সত্য সমাগত, মিথ্যা অপসৃত...............।
ক্লাস টেনে পড়বার সময় উপন্যাসটা কীভাবে যেন হাতে আসে। পরের চারদিন এটির উপর দিয়েই গিয়েছিল। স্রেফ গোগ্রাসে গিলেছি। সমরেশের "কালপুরুষ" পড়বার পরে এটিই ছিল ওপার বাঙলার কোন সাহিত্যিকের লেখা দ্বিতীয় বই।
পরবর্তীতে এটি আরো বার দুয়েক পড়েছি বোধ হয়!
একই মলাটে দুইটি আলাদা উপন্যাস পড়ার অভিজ্ঞতা প্রায় সবারই আছে। কিন্তু, "দূরবীন" এই অভিজ্ঞতার মাঝে এক নতুন সংযোজন। দুইটি আলাদা কাহিনী; একটির বিস্তৃতি বিগত শতকের বিশের দশকের শেষভাগ হতে ত্রিশের দশক আর অপরটির বিস্তৃতি আশির দশক। পাঁচ শতাধিক পৃষ্ঠা আর শ'খানেক পরিচ্ছদ নিয়ে এ উপন্যাসের ব্যাপ্তী।
১৯২৯ সালের শীতকালের এক ভোরে মধ্য চল্লিশের বিপত্নীক আত্মভোলা জমিদার হেমকান্তের হাত হতে কুয়োর বালতি পড়ে যাওয়া এবং তা হতে উদ্ভূত মৃত্যুচিন্তার মধ্য দিয়ে প্রথম কাহিনীর যাত্রা শুরু।
দ্বিতীয় পরিচ্ছদেই শুরু হয়েছে দ্বিতীয় কাহিনীটি। ধ্রুবর বোহেমিয়ান জীবনের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে মৃত্যুর কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী রেমীর অতীত রোমন্থনের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে এই গল্প। এভাবে এক পরিচ্ছদে ত্রিশের দশক আর পরের পরিচ্ছদেই আশির দশক- অর্ধ শতক আগুপিছু করে করে এগিয়েছে এ উপন্যাস, যা এক কথায় অভিনব। আর এই দুই পর্বের মাঝেই সেতুবন্ধ একজনই- কৃষ্ণকান্ত চৌধুরী।
পূর্ববঙ্গের বিপত্নীক জমিদার হেমকান্ত আত্মভোলা সংসারবিরাগী মানুষ।
স্ত্রী সুনয়নীর মৃত্যুর পর হতে এ বিরাগ আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। ছোট দুই সন্তান বিশাখা আর কৃষ্ণকান্ত ছাড়া বাকী সন্তানেরা বিবাহিত, পারিবারিক কিংবা জীবিকার তাগিদে বিদেশ-বিভুঁইয়ে। এমন পরিস্থিতিতেও সংসারটা যে ভেসে যায় নি তার কৃতিত্ব এককভাবে রঙ্গময়ীর পাওনা। ত্রিশের দশকের তুলনায় এই স্বল্প শিক্ষিত পুরোহিত কন্যা অনেক বেশী আধুনিক। বালিকা বয়স থেকেই হেমচন্দ্রের প্রতি বিশেষ অনুরক্ত বাড়ির পুরোহিত বিনোদচন্দ্রের এই কুমারী/ অনূঢ়া কন্যাটি বয়সে হেমচন্দ্রের প্রায় পনের বছরের ছোট! হেমকান্তও দিনে দিনে যেন বেশী করে রঙ্গময়ীর উপর নির্ভর করতে থাকেন।
এর মাঝে একদিন এ বাড়িতে স্বদেশী হাওয়া লাগে। ফেরারী স্বদেশী শশীভুষন অসুস্থ হয়ে ক'দিনের জন্য আশ্রয় নেয় এ বাড়িতে। শশীভুষনের প্রভাবে আর রঙ্গময়ীর প্রশ্রয়ে কিশোর কৃষ্ণকান্ত স্বদেশী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে। দারোগা রামকান্ত রায়কে হত্যা করে ফেরারী হয়ে যায়।
প্রিয় পুত্র কৃষ্ণকান্তের অন্তর্ধানে একেবারে ভেঙ্গে পড়েন হেমকান্ত।
এ সময়ে তাঁর সার্বক্ষনিক সেবা-সাহচর্যে থাকবার জন্য পরিবারের সবার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তিনি অবশেষে রঙ্গময়ীর প্রণয়কে পরিণয়েরর দিকে নিয়ে যান। বিশাখার বিয়ে দিয়ে জমিদারীর সমস্ত কিছু কনিষ্ঠ পুত্র কৃষ্ণকান্তের নামে লিখে জামাই শচীনের হাতে ভার বুঝিয়ে দিয়ে হেমকান্ত-রঙ্গময়ী কাশী চলে যান। চার বছর বছর জেল খেটে কৃষ্ণকান্ত সেখানে পিতাকে দেখতে যান। এর কদিন পর কাশীতেই মারা যান হেমকান্ত। প্রিয় পুত্রকে এক নজর দেখবার জন্যই যেন এতদিন এই নশ্বর জীবন বয়ে চলছিলেন তিনি।
শেষ হয় এক অধ্যায়।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে কৃষ্ণকান্ত বৃদ্ধ হয়েছেন। দেশভাগ হয়েছে। পূর্ববঙ্গের পাঠ চুকিয়ে পুরো পরিবার সহ চলে এসেছেন কোলকাতা। স্বাধীনতা আন্দোলনে অবদানের জন্য নাম হয়েছে, যশ-খ্যাতি সবই পেয়েছেন।
প্রবল প্রতাপে মন্ত্রিত্ব করে যাচ্ছেন প্রাদেশিক পর্যায়ে। শত শত গুনগ্রাহী অনুচর তার। পিতার সম্পত্তি একাই পেয়ে যাওয়ায় অন্য ভাইরা ঝামেলা করতে চাইলেও দেশভাগের পর তাদের প্রতিষ্ঠা করতে তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য আর বেশী কিছু বলতে পারে নি তারা। প্রবল প্রতাপশালী আর প্রচন্ডভাবে গোষ্ঠী অন্তপ্রান এই অহংকারী ব্যক্তিটিকে পুরো পরিবার মেনে চলে, ভয় পায়। শুধু সন্তানেরাই তাঁকে ভালবাসে না।
বিশেষকরে সন্তানদের মাঝে উজ্জ্বলতম এওং প্রিয় মেঝ পুত্র ধ্রুব সচেতনভাবেই পিতা কৃষ্ণকান্তকে আঘাত করে চলে অবিরাম। রাজনীতির ব্যস্ততায় পরিবারের প্রতি অবেচেতনভাবে যে অবহেলা কৃষ্ণকান্ত দেখিয়েছেন এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে স্ত্রীর (ধ্রুবর মা) আগুনে পুড়ে আত্মহত্যার ঘটনা, শিশু ধ্রুবর মনে যে ঘৃনার আগুন জ্বালিয়ে দেয় তার দাবদাহে সে পিতার সম্রাজ্য পুড়িয়ে দিতে চায়। ধ্রুব দেখে, স্বাধীনতা পূর্ববর্তী নীতিবান কৃষ্ণকান্ত সময়ের সাথে সাথে সিস্টেমের বেড়াজালে আটকে একে একে বিসর্জন দিচ্ছেন নীতিবোধ, অথচ এর পরেও দেশের মানুষের প্রতি তাঁর রয়েছে এ অপরিসীম ভালবাসা। এই অসম সমীকরণ মিলাতে গিয়ে ধ্রুব যেন আরো ভারসাম্যহীন হয়ে ওঠে। পিতার প্রতি অবমাননাকর মন্তব্য ছুঁড়ে দেয়া, মদের প্রতি কোন আসক্তি না থাকা সত্ত্বেও মাতাল হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকা; একের পর এক চাকরি ছাড়া; নারীসংসর্গ -হেন কর্ম নেই যা ধ্রুব করে না আর সবই করে কৃষ্ণকান্তকে অপমান করবার জন্য।
উপায়ান্তর না দেখে কৃষ্ণকান্ত ধ্রুবকে বিয়ে দেন মিষ্টি মেয়ে রেমীর সাথে। অসম্ভব মমতাময়ী রেমীর মাঝে কৃষ্ণকান্ত যেন নিজের মৃত মায়ের সন্ধান পেয়ে যান আর এভাবে ধ্রুব পেয়ে যায় কৃষ্ণকান্তকে আঘাত করার আরেক মোক্ষম অস্ত্র। অবহেলা-অনাদরে সে ক্ষত-বিক্ষত করতে থাকে রেমীকে। অসীম ভালবাসা দিয়ে রেমী তাকে যতই ঘিরে ধরতে যায়, ততই দূরে সরে যায় সে। কখনো কখনো একটুক্ষনের জন্য কাছে টেনে আবার দূরে ঠেলে দেয়া হতে শুরু করে রেমীর অনুরাগী রাজার সাথে রেমীকে বিয়ে দিয়ে দেবার চেষ্টা পর্যন্ত যতরকমভাবে রেমীকে আঘাত করা যায়, তার কোনকিছুই বাকী রাখে না ধ্রুব।
রেমী তবু অবিচল।
এ যেন বদ্ধঘরে উড়তে থাকা দিকভ্রান্ত একটি পতঙ্গের কাহিনী। প্রদীপের আলো ছাড়িয়ে যতই দূরে যেতে চায়, ততই বদ্ধ ঘরের নির্মম দেয়াল তাকে আটকে দেয়। নাছোড়বান্দা বোকা পতঙ্গ এবার আগুনে ঝাপ দিয়ে আলোটাকে নিভিয়ে দিয়ে চায়। এতে নিজে পুড়ে যাওয়া ছাড়া প্রদীপের কোনই ক্ষতি করতে পারে না সে।
একগুঁয়ে পতঙ্গের তবু বিরাম নেই। এদিকে, প্রদীপের তেলও ফুরিয়ে আসে, পতঙ্গেরও জীবনীশক্তি নিঃশেষ হবার পথে। তবু, কেউ কারো কাছে হারতে চায় না! বছরের পর বছর ধ্রুবর এই আত্মপীড়নে এ পক্ষ- ও পক্ষ উভয়েই ক্ষয়ে যেতে থাকে। একদিকে, চরম উচ্ছৃংখলতা আর জোরপূর্বক মদ্যপানের প্রভাবে ভেঙ্গে যেতে থাকে ধ্রুবর শরীর ও মন। ধারার মত ধারাল মেয়ে পর্যন্ত যে ধ্রুবকে কাছে টানতে পারে নি, সেই ধ্রুবই শেষমেষ নোটনের মত খেলো মেয়ের আঁচলে ধরা পড়ে যায়।
যদিও ঠিকই ফিরে আসে। অন্যদিকে, পুত্রস্নেহে বিহবল কৃষ্ণকান্তের হৃদয় ভালবাসাহীনতার হাহাকারে ক্রমশঃ শূন্যতায় ডুবে যেতে থাকে। তিনি বুঝতে পারেন মাথার উপরে পিতার বিশাল ছায়াই ধ্রুবর মনোবেদনার কারন।
অবশেষে, সকলের সুখের কথা চিন্তা করে কৃষ্ণকান্ত বেছে নেন ইচ্ছামৃত্যুর পথ। দিল্লীতে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের লোভ ছেড়ে দিয়ে সংসারের ভার সুকৌশলে ধ্রুবর হাতে তুলে দিয়ে তিনি পাড়ি দেন অজানার দেশে।
যাবার আগে ধ্রুবকে লিখা চিঠিতে তিনি তাঁর পাওয়া-না পাওয়ার কথা, দুঃখ-বেদনার কথা জানিয়ে যান, যা তাঁর মৃত্যুর পর ধ্রুবর হস্তগত হয়। এত বছরের নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্রোহের মাধ্যমে যে ধ্রুব পিতার পরিচয় পায় নি, তার কাছে এক নিমিষে সে পরিচয় ষ্পষ্ট হয়ে ওঠে! কিন্তু, ততদিনে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে। ঠাকুর্দা হেমকান্ত যে দূরবীন চোখে দিয়ে দুরের কৃষ্ণকান্তকে কাছে টেনে এনেছিলেন, সেই দূরবীনই যেন উলটো করে চোখে তুলে ধ্রুব কাছের কৃষ্ণোকান্তকে দূরে ঠেলে দিয়েছিল।
মানবমনের গহীন প্রদেশের আলো-আঁধারির খেলা আর সামাজিক সম্পর্কের নানা ঘাত-প্রতিঘাত সুক্ষ্ম কলমের আঁচড়ে তুলে আনতে শীর্ষেন্দু অনবদ্য। অনেক অনেক প্রধান-অপ্রধান চরিত্রের সমাবেশ আর তাদের মাঝে অবিরত ক্রীয়াশীল আন্তঃসম্পর্কের রসায়নে শীর্ষেন্দুর উপন্যাসগুলো একই সঙ্গে হয়ে ওঠে জটিল এবং উপভোগ্য।
দুরবীন উপন্যাসেও এর ব্যতয় ঘটেনি। আর বর্ণনাশৈলী তো এককথায় অভিনব। অসংখ্য চরিত্রের মাঝে অল্প কয়টি প্রধান চরিত্রকেই এখানে সামনে আনা গিয়েছে। অন্যান্য চরিত্রের মধ্যে শচীন-বিশাখা অনেক উজ্জ্বল আর তাদের প্রেমের শুরুর বিরাগ, পরবর্তীতে নাটকীয়ভাবে সৃষ্ট অনুরাগ আর সবশেষে মিষ্টি পরিণয় বেশ উপভোগ্য। আর একজন আছেন কোলকাতাবাসী উকিল সচ্চিদানন্দ, হেমকান্তের বাল্যবন্ধু এবং কংগ্রেসী।
হেমকান্ত নিজের মনের সকল কথা চিঠিপত্রের মাধ্যমে তাঁকে জানান আর সচ্চিদানন্দও জবাব দেন, পরামর্শ দেন; কিন্তু পুরো কাহিনীর কোথাও তাঁকে সামনে দেখা যায় না। এছাড়া, গল্পের ফাঁকে ফাঁকে এ সুবৃহৎ উপন্যাসে অবধারিতভাবেই উঠে এসেছে ইংরেজ শাসন, স্বদেশী আন্দোলন, দেশভাগ সহ নানান প্রসংগ।
প্রাসঙ্গিক তথ্যঃ দেশ পত্রিকায় সুদীর্ঘ ২ বছর ধরে এ অনবদ্য উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশের পর গ্রন্থাকারে বাজারে আসে ১৯৮৬ সালে। প্রকাশের পর হতেই অসামান্য জনপ্রিয়তা অর্জন করে এই বই। "মানবজমিন", "যাও পাখি", "পার্থিব", "পারাপার" এর মত অনন্য সৃষ্টি থাকা সত্ত্বেও "দূরবীন"ই সম্ভবতঃ শীর্ষেন্দুর শ্রেষ্ঠতম কীর্তি।
অবশ্য এর মধ্যে কোন একটা পড়তে মিস করা মানে অনেক কিছু মিসিং নিঃসন্দেহে।
কোন বই নিয়ে কিছু লিখতে গেলে আমি নেটে একটু ঘুরাঘুরি করি। যদি ঐ বই সম্পর্কে কিছু পাওয়া যায়! (কৃতজ্ঞতা স্বীকারে আমি বড়ই সিদ্ধহস্ত)। সত্যি কথা হলো, এতে রিভিউ লেখাটা তুলনামূলক সহজ হয়ে যায়। কিন্তু, "দূরবীন" নিয়ে লিখতে গিয়ে বিপদেই পড়েছিলাম।
তেমন কিছুই পাই নি। কেবলমাত্র এই আর্টিকেলটা পেলাম। শীর্ষেন্দুর লেখক সত্ত্বার একটি ভাল বিশ্লেষন। ভালই লিখেছে। পড়ে দেখতে পারেন।
……………………………………………………………………………………………..
আগের লেখা।
জীবনে যা পড়েছি-৫ (মানিকের পুতুল নাচের ইতিকথা)
জীবনে যা পড়েছি-৪ (তারাশংকরের কবি)
জীবনে যা পড়েছি-৩ (পথের পাঁচালী)
জীবনে যা পড়েছি-২ (লোটাকম্বল)
জীবনে যা পড়েছি-১ (লা মিজারেবল)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।