স্বপ্ন যে শুধুই মিথ্যা আশা জাগায়
আমাদের কথা
বুয়েটে ঢুকে ঘুরাঘুরি শুরু করার পর ইতোমধ্যে রাঙ্গামাটি, সিলেট, চাঁদপুর, কক্সবাজার ঘুরা হয়ে গেছে। বাকি ছিল সুন্দরবন। এবার হঠাৎ করেই সুযোগ মিলল, সুন্দরবন গমনের। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর খবর পেলাম একদল ক্যাডেট সুন্দরবন যাবে। তো এই কথা শুনে আমাদের ঘুরাঘুরি গ্রুপের প্রধান ভাঙ্গা পেন্সিল সুন্দরবন যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করল।
অন্যরা (আমি সহ) প্রথমে একটু গাছাড়া ভাব দেখালেও শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে গেলাম। ধীরে ধীরে বাড়তে বাড়তে সংখ্যাটা দাড়াল ১৬ জনে। শেষ পর্যন্ত দুইজন মিস করলেও স্টেশন এসে জুটল আরোও ৬ জন বুয়েটিয়ান, মানে ৬ জন জুনিয়র। আর একজন এর বাড়ি খুলনায় হওয়ায় সে এই ট্রেন সফরের স্ংগী হল না। অবশেষে এই উনিশজন বুয়েটিয়ান মিলে সুন্দরবনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম।
ট্রেন ও লঞ্চ
যাত্রাপথে রূপসা সেতু
খুলনা যাওয়ার ট্রেন ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল সন্ধ্যা সাতটায়, কিন্তু ট্রেন মহোদয় স্টেশনে আসিলেন রাত ৯টায়। অবশেষে ট্রেন ছাড়ল রাত ৯.৩০ টায়। আমরা ১৩ বান্দর কাছাকাছি বসায় বাকিরা আমাদের জ্বালায় রাতে ঘুমাতেই পারল না। শেষ পর্যন্ত কেউ কেউ ক্ষান্ত দিয়া ঘুমালেও অনেকেই ট্রেনের অতি ঝাকুনির দরুন ঘুমাতে পারল না। ট্রেন খুলনা স্টেশনে পৌছল সকাল সাতটায়।
সেখানে গিয়া খুলনা নিবাসী জ্যোতির দেখা পেলাম। সেই একটা ট্যুর কোম্পানীর সাথে ব্যবস্থা করে রেখেছিল। অতঃপর আমরা রূপসা ঘাটে গিয়ে লঞ্চ এ উঠলাম। প্রথমে লঞ্চ নিয়ে সবাই (আসলে আমি নিজেই) একটু দুশ্চিন্তায় থাকলেও আমাদের সবার দুশ্চিন্তা চলে গেল লঞ্চ দেখে। লঞ্চটা বেশ ভালো ছিল এবং আমাদের ১৮ জনের জায়গা হল গ্রাউন্ডফ্লোর।
যেখানের জানালা থেকে নদীর পানি প্রায় ছোঁয়া যায়। শেষ পর্যন্ত লঞ্চ ৯.৩০ টায় কটকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করল।
কটকা
অবশেষে সুন্দরবন
বনের দেখা
বেলা দুইটার দিকে আমরা সুন্দরবনের দেখা পেতে শুরু করলাম। ধীরে ধীরে লোকালয় ছেড়ে চলে গেলাম, এবং এমন জায়গায় এসে পৌছলাম যেখানে এক পাশে বন মাঝে নদী আবার আরেক পাশে বন। সে এক দেখার মত পরিবেশ।
সারা জীবন যে বনের কথা বই পত্রে পড়ে এসেছি তা আজ চোখের সামনে। লঞ্চ থেকে সুন্দরীদের (গাছ) দেখা পাচ্ছিলাম। সে এক অন্য অনুভূতি। অনেকেই ক্যামেরা নিয়ে অনেক নাড়াচাড়া করল। কিন্তু কেউই আসল দৃশ্যটা ধারণ করতে পারল না।
চোখ দিয়ে যে সৌন্দর্য্য দেখা যায় তা সব বোধহয় ক্যামেরায় ধারণ করা সম্ভব নয়। যাই হোক রাত ৯টা -১০টার দিকে আমরা কটকায় পৌছলাম। লঞ্চ সেখানেই থামল। রাতের বনের কোন ছবি আমাদের কাছে নেই। কিন্তু রাতের বেলার বনের যে মোহনীয় রূপ তা বোধহয় আমাদের স্মৃতিতে আজীবন থাকবে।
পুরো নিস্তব্ধ বন, মাঝে মাঝে পাখির ডাক শোনা যায়। আমরাও উৎসুক হয়ে ছিলাম ব্যাঘ্র মামার ডাক শোনা যায় কিনা। কিন্তু মামা মনে হয় শিকারের খোজে ব্যস্ত ছিলেন। তাই ডাকাডাকি করলেন না।
বন ও সমুদ্র দর্শন
বনের পথে সবাই
সমুদ্রের হাতছানি
পরদিন সকালে আমরা বন দেখতে বের হলাম।
এবার আরো কাছ থেকে বন দেখা। দুইধারে বন, মাঝে সরু খাল। মাঝে মাঝে গাছের ডাল আমাদের মাথে ছুয়েযাচ্ছিল। সে এক দারুন অভিজ্ঞতা। দেখা মিলছিল বনের প্রানীদের।
হরিণের পাল দেখে এক জায়গায় আমরা নামলাম এবং শ্বাসমূলের খোঁচায় বিদ্ধ হলাম। সকালের নাস্তা খেয়ে আমরা টাইগার পয়েন্টে নামলাম এবং সেখান থেকে প্রায় ২.৫ কিমি দূরে কটকা বীচের উদ্দেশ্যে গমন করলাম। এর মাঝে আমরা বাঘ মামার পায়ের ছাপ দেখলাম, হরিণের পাল দেখলাম। তবে বনের মাঝে চলার সময় আসলেই খুব ভয় হচ্ছিল। কোন সময় না বাঘ এসে পড়ে।
কারণ ওই এলাকায় আসলেই নাকি বাঘ আছে, তাছাড়া সাপখোপও নাকি আছে। গার্ডেরা বলছিল পায়ের দিকে খেয়াল রাখতে। অবশেষে কোন বিপদ ছাড়াই সমুদ্রের দেখা পেলাম। এই সমুদ্রের বৈশিষ্ট্য হল এর পানি লবণাক্ত না। সমুদ্রস্নান করে লঞ্চে ফিরে আসলাম।
তারপর একটু বিশ্রাম নিয়ে বিকালে সূর্যাস্ত দেখতে গেলাম। যেতে যেতে আইলার কারণে সুন্দরবনের বিদ্ধস্ত অবস্থাও দেখলাম। বুঝলাম সুন্দরবন না থাকলে আসলেই খবর ছিল।
আইলায় বিদ্ধস্ত গাছ
বাঘ মামার অস্তিত্ব অনুধাবন
আমাদের আসল অভিজ্ঞতা হল রাতে। রাতে খাওয়ার পর আমাদের লঞ্চের এমডি ফারুক আঙ্কেল বললেন আমাদের নিয়ে বের হবেন।
তো রাতের বেলায় ছোট ছোট খালের মাঝে ঘুরছি আর গল্প করছি। এমন সময় গার্ড সবাইকে চুপ হতে বলল। অন্য সময় জঙ্গলে পাখি ডাকাডাকি করলেও জঙ্গল পুরো নিস্তব্ধ। আমরা সবাই চুপ হয়ে গেলেও দূরে বনের ধারে বড় কিছু একটার নড়াচড়া টের পেলাম। গার্ড বলল ওটা বাঘ।
সারাদিন বাঘের আসায় থাকলেও ভাবিনি বাঘ এভাবে চলে আসবে। তখন মনে হচ্ছিল বাঘ না হলেই ভাল। তবে আমাদের দূর্ভাগ্য নাকি সৌভাগ্য বাঘ মামা তার চেহারা দেখালেন না। অবশেষে আমরা বেশ কিছুক্ষন অপেক্ষায় থেকে লঞ্চে ফিরে আসলাম।
মন না চাইলেও ফিরতে তো হবেই
পরদিন সকালে ফেরার উদ্দেশ্য যাত্রা করলাম।
রাত আটটায় খুলনায় পৌছলাম। তবে ফেরার সময় প্রায় সবারই মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কারণ আমরা এই তিনটা দিন পুরো একটা পরিবারের মত ছিলাম। সবাই আমাদের সাথে এমনভাবে মিশে গিয়েছিল মাথায়ই আসেনি এখানে কে কে বুয়েটিয়ান আর কে না। এখানে ফারুক আঙ্কেল, বেলায়েত আঙ্কেল সহ সব আঙ্কেলই সবসময়ই আমাদেরকে হাসিয়েছেন, আমাদের সাথে মজা করছেন, তাস খেলেছেন।
আন্টিরা, আপুরা বন্ধুর মত আমাদের সাথে গল্প করেছেন। আসলেই আমরা পুরো একটা পরিবারের মত হয়ে গিয়েছিলাম। আর পিচ্চিরা তাদের পিচ্চিসুলভ কর্মকান্ডে সারাক্ষনই আমাদের মাতিয়ে রেখেছিল। ফেরার সময় আমাদের মনে হচ্ছিল যেন নিজের পরিবার ছেড়েই চলে যাচ্ছি।
অন্যদের জন্য কিছু কথা
সুন্দরবন সম্পর্কে অনেকেরই ভুল ধারনা আছে।
অনেকেই বাঘের ভয়ে যেতে চাননা। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি সুন্দরবনে বাঘের দেখা মেলা আসলেই কঠিন। বাঘকে বিরক্ত না করলে বাঘও বিরক্ত করেনা। কিন্তু সুন্দরবনের যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য তা না দেখা মানে বাংলাদেশকেই না দেখা। আমাদের মাঝে কক্সবাজার ঘুরেছেন এমন অনেকেই পাওয়া যাবে সেই তুলনায় সুন্দরবন দেখা মানুষের সংখ্যা অনেক কম।
তবে উপদেশ হল সুন্দরবন যেতে চাইলে ট্যুর কোম্পানী অথবা অভিজ্ঞ কারো সাথে যাওয়াই ভালো। সুন্দরবন ঢোকার ব্যাপারে অনেক বাধ্যবাধকতা আছে। অনেক নিয়মকানুন আছে। কিন্তু সেসব ঝামেলা আপনাদের পোহাতে হবে না যদি না ট্যুর কোম্পানীর সাথে যান। আর সুন্দরবন নিয়ে অনেক গুজব আছে।
আমাদের এক বন্ধুর যাওয়া প্রায় বাতিল হয়ে গিয়েছিল সুন্দরবনে জলদস্যু আছে এ কথা শুনে। কিন্তু স্থানীয় লোকদের কাছে শুনলাম জলদস্যু আছে ঠিকই কিন্তু তারা কখনো টুরিস্টদের উপর হামলা করে না। সে দিকদিয়ে পুরোপুরি নিরাপদ। আর যাওয়া আসার খরচ খুব বেশীও নয় , সুতরাং আমি মনে করি যারা পারবেন তাদের অবশ্যই সুন্দরবন ঘুরে আসা উচিত। এবং আমি বলতে পারি সবাই একবাক্যে স্বীকার করবেন আসলেই সুন্দরবন সেভেন ওয়ান্ডারস এ স্থান পাওয়ার যোগ্য।
আরো কিছু ছবিঃ Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।