আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ইজ্জত লইয়া চলছি আইজও পুরানা ঢাকার

সব কিছুর মধ্যেই সুন্দর খুঁজে পেতে চেষ্টা করি............

ইজ্জত লইয়া চলছি আইজও পুরানা ঢাকার জুড়ি ঘোড়ার গাড়ি প্রাচীন ঢাকার ঐতিহ্য বুকে ধারণ করে আজও রাজপথে চলছে। সদরঘাট টু গুলিস্তান চলালচলকারী নানা সমস্যায় জর্জরিত এ যানবাহনটি আর কতদিন টিকে থাকতে পারবে- সে প্রশ্নটিকে সামনে রেখেই এ প্রতিবেদন "জুড়ি ঘোড়ার গাড়ি আমার বড় চমৎকার, ইজ্জত লইয়া চলছি আইজও পুরানা ঢাকার"। ঢাকাই ছবির বিখ্যাত(!) গান এটি। সেদিন এই গানটি গুনগুন করে গাইতে গাইতে ৬ বন্ধু চেপে বসলাম ঐতিহ্যবাহী টমটমে। টগবগ টগবগ ছন্দে ছুটে চলেছে টমটম গাড়ি।

মনে হয় কোন রূপকথার রাজ্যের ছুটে চলেছি। বন বাদাড় পেরিয়ে অজানা এক রাজকন্যার সন্ধানে এই ছুটে চলা। কি এক শিহরণ তোলা অনুভব। হঠাৎ ক্যাচ ক্যাচ শব্দে সমস্ত দিবাস্বপ্ন ভেঙে যায়। চেয়ে দেখি, এ তো কোন রূপকথার পথঘাট নয়।

আমার নিজের শহর ঢাকা। তীব্র যানজটে আটকা পড়েছে আমাদের মত ক'জন যাত্রীকে নিয়ে ছুটে চলা টমটম গাড়িটি। গন্তব্য গুলিস্তান থেকে সদরঘাট, আবার সদর ঘাট থেকে গুলিস্তান হয়ে চাঁন খারপুল। যান্ত্রিক পথে অযান্ত্রিক যান। নগরীর এই একটিমাত্র রুটেই এখনো ছন্দ তুলে ছুটে চলে ঘোড়ার গাড়ি তার সওয়ারী নিয়ে।

ভাড়া জনপ্রতি ৮ টাকা। আমরা ৬ বন্ধু একটা গাড়ি রিজার্ভ করে নিয়েছিলাম। যারা একটু আরামে বসে ধীরে সুস্থে নিজ গন্তব্যে যেতে চান তারাই বর্তমানে এই ঘোড়ার গাড়িতে চড়েন। মিরপুরের বাসিন্দা মনির হাওলাদার তার দু'ছেলে মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে বাস থেকে নেমেছেন গুলিস্তান। দেশের বাড়ি বরিশাল।

যাবেন সদরঘাট থেকে স্টিমারে করে। কিন্তু সদরঘাট যাওয়ার জন্য তিনি গুলিস্তানে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছেন ঘোড়ার গাড়ির জন্য। "অন্য যানবাহনে কেন যাবেন না?"- প্রশ্ন করতেই জানালেন, "গোটা পরিবার নিয়ে বাসে গাদাগাদি করে এই মাত্র মিরপুর থেকে এসেছি। এ রকম ঠেলা ধাক্কা খেয়ে আর বাকী পথটুকু যাওয়ার ইচ্ছে নেই। একটু আয়েস করে আরামে যাওয়া যাবো বলেই টমটম এর জন্য অপেক্ষা করছি।

" তিনি আরও জানান, সবসময়ই টমটমে করে সদরঘাট যান কিংবা গ্রাম থেকে ফিরে সদরঘাট থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত আসেন। তার কাছে এই টমটমে সামান্য পথ চলাটুকু খুবই স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপদ মনে হয়। এই যান্ত্রিক নগরীতে এমন বহু যাত্রীই রয়েছেন, যারা এখনো ঘোড়ার গাড়িতে যাতায়াত করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। আর সেজন্যই বোধহয় প্রাচীন এই যানটি টিকে রয়েছে ৪০০ বছরের পুরনো ঢাকা নগরীতে। পুরান ঢাকার এই একটিমাত্র রুটেই বর্তমানে চলাচল করছে ২২টি টমটম গাড়ি।

এদেরকেও সিটি কর্পোরেশনের রুট পারমিট ও লাইসেন্স দেয়া হয়। ফুলবাড়িয়া এলাকা ও চানখাঁরপুল এলাকায় মূলত টমটম সার্ভিসের অফিস ও গ্যারেজ রয়েছে। এখানে বিভিন্ন নামে অনেকেই এই ঘোড়ার গাড়ির পরিবহন ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। ‘সিটি টমটম সার্ভিস’-এর মালিক মোঃ মানিক জানালেন, এই পেশার সঙ্গে জড়িত রয়েছে বর্তমানে প্রায় পাঁচ হাজার কর্মী। চালক, সহিস, ঘোড়ার রক্ষণাবেক্ষণ-সব খরচ হিসেব করলে এমন কঠিন দ্রব্যমূল্যের বাজারে এই পেশার লোকজন বহু কষ্টে টিকে রয়েছে।

এই ব্যবসায় আজ পর্যন্ত কোন সংস্থা বা সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা তারা পায়নি। তিনি জানান, শুধুমাত্র পারিবারিক পেশা ও ঐতিহ্যকে ধরে রাখার জন্যই এই সার্ভিস চালিয়ে যাচ্ছেন। সপ্তাহের পাঁচদিন কর্মচঞ্চল নগরীতে যদিও বেশ ভালো যাত্রী পাওয়া যায়। কিন্তু ছুটির দু'টো দিন শুক্র ও শনিবার তেমন যাত্রী থাকে না টমটমে। ফলে যা আয় হয় তা প্রতিদিনকার ব্যয়েই চলে যায়।

মানিক জানান, একটু বাড়তি আয় হয় তাদের যখন গাড়িগুলো কোন অনুষ্ঠানের জন্য রিজার্ভ ভাড়া দিতে পারি। এক্ষেত্রে শ্যূটিং, বিয়ের অনুষ্ঠান, সিনেমার বিজ্ঞাপন, নানা অনুষ্ঠানের শোভাযাত্রা ও বিভিন্ন সামাজিক ও পরিবারিক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে থাকে টমটম সার্ভিস। তখন স্থান ও সময় নির্ধারণমত ভাড়া ৫০০ থেকে ২০০০ টাকা পর্যন্ত প্রতি গাড়িতে আয় হয়ে থাকে। এসব অনুষ্ঠানের ভাড়া খাটে বলেই কিছুটা রেহাই পান টমটম সার্ভিস ব্যবসায়ীরা। অন্যদিকে সিদ্দিকবাজারের মোঃ নিজামউদ্দিন তার "আদরের টমটম" নামে ঘোড়া গাড়ির সার্ভিস পরিচালনা করছেন বর্তমান প্রজন্ম হিসেবে।

তারও পূর্ব প্রজন্ম এই পেশায় জড়িত ছিলেন। তবে নিজামউদ্দিন শুধুমাত্র অনুষ্ঠানেই গাড়ি ভাড়া দেন। তার গাড়িগুলো বেশ বড়সড় এবং নকশা করা ঝকঝকে। তিনি ভাড়া নেন ঘোড়ার রং বুঝে/কালো ঘোড়া, সাদা ঘোড়া এবং লালচে ঘোড়ার জোরা গাড়ি ভিন্ন ভিন্ন দামে ভাড়া খাটে। তিনি গাড়ি প্রতি এক থেকে দু'হাজার টাকা ভাড়া নেন।

বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের অনেক দেশেই এখনো দ্রুতগামী সব যানবাহনের পাশাপাশি ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন রয়েছে। সেখানে প্রাচীন সাংস্কৃতির ধারক হিসেবে যতেœর সঙ্গে লালন করা হয় এ যানবাহনটিকে। কিন্তু এদেশে তেমনটা ঘটে না। বহু ঐতিহ্য আজ বিলুপ্ত হয়েছে সার্বিক পরিচর্যা ও সংরক্ষণের অভাবে। টমটম ব্যবসায়ীদের পক্ষে মোঃ মানিক আকুল আবেদন জানালেন, ঢাকার আদি যানবাহন হিসেবে এই ঘোড়াগাড়িকে টিকিয়ে রাখতে সরকার ও অন্যান্য মহল যেন এগিয়ে আসে।

পেটের দায়েই হোক, কিংবা নিতন্ত পারিবারিক ব্যবসা থেকে তারা এ ঐতিহ্যকে আজ পর্যন্ত ধরে রেখেছেন। কিন্তু আর্থিক সমস্যায় হয়তো একদিন এটাও হারিয়ে যাবে ঢাকার ঐতিহ্য, অহংকার টমটম।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।