কয়েকটা ছোবলও দিতে পারে। একে স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে এর অস্বাভাবিক ধৈর্য্য, শিকারের গন্ধ শুঁকে এর যাতায়াতের পথটা খুঁজে নিয়ে এরপর সেই পথে ঘাপটিমেরে অপেক্ষা করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, কখনো দিন পার হয়ে যায়। তারপরে বাগে পেলেই খতম।

বোয়া কন্সট্রিকটর বিষাক্ত সাপদের ছেড়ে এবার বিষহীন তবে শক্তিমানদের দিকে চোখ ফেরানো যাক। এখানে প্রথমেই নাম আসে বোয়া কন্সট্রিক্টরের। এই পরিবারের সব ক'টা সাপকেই বোয়া কন্সট্রিক্টর বলে, তবে প্রচলিত অর্থে এই নামে যে সাপটাকে আমরা বুঝে থাকি সেটার প্রকৃত নাম বোয়া কন্সট্রিক্টর কন্সট্রিক্টর। ১৩ ফিট পর্যন্ত লম্বা, প্রচণ্ড শক্তিশালী এই সাপ শিকারকে মারে বিষ দিয়ে নয়, বরং জড়িয়ে ধরে চাপ দিয়ে পিষে, এর জন্যই এর নাম কন্সট্রিক্টর। খাদ্য হলো ইঁদুর জাতীয় প্রাণী আর পেকারির মত ছোটখাটো জন্তু, সাথে পাখি।

মূলত নিশাচর, থাকে মাটিতে, তবে প্রথম বয়সে গাছেও উঠতে পারে। বাদামী বা ধুসর রঙের এই সাপ এমনিতে মোটামুটি শান্ত, বিরক্ত করা না হলে আক্রমণও করে না। বিরক্ত করলে কামড়ে দেয়, তবে বিষাক্ত নয়, এমনিতে মানুষ মারার কোন রেকর্ডও নেই। এই শান্ত স্বভাবের জন্যই একে পোষও মানানো যায়, পোষা সাপ হিসেবে ইউরোপ আমেরিকাতে এর বেশ কদরও আছে, কদর আছে এর চামড়ার জন্যও, ফলে শিকারীদের বড় লক্ষ্য। ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৩ এর মাঝে শুধু আমেরিকাতেই রপ্তানি হয়েছিল ১ লাখ ১৩ হাজার বোয়া, ফলে এর অস্তিত্বই বিপন্ন হতে বসেছিল।

বর্তমানে অবশ্য এই সাপ খামার করেও জন্মানো হয়, ফলে বনের গুলো বেঁচে গেছে খানিকটা। কাঁকড়া বিছা বা স্করপিয়ন আবারো একটু ছোটখাটো প্রাণীর দিকে ফেরা যাক, যদিও কাঁকড়া বিছা বা স্করপিয়নকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কিছু নেই। কালো রঙের, আর লেজের আগায় বাঁকানো হুল লাগিয়ে ঘুরে বেড়ানো এই ছোটখাটো প্রাণীটা যেমনই বদমেজাজী তেমনই বিপজ্জনক। যেহেতু লোকালয়ের আশপাশে ঘুরাঘুরি করে, মানুষজন প্রায়ই কামড় খায় এর, সময়মত চিকিৎসা না করলে এই কামড় মৃত্যুরও কারণ হতে পারে। সৈনিক পিঁপড়া তবে এই মৃত্যুদূত সাপ বা স্করপিয়নকে যদি জিজ্ঞেস করা যায় তাদের কাছে সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণী কি, নিশ্চিতভাবেই বিস্ময়কর একটা জবাব দেবে তারা, সেটার নাম সৈনিক পিঁপড়া।

সাধারণ পিঁপড়ার চেয়েও কয়েকগুণ বড়, তবে সেটার জন্য নয়, বরং মাংসাশী এই পিঁপড়ার ঝাঁক কুখ্যাত তাদের শিকারী স্বভাব এবং একগুঁয়ে চলার জন্য। সৈনিকদের মতই এরা কোন বাধার সামনে থামে না, বরং সামনে যা পায় তাকে মেরেকেটে সাফ করে, বা এদের বেলায় বলা যায়, খেয়েদেয়ে সাফ করে চলে যাওয়াই নিয়ম। একেকটা সৈনিক পিঁপড়ার কলোনিতে ১০ লাখ থেকে ২ কোটির উপরে পিঁপড়া থাকতে পারে,এবং পুরো কলোনি মোটামুটি একই সাথে ঘুরে বেড়ায়, কোথাও স্থায়ী বাসা বাঁধে না। পথ দেখায় স্কাউট পিঁপড়া, তার দেখানো পথে খাদ্যকে অনুসরণ করে যায় বাকিগুলো। একেকটা সৈনিক পিঁপড়ার সারি মাইল পর্যন্ত লম্বা হয়, কামড়ে খানিকটা বিষ আছে, এবং যে শিকারই সামনে পেয়ে যাক, হোক সেটা সাপ বা কুমীর বা ছোট জন্তু বা মানুষ, হাজার হাজর পিঁপড়া তার উপর ঝাঁপিয়ে হুল ফুটিয়ে দিতে থাকে আর কামড়ে মাংস তুলে নিতে থাকে, ফলে কয়েক মিনিট পরেই শিকারের কঙ্কাল ছাড়া কোন কিছু অবশিষ্ট থাকে না।

মাইলখানেক লম্বা এই কোটি পিঁপড়ার সাথে লড়াই চলে না, ফলে যখনই সৈনিক পিঁপড়ার দল আমাজনের কোন এলাকার উপর দিয়ে তাদের "রেইড" শুরু করে, মানুষ থেকে বড়সড় বাঘ পর্যন্ত তাদের পথ ছেড়ে বাপ বাপ করে সরে পড়ে, এমনকি কোন গ্রামের উপর দিয়ে গেলে সেখানকার বাসিন্দারা পর্যন্ত গ্রাম খালি করে কেটে পড়ে, যতক্ষণ না পিঁপড়ার ঝাঁক সরে না যায়, ফিরে এসে দেখে পুরো গ্রামের পোকামাকড় ইঁদুর-বাদর খেয়ে সাফ। অ্যানাকোন্ডা অ্যানাকোন্ডা!! "একটা ভয়ংকর সাপ"-- এই কথা বললে একে অপমানই করা হয়। অ্যানাকোন্ডা নামটা শুনলেই ভয়, আতঙ্ক, বিস্ময় মেশানো একটা বিচিত্র অনুভূতি জেগে ওঠে যে কারো মনে, আমাজনের অধিবাসীদের কাছে অবশ্য সেটা বিশুদ্ধ আতঙ্ক। এই একটা প্রাণীকে নিয়ে যত উপকথা আর ভয়ংকর গুজব আছে, পৃথিবীর আর কোন প্রাণীই তার ধারেকাছেও যাবে না, অ্যানাকোন্ডা যেন এক অশরীরি কিংবদন্তী। নিঃশব্দ চলাচল, দৈর্ঘ্য, অস্বাভাবিক শক্তি আর অসামাজিক হিংস্র স্বভাব নিয়ে অ্যানাকোন্ডা আমাজনের বাসিন্দাদের কাছে অশুভ এক প্রেতাত্মারই নামান্তর।

এর বাসস্থানটাও তার জন্য মানানসই, নদী বা জলাভূমির ঘোলা পানিতে বা নদীর নিচের কোন জলজ আগাছা ঘেরা খাদে, দিনের পর দিন লুকিয়ে থাকতে পারে সেখানে। ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করে শিকারের, পানির নিচে দম না নিয়ে থাকতে পারে ১০ মিনিটেরও বেশি, মাথাটা সামান্য জাগিয়ে শিকারের সন্ধানে সাঁতরে বেড়ায়, বেশিরভাগ সময়েই তাই একদম গায়ের কাছে এসে পড়লেও শিকার টেরই পায় না মৃত্যু তার কত কাছে। অন্য সাপের তুলনায় ব্যতিক্রম, অ্যানাকোন্ডার দাঁত ২ সারিতে বসানো। ঝাঁপিয়ে পড়ার মুহূর্তেই কামড়ে ধরে শিকারকে যাতে ছুটে না যায়, এরপর বোয়া গোষ্ঠীর এই সাপ (অ্যানাকোন্ডার আরেক নাম ওয়াটার বোয়া) শিকারকে পেঁচিয়ে ধরে, যতবার আক্রান্ত প্রাণী শ্বাস ছাড়ে ততবারই বাঁধন আরো শক্ত করে শ্বাস নেয়া অসম্ভব করে দেয়, মৃত শিকারকে এরপরে আস্তে আস্তে গিলে খায়। সাধারনত এর খাবার ক্যাপিবারা বা পেকারির মত মাঝারি আকারের প্রাণী, মানুষ খাওয়ার যতই গুজব থাকুক এখনো তার কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি, তবে মানুষ মারার রেকর্ড অনেকই আছে।

কিংবদন্তীতে যদিও এই সাপের দৈর্ঘ্য মাইল ছাড়িয়েছে, তবে এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে বড় আকারের অ্যানাকোন্ডা যেটা ধরা পড়েছে তার দৈর্ঘ্য ৩০ ফিট। তবে যে বৈশিষ্ট্য এমনকি বাস্তবেও অ্যানাকোন্ডাকে অদ্বিতীয় ভয়ঙ্কর করে তুলেছে তা হলো, অ্যানাকোন্ডা কখনোই পোষ মানে না, কোন ভাবেই না। মহাবনের মহাভয়ঙ্করের উপযুক্ত স্বভাবই বটে! অনেক ভয়ঙ্কর প্রাণীর বর্ণনা হলো, যার সবই শুধু আমাজনের সম্পদ। সুন্দর প্রাণীগুলো আপাতত বাদ গেল, অবশ্য সেগুলোর সব এখনো আবিষ্কৃতও হয়নি, এই মহাকাশ যুগেও আমাজন তার অপার রহস্যের সব মানুষের কাছে প্রকাশ করেনি। কিন্তু মানুষ বড় ভয়ঙ্কর, এমনকি আমাজনের হিংস্রতম জন্তুও সম্ভবত মানুষের চেয়ে অনেক নিরীহ।

পৃথিবীর অসংখ্য মানুষের খাদ্যের যোগানদাতা আমাজনকেও তাই পড়তে হয় চোরাশিকারী আর গাছকাটার লোলুপ থাবার মুখে, উজাড় হয় মহা অরণ্য, বিপন্ন হয় গোটা পৃথিবীই সেই সাথে। যাদের নামে নাম সেই আমাজন নামের নারী যোদ্ধাদের মতই ভয়ঙ্কর সুন্দর এই আমাজনকে আমরা, মানুষ নামের জন্তুগুলো কি একটু শান্তিতে নিজের মত থাকতে দিতে পারি না? আমাদের নিজেদের অস্তিত্ব বাঁচানোর জন্যই যে সেটার খুব বেশি প্রয়োজন।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।