রাঁধুনি হেমব্রমের রক্ত
আজকের লড়াইয়ের রসদ
মৃণালকান্তি দাস
গাঁয়ের নাম অনন্তপুর।
উত্তর দিনাজপুরের বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষা এই অজ গাঁয়ের নাম কারোর জানার কথা নয়। এ রাজ্যের অন্য হাজারো গাঁয়ের মতোই এই আদিবাসী গ্রাম আজ সবুজে সবুজ। খাদ্যের জন্য নেই হাহাকার। কিন্তু এই গাঁ কেমন করে ভুলবে খাদ্যের জন্য সেই নিদারুণ যন্ত্রণার অতীত? এই গাঁয়ে যে আঁচড় কেটে গেছেন রাঁধুনি হেমব্রম।
এই আদিবাসীদের গাঁয়ের গৃহবধূ রাঁধুনি হেমব্রম খাদ্য আন্দোলনের প্রথম মহিলা শহীদ।
রাঁধুনি হেমব্রমের ইতিহাসের খোঁজ করতেই হলো, কারণ এতোদিন পর পশ্চিমবাংলার সংবাদপত্রগুলি সাতের দশকের সন্ত্রাসের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা শুরু করেছে। প্রশ্নের মুখে রাঁধুনিদের শহীদ হওয়ার রক্তাক্ত ইতিহাস।
সাতের দশকের প্রথমে রাষ্ট্রপতি-শাসনের বকলমে, তারপর জাল-নির্বাচনে কায়েম হওয়া কংগ্রেসী সরকারের জমানায়, শেষে জরুরী অবস্থায় পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসীরা ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি যে আধা-ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাস চালিয়েছিলো, হাজারের উপর সি পি আই (এম) কর্মী খুন হয়েছিলেন যে সময়ে, ঘরছাড়া হয়েছিলেন পার্টিকর্মী-সমর্থক-দরদীরা পাড়ায় পাড়ায় প্রায় সর্বত্র, ৩০-৩৫ বছর পর এখন এরাজ্যের কিছু সংবাদপত্র প্রশ্ন তুলছে, ওই সময়ে সন্ত্রাস যে হয়েছিলো, তার প্রমাণ কই?
জবাব দিয়েছেন অনন্তপুরের মাইদি।
‘শহীদ’-দের অর্থ জানেন না মাইদি।
জানেন শুধু, সেদিনের অকুতোভয় অনন্তপুর রক্তাক্ত হয়েছিলো একমুঠো চালের দাবিতে। জানেন, জমিদারের জোটাল ভেঙে চাল জোগাড়ের লড়াইয়ে শামিল হয়েছিলেন তাঁর মা রাঁধুনি হেমব্রমও। আর জানেন, তাঁর মায়ের সেদিনের লড়াই ছিলো, কোনো বিক্ষিপ্ত ঘটনা নয়, আসলে এক শ্রেণীসংগ্রাম। মাইদি এসব শিখেছেন এলাকার কৃষকনেতাদের কাছ থেকে। নিজের জীবন-যন্ত্রণার মধ্যে।
নিজেদের কলঙ্কিত ইতিহাস ঢেকে রাখতে চাইছে ঘাতকবাহিনীর পৃষ্ঠপোষকরা। সেই জন্যেই ওরা অতীতের মতোই এতদিন পরেও সক্রিয়। কখনও কখনও অন্যরকম কায়দায়ও।
১৯৫৯-এর কথা।
চারদিকে অনাহার, দুর্ভিক্ষের হাহাকার।
দিনকয়েক আগেই কৃষকসভার নেতৃত্বে খাদ্যের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়েছে কালিয়াগঞ্জ রেল স্টেশনে। স্থানীয় জমিদার-জোতদারের মদতে পুলিস প্রশাসন আন্দোলনকারীদের দেখলেই গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছে। গাঁয়ের আনাচে-কানাচে পৌঁছে গেছে সেই খবর। কিন্তু সারাদিন গতর-খাটা খেতোয়ালী পেটের জ্বালা সইবে কি করে? পুলিস প্রশাসনের হুমকিতে তাই এতটুকু ভয় পায়নি অনন্তপুরের মতো হাজারো খেতোয়ালীর গাঁ। মরদের লড়াইয়ে কোমর বেঁধে নেমেছিলেন গাঁয়ের ‘রাঁধুনিরা’ও।
সেদিন ছিলো শনিবার দুপুর ১টা।
বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষা অনন্তপুরের আদিবাসীপাড়ার মঙ্গল হাঁসদা দুধ বেচতে কালিয়াগঞ্জে যাচ্ছিলেন। নজরে আসে, গোরুর গাড়ি বোঝাই চাল পাচার হচ্ছে কোথাও। দুধের বাঁক ফেলে গলার শিরা ফাটানো চিৎকার। গাঁয়ের অন্দরে যতদূর পৌঁছে দেওয়া যায় চাল পাচারের খবর।
ইকপুকুরপাড়ের মাটির রাস্তায় গোরুর গাড়ির পথ আটকে তখন শুধু মঙ্গল হাঁসদা আর তাঁর বউ রাঁধুনি হেমব্রম। খবর যায় ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে পুলিস ক্যাম্পে। নির্দেশ আসে চৌধুরীবাড়ির জমিদারী থেকে।
নির্দেশমতো পুলিস এসেই এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়তে থাকে। রাইফেলের গুলি এসে লাগে কৃষক যোদ্ধা মঙ্গল হাঁসদার ডান হাতে।
ফের গুলি করে জোরদারের পেটুয়া পুলিস। সমস্ত শরীর ঝাঁঝরা হয়ে যায় ৩৯বছর বয়সী আদিবাসী রমণী রাঁধুনি হেমব্রমের। কচি কচি দুটি মেয়ে ছুটে আসে বাড়ি থেকে। মা তাদের আর কোনদিন ফিরবে না, বাবা আর বাঁকে করে দুধ দিতে যাবে না বড়লোকদের কালিয়াগঞ্জে। সে এক ইতিহাস।
পুলিসের গুলিতে ফুটো হওয়া দুই হাত নিয়ে বেশ কিছুদিন বেঁচেছিলেন মঙ্গল হাঁসদা।
ঘটনার বিচারবিভাগীয় তদন্ত তখন অলীক কল্পনা।
৩৮জন আদিবাসী কৃষকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা শুরু হলো। সে এক অতীত ইতিহাস। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী জানা নাগ প্রয়াত।
আজও শ্রদ্ধার সাথে সম্মান জানানোর রীতি আছে কৈপুকুর পাড়ের শহীদ রাঁধুনি হেমব্রমের শহীদবেদীতে। পঞ্চাশোর্ধ্ব মেয়ে বড় মাইদি হাঁসদা থাকেন বাপের ভিটায় চার ছেলেমেয়ে নিয়ে। ছোট মাইদি হাঁসদা পতিরামের ভাতিন গ্রামের শ্বশুরবাড়িতে।
বড় মেয়ে মাইদির ঘটনা সব মনে নেই, শুধু মনে পড়ে বাপের ফুটো হাতের রক্ত মায়ের সিঁথির উপর টপটপ করে ঝরছে, বাবার কোলে মায়ের নিথর দেহ। সি পি আই (এম) পার্টির তৈরি মায়ের শহীদবেদীর পাশে দাঁড়িয়ে ফ্যালফ্যাল করে চারিদিকের সবুজ খেতের দিকে তাকিয়ে শহীদ রাঁধুনি হেমব্রমের মেয়ে।
বাংলায় খাদ্য সঙ্কট আজ স্মৃতি। প্রথম মহিলা শহীদের মেয়ে বললেন — ‘বাংলার লড়াই বাঁচার লড়াই, এ লড়াই তোমাদের জিততেই হবে। ’
১৯৫৯সালের ঐতিহাসিক খাদ্য আন্দোলনের সময়, কংগ্রেসী শাসনে গ্রামবাংলার অবস্থা কী ছিলো, তা আজকের দিনে একবার মনে করা খুবই প্রাসঙ্গিক। সেইসময় বিধানসভায় কমিউনিস্ট নেতা জ্যোতি বসু যে অনাস্থা প্রস্তাব এনেছিলেন রাজ্যের কংগ্রেস শাসনের বিরুদ্ধে, ওই নিয়ে আলোচনায় বসু যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তা থেকেও ওই সময়ের গ্রামবাংলার শোচনীয় হালহকিকতের চিত্র মেলে। যা থেকে বোঝা যায় কেন ১৯৫৯সালের খাদ্য আন্দোলন অনিবার্য হয়ে উঠেছিলো এবং তা দমন করতে কেন ডাঃ বিধান রায়ের সরকার এতো মারমুখী হয়েছিলো।
১৯৫৮সালের কংগ্রেস সরকারের দ্ব্যর্থহীন ভাষায় প্রচার ও অভিমত ছিলো যে, গ্রামের নাকি উন্নতিসাধন হয়েছে, মানে গ্রামীণ অর্থনীতিতে। কৃষির ব্যাপারে কথা ছিলো যে, তাঁরা ৯লক্ষ ৩২হাজার টন উৎপাদন করবেন। কিন্তু ১৯৫৬-৫৭সালে কংগ্রেসের রাজ্য সরকার প্ল্যানিং কমিশনের কাছে যে রিপোর্ট দিয়েছিলো তাতে তাঁরা ৮৪হাজার টন করতে পেরেছে বলে জানিয়েছিলো। এবং ১৯৫৭-৫৮সালে তাঁরা করতে পেরেছিলেন ১লক্ষ ২৭হাজার টন বেশি। ১৯৫৪সালে কিছু উদ্বৃত্ত হয়েছিলো কিন্তু সেই উদ্বৃত্ত হয়েছিলো প্রয়োজন মতন এবং সময় মতন বৃষ্টিপাতে।
তার মধ্যে কোনো পরিকল্পনা ছিলো না। সেবার ৭লক্ষ টন বাড়তি উৎপাদন হয়েছিলো কিন্তু ১৯৫৮সালে দেখা যায় যে তখন রাজ্যে সাড়ে সাত লক্ষ টন ঘাটতি! এইভাবেই দেখা যায় ১৯৫৭সালে ঘাটতি ৪লক্ষ টন, ১৯৫৫-তে ৫লক্ষ ৪০হাজার টন, ১৯৫৩-তে ২লক্ষ ৪২হাজার টন এবং ১৯৫২-তে ৫লক্ষ ৮২হাজার টন। অন্তত ৯লক্ষ একরে সেচ ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করার কথা ছিলো। কিন্তু ১৯৫৮সাল অবধি মাত্র সাড়ে তিন লক্ষ একর জমিতে সেচ ব্যবস্থায় জল দেওয়া হয়েছিলো। ময়ূরাক্ষী থেকে ৬লক্ষ একর জমিতে জল দেবার কথা ছিলো।
কিন্তু ৬ লক্ষের টার্গেট ১৯৫৮-তে ৪লক্ষ-তে নেমে আসে। এই ছিলো তখনকার পরিকল্পিত গ্রামের উন্নতি এবং দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করবার ব্যবস্থা। তখনকার কংগ্রেস সরকারের কৃষি ব্যবস্থার ফল ছিলো অদ্ভুত। ১৯৩৭-৩৮সালে প্রতি একরে ১২.১৮টন ফসল হতো, ১৯৫৩-৫৪সালে ১৩.৪৮টন, ১৯৫৪-৫৫সালে ১০.৪০টন, ১৯৫৫-৫৬সালে ১১.১১টন ফসল হয়েছিলো। অর্থাৎ ১৯৩৭-৩৮সালে তা ছিলো ফলন তাও ১০বছরের কংগ্রেসের রাজত্বে নেমে এসেছিলো।
তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গে ১কোটি ১৯লক্ষ একর জমিতে ফসল হতো। তার মধ্যে ১৮লক্ষ একর জমিতে দুই ফসল হতো এবং ১কোটি একর জমিতে খালি একফসল হতো। তার বেশি কিছু হতো না। যখন সরকার বলছিলো ইস্টবেঙ্গল থেকে লোক আসছে, তখন কিন্তু সেই জমিগুলিকে সরকার উদ্যোগ নিয়ে দো-ফসলী করতে পারতো। এপার-ওপার সবাইকে তারা খাওয়াতে পারতো।
অ্যামোনিয়া সালফেট সার তখন ৪০হাজার টন প্রয়োজন পশ্চিমবাংলায়। ১৮হাজার টনের বেশি ব্যবস্থা করতে পারেনি সরকার। প্রকৃত ভূমিসংস্কার তো দূরঅস্ত। ছিলো না অল্প সুদে কো-অপারেটিভ ব্যবস্থায় দীর্ঘমেয়াদী ঋণ।
সেইসময় কংগ্রেস সরকার বহুরকম দমননীতি চালিয়েছিলো খাদ্য আন্দোলনকে ধ্বংস করতে।
সরকার নানারকম কারণ দেখিয়ে তাদের পক্ষে সমর্থন আদায় করতে চেষ্টা করেছিলো। যেমন অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, উদ্বাস্তুদের আগমন, পাট চাষ বেশি হওয়ায় ধানের উৎপাদনে জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে ইত্যাদি। কিন্তু তাদের নানারকম বাহানা, জনগণের কাছে ধোপে টেকেনি। সেইসময় পর্যন্ত কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গে বারো বছরের বেশি রাজত্ব করছিলো। কিন্তু তাদের আট বছর পরিকল্পনাতে শতকরা তিন ভাগের বেশি জলসেচের ব্যবস্থা করতে সরকার ব্যর্থ।
শতকরা আঠাশ ভাগ জমিতে এক ফসল হয়, দুই ফসল হয় না। রাজ্য সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকারের বিবৃতিতে কোনোরকম সামঞ্জস্য ছিলো না। পণ্ডিত নেহরু, শ্রী জৈন, শ্রী পাতিল, এনারা বলেছিলেন যে, খাদ্যসঙ্কট অন্য ব্যাপার। খাদ্যের যথেষ্ট উৎপাদন হয়েছে। দেশের কোথাও খাদ্যসঙ্কট নেই।
পশ্চিমবঙ্গ যা সাহায্য চেয়েছিলো তার অতিরিক্ত পেয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারই বলেছিলো আর ঘাটতি নেই, তাহলে কেন তখন ৩৪-৩৫ টাকা মণ চাল কিনতে হয়েছিলো? আসলে ব্ল্যাক মার্কেটে অনেক খাদ্যসামগ্রী চলে গিয়েছিলো। লক্ষ্য ছিলো ইলেকশন ফান্ডকে সুনিশ্চিত করা। সাধারণ মানুষ সেটা বুঝেছিলেন।
তাই চোয়াল শক্ত করে, কোমর বেঁধে আন্দোলনে নেমেছিলেন।
রক্তাক্ত হয়েছিলেন, শহীদ হয়েছিলেন। লড়াই সংগ্রামের সেই ইতিহাসের শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়েই বামফ্রন্ট সরকার দীর্ঘ ৩২বছর পথ হেঁটেছে। এবার সেই ইতিহাসকেও কলুষিত করার পথ বেছেছে এ রাজ্যের বিরোধীরা।
এদের জন্য শুধু চরমতম ঘৃণা রাখলেই চলবে না। চাই এদেরকে জনবিচ্ছিন্ন করার প্রক্রিয়া জারি রাখার অঙ্গীকারও।
সেই অঙ্গীকারকে শাণিত করার একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিন হলো ‘৩১শে আগস্ট’। শুধু খাদ্য আন্দোলনের শহীদ দিবস নয় এই দিনটি। গণ-আন্দোলনেরও শহীদ স্মরণ দিবস ‘৩১শে আগস্ট’। এমন একটা দিনে আমাদের শপথ গ্রহণ আরো বেশি আজ প্রাসঙ্গিক, কারণ এখন উন্নয়ন চেয়েও পশ্চিমবঙ্গের মানুষ আক্রান্ত।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।