আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভৌতিক গল্প : ভয়

আমি যে কেনো কাঁদি , জন্মাবধি ! বৃষ্টি-দগ্ধ হয়ে ডুবে থাকি কারো তন্দ্রাহত দৃষ্টির গভীরে ... ১. মধুপুরের বিখ্যাত ডাকাত ইদ্রিস আলি কে খুন করা হয়েছিল সন্ধাবেলা । মাথার পেছনে প্রথমে শক্ত কিছু দিয়ে আঘাত করে অজ্ঞান করা হয় , তারপর গলায় রশি পেচিয়ে ঝুলিয়ে দেয়া হয় মধুপুর মসজিদের পাশের আম গাছটায় । ফজরের নামাজ পড়তে এসে গ্রামের সব চেয়ে বৃদ্ধ লালু শেখ যখন আমগাছ তলায় কিছু একটা দেখে অজ্ঞান হয়ে যায় , খবরটা তখনও কেউ জানেনি । বোবা জামাল শীতে কাপতে কাপতে খেজুর গাছ থেকে রসের হাড়িটা নিয়ে যখন নামছিল , হঠাৎ করেই তার চোখ গেল আমগাছটার দিকে , আধহাত লম্বা জিহ্বা বের করে ইদ্রিস আলি তখন তার দিকেই চেয়ে আছে । বোবা জ়ামালের হাত থেকে রসের হাড়িটা পড়ে গেল , গাছ থেকে এলোপাথাড়ি নামতে গিয়ে দুই পা কেটে গেল , সেখান থেকে দরদর করে রক্ত বেরুতে লাগল ।

গাছ থেকে নেমেই সে বিকট চিৎকার করতে করতে গ্রামের দিকে ছুটল । যে খবর সারারাতে কেউ জানেনি , পরবর্তী আধ ঘন্টায় গ্রামের সকল মানুষ তা জেনে গেল । বোবা জামাল তাদের মুখে কিছুই বলতে পারে নি, কিন্তু বারবার আমগাছ তলার দিকে আঙ্গুল উচিয়ে কিছু একটা দেখানোর চেষ্টা করছিল , লোকজন কিছু একটা আন্দাজ করে আমগাছতলায় এসে থমকে যায় । ইদ্রিস আলীর বের করা জিভে তখন মাছি ভন ভন করছে ,সারা মুখ কালো হয়ে আছে রক্তে , কোটর থেকে চোখটা যেন বের হয়ে আসতে চাচ্ছে । জীবিত ইদ্রিস আলীর সাথে এ মৃত ইদ্রিস আলীর কোনই মিল নেই ।

এ ভয়ংকর মৃত্যু অনেকেই সহ্য করতে না পেরে পালিয়ে যায় আমগাছতলা থেকে । লাশের নিচে তখনো লালু শেখ পড়ে আছে , বিড়বিড় করে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে । কেউ তাকে তুলতে যাচ্ছেনা , সবাই তাকিয়ে আছে লাশের দিকে , এ যেন এক মায়া ! কুহক ! । ক্রমে মানুষ ভীড় করতে লাগল এ আমগাছতলায় । যে আমগাছতলা এতকাল ছিল নিরব নির্জন , সকাল দশটার মাঝেই সে আমগাছতলা হয়ে গেল লোকে লোকারণ্য ।

দশটার কিছু পরে সাবইন্সপেকটর কাওসার আহমেদ গ্রামের চেয়ারম্যান জলিল হোসেনের বাড়িতে এসে হাক ছাড়ল, --জলিল সাব বাড়িতে আছেন নি? জলিল হোসেন তখন উঠোনে পিড়িতে বসে নাপিত দিয়ে চুল কাটাচ্ছিলেন । বিরক্ত স্বরে বললেন --আছি । কেডা? --আমি কাওসার । --ও , সাবইন্সপেকটর সাব । আসেন ভিতরে আসেন ।

কাওসার বাড়ির ভিতরে ঢুকেই চেয়্যারম্যানকে বলল, --তা , লাশের কি করবেন ,কিছু ঠিক করলেন ? --না , এহনো ঠিক করি নাই । আপনে কি কন , কি করা যায় ? --আমি কই ,লাশ কবর দিয়া ফালান । এইটা নিয়া ঝামেলা করার ইচ্ছা করতাছেনা । --ঠিক আছে , ইস্নপেকটর সাব । তাই করতাছি।

আপনে কিন্তু চা খাইয়া যাইয়েন । সাবইন্সপেকটর কাওসার চা খেয়ে চলে গেলেন । লাশটা তখনো গাছে ঝুলছে । কেউ লাশ নামাতে যাচ্ছে না । এ মৃত্যু স্বাভাবিক নয় ।

মানুষ সকল অস্বাভাবিকতাকে ভয় পায় । এটা মানুষের এক সহজাত ধর্ম । এখানে কোন অতিপ্রাকৃতিক ঘটনা ঘটেনি , কিন্তু ইদ্রিস আলীর মৃত্যু সব অতিপ্রাকৃতিক ঘটনাকে ছাড়িয়ে গেছে । এখানে সবাই মৌন । কিছু একটা দেখার প্রতীক্ষায় তাকিয়ে আছে সবাই ।

হঠাৎ মসজিদের ইমাম সিরাজ মিয়া কোথা হতে উদয় হয়ে চেচিয়ে উঠল , --ওই মিয়ারা লাশ কি গাছেই পচব নাকি ? আসেন , লাশ নামাইতে অইব । বলেই সিরাজ মিয়া লুঙ্গি মালকোচা মেরে তরতরিয়ে গাছে উঠে গেল । লাশের নিচে দুইজন চট বিছিয়ে ধরল । সিরাজ মিয়া উপর থেকে রশি কেটে দিতেই ধপ করে লাশটা পড়ল চটে । তীব্র মানুষ পচা দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল এলাকাজুড়ে ।

বিকেল হওয়ার আগেই, জানাজা না পড়িয়েই ইদ্রিস আলীকে পুঁতে ফেলা হল গ্রামের দক্ষিণ দিকের পোড়াবাড়ির পাশের জমিতে । অপঘাতে মরা লাশ । কি না কি হয়, এই ভয়ে গ্রামের সকল ছেলেবুড়োকে নিষেধ করা হল আগামী সাতদিন যাতে এদিকে কেউ না আসে । পরদিন সকালে লাল্টুদের মুদি দোকানে বসে সিরাজ মিয়া চা খেতে খেতে আচমকা বলে উঠল --ও লাল্টুর বাপ । কালকে রাইতে তো মনে হয় ইদ্রিসরে দেখলাম ।

--কি কন ইমাম সাব! ইদ্রিসরে ? --হ, ফজরের নামাজ পড়ানোর জন্য ওজু করতাছিলাম । আন্ধাইর তহনো যায় নাই । হঠাৎ চোখ গেলগা আম গাছটার দিকে । আন্ধাইরে ঠিকমতো কিছু দেহা যায়না । তবুও ছায়ার মতো দেখলাম আমগাছতলায় আন্ধইরে কিছু একটা বইয়া আছে ।

আমি পাত্তা না দিয়া ওজু করতে লাগলাম । আন্ধাইরে কত কিছুই দেহা যায় । সবকিছুকে পাত্তা দিতে নাই । কিন্তু কিছুক্ষণ পরে হুনলাম ,খুবই অদ্ভুত স্বরে কেডা জানি কানতাছে । আর কান্নার শব্দটা আইতাছিল ওই আমগাছের তল থেইকা ।

তহন পাইলাম ভয় । তাড়াতাড়ি ওজু শেষ কইরা মারলাম দৌড় । এ ঘটনা সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়তে বেশী দেরি হলনা । আমগাছতলাটা সকলের কাছে হয়ে গেল ভীতিকর এক জায়গা । এর একমাস পর ফজরের নামাজ পড়তে এসে গ্রামের লোকজন, ইমাম সিরাজ মিয়াকে মসজিদে না পেয়ে খুজতে খুজতে যখন আমগাছতলায় আসল , তখন আমগাছের ডালে সিরাজ মিয়ার ফাসিতে ঝুলানো বিকৃত লাশটা দেখতে পায় ।

২ করপোরেট জীবনে ছুটি খুব একটা পাওয়া যায় না । এবার তিনদিনের ছুটি পাওয়াতে বন্ধু অরুণের সাথে বেড়াতে চলে এলাম মধুপুরে । মধুপুর গ্রামটি সত্যিই সুন্দর । অরুণ যতটুকু বলেছিল তার চেয়েও বেশী । সে এ গ্রামেই জন্মেছে ।

পৃথিবীতে কিছু স্বপ্নাবিষ্ট মানুষ জন্মায় যারা কখনো তাদের শিকড়কে অস্বীকার করে না । অরুণ তাদেরই দলে । তার কাছে এ গ্রামের কথা এতো শুনেছি যে , এখানে এসে মনে হচ্ছে মধুপুরকে আমি অরুণের চেয়েও ভাল চিনি । ট্রেন থেকে নেমেছি সেই দুপুরবেলা । এখন গরু গাড়িতে করে চলেছি অরুণদের বাড়িতে ।

বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় গরুর গাড়িতে চড়া খুবই আরামের । কিন্তু গরু গাড়ি যে এতঝাকি খায় , না চড়লে বুঝা যায়না । তীব্র ঝাকিতে আমার মাথাব্যথা শুরু হয়েছে । অরুণ আমার পাশে বসে একনাগাড়ে কথা বলেই যাচ্ছে । শেষে বিরক্ত হয়ে বললাম --কি রে ? আর কত দূর? --এইতো দোস্ত , এসে পড়েছি ।

আর আধঘন্টাখানেক । -- আরও আধঘন্টা ! প্রচুর ক্ষুধা লাগছে রে । এখন কি করি ? -- চিন্তা করিস না ,বাড়িতে ফোন কইরা দিছি । সব রান্না রেডী । খাইয়া খাইয়া পেট বানাইছস বটে একখান ! দোস্ত এখন থেকে একটু কম খাওয়া শুরু কর ।

ডায়েট করা শুরু কর । --এত কথা বলিস না । এখন চুপ কর , মাথা ব্যথা করছে । বিকেলের আগেই পৌছে গেলাম অরুণদের বাড়িতে । অরুণের চাচা রহিম উদ্দিন আগেই দাড়িয়ে ছিলেন রাস্তায় এসে ।

গাড়ি থেকে নেমেই চাচাকে সালাম দিলাম, চাচা হাসি মুখে বললেন, --এতক্ষণে আইলা তোমরা । --আর বইলেন না চাচা , গরুর গাড়িতে চড়ে মাথা ব্যাথা করতাছে । --নতুন উঠলে একটু আধটু মাথা ব্যথা করেই । লও লও ভিতরে লও। অরুণদের বাড়িটা সুন্দর ।

শুধু সুন্দরই না ,সজানোও বটে । উঠোনের এক কোণায় ফুলের বাগান , ফুল ফুটে আছে সেখানে । আর এতেই এ বাড়ির সৌন্দর্য বেড়ে গেছে বহুগুণে । কিছু অচেনা ফুলের গন্ধে বাড়ি ভরে গেছে । আমি বললাম , -- এটা কি ফুলের গন্ধরে? --কি জানি ।

চল আগে হাতমুখ ধুয়ে আসি । বাড়ির পাশেই বিরাট পুকুর । আমরা পুকুর থেকে হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসে গেলাম । খাওয়া শেষে অরুণ আমায় ঘুরতে নিয়ে বের হল । রাত তখন দশটা ।

হারিকেনের আলোয় অরুণ আর আমি বিছানা ঝাড়ু দিয়ে ঘুমানোর আয়োজন করছি । অরুণ হঠাৎ বলল --সকালে আমার আবার ফজরর নামাজ পড়ার অভ্যাস আছে , তুই পড়বি নাকি ? --আমার যা ঘুম । হাতি দিয়েও টেনে তুলতে পারবি কিনা সন্দেহ । ডাক দিয়ে তুলতে পারলে যাব ,ডাকিস । দুজনে শুয়ে কথা বলতে বলতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছি জানিনা ।

ঘুম ভাঙল অরুণের ডাকে । --দোস্ত উঠ ,উঠ । সকাল হয়ে গেছে । নয়টা বাজে । উঠ ।

বিছানায় উঠে দেখি সকাল হয়ে গেছে । রোদের আলোয় ঝলমল করছে চারপাশে । অরুণ গম্ভীর মুখে দাড়িয়ে আছে বিছানার পাশে ,বলল --আজকেই ঢাকা চলে যাব । উঠ । রেডি হয়ে নে ।

আমি অবাক হয়ে বললাম --কিরে কি হয়েছে ? এসেছি তিনদিন থাকব বলে । আর তুই আজই চলে যাবি ? কিছু কি হয়েছে? -- না কিছু হয়নি । এখন রেডি হয়ে নে । দুপুরের ট্রেন ধরতে হবে । আমি অবাক হয়ে অরুণের দিকে তাকিয়ে রইলাম ।

ভাবলাম হয়তো অরুণের সাথে তার চাচা বা চাচীর ঝগড়া হয়েছে । কথা না বাড়িয়ে বিছানা থেকে উঠে সোজা পুকুর পাড়ে চলে এলাম । হাত মুখ ধুয়ে পুকুর থেকে উঠেই দেখি অরুণের চাচা দাড়িয়ে --তোমরা না কি আজই চইলা যাইতাছ ? --অরুণতো তাই বলল । আচ্ছা চাচা কি হয়েছে যে অরুণ চলে যেতে চাচ্ছে ? --কি জানি । বুঝবার পারলাম না ।

তুমি মনে কিছু লইও না , ও একটু এমনই । তয় পরে আরেকবার সময় কইরা আইস । ৩ সেদিন বিকালের ট্রেনেই আমরা ঢাকায় রওনা দিলাম । অরুণ সকাল থেকেই গম্ভীর হয়ে আছে । আমার সাথে তেমন একটা কথা বলছে না ।

অরুণকে আমি সবসময়ই হাসিখুশি থাকতে দেখেছি । এমন গম্ভীর মুখে তাকে কখনোই দেখিনি । আমি শতবার তাকে জিজ্ঞেস করেছি --কিরে কি হয়েছে ? একবারও সে উত্তর দেয়নি । রাত তখন আটটা কি নয়টা । অরুণ আর আমি ট্রেনে সামনাসামনি বসে আছি ।

ট্রেনের এ কামরাটা অপেক্ষাকৃত নির্জন । ট্রেনের সকল বাতি নিভানো হয়েছে অনেক আগেই । পাশের জানালাটা খোলা । খোলা জনালা দিয়ে হুহু করে বাতাস আসছে । চাঁদের আলো খানিকটা এসে পড়েছে অরুণের মুখে ।

আর এতেই আমি তাকে আবছাভাবে দেখছি । এ অদ্ভূত পরিবেশে হঠাৎ অরুণ আমার দিকে ফিরে আচমকা বলল --আচছা,শহিদ, তুই কি আত্নায় বিশ্বাস করিস? আলো ছায়াময় সেই নির্জন ট্রেনের কামরায় এমন একটা প্রশ্ন শুনে আমি শিউরে উঠলেও বলি -- না । আমি বিশ্বাস করিনা । হঠাৎ এ প্রশ্ন করলি যে । অরুণ কিছুক্ষন চুপ করে কি যেন ভাবল , তারপর বলতে লাগল, -- তাহলে শোন , তোকে একটা ঘটনা বলি ,অনেকদিন আগে মধুপুরে দুইজন মানুষ মারা যায় ।

একজনকে মসজিদের পাশের আমগাছটায় ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয় । এর একমাস পরেই আরেকজন সেই একই গাছে আত্নহত্যা করে । গ্রামাঞ্চলে এইসব ঘটনা নিয়ে খুব তোলপাড় হয় । তখন থেকে আমগাছটা সবাই এড়িয়ে চলতে শুরু করে । পারতপক্ষে কেউ রাতে ভুলেও আমগাছটার তলা দিয়ে যায়না ।

গতকাল রাতে ফজরের নামাজ পড়তে এই আমগাছটার তলা দিয়েই যাচ্ছিলাম । তখনো অন্ধকার কাটেনি । চাঁদের আলো হয়তো ছিল । কিন্তু আমি যখন যাচ্ছি তখন ঘোর অন্ধকার । এমনিতে আমি বেশ সাহসী ।

কিন্তু আমগাছটার তলা দিয়ে যখন যাচ্ছিলাম , তখন খেয়াল করলাম আমি আসলে ভয় পাচ্ছি , সম্পূর্ণ বিনা কারণে ভয় । নির্জন একটা রাস্তা দিয়ে একা গেলে যে কেউ ভয় পেতে পারে । কিন্তু আমার ভয়টা সম্পূর্ণ অন্যরকম । আমার মনে হল ঠিক আমগাছের গোড়ায় কিছু একটা দাড়িয়ে আছে । আমি কিছু দেখিনি , তবুও মনে হল কিছু একটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে ।

তার অস্তিত্ত্ব নেই , শরীর নেই , কিছু নেই , তবুও মনে হইল কিছু একটা আমার পাশে ঠিকই আছে । ঠিক তখনি ,অন্ধকারে দেখলাম ঠিক মানুষ বলা যায়না , তবুও অনেকটা মানুষের মত অবয়ব ঠিক আমগাছের গোড়ায় দাড়িয়ে আছে । তখন এক জান্তব ভয় আমাকে গ্রাস করল । এমন তীব্র ভয় আমি জীবনে কখনো পাইনি । তখন আমি খেয়াল করলাম আমার পা কাঁপছে ।

আমি এক চিৎকার দিয়ে মসজিদের বারান্দায় এসে অজ্ঞান হয়ে যাই । তারপর কি হয় জানিনা । জ্ঞান ফিরলে দেখি মসজিদের বারান্দায় শুয়ে আছি । অনেক মানুষ ভীড় করে আছে । একনিশ্বাসে কথাগুলো বলে অরুণ হাপাতে লাগল ।

আমি প্রচন্ড ভয়ে কথা হারিয়ে ফেলেছি । সেদিন ট্রেনে অরুণের সাথে আর কোন কথা হয়নি । অরুণ সারা পথই কি যেন ভাবছিল । রাত তিনটায় যখন ট্রেনটা ঢাকায় আসে তখন ট্রেন থেকে নেমে অরুণ শুধু বলেছিল - যাই । পরে দেখা হবে ।

অরুণ থাকে মগবাজারে , তার বাবা মাকে নিয়ে । আর আমি থাকি মালিবাগে , একা একটা ছোট ফ্ল্যাট ভাড়া করে । বাসায় ফিরে সেদিন আর ভয়ে ঘুমুতে পারিনি । বই পড়ে , আলো জ্বালিয়ে রাতটা কোনমতে পার করেছিলাম । কিছুদিন পর প্রচন্ড কাজের চাপে অরুণের গল্প ভুলেই গেছিলাম ।

মধুপুরে যাওয়ার এক সপ্তাহ পরে হঠাৎ অরুণ আমাকে ফোন করে উদভ্রান্তের মত বলল -- দোস্ত তুই আমারে বাঁচা -- কেন কি হয়েছে ? --আমি বোধহয় পাগল হয়ে যাচ্ছি । --কি হয়েছে । খুলে বল । --সেদিন গভীর রাতে মধুপুর থেকে ফিরে , ট্রেন স্টেশন থেকেই একটা রিকশা নিয়ে বাসায় ফিরছিলাম । রিকশাটা চলতে চলতে যখন একটা অন্ধকার গলিতে ঢুকল , ঠিক তখনি আমার মনে হল কিছু একটা আমার পাশের খালি জায়গায় বসে আছে ।

অনুভূতিটা এতই তীব্র যে আমি আমার পাশে একঝলক তাকিয়েও দেখলাম । সেখানে কিছুই নেই । আমি বুঝতে পারলাম এটা আমার মনের ভুল । ঠিক তখনই আমার মনে একটা অদ্ভুত চিন্তা আসল , ভয়ানক কোনকিছু মধুপুর থেকে আমি আমার সাথে করে নিয়ে আসিনি তো ? মন থেকে যতই চিন্তাটা ফেলে দিতে চাইলাম ততই তা ঝাকিয়ে বসল । কিন্তু রিকশা ভাড়া মিটিয়ে যখনই আমাদের বাড়ির গলিটাতে ঢুকলাম তখনই ঐটাকে দেখলাম ।

সামনেই অন্ধকারে দাড়িয়ে আছে । তার চোখ নেই ,মুখ নই, পা নেই , তবু মনে হল ওটা চেয়ে আছে আমারই দিকে , তার মুখে ক্রুর হাসি । । আমি দৌড়ে বাড়ির গেটে যেয়ে দারোয়ানকে ডাকতে থাকি । দারোয়ান আমাকে ধরে নিয়ে পৌছে দিয়ে আসে আমাদের ফ্ল্যাটে ।

এতকথা অরুণ একনাগাড়ে বলে হাপাতে লাগল । আমি বললাম --এ সবই তোর কল্পনা । চিকিৎসা নিলে মনে হয় ঠিক হয়ে যাবে । --প্রথমে আমিও তাই ভেবেছিলাম । তিনজন সাইকোলজিস্টের সাথে দেখা করেছি , সব বলেছি, কিন্তু তারা কিছুই করতে পারেনি ।

এখন আমি আমার রুমে তাকে দেখি , দেখি কিছু একটা হাটছে আমার অন্ধকার ঘরে । -ঘর অন্ধকার করে ঘুমালে প্রায়ই দেখি মশারির ওপাশে কিছু একটা দাড়িয়ে আছে । তাই এখন বাতি জ্বালিয়ে ঘুমাই । --ঠিক আছে তোকে আরো কিছু সাইকিয়াট্রিস্টের ঠিকানা দিই , তুই গিয়ে দেখা করে আয় । ঠিকানা নিয়ে অরুণ ফোন রেখে দেয়।

আমার দেয়া ঠিকানাগুলোতে সে গিয়েছিল কিনা জানিনা । কিন্তু মাসখানেক পর অরুণ যখন তার রুমের ফ্যানে ফাঁস লাগিয়ে আত্নহত্যা করে তখন খুবই অবাক হই । বহু কাজের মধ্যেও তার জানাজায় যাই । তার বাবা সেদিন আমাকে জড়িয়ে কাঁদলেন অনেকক্ষন । কেন অরুণ আত্নহত্যা করেছে তা কেউ বলতে পারেনি ।

তবে শেষের দিকে অরুণ নাকি গভীর রাতে- কে কে বলে চেচিয়ে উঠত আর একা একা কথা বলত । ৪ অরুণের লাশ কবর দিয়ে যখন বাসায় ফিরছি তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে । অরুণ আমার অনেক কালের বন্ধু । সে আর আমি একসাথে কত জায়গায় ঘুরতে গেছি । তার আর আমার বহু স্মৃতি মনে পড়ে কষ্ট হতে লাগল ।

জানিনা কতক্ষণ উদ্দেশ্যবিহীন হেটেছি , জানিনা কেদেছি কিনা , কত কি ভেবেছি তাও জানিনা । রাত দশটায় বাড়ির গেটে আসতই দারোয়ান বলল --ভাইজানের কি মন খারাপ ? --না । --তাইলে মুখ অমন শুকনা কে ? আমি ঊত্তর না দিয়ে গেট দিয়ে ঢুকে পড়লাম । সিড়ি দিয়ে উঠার সময় পাশের বাসার বিড়ালটাও উঠতে লাগল আমার সাথে । আমার ফ্ল্যাট তিনতলায় ।

ফ্ল্যাটের দরজা খুলে ভিতরে তাকাতেই এক তীব্র ভয় আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল । আমার রুম তখন পুরো অন্ধকারে ডুবে আছে , পাশের বাড়ি থেকে কিছু আলো এসে পড়েছে আমার রুমে । আর এই অস্পষ্ট অদ্ভূত আলোতে আমি স্পষ্ট দেখলাম আমার শোয়ার ঘরের সিলিং ফ্যানটায় ঝুলে আছে অরুণের লাশ ! তীব্র ভয়ে কাপতে কাপতে দৌড়ে নিচে নেমে ,গেটের কাছে এসে হাপাতে লাগলাম । দারোয়ান দৌড়ে এসে বলল -- আরে ভাইজান কি হইছে? --লাশ! -- লাশ ? কোথায় ? --আমার রুমে দারোয়ান পানি দিয়ে বলল -- লন পানি খান । আর কি হইছে একটু খুইলা কন ।

--রুমের দরজা খুলে তাকিয়ে দেখি , সামনের রুমে যে ফ্যানটা তাতে রশি পেচিয়ে কেউ একজন ঝুলে আছে । --কন কি? চলেন তো আমার সাথে । ফ্ল্যাটে এসে দেখি কিছুই নেই । দারোয়ান মৃদু হাসি দিয়ে বলল-- বেহুদাই ভয় পাইছেন । দারোয়ান চলে গেলেও আমি ফ্ল্যাটে ঢুকতে সাহস পেলাম না ।

আধ ঘন্টা পরে যখন ঢুকলাম তখন আগের ঘটনাটা নিজের কাছেই কেমন হাস্যকর লাগছে। রাতে আরেকবার গোসল সেরে কিছু না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লাম । গভীর রাতে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল । আমার ঘুম এত সহজে ভাঙ্গে না । তারমানে কিছু একটা হয়েছে ।

ভালো করে কান পেতে কিছু একটা শুনতে চেষ্টা করলাম তখন হঠাৎ মনে হল কিছু একটা নিশব্দে হাটছে আমার বিছানার চারপাশ দিয়ে । মশারির জন্য ভালো করে কিছুই দেখতে পারছি না তবু মনে হল গাঢ় অন্ধকারে আরো গাঢ় কিছু একটা নড়াচড়া করছে । তীব্র একটা ভয় আমাকে গ্রাস করল । এতো তীব্র ভয় আমি জীবনে পাইনি । ঘরে বাতাস নেই , ফ্যান বন্ধ, তবুও আমি স্পষ্ট দেখলাম , আমার মশারিটা হঠাৎ নড়ে উঠল ।

হঠাৎ পায়ের দিকে মশারির দিকে আমার চোখ গেল , আর তীব্র আতঙ্ক নিয়ে দেখলাম , সেখানে একজন মানুষের মুখ দেখা যাচ্ছে , অনেকখানি জিভ বের হয়ে আছে , মুখ রক্তে কালো , চোখটা বের হয়ে আসতে চাচ্ছে বাইরের দিকে । জ্ঞান হারানোর পূর্বে টের পেলাম মানুষ পচা তীব্র দুর্গন্ধ আমার রুমজুড়ে ছড়িয়ে গেছে । ৫ গভীর রাতে এখনো আমার ঘুম ভেঙ্গে যায় । তাকিয়ে থাকি অন্ধকারে । কিছুই দেখি না ।

তবু মনে হয় কিছু একটা তাকিয়ে আছে আমার দিকে!!ভয়ানক কিছু একটা হওয়ার প্রতীক্ষায় আমি দিন গুনছি । বারান্দায় কিছু একটা হাটছে । ধীর পদশব্দ শোনা যাচ্ছে , আর কিছু ফিস ফিস শব্দ । নাহ! আজ আর লিখতে ইচছে করছে না , জানিনা আর কোনদিন লিখার সুযোগ পাব কিনা । * * * ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।