আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জনগণ জেগে ওঠা মানে সকল অপশক্তির পরাজয় অবশ্যম্ভাবী // অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ এর সাক্ষাৎকার



তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদকে পুলিশ গত ২ সেপ্টেম্বর পেট্রোবাংলা ঘেরাও অভিমুখে মিছিলের সময় ব্যাপক লাঠিচার্জ করে। এতে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন। তার সাথে আহত হন বিপ্লবী ওয়ার্কাস পার্টির সাইফুল হক সহ আরো পঞ্চাশ জনের মত রাজনৈতিক কর্মী ও ছাত্র-ছাত্রী। অধ্যাপক আনু মুহাম্মদকে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ এবং পরে সেখান খেকে স্কয়ার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানকার ডাক্তার এর কাছে জানা গেছে যে তার পায়ের দুটি হাড় ভেঙ্গে গেছে।

স্কয়ার হাসপাতালে তার এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন প্রখ্যাত ফটোগ্রাফার শহীদুল আলম, অনুলিখনে ছিলেন রাহনুমা আহমেদ। এটি দৈনিক New Age পত্রিকায় গত ৫ সেপ্টেম্বর ছাপা হয়েছিল। আমরা সেখান থেকে এটা তরজমা করে পাঠকের সামনে রাখলাম- শহীদুল আলমঃ আপনাদের প্রতিবাদটা আসলে কিসের বিরুদ্ধে ছিল? আনু মুহাম্মদঃ বাংলাদেশের গ্যাস সম্পদ, স্থলভাগ ও সমুদ্রভাগ দুটি মিলিয়েই, খুব সীমিত। তারপরও আমরা যদি এই সীমিত গ্যাস সম্পদ ঠিকঠাক ব্যবহার করতে পারি তবে কিন্তু খুব সহজেই আমরা বেশ কিছু সমস্যার সমাধান করতে পারি। আমরা বিদ্যুৎ এর সমস্যা দূর করতে পারব, দূর করা যাবে স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতের কিছু সমস্যাও।

আর এটা তো খুব সহজ কথা যে শিল্পায়ন করতে গেলে আমাদের জ্বালানী নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই হবে। কিন্তু বিগত দু’দশক ধরে আমরা দেখছি নানা ধরনের চুক্তির মাধ্যমে একটার পর একটা গ্যাসক্ষেত্র তুলে দেয়া হচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানীগুলোর হাতে। অথচ আমাদের বাপেক্স এবং এর সহযোগী বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে যার মাধ্যমে আমরা নিজেরাই এই গ্যাস তুলতে পারি। কিন্তু তা না করে সরকার একটার পর একটা গ্যাসক্ষেত্রের নিয়ন্ত্রণ দিয়ে দিচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানীগুলোকে। সম্প্রতি সরকার সাগরের তিনটা গ্যাস ব্লক বহুজাতিক কোম্পানীর কাছে ইজারা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

এর মধ্যে দুইটা দেয়ার কথা আমেরিকান বহুজাতিক কনাকো ফিলিপস এবং বাকি একটা আইরিশ বহুজাতিক টাল্লোকে। এবং এইবারের পিএসসিতে কোম্পানীগুলোকে উত্তোলিত গ্যাসের ৮০% রপ্তানী করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। এইটা একটা ভয়াবহ ব্যাপার এবং তার চাইতেও ভয়াবহ ব্যাপার হলো আমরা চুক্তিটা ঘেঁটে দেখেছি যে কাগজে কলমে সেটা ৮০% হলেও তারা আসলে পুরো ১০০%ই রপ্তানী করতে পারবে। আমাদেরকে বারবার বলা হচ্ছে যে এই গ্যাসের মাধ্যমে আমাদের গ্যাস সংকট, বিদ্যুত সংকট সব দূর করা যাবে কিন্তু বাস্তবে এই চুক্তির আওতায় এতটুকু গ্যাসও বাংলাদেশ পাবে না। এই ধরনের চুক্তি কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না।

আমরা এমন চুক্তি কোনভাবেই মেনে নিতে পারি না যেখানে আমাদের সম্পদের উপর আমাদের নিজেদেরই কোন নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। যে চুক্তি আমাদের ভবিষ্যতকে অন্ধকারের মুখে দাঁড় করিয়ে দেবে সেটা আমরা কিভাবে মেনে নেব? এই চুক্তি অবিলম্বে বাতিল করতে হবে। এই মূহুর্তে এটাই জনগণের দাবি। আমাদের আজকের প্রতিবাদ মিছিলের দাবি ছিল সরকার যেন এই চুক্তি বাতিল করে এবং কর্মসূচী অনুযায়ী আমরা পেট্রোবাংলা ঘেরাও করতে চেয়েছিলাম কারণ আমরা দেখছিলাম পেট্রোবাংলাকে ক্রমাগতভাবে এইসব বহুজাতিক কোম্পানীর স্বার্থ সংরক্ষণকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হচ্ছিল। এটাকে কোনভাবেই আর বাংলাদেশের কোম্পানী বলার সুযোগ নেই।

আমাদের মিছিল শান্তিপূর্ণভাবেই এগুচ্ছিল কিন্তু একশ গজের মত যেতে না যেতেই পুলিশ হঠাৎ আমাদের উপর চড়াও হয়। লাঠিচার্জ, কিল-ঘুষি, এমনকি তারা বুট দিয়ে আমাদের লাথিও মারতে থাকে। তারা এতটাই বেপরোয়া ছিল যে কাকে লাঠিপেটা করছে, ছেলে না মেয়ে, সেটাও তাদের ধর্তব্যের মধ্যে ছিল না। সত্যিকার অর্থেই তারা ছিল নৃশংস। এতে করে আমাদের ৫০ জন আহত হয়, কারো কারো অবস্থা বেশ গুরুতর রকমের।

এখন আমরা যেটা বলতে চাই সেটা হল লাঠিপেটা করে, কিল-ঘুষি মেরে আমাদের দমানো যাবে না। আমরা কোনভাবেই এ চুক্তি হতে দেব না কারণ আমরা জানি জনগণ এটা কোনভাবেই মেনে নেবে না এবং তারা সবাই আমাদের পাশে রয়েছেন। শহীদুল আলমঃ আপনার পাশাপাশি আজ আর কারা কারা আহত হয়েছেন? আনু মুহাম্মদঃ আমাদের একজন নেতা সাইফুল হকসহ প্রায় পঞ্চাশ জনের মত আজ আহত হয়েছেন। এর মধ্যে বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক কর্মী, বেশ কয়েকজন ছাত্রও আছেন। ছাত্রদের মধ্যে জুয়েল ও তানিয়াকে মাথায় আঘাত করা হয়েছে।

আমাকে মারার সময় দু’জন ছাত্রী আমাকে রক্ষা করতে গিয়ে বেশ বাজেভাবে আহত হয়েছে। তারা যখন দেখল যে পুলিশ আমার মাথা ও তলপেট টার্গেট করে মারার চেষ্টা করছে তখন তারা আমার গায়ের উপর পড়ে আমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছে। তাদের দু’জনের অবস্থাই বেশ খারাপ এবং দু’জনেই হাসপাতালে। শহীদুল আলমঃ আমরা প্রায়ই শুনতে পাই এই সরকার গণতান্ত্রিক। তো এই আচরণ থেকে আপনার কি মনে হয় এই সরকার পূর্ববর্তীগুলোর তুলনায় ভিন্ন কিছু ? আনু মুহাম্মদঃ আমাদেরকে গত বেশ কিছুদিন ধরে শোনানো হচ্ছে এটা নাকি দিন বদলের সরকার।

এটা আসলে স্রেফ একটা ধাপ্পাবাজি। বাস্তবে কোনকিছুই বদলায়নি কেননা ক্ষমতায় গিয়ে এরা স্বার্থ দেখে সাম্রাজ্যবাদের, ন্বার্থ দেখে বহুজাতিক কোম্পানীগুলোর। আওয়ামী লীগ-বি·এন·পি যেই ক্ষমতায় থাকুক এদের নীতি একই এবং সেটা হল সাম্রাজ্যবাদ তোষণ। মূলগতভাবে এদের মধ্যে কোন পার্থক্যই নেই। সাম্রাজ্যবাদকে রক্ষার জন্য, বহুজাতিক কোম্পানীগুলোকে রক্ষার জন্য এরা সর্বশক্তি প্রয়োগ করে- আর্মি, পুলিশ, আইন-আদালত, পোষা গুন্ডা-বদমাশ সবই মাঠে নামিয়ে দেয়।

বিনিময়ে বখরাও পেয়ে থাকে বহুজাতিক কোম্পানীগুলোর কাছ থেকে। শহীদুল আলমঃ তো এই মূহুর্তে জনগণ আসলে কি ভূমিকা পালন করতে পারে বলে আপনি মনে করেন? আনু মুহাম্মদঃ আমি মনে করি এবং বিশ্বাস করি যে জনগণ যখনই উপলব্ধি করতে শুরু করবে যে এটা তাদের সম্পদ এবং তারাই এটার প্রকৃত মালিক তখন এটা তারা কোনভাবেই বিদেশী কোম্পানীর হাতে তুলে দিতে দেবে না এবং এটা আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি। লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলে তাদেরকে আমার বেশ সচেতনই মনে হয়েছে। এটা কেবল সমুদ্রের তিনটি গ্যাস ব্লকের ব্যাপারই নয়, এটার উপর নির্ভর করবে আগামী দিনে বাংলাদেশের কর্তৃত্ব কার হাতে থাকবে। আমি বেশ আশাবাদী জনগণ জেগে উঠবেই এবং আপনি আমি সবাই জানি যে জনগণ জেগে ওঠা মানে সকল অপশক্তির পরাজয় অবশ্যম্ভাবী।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.