আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার প্রথম ভৌতিক অভিজ্ঞতা

সৃষ্টিকর্তার সকল অপূর্ব সৃষ্টির মাঝে একমাত্র খুঁত সম্ভবত তাঁর সেরা সৃষ্টি ...
সেদিন ছিল আমার এক জিগরী দোস্ত সুব্রতর জন্মদিন, কিন্তু কোথায় ব্যাটাকে জন্মদিনের শূভেচ্ছা জানাবো আর একটু গুলতানি করব(সেইসাথে পেটপুজোর কথা ভুললে চলবে না) - সেখানে কিনা তিনি ফোন বন্ধ করে বসে আছেন। মেজাজ খারাপ করে মনে মনে যখন 'শ’খানেক ছাপার অযোগ্য গালি দিয়ে ফেলেছি তখনি মহাশয়ের ফোন। ফোনেই বিস্তারিত জানা গেল, এই শুভদিনে নাকি বেচারার টাকা-পয়সার বেজায় অভাব। আবার পাড়ায় জনপ্রিয় হওয়ার ঠেলা সামলাতে হচ্ছে এখন - পাড়ার পোলাপান নাকি এক হপ্তা আগে থেকেই ঝুলোঝুলি করছে জন্মদিনের দিন ভূরিভোজ করাতে হবে। ওদিকে পকেটের স্ট্যাটাস তো আশরাফুলের অ্যাভারেজের থেকেও খারাপ।

এমতাবস্থায় পাড়ার জনপ্রিয় সুব্রতদা ইজ্জত আব্রু রক্ষার্থে ভোরে কাকচিলের ঘুম ভাঙার আগেই বাড়ি থেকে চম্পট দিয়েছেন ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টের উদ্দেশ্যে। সেখানেই তার জন্মদিনের হদিশ জানে না এমন কিছু দূরসম্পর্কীয় আবাল বন্ধূবান্ধবের সাথে আড্ডা মেরে কালাতিপাত করছেন। বাসায় বলে এসেছেন জরুরী কাজে সারাটা দিন বাইরে থাকবেন আর পোলাপানের যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে ফোন নামক যন্তরটারও গলা টিপে ধরে রেখেছিলেন এতটাখন। গরম মেজাজ খানিকটা ঠান্ডা হল কিন্তু তবুও রাগ গেল না, জানতে চাইলাম তাহলে এখন কি এমন মহাগুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে গেছে যে আমার মতো অধম বন্ধুবরটির কথা তেনার ব্যস্ত মনে উদয় হলো? না খাওয়ানোর পার্টিতে কি আমার নামটাও ধরেন নি? মুখপোড়া ব্যাটা জানান দিল, না খাওযানোর ব্যাপারটা নাকি আমি ঠিকই ধরতে পেরেছি! যাহোক প্রতি জন্মদিনেই নাকি এই স্বঘোষিত “নাস্তিক”টি কালীমাতাকে ভোগ দেয়, তাই এবারও এই নিয়মটির ব্যত্যয় ঘটাতে মন চাইছে না। পরম সৌভাগ্যের বিষয় যে ময়নামতির মতো জনবিরল এলাকোতেও একটা ছোট্ট কালীমন্দিরের হদিশ পাওয়া গিয়েছে - কিন্তু একা যেতে মন চাচ্ছে না বলেই আমাকে স্মরণ করা।

জন্ম নিয়েইতো কালী দেবীর অনেক দূর্ভোগ ডেকে এনেছিস আবার পুজো দিয়ে সেটা জানান দেবার মানে টা কি - ইত্যাদি ইত্যাদি গজগজ করতে করতে রাজি হলাম; সত্যি কথা বলতে কি এই প্রস্তাব পেয়ে বেশ খুশীই হয়েছিলাম - ছুটিতে বাসায় বিনাশ্রম কারাদন্ড ভোগ করবার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়ে দুদন্ড বাইরের হাওয়া বাতাস গায়ে লাগালে খুব একটা মন্দ হয় না। তাই কোনমতে গায়ে ভদ্রস্থ একটা কাপড় চড়িয়ে ছুট রাগালাম। গিয়ে দেখলাম বাবু একটা বিরান মাঠে বসে মনের সুখে বিড়ি টানছেন, রোজদার মানুষ চাইতেও পারি না; মনটা আরো তিতকুটে হয়ে গেল। তবে ওর হাতে বড় একটা মিষ্টির প্যাকেট দেখে একটু শান্ত হলাম - দেবীই নিশ্চয়ই সব খাবেন না আমারও কিছু প্রসাদ মিলবে। যখন পৌছলাম তখনি ইফতারের সময় হয় হয়, কাজেই রাস্তায় ইফতার সেরে বেরুতে বেরুতে পুরোপুরি অন্ধকার নেমে এল।

আর মাঠের দিকে তাকিয়ে তো আমার চোখ ঐ মিষ্টির প্যাকেটেরই রসগোল্লার মতো গোলগোল হয়ে গেল - দেখে মনে হচ্ছে মাঠের দুশ্যটার ওপর কোন অদৃশ্য হাত মনের সুখে ভুষোকালি মাখিয়েছে। একি সর্বনাশ! এক হাত দূরের জিনিসও ঠাহর করা যাচ্ছে না। কাটা ঘায়ে মরিচবাটা দেওযার মতো করেই সুব্রত হাসিমুখে জানাল এই তেপান্তরের মাঠ পেরিয়েই নাকি ঐ মন্দির দর্শন করতে হবে, বেশ দূরেই কালীদেবীর ঐ নিবাস কাজেই তাড়াতাড়ি রওনা দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। দেরী হলেই বা কি হল, এর থেকে বেশি অন্ধকারতো আর হতে পারে না, এই ভাবতে ভাবতে হঁাটতে লাগলাম। অমাবশ্যা না হলেও সেদিন আকাশে চাঁদ মামা তার ভাগ্নেদের দেখা দিলেন না, ভাগ্যে সুব্রত বুদ্ধি করে একটা টার্চ এনেছিল, কিন্তু এই আঁধারের মহাসমুদ্রে ঐ ছোট্ট টর্চটা তার সর্বশক্তি দিয়েও আমাদের সামনের পা ফেলার জায়গাটা ছাড়া আর কিছুই দেখাতে পারছে না।

আকাশের চাদোঁয়াতে মিটমিটে দুটো তিনটে তারার উপস্থিতিতে আবছা আবছা বড় গাছগাছালির ছায়া দেখা যাচ্চে এই যা। পুরোপুরি গা ছমছমে পরিবেশ। আমরা এসব খেয়াল না করে নিজেদের মাঝে কথা বলছি, হাজার হলেও অনেকদিন পর দেখা। আড্ডা মারতে মারতে কয়েক ঘন্টা কি দিন চলে গেল বলতে পারবো না, শুধু মনে হচ্ছিল অনন্তকাল ধরে হাটছি আর হাটছি। হাঁটতে হাঁটতে একসময় এমন একটা জায়গায় পৌছালাম যেখানে রাস্তার দুপাশে দুটো হুবহু একই আকৃতির দুটো গাছ(সম্ভবত আমগাছ) সান্ত্রীর মতো দাড়িয়ে আছে।

গাছ দিয়ে তৈরী প্রাকৃতিক ঐ গেটের নিচে পৌছাতেই হঠাৱ সুব্রত বলল ঐতো মন্দিরটা ... আর তার কথা শেষ হতেই আমি ঘন্টার আওয়াজ শুনলাম স্পষ্ট - টং ... টং ... টং পরপর তিনবার বাজতেই আমি সুব্রতকে জিজ্ঞেস করলাম মন্দিরে পুজো হচ্ছে নাকি? বলামাত্রই ঘন্টার আওয়াজ থেমে গেল। সুব্রত জানাল সে নাকি কিছুই শোনে নি, আর তাছাড়া মন্দিরের পুরুতমশাই সন্ধ্যার আগে আগেই মন্দিরের বাতি জ্বালিয়ে বাড়ি চলে যান - জায়গাটা এমনই নির্জন যে মন্দিরের আশে পাশে দুএক কিলোমিটারের মাঝে মনে হয় কোন জনবসতি নেই - কাজেই আমার ঘন্টার আওয়াজ শোনার কোন যুক্তিসংগত কারণ নেই। আমি কোন কথা না বলে মেনে নিলাম, কিন্তু ঘন্টার আওয়াজ শূনেছি এতে কোন ভুল নেই - হয়তোবা বাতাসেই মন্দিরের ঘন্টা বেজে উঠেছে(যদিও পবনদেবের টিকিটরও দেখা পাওয়া যাচ্ছে না তবুও মনকে সান্ত্বনা দেওয়া)। যাহোক তর্ক না বাড়িয়ে আলোটার দিকে দুজনে এগোলাম। মন্দিরের কাছে পৌছে দেখলাম সুব্রতর কথাই ঠিক, গেটে বিশালাকারের তালা ঝুলছে আর চারদিকে কোন মানবসন্তানের চিহ্নও নেই, ভেতরে টিমটিমে একটা ৬০পাওযারের বাল্ব তার উপস্থিতি জানান দিচ্ছে মহাকষ্টে।

কিন্তু পুজো তো দিতেই হবে, অগত্যা টারজান গিরি ফলিয়ে দেয়াল টপকে দুজনে ভিতরে ঢুকলাম। সুব্রত যখন পুজো দিচ্ছিল তখন আমি ঘুরে ঘুরে দেখলাম মন্দিরখানা, কিন্তু যেখানে ঘন্টা থাকার কথা সেখানে কোন ঘন্টার হদিশ নেই! সম্ভবত পুরুতমশাই তালাখানার ওপর ভরসা করতে না পেরে বাড়িতে নিয়ে গেছেন। তাহলে আসলেই কি ঘন্টার আওয়াজ শুনেছি না মনের ভূল? সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে প্রসাদের মিস্টিগুলো সাবাড় করলাম দুজনে মিলে। উদরপূর্তি শেষ করে যখন উঠলাম তখন অসম্ভব মনে হলেও বাইরের অন্ধকার আরো গাঢ় মনে হচ্ছে - কিন্তু সমুদ্রে পেতেছি শয্যা, এখন আর শিশিরে ভয় করে লাভ কি? তাড়াতাড়ি দুবন্ধু পা চালালাম। দুজনের মুখে এখন আর কথা নেই, ঘরের ছেলে ভালমত ঘরে ফিরতে পারলে বাঁচি।

এবার আবার যখন সেই দুটো গাছের তোরণের নিচে এসে পৌছালাম ঠিক ঐ মুহুর্তেই আবারো একইরকম ঘন্টাধ্বনি শোনা গেল .... টং ... টং ... টং ... টর্চের আলোয় যতটুকু মুখ দেখা যাচ্ছিল তা দেখেই আমি বুঝলাম এবার সুব্রতও শুনতে পেরেছে। তবুও আমি বললাম “এবার বিশ্বাস হয়েছেতো?” আমার মুখ থেকে কথাগুলো বের হওয়ামাত্রই ঘন্টাধ্বনি থেমে গেল ঠিক আগেরমতো - চারদিক এখন কবরস্থানের মতো নীরব, এর মাঝে মূর্তির মতো দাড়িয়ে আছে দুজন হতচকিত যুবক। কতক্ষণ জানি না, তবে বেশ খানিক্ষণ ঐভাবেই দাড়িয়েছিলাম আমরা - কিন্তু সেই ঘন্টার আওয়াজ আর শোনা গেল না। কোন কথা না বলে দ্রুতপায়ে ফেরত আসলাম আমরা। পরদিন দিনের বেলায় একই জায়গায় গিয়েছিলাম, খুবই সাধারণ একটা জায়গা।

কিন্তু এ কথা সত্য যে মন্দিরের মাইলখানেকের মাঝে কোন জনবসতি নেই, এবং সন্ধ্যার পর পুরুতমশাই ঘন্টাখানা বগলদাবা করে বাড়ি ফেরেন সেটাও সত্য। তাহলে আমরা যে ঘন্টাধ্বনি শুনলাম তা কোথা থেকে আসলো?? এখন হাস্যকর লাগছে ব্যাপারটা কিন্তু তখন হয়তো পরিবেশের কারণেই ভয় না পেলেও বেশ চমকে গিয়েছিলাম। ভূত-প্রেত, জ্যোতিষী, হোমিওপ্যাথি আর বাংলাদেশের নেতা এই চারটি বস্তুর ওপর অবিশ্বাস জ্ঞান হবার পর থেকেই। এবং এ ঘটনাও কিন্তু সেই অবিশ্বাসের ভিতকে নাড়াতে পারে নি। তবুও কেন ঘন্টাধ্বনি শুনলাম এ ব্যাপারে আর খোঁজখবর করি নি, থাক না কিছু জিনিস রহস্য হয়ে।

কারণটা জেনে ফেললে তো আর এটা আমার জীবনের প্রথম ভৌতিক অভিজ্ঞতার মর্যাদা পাবে না!!
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।