আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

২০১০ সালে পারছি না, ২০২১ সালে পারবো তো?



২০১০ সালে পারছি না, ২০২১ সালে পারবো তো? ফকির ইলিয়াস ======================================== ভবিষ্যতকে খুঁজতে গেলে অতীতকে খুব ঘনিষ্ঠভাবে পরখ করতে হয়। তা, আমিও করি। দেখি আমাদের সংকল্পগুলো। কী চেয়েছিলাম? কী পাচ্ছি। আর কী পেতে পারতাম।

কেন পেলাম না। কেন ইচ্ছেগুলোর বাস্তবায়ন হলো না আমাদের! এরকম অনেক প্রশ্ন আমার মনে উঁকি ঝুঁকি দিয়ে যায়। গত কদিন ধরে আমি একটি বই পুনর্পাঠ করছি। বইটি লিখেছেন দেশের কৃতী ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গ্রন্থটির নাম ‘বাংলাদেশ ২০১০’।

গ্রন্থটি পুনরায় পড়ার একটা উদ্দেশ্য আছে আমার। কারণ ২০১০-এর আর মাত্র এক বছর বাকি। এই বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ফেব্রুয়ারি ২০০০ সালে। একবিংশ শতাব্দীতে প্রবেশের প্রাক্কালে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশ সম্পর্কে কী ভেবেছিলেন? তার সেই ভাবনাগুলো আছে এই গ্রন্থে। মাত্র পাঁচটি দীর্ঘ প্রবন্ধ নিয়ে গ্রন্থটি।

‘বাংলাদেশ ২০১০’, ‘দরিদ্র ও ক্ষুধা আমাদের নির্মূল করতে হবে’, ‘আগামী দিনের গ্রাম’, ‘প্রযুক্তির পিঠে সওয়ার হবো, নাকি প্রযুক্তির তলানি কুড়াবো?’, ‘ধন্যবাদ বিংশ শতাব্দী’- এই মোট পাঁচটি শিরোনামের প্রবন্ধ। প্রথম প্রবন্ধটি নিয়ে কিছু আলোচনা করা যাক। এই প্রবন্ধে তিনি আশা করেছিলেন- ‘তথ্যপ্রযুক্তি আমাদের সামনে যে সুযোগ এনে দিয়েছে তা যদি আমরা সদ্ব্যবহার করতে পারি, তাহলে ২০১০ সালের মধ্যে মাথাপিছু আয় দ্বিগুণ করতে পারবো। ’ তার সেই প্রত্যাশাটি কি পূর্ণ হয়েছে? যদি হয়ে না থাকে, তবে কেন হয়নি? দীর্ঘ এই প্রবন্ধটিতে তিনি বলেছেন, দুর্নীতি ও সন্ত্রাস দুই সহোদর ভাই। বাংলাদেশে গেলো এক দশকে দুর্নীতি এবং সন্ত্রাস তো দূর হয়নি, বরং এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মৌলবাদী জঙ্গিতন্ত্র।

একটি চক্র সন্ত্রাসের চরমত্ব হাতে তুলে নিয়েছে ধর্মীয় লেবাসে। তারা ভর করেছে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনেও। গেলো জোট সরকারের সময়ে একটি বিশেষ মহলকে সুবিধা দিয়ে বিভিন্ন পদে আসীন করার ঘটনাবলী ও বেরিয়ে আসছে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে। ২০০০ সালে যখন আমরা একবিংশ শতাব্দীতে প্রবেশ করি তখন একটি প্রধান প্রত্যয় ছিল, একটি সুশিক্ষিত প্রজন্ম গড়ে তোলা। একটি প্রযুক্তির বাংলাদেশ গড়ে তোলা।

শিক্ষার প্রসার ঘটাতে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে টেক্কা দিয়ে দেশে গড়ে উঠে অনেকগুলো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ। কিন্তু হালে আমরা দেখছি এ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো রাষ্ট্রীয় আইন কানুন না মেনেই নিজেদেরকে পরিচালিতা করছে। শুধুমাত্র টাকা বানানোর ধান্দা নাকি প্রকৃত শিক্ষাদান; সে প্রশ্নটি উত্থাপিত হচ্ছে এখন প্রায় সর্বমহলেই। শিক্ষার মাধ্যমে সেবা প্রদানের একটি উদ্যোগ সকল উন্নত রাষ্ট্রেই থাকে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষানবিশরা তাদের অবসর সময়ে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেন সামাজিক উন্নয়নে।

বাংলাদেশে শুধুমাত্র দুর্যোগকাল ছাড়া এই কর্মউদ্যম লক্ষ্য করা যায় না। এই বিষয়টি প্রমোট করার রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টা প্রয়োজন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজের স্বেচ্ছাসেবক দল নিজ নিজ এলাকা তথা প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে মানবসেবামূলক কাজগুলোর হাল ধরতে পারেন। দুই. আমরা পারিনি অনেক কিছুই। চেষ্টা করেও পারিনি।

কেন পারিনি তা ভেবে দেখার দরকার। একটি রাষ্ট্রের পরিশুদ্ধ কাঠামো নির্মাণে রাজনীতির শ্রদ্ধায়ন খুবই জর"রি বিষয়। গ্রাম-প্রধান একটি দেশে দারিদ্র্যবিমোচন করা খুব সহজ কাজ নয়। কারণ কিছু কিছু সমস্যা আছে, যা সচেতনতার মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব। যেমন পরিষ্কার-পরি"ছন্নতা, গণস্বাস্থ্যের উন্নয়ন ইত্যাদি।

মনে রাখতে হবে শুধু মাত্র দুচারটি বড় বড় রাস্তা নির্মাণ কিংবা কিছু ব্রিজ কালভার্ট নির্মাণের নামই গ্রামীণ উন্নয়ন নয়। গ্রামের মানুষকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলার দায়িত্বটি রাষ্ট্রের হলেও মানুষকেও এগিয়ে আসতে হবে। কিন্তু দারিদ্র্য যদি মানুষের মেরুদণ্ডকে ভঙ্গুর করে রাখে তাহলে সে দাঁড়াবে কিভাবে? দারিদ্র্য বিমোচনের কথা মুখে বলা হলেও, মানুষকে প্রকৃত শিক্ষিত করে তোলার কাজটি কোনো সরকারই করেনি। যদি করতো তবে দেশে শিক্ষিতের হার এতো নিচে থাকতো না। ড. মুহাম্মদ ইউনূস-এর ‘আগামী দিনের গ্রাম’-এর চিত্রই যদি দেখি তবে দেখবো, গেলো দশ বছরে গ্রামগুলোর দশ শতাংশ উন্নয়নও হয়নি।

দশ বছরে যদি দশ শতাংশও না হয়, তবে শতভাগ হতে কতো বছর লাগবে? কেন লাগবে? দেশে সরকারি এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার তো অভাব নেই। তাহলে উন্নয়ন হচ্ছে না কেন? এরা কী করছে? সম্প্রতি ‘প্রশিকা’ নামক এনজিওটির ক্ষমতা দখলের মারামারি দেখে আমার বারবার মনে হয়েছে সামন্তবাদী দানবের প্রেতাত্মাই ভর করে আছে বাংলাদেশের উন্নয়নের সকল দরজায়। এই কপাট খোলা খুব সহজ কাজ নয়। গরু চুরির হিড়িক, জমির আল নিয়ে কোন্দল, ফতোয়াবাজদের দাপট, বাল্যবিবাহ প্রথা, গ্রাম্য মোড়লীপনা আর কুসংস্কারগুলোই গ্রামের প্রধান সমস্যা নয়। সমস্যা হচ্ছে, গ্রামের মানুষ তাদের কৃষিকর্মের ন্যায্য মূল্যায়ন যেমন পাচ্ছেন না, তেমনি গ্রামীণ প্রজন্মকে শিক্ষিত করে তোলার জন্য পাঠশালাগুলো প্রয়োজনীয় রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোকতা পাচ্ছে না।

‘পাঁচশত ছাত্রছাত্রীর জন তিনজন শিক্ষক’- এই গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না গ্রামীণ বিদ্যাপীঠগুলো। এই অবস্থার অবসান কবে হবে, আদৌ হবে কিনা, তা কেউ জানে না। রাষ্ট্রকে প্রযুক্তির পিঠে সওয়ার হতে হলে রাষ্ট্রের মানুষকে ‘সওয়ারি’ করে গড়ে তুলতে হবে। প্রতিবেশী দেশ ভারতে বেশ কটি নামকরা প্রযুক্তি ইনস্টিটিউট গড়ে উঠেছে কেরালা, তামিল নাড়-, প্রভৃতি অঙ্গরাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও। ভারত প্রতিবছর হাজার হাজার আইটি স্পেশালিস্ট রপ্তানি করছে বিদেশে।

বিশেষ করে ইউরোপ আমেরিকায়। বাংলাদেশে তেমন কোনো ইনস্টিটিউট গড়ে উঠেছে কি? ড. মুহাম্মদ ইউনূস যে ২০১০ সাল দেখতে চেয়েছিলেন তা আমরা পাচ্ছি, এমন কোনো ভরসা করতে পারছি না। কেন পারছি না তার উত্তর সবাইকে খুঁজতে হবে। খুঁজতে হবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকেও। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান পেয়েছেন।

তার নামের সঙ্গে আলোকিত হচ্ছে বাংলাদেশের নাম। কিন্তু সেই সব এনজিও নামের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাপক লাভবান হলেও বাংলাদেশের খেটে খাওয়া মানুষেরা আলোর মুখ দেখছে খুবই কম। আমরা ২০১০ সালে পারিনি। ২০২১ সালে পারবো তো? এর প্রস্তুতি কি আমরা নিচ্ছি? নিতে পারছি ?? -------------------------------------------------------------------- দৈনিক ভোরের কাগজ। ঢাকা।

১০ আগষ্ট ২০০৯ সোমবার প্রকাশিত

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.