আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বুদ্ধিবৃত্তির বিকার: মেরিল-প্রথম আলো চলচ্চিত্র ‘সমালোচক পুরস্কারের’ রাজনৈতিক অর্থনীতি১



[প্রথম আলো আর চ্যানেল আই এর ভয়ে এই লেখাটি ফিল্ম আর্কাইভ জার্নাল ছাপনি, যদিও আর্কাইভ কর্তাদের অনুরোধেই লিখেছিলাম ২০০৮-এর ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে। আর আমি অন্তটীকা ঠিকমতো বসাতে পারলাম না, ক্ষমা চাই। লেখার পাশের সংখ্যাগুলোকে অন্তটীকা নির্দেশক হিসেবে পড়তে হবে...আ-আল মামুন ] সংগীত, টেলিভিশন অনুষ্ঠান ও চলচ্চিত্রে বিশেষ অবদানের জন্য মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার দেয়া হচ্ছে গত কয়েক বছর। নারী ও পুরুষ বর্গে পাঠক জরিপের মাধ্যমে সেরা কণ্ঠশিল্পী, সেরা অভিনেতা-অভিনেত্রী; সেরা চিত্রনাট্যকার, সেরা পরিচালক, সেরা চলচ্চিত্র ইত্যাদি নির্বাচন করে পুরস্কৃত করা হয়। তদুপরি, একগুচ্ছ জুড়ি বোর্ডের মাধ্যমেও এসব বর্গে পুরস্কার দেয়া হয়।

এ পুরস্কার ‘বিরল সম্মানজনক’- এ নিয়ে প্রথম আলো স্লাঘা বোধ করে, আর যারা পুরস্কৃত হন তারাও গর্বে ফেটে পড়েন। ২ যেমন অভিনয় শিল্পী সোহানা সাবা বলেন, ‘সবচেয়ে সম্মানজনক মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারে মনোনয়ন পাওয়ার প্রত্যাশা করেছিলাম। ’ আর, কণ্ঠশিল্পী আসিফ বলেন ‘আগেও বলেছি, এখনো বলছি, বাংলাদেশের অস্কার হলো মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার। ’ (‘আনন্দ’ প্রথম আলো ৫ এপ্রিল ২০০৭) শিল্পীদের মুখনিসৃত এরূপ ধারণা প্রথম আলোর পাতায় প্রকাশের মানে হলো পত্রিকা কর্তাব্যক্তিরাও পুরস্কারের গুণমান নিয়ে অনুরূপ ধারণা পোষণ করে সুখ পান। এ-প্রবন্ধে অনুসন্ধানের বিষয়: মেরিল-প্রথম আলো ‘চলচ্চিত্র সমালোচক পুরস্কার’।

মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার-২০০৬ প্রদানের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয় ২০০৭ সালের এপ্রিলে। মেরিল-প্রথম আলো নিয়োজিত ‘সমালোচকদের দৃষ্টিতে’ সেরা-চলচ্চিত্র বর্গে প্রাথমিকভাবে মনোনিত হয়: তারেক মাসুদ প্রযোজিত অন্তর্যাত্রা, ফরিদুর রেজা সাগর প্রযোজিত আয়না এবং দিদারুল আলম প্রযোজিত নন্দিত নরকে। এই ছবিগুলো থেকে ‘সমালোচকদের রায়ে’ শ্রেষ্ঠত্ব পায় আয়না। এই সমালোচকগণ সেরা চলচ্চিত্র অভিনয়শিল্পী (নারী) হিসেবেও নির্বাচিত করেন আয়নার কেন্দ্রীয় চরিত্র-অভিনয়কারী সোহানা সাবাকে। চলচ্চিত্র সমালোচক পুরস্কারের জন্য গঠিত জুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন কবি-ঔপন্যাসিক-চিত্রনাট্যকার সৈয়দ শামসুল হক; সদস্য ছিলেন শিবলী সাদিক, বাদল রহমান, সাইদুল আনাম টুটুল এবং শামিম আকতার।

কোন বিচারে এবং কেন আয়নাকে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্বাচিত করা হলো তা এই প্রবন্ধের কেন্দ্রীয় জিজ্ঞাসা। ৩ অর্থাৎ, চলচ্চিত্রটির টেক্সটের কী ধরনের উৎকর্ষতার গুণে এবং/বা কোন সম্পর্কগুলোর সূত্রে আয়না প্রাথমিক মনোনয়নপ্রাপ্ত অন্য দুটো চলচ্চিত্রকে টপকে শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি পায় তাই এখানে মূল অনুসন্ধান-আগ্রহ। সেরা চলচ্চিত্র অভিনয়শিল্পী (নারী) হিসেবে আয়নার কেন্দ্রীয় চরিত্র-অভিনয়কারী সোহানা সাবাকে নির্বাচনের বিষয়টিও এই একই উদ্দেশ্য থেকে অনুসন্ধান করবো। এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমি প্রথমত চলচ্চিত্র তিনটির কাহিনী (ন্যারেটিভ, নির্মাণ শৈলী, ইমেজ) বিশ্লেষণ করবো; দ্বিতীয়ত চলচ্চিত্র তিনটির মধ্যে একটা তুলনামূলক আলোচনা করবো শ্রেষ্ঠত্ব বিচারের সুলুক সন্ধান করতে; এবং তৃতীয়ত, আয়নার বয়ান ও আয়নার নির্মাতাদের সাথে মেরিল-প্রথম আলোর মতাদর্শ ও এজেন্ডার সম্পর্ক সন্ধান করবো। সহজ কেন্দ্রীয় জিজ্ঞাসাটির জটিল উত্তর বস্তুত অনেকটাই লুকিয়ে আছে চলচ্চিত্রগুলোর কনটেন্টের ভিতরে।

তাই প্রথমেই চলচ্চিত্রগুলোর কনটেন্টের মাধ্যমে নির্মিত বয়ান অনুসরণ করে এগোবো। তবে, নন্দিত নরকে এবং অন্তর্যাত্রার বয়ানের খুঁটিনাটির দিকে যাব না, আয়নার বয়ান ও খুঁটিনাটি বিচার-বিশ্লেষণ করবো, যেহেতু এ-প্রবন্ধের মূল জিজ্ঞাসা ‘চলচ্চিত্র সমালোচক’ পুরস্কার এবং পুরস্কারটি পেয়েছে কবরী সরোয়ারের আয়না। নন্দিত নরকের মানুষগুলো বাংলাদেশের অসামান্য জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদ-এর প্রথম উপন্যাস নন্দিত নরকে থেকে নির্মিত হয়েছে নন্দিত নরকে চলচ্চিত্রটি। কাহিনী, সংলাপ ও চিত্রনাট্য লিখে দিয়েছেন স্বয়ং হুমায়ূন আহমেদ। আর পরিচালনা করেছেন বেলাল আহমেদ।

কাহিনী একজন মানসিক প্রতিবন্ধী কিশোরীর। এটুকু বললে নন্দিত নরকের কাহিনী সম্পর্কে কিছুই বলা হয় না। চার সন্তান, পিতা-মাতা ও একজন লজিং মাস্টারকে নিয়ে মফস্বলের নিম্নমধ্যবিত্ত ভদ্র পরিবারে বাবা-মার বড় সন্তান প্রতিবন্ধী রাবেয়া নিবিড়ভাবে সংলগ্ন। এই পরিবারের আটপৌরে জীবনের ক্লেদ, আশা-আকাঙ্ক্ষা, সাধ-আহ্লাধ, প্রতিবন্ধী মেয়েকে নিয়ে সংকট সবই ফুটে ওঠে সংলাপ ও ভিস্যুয়ালের ভিতর দিয়ে- আর সব মিলে একটা দুর্দান্ত কাহিনী বিকশিত হয়ে পরিণতির দিকে এগিয়ে চলে। অন্ধকার রাতে মাস্টার ঠকঠক শব্দে পায়চারি করেন উঠোনজুড়ে।

বাচ্চা মেয়েরা ভয় পায়, বাবার গলা শোনা যায়, ‘আরে ও মাস্টার, কী করো এতো রাতে? ছেলেপেলেরা ভয় পায়, ঘুমাতে পারছে না, ...ঘরে যাও। ’ মাস্টার চিরকুমার। এই পরিবারটিতে থাকে, ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা করায়। ছিমছাম পরিবারে চারটি সন্তান, বড় সন্তান রাবেয়া মানে রাবু, তার ছোট খোকা, মন্টু আর রুনু। পরদিন মাস্টার খোকা আর রুনুকে নিয়ে ছাদে বসে গামলার পানিতে সূর্যের প্রতিফলন থেকে সূর্যগ্রহণ দেখে।

এসময় রাবু নিচে থেকে ‘সাপ সাপ, এই তোরা নিচে নেমে আয়, মন্টু একটা সাপ মেরেছে, মন্টু বিরাট একটা সাপ মেরেছে’ বলে চিৎকার করতে করতে ছাদে উঠে আসে এবং এক ছুটে ফিরে যায় সাপের কাছে। সবাই আসে সাপ দেখতে। মন্টু লাঠির ডগায় মৃত সাপটি ঝুলিয়ে দেখায়। রাবু জোরে জোরে বলতে থাকে, ‘মন্টু এটা কিন্তু তুই নিবি না, এটা কিন্তু আমার সাপ। ’ তারপর সে মন্টুর হাত থেকে সাপ-ঝোলা লাটিটা নেয়: ‘এই, সাপটা আমার কাছে দে, এটা আমার সাপ।

’ ‘এটা কিন্তু আমার সাপ’ বলতে বলতে অনেকক্ষণ লাফিয়ে বেড়ায়। মা রান্নায় বসেছেন, পাশে বাবা, মা বলেন, ‘এতোবড় সাপ বাড়িতে ঢুকলো কী করে!’ বাবা: ‘বাস্তু সাপ। ’ মা শঙ্কা প্রকাশ করেন, ‘সাপ তো জোড়ায় জোড়ায় থাকে, এর জোড়াটা তো বেঁচে আছে, সেটা যদি মন্টুকে কামড়ায়?’ একটু পরে দেখা যায়, রাবু লম্বা একটা নালা খোঁড়ে সাপটা কবর দেবার জন্য। সে জিজ্ঞাসা করে: ‘মাস্টার চাচা, এটা মেয়ে না ছেলে সাপ?’ মাস্টার উত্তর দেয়, ‘ছেলে’। আমার মনে হয়েছে, নন্দিত নরকের পুরো কাহিনীটাই প্রতীকায়িত হয়েছে এইটুকু টেক্সটে- এবং চমৎকারভাবে।

মা রাবেয়ার শাড়ীতে সেফটি-পিন লাগাচ্ছেন, আর রাবেয়া দুলছে। রুনু স্কুলে যাওয়ার আগে মায়ের পাশে এসে দাঁড়ায়। রাবেয়া মাকে বলে, ‘তুমি আমার কাপড়ে এতো সেফটিপিন লাগাও, রুনুর কাপড়ে তো লাগাও না। ’ মা: ‘তুই কাপড় ঠিক রাখতে পারিস না, শরীর দেখা যায়। ’ রাবেয়া: ‘শরীর দেখা গেলে কী হয়?’ মা: ‘শরীর দেখানো ভালো না রে মা।

’ রাবেয়া: ‘কেন ভালো না?’ মা আর জবাব দেন না, একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার গলা দিয়ে। রাবেয়া অসংখ্য সেফটিপিন লাগানো নিজের শরীর এঁকেবেঁকে দেখে, কিন্তু তার তো জবাবটা চাই। সে অধ্যয়নরত খোকাকে গিয়ে প্রশ্ন করে, ‘খোকা বলতো শরীর দেখানো ভালো না কেন, ব...ল...না?’ খোকা পড়ায় মনোযোগ দিতে না-পেরে ‘ধ্যাত্তরি’ বলে বই-হাতে ছাদে চলে যায়। রাবেয়া ঝপ করে ফাঁকা চেয়ারটাতে বসে কী-যেন ভাবে এবং দুহাত ছুঁড়ে টেবিলের বইগুলো এলামেলো ছিটিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে ধপধপ পায়ে ছাদে উঠে যায়, দূর থেকেই খোকাকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন ছোঁড়ে, ‘এই তুই আমার কথার জবাব দিলি না কেন? জবাব না দিলে কিন্তু তোর হাত থেকে বই নিয়ে আমি নিচে ফেলে দেব। ’ বলেই সে খোকার হাত থেকে বই কেড়ে নিয়ে ফেলে দিতে উদ্যত হয়।

এসময় গলিতে ট্রাকের হর্ণ বেজে ওঠে, পাশের শান্তি কটেজে নতুন ভাড়াটিয়া এসেছে। রাবেয়ার মনোযোগ সেদিকে সঞ্চালিত হয়। এই বড়লোক প্রতিবেশী পরিবার তিন সদস্যের- মা, এক ছেলে, এক মেয়ে। ছেলেটির নাম হারুন। ছেলেটি আসবাবপত্র নামানো তদারকি করছে।

রাবেয়া ছেলেটার কাছে গিয়ে, কোনো জবাব প্রত্যাশা না-করেই হয়তো, বলে, ‘আপনারা এই বাড়িতে নতুন এসেছেন? আপনার নাম কি? আমার নাম রাবেয়া। ছাদে যে হাঁটছে সে আমার ভাই, তার নাম খোকা। ’ বলেই সে ছুটে-ছুটে নানা জিনিসপত্র দেখতে থাকে। গ্রামোফোন নামানো হলে জিজ্ঞাসা করে, ‘ওটা কি?’ ছেলে বলে, ‘ওটা গ্রামোফোন। ’ রাবেয়া: ‘আপনাদের গ্রামোফোন আছে! আমাদের নেই।

খোকা যখন পাশ করে চাকরি করবে তখন কিনে দেবে বলেছে। ’ ফিরে এসে খোকাকে ডেকে তার জেনে-আসা খবরগুলো জানায়: শান্তি কটেজে নতুন ভাড়াটে এসেছে, ওরা অনেক বড়লোক, ওদের গ্রামোফোন আছে, বড় একটা আয়না আছে। খোকার কাছে আবদার করে, ‘তুই আমাকে বড় একটা আয়না কিনে দিবি, আমি চুল আঁচড়াবো?’ খোকা চাকরি পেলে বড় আয়না কিনে দেবার আশ্বাস দেয়, আর রাবেয়ার মুখ এক অদ্ভুত বিরল হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে- আমার এই প্রতীকি ভাষায় ওই হাসির সৌন্দর্য প্রকাশ করা অসম্ভব, ভিস্যুয়াল মাধ্যমে যার প্রকাশ অনায়াসসাধ্য। যারা মনোযোগ দিয়ে দেখেছেন নন্দিত নরকে এবং রাবেয়া চরিত্রটির প্রকাশ-ঢঙ লক্ষ্য করেছেন তারা বুঝবেন আশা করি। রাতে উঠোনে পাটি পেতে বসে মাস্টার তারা দেখেন, গতিপ্রকৃতি লক্ষ্য করেন, আর বইয়ের সাথে মিলিয়ে নেন।

বাবাকে ডেকে কাছে বসিয়ে তারা চেনান। বাবা বলেন, তারা দেখে কী হয়, সংসার দেখে কূল পাইনা, আবার তারা! মাস্টার একটা দূরবীন কিনে মজা করে তারা দেখার জন্য টাকা জমায়। বাবা হেঁয়ালী করেন, ‘কেনো, কেনো দূরবীন কেনো, তারা দেখো। ’ মন্টু বাসায় ফেরে। সাইকেল তার নিত্য সঙ্গী।

খোকা পড়ালেখায় ব্যস্ত, কাল থেকেই তার এমএসসি পরীক্ষা শুরু। রুনু রাবেয়ার কাপড়ে সেফটিপিন লাগায়, আর রাবেয়া ওকে প্রতিবেশীদের গল্প শোনায়- ওদের অনেক কিছু আছে, ওরা অনেক বড়লোক। প্রতিবেশীর বাড়িতে গ্রামোফোন বেজে ওঠে, ‘মদিনাবাসী প্রেমে ধরো হাত মম’। নজরুল গীতি। গানের সুর কানে যেতেই রাবেয়া শান্তি কটেজের নিকটবর্তী জানালায় ছুটে গিয়ে গভীর আগ্রহে গান শোনে।

রাবেয়া যায় পাশের বাড়ি বেড়াতে। হারুনের কাছে গিয়ে প্রশ্ন করে, ‘আমাকে চিনেছেন, চেনেননি, আপনার সাথে তো আমার দেখা হয়েছিল!’ সে রাতে শোনা পুরো গানটি গেয়ে শোনায়। বিস্মিত হারুন প্রশংসা করতেই বলে, আমি খুব সুন্দর পুতুলও বানাতে পারি...। রাবেয়ার কাঁধের কাপড় থেকে একটা সেফটিপিন খুলে যায়। সে হারুনকে লাগিয়ে দিতে বলে।

কারণ সেফটিপিন খুলে গেলে মা রাগ করে। সে জিজ্ঞাসা করে, বলুনতো আমার কাপড়ে কত্তোগুলো সেফটিপিন আছে? হারুন বলতে পারে না। সে তখন আনন্দে বলে, ‘ছত্রিশটা’। আবার বলে, ‘বলুনতো এত্তোগুলো সেফটিপিন কেন?’ হারুন বলতে পারে না। তৎক্ষণাৎ রাবেয়া গড়গড় করে বলে দেয়, ‘সেফটিপিন না লাগালে আমার শাড়ি খুলে যায়।

সেটা খুবই লজ্জার। ’ তারপর কাউকে না-বলার শর্তে হারুনকে একটা গোপন কথা বলে, ‘আপনাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে, আচ্ছা আপনার নাম কী?’ রাবেয়াকে হারুনের ভালো লাগে। একদিন রাতে মাস্টার বারান্দায় বসে খোকার হাত দেখছে, ভূতভবিষ্যত বলছে। রাবেয়া এলামেলো পোশাকে এসে বলে, ‘মাস্টার চাচা বলুন না আজ বৃষ্টি হবে কি হবে না, আমি গরমে সেদ্ধ হয়ে যাচ্ছি। ’ বলেই সে নিজের ঘরে ঢুকে শাড়ি খুলে আঁচল দিয়ে বাতাস করে।

মা এসে থাপ্পর কষে কাপড় ঠিক করে দেয়। প্রবল বৃষ্টি নামে, রাবেয়া বৃষ্টির মধ্যে নেচে বেড়ায়, গায়ে পাতলা কাপড় আটকে থাকে। মাস্টার তখনও খোকার হাত দেখে চলেছেন। তার ধারালো দৃষ্টি রাবেয়ার শরীরে আটকে যায়। খোকার দৃষ্টি এড়ায় না।

সে উচ্চস্বরে বলে, ‘রাবু এই রাবু ঘরে যা। এই রুনু রাবুকে ঘরে নিয়ে যা। ’ রুনু রাবেয়ার গায়ে গামছা পেঁচিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু বোঝা যায় মাস্টারের মনের মধ্যে বিষাক্ত সাপ জেগে উঠছে, সুযোগ পেলেই ছোবল দেবে। বৃষ্টির সময় ওবাড়িতে গ্রামোফোন বাজে, রবি ঠাকুরের ‘আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদল দিনে।

’ দৃশ্যায়নের সাথে গানটা হয়তো মানানসই, কিন্তু গায়কী নয়। পরিচালক দেখান গ্রামোফোন বাজছে, কিন্তু আমরা শুনি পাপিয়া সরোয়ারের গলা। যে-সময়ের কাহিনী সে-সময় কি পাপিয়া সরোয়ার গান গাইতেন? তিনি গ্রামোফোনে আদৌ কখনো রেকর্ড করেছেন কি? হারুনের মা ছেলেকে পাত্রীর ফটোগ্রাফ দেখান। হারুন বিশেষ উৎসাহ না-দেখিয়ে জানায় সে নিজের পছন্দের কোনো একটা মেয়েকে বিয়ে করতে চায়। মন্টু নাটাই-ঘুড়ি নিয়ে সাইকেলে বাড়ি ফিরছে, রাবেয়া সেই ঘুড়ি নিয়ে চলে আসে হারুনদের বাড়িতে, হারুন রাবেয়ার সাথে ছাদে ঘুড়ি ওড়াতে যায়।

গৃহকত্রীর বুঝতে বাকি থাকে না কাকে ছেলের পছন্দ হয়েছে। তিনি রাবেয়াদের বাড়িতে গিয়ে তার মাকে ‘পাগল মেয়ে’ লেলিয়ে দেওয়ার অভিযোগ করে যা-তা বলেন এবং আঙুল উঁচিয়ে শাসিয়ে আসেন যে এক সপ্তাহের মধ্যে তিনি ছেলেকে বিয়ে দেবেন, রাবেয়াকে যেন আর ওবাড়িতে না-যেতে দেওয়া হয়। ওদিকে হারুন ঘুড়ি ওড়াতে ওড়াতে রাবেয়াকে বলে, ‘আচ্ছা তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে?’ রাবেয়া বলে, ‘তাহলে তো আমাকে বিয়ের শাড়ি কিনতে হবে, বিয়ের শাড়ি না কিনলে বিয়ে করব কিভাবে?’ ‘নাটাই-ঘুড়ির’ স্বপ্ন আর হারুনের পূরণ হয় না। মায়ের ইচ্ছেমাফিক হারুনের বিয়ে হয়ে যায়। রাবেয়াকে তার আত্মসম্মানবোধ-সম্পন্ন মা ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখেন।

রাবেয়া বোঝে না কেন তাকে তালাবন্ধ করে রাখা হয়েছে। সে বিছানা ওলটপালট করে সবাইকে ডেকে তালা খুলে দিতে বলে কান্নাকাটি করে। দেবদূতের(!) মতো আসেন মাস্টার চাচা। রাবেয়া বাইরে বেরিয়েই বলে, ‘আহ বাঁচলাম! মাস্টার চাচা আমি কি ভেবেছিলাম জানেন, আমি ভেবেছিলাম আমার দরোজা কেউ খুলবে না। ’ মাস্টার বলেন, ‘আজ তোকে নিয়ে ঘুরবো।

তুই কোথায় যেতে চাস বলতো? নৌকায় করে ঘুরবি, এ জার্নি বাই বোট হা হা..। ’ রাবু মাস্টার চাচার হাত ধরে বেরিয়ে যায়। নৌকায় ওঠে। কিন্তু সে বোঝেনা তার মাস্টার চাচা কী কুৎসিত পরিকল্পনা এঁটে তাকে বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছে। নৌকায় উঠে রাবেয়া দূরে মন্টুকে দেখে ডাকে, ‘ যাবি আমাদের সাথে বেড়াতে।

’ মন্টু ‘না’ বলে চলে যায়। রাবেয়া ছইওয়ালা নৌকার ভিতরে বসে, মাস্টার অনেকখানি নৌকা বেয়ে ভেতরে ঢোকেন এবং ছইয়ের পর্দা ফেলে দেন। এঘটনায় রাবেয়ার মন খুব খারাপ হয়। সে কাউকে বুঝাতে পারে না, নিজেও বোঝে না। খোকা, মা, মন্টু কারো কাছে পাত্তা পায় না।

এরপর আমরা দেখি সে কঞ্চি হাতে বাতাসে বাড়ি মারছে আর উঠোনজুড়ে ঘুরে ঘুরে বলছে ‘আমার মন খারাপ’। হারুনের বৌ আসে রাবেয়াদের বাড়িতে, রাবেয়াকে বলে, ‘তোমার নাম রাবেয়া, না?’ রাবেয়া প্রশ্ন করে, ‘তুমি কে?’ বৌ: ‘তোমার হারুন ভাই আমাকে বিয়ে করেছে, আমি তোমাকে দেখতে এসেছি। ’ বৌ বলে, আমার সাথে এসো তোমাকে সাজিয়ে দেব। রাবেয়া: ‘কিন্তু আমি তো তোমার সাথে যেতে পারব না, আমার নিষেধ আছে। ’ হারুন বিদেশ চলে গেছে।

বৌ বলে আর কোনো নিষেধ নাই, তোমার যখন ইচ্ছে ওবাড়িতে যাবে। তখন রাবেয়া আনন্দে লাফিয়ে ওঠে ‘এতাক্ষণ আমার মন অনেক খারাপ ছিল, এখন আমার মন অনেক ভালো’ বলে সে বৌটির সাথে ওবাড়িতে সাজতে চলে যায়। একদিন শান্তি কটেজের ছাদে হারুনের বোন, রাবেয়া ও বৌ মিলে খেলছে। রাবেয়ার বমি আসে। সে রেলিং ধরে বমি করে, শরীর খারাপ।

‘আর খেলবো না, হু’ বলে রাবেয়া নিজের বাড়ি চলে আসে। রাতে রাবেয়া অনেক কষ্ট পায়। (লাইটের কাজ খুবই দুর্বল) রুনু জেগে বোনের বমি করা দেখে মাকে ডাকে। মা শঙ্কিত হন। বাবা চিন্তিত হন, তবু ভাবেন হয়তো কোনো কারণে শরীর খারাপ হয়েছে, ঠিক হয়ে যাবে।

মাস্টার ততোদিনে দূরবীন কিনেছেন। মজা করে নিহারিকাপুঞ্জ দেখেন, বাবাকে ডেকে পাশে বসিয়ে বোঝান, ‘...আমরাও সৌরজগতের একটা পার্ট। ’ কিন্তু বাবার মন মেয়ের চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। মা ঘরে সিটকিনি তুলে দিয়ে রাবেয়াকে বিছানায় ফেলে দেয়, ‘বল কে তোর গায়ে হাত দিয়েছে’। রাবেয়া বোঝে না মায়ের প্রশ্ন, বলে ‘তুমি হাত দিয়েছ’।

মা থাপ্পর মারে, কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘বল মা কে তোর গায়ে হাত দিয়েছে?’ রাবেয়া: ‘জানিনাতো’। বাইরে বসে-থাকা রুনু সব বুঝতে পেরে কাঁদে। মন্টু বাড়িতে ফিরে রুনুর গায়ে হাত দিয়ে বলে, ‘কাঁদছিস কেন, কী হয়েছে?’ সেও মায়ের গলা শুনতে পায়, বুঝে যায় রাবেয়ার কী হয়েছে। পরিবারের, মেয়ের ইজ্জত বাঁচাতে হবে। বাবা-মা মিলে এক গ্রাম্য আয়া ডেকে আনে মেয়ের পেট খালাস করতে।

আয়া তার কাজ সেরে চলে যায় রাত নটায়। বাবা বাইরে বসে তসবি জপেন। কিন্তু রাবেয়ার শরীর নিস্তেজ হয়ে আসে, রক্তে মেঝে ভেসে যায়। রাবেয়া নিস্তেজ কণ্ঠে বলে, ‘বাবা, আমি কি মরে যাচ্ছি, আমার বুকটা খালি খালি লাগছে কেন? ...বাবা...রুনু কই, মন্টু কই বাবা...’। বাবা ছুটে যান বাইরে, মাস্টারকে ডাক্তার ডাকতে বলেন।

ডাক্তার আসে, বলেন এখনই হাসপাতালে নিতে হবে। বাবা-মা মানসম্মানের ভয়ে রাজী হন না। ডাক্তার চলে যান। মাস্টার মন্টুর পাশে চেয়ারে বসে মাথায় হাত বুলান। উঠোনের একদিকে রুনু আর খোকা বসে।

বাবা আবার বেরিয়ে এসে খোকাকে বড় কোনো ডাক্তার আনতে বলে মেয়ের কাছে ফিরে যান। ভোর হয়ে আসছে, ডাক্তার আনতে যাবার আগেই রাবেয়ার মৃত্যু ঘটে। বাবা শক্ত একখণ্ড পাথরের মতো বাইরে এসে উঠোনে দাঁড়িয়ে ‘রাবেয়া মারা গেছে, আমার বড় মা মারা গেছে’ বলেই জ্ঞান হারান। ওদিকে মন্টু এখবর শুনেই স্থিরপ্রতিজ্ঞভাবে রান্নাঘরে চলে যায়, বটি নিয়ে ফিরে এসে মাস্টারের পাশে দাঁড়ায়, তারপর এক কোপে মাস্টারের গলা নেমে যায়। আমরা মন্টুর হাতের বটি উঠতে দেখি, একটা শব্দ, মন্টুর গালে ছিটকে পরা একটু রক্ত, আর তারপর উঠোনে পড়ে থাকা মাস্টারের নিঃশ্চল হয়ে যাওয়া পা দুটো দেখি।

বিচার চলে আদালতে। মন্টু স্বীকার করে খুন করার উদ্দেশ্যেই মাছ-কাটা বটি দিয়ে কোপ দিয়েছে। কিন্তু কেন খুন করেছে সে প্রশ্নের জবাব দেয় না। বাড়িময় শ্বশানের স্তব্ধতা, কোনো হুল্লোর নেই, বাবা পাথর, মা পাথর, রুনু কাঁদে, খোকা স্তব্ধ। মা রান্না চড়িয়ে মুখে হাত দিয়ে বসে থাকেন, পাশের গাছে কাক ডাকে, মা যেন অশনি সংকেত শুনতে পান।

তিনি কাক তাড়িয়ে দেন। মন্টু কারাগারে ফেলে-আসা দিনগুলো স্মরণ করে। রাবেয়া তার স্বপ্নে এসে দেখা দেয়। আদালত ফাঁসির রায় দেয়। বাবা মার্সি পিটিশন করেন, জবাব আসে না।

মা বাড়িতে কোরান পড়েন, গভীর রাতে বাবা-খোকা জেলের গেটে অপেক্ষা করেন, মন্টুর লাশ নিয়ে যাওয়ার জন্য। বাবা ভাঙ্গা স্বরে জিজ্ঞাসা করেন, ‘খোকা, মন্টুর ফাঁসি কখন হবে?’ খোকা জবাব দেয় না। স্তব্ধ রাত, একসময় ঝটপট কিছু কাক কা...কা শব্দে উড়ে যায়। বাবা খোকা দুজনেই সেদিকে তাকান, বাবা-খোকা উত্তরও পেয়ে যান। নন্দিত নরকে সিনেমায় সম্পাদনার দুর্বলতা খুবই চোখে লাগে, কখনো কখনো অতি প্রকট।

ক্যামেরার কাজেও দুর্বলতা আছে, যেমন সাপ-মারা উপলক্ষ্যে রুনু পদ্য লেখে: মন্টু ভাই তো মারলেন/মস্ত বড় সাপ/চার হাত লম্বা সেটি/কী তার প্রতাপ। ’ এসময় দেখা যায় রুনু খাতা-কলম নিয়ে টেবিলে বসে- খাতার ওপর ক্যামেরা ফোকাস করে, কিন্তু কিছুই দেখা যায় না। গানের ব্যবহারে অন্যায় আছে। দেখানো হয় গ্রামোফোন বাজছে, কিন্তু আমরা সাদিয়া আফরিন মল্লিকের নজরুল সংগীত আর পাপিয়া সরোয়ারের কণ্ঠের রবীন্দ্র সংগীত শুনি। তবু অত্যন্ত শক্তিশালী কাহিনীর কারণে, ডিটেইলের ব্যবহারের কারণে এবং রাবেয়া, বাবা-মা, মন্টু সবগুলো চরিত্রের অভিনয় কুশলতায় এটি সিনেমা হয়ে ওঠে- এক অপরূপ বাস্তবতা তার আনন্দ-ক্লেদ-যন্ত্রণাসহ দর্শকের পরিপূর্ণ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে।

অন্তর্যাত্রার পরিসর অন্তর্যাত্রা তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদের দ্বিতীয় কাহিনীনির্ভর চলচ্চিত্র। চিত্রনাট্য দুজনে লিখেছেন। কাহিনীকার তারেক মাসুদ নিজে। বৃটিশ কাউন্সিল ও হুবার্ট বলস ফাউন্ডেশনের সহায়তায় নির্মিত অন্তর্যাত্রা বাংলাদেশে ডিজিটাল ফরম্যাটে তৈরি প্রথম চলচ্চিত্র। আমি ন্যারেটিভ ধরেই এগোবো, এর বিন্যাস ও পরিসর পর্যালোচনা করবো।

যে ডিভিডি থেকে লিখছি তার কভারে কাহিনী সম্পর্কে বলা আছে, অন্তর্যাত্রা মিশ্রসংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা স্থানচ্যুত মানুষের শিকড় সন্ধানের গল্প। প্রাক্তন স্বামীর মৃত্যুসংবাদ পেয়ে লন্ডন প্রবাসী মা ছেলে সোহেলকে নিয়ে ১৫ বছর পর দেশে ফেরে। এই ফেরার মধ্য দিয়ে সোহেলের বাবা সম্পর্কে মা-ছেলের মধ্যে বিদ্যমান দীর্ঘ নীরবতার অবসান ঘটে। অন্যদিকে পাঁচ বছর বয়সে ছেড়ে যাওয়া প্রায় অপরিচিত নিজের বৃহত্তর পরিবার, দেশ ও সংস্কৃতির সাথে সোহেলের পরিচয় ঘটে। সিলেট ও পুরান ঢাকায় বেড়ে ওঠা শিরিনের জন্য এই ফিরে আসা একই সঙ্গে নস্টালজিয়া এবং ছেড়ে যাওয়া সম্পর্কগুলোর মুখোমুখি হওয়ার ভাবনায় মিশ্র অনুভূতির।

পাশাপাশি এই যাত্রা- পরিবারের বিভিন্ন প্রজন্ম এবং সংস্কৃতিকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। শুধু এইটুকু? সিনেমার ইমেজ-শব্দে-ভাষায় যে টেক্সট হাজির তার ব্যাখ্যা কী? অন্তর্যাত্রায় উপস্থিত টেক্সট অনুপস্থিত কোন কোন টেক্সটকে সম্পৃক্ত করে? এ-কাহিনীর মাধ্যমে পরিচালকদ্বয় কী বলতে চেয়েছেন? লন্ডনের পরিপাটি বাসায় সদ্য এক বাঙালি কিশোর ল্যাপটপে অনলাইনে চ্যাট করছে। ফোন বাজে। মা ফোনসেট থেকে দূরে, ছেলেকে ফোনটা ধরতে বলছেন। ছেলেটি জানায় সে ফোন ধরতে পারবে না, ব্যস্ত আছে।

হন্তদন্ত মা এসে ফোনটা ধরেন। তার বড়ভাই খালেদ ঢাকা থেকে ফোন করে খবর দেয় ছেলেটির বাবা মারা গেছেন। ফোনালাপে উদ্বেগ আঁচ করে ছেলে সোহেল মার কাছে এসে দাঁড়ায়, প্রশ্ন করে, হোয়াট হ্যাপেন্ড? আঙ্কেলের কিছু হয়েছে? কেউ কি মারা গেছে? মা বলেন, ‘ইটস ইওর ফাদার। ’ মা ছেলের মুখে হাত বুলিয়ে জানায়, ‘তোর বাবাই আর নাই...’ ছেলে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ল্যাপটপের কাছে ফিরে যায়, কম্পিউপার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে, বেশ কিছুক্ষণ অব্যবহৃত কম্পিউটার-স্ক্রিনে ‘স্টার ফিল্ড’ স্ক্রিনসেভার দেখা যায়- যেন একটি নভোযান দ্রুতবেগে ছুটে চলেছে। প্লেন টেকঅফ ও ল্যান্ডিংয়ের শব্দ।

এসময় ছবির নাম, পরিচালক ও অভিনয়-শিল্পীদের নাম দেখানো হয়। তারপর জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের একটা মাস্টার সর্ট। মা-ছেলে খালেদের সাথে বেরিয়ে আসে বিমানবন্দর থেকে। এখান থেকেই কাহিনীর শুরু, কিংবা বলা চলে, পরিচালকদ্বয় বাংলাদেশ, এর সংস্কৃতি, আত্মপরিচয় সন্ধানের যে গল্প বলতে চান তার যাত্রা শুরুযে যাত্রা নতুন ঢাকা, পুরান ঢাকা হয়ে ট্রেনে চেপে সৌন্দর্যমণ্ডিত সিলেট অভিমুখী। এর পাত্রপাত্রীরা ইংরেজি ও সিলেটীর মিশ্রণে কথা বলে।

পনেরো বছর আগে দেশ ছেড়ে-যাওয়া শিরিন গাড়ি দেখে অবাক হয়: ‘এত্তো গাড়ি’। চারদিক দেখতে দেখতে সে বলে, ‘ইটস টোটালি ডিফারেন্ট কান্ট্রি ফ্রম দ্য ওয়ান আই লেফট!’ খালেদ বলেন, ‘গাড়ি বাড়ছে কিন্তু রাস্তার সাইজ আর বাড়ছে না। ’ খালেদ গাড়ি চালাতে চালাতেই ভাগ্নের কাঁধ চাপড়ে বলেন, ‘...রফিক, মানে তোমার বাবা বেশ সংগীত-প্রিয় লোক ছিলেন। উই কেপ্ট ইন টাচ ইভেন আফটার ইওর প্যারেন্টস ডিভোর্স। ’ ভিড়ভাট্টা ঠেলে তাদের গাড়ি এগিয়ে চলে।

দেখা যায় সুবারু গাড়ি, টেম্পো, ইন্টারসিটি বাস চলছে। একসময় ঘোঁড়ার গাড়িও চোখে পড়ে, বোঝা যায় পুরান ঢাকায় তারা প্রবেশ করেছে। তারপর সরু গলি বেয়ে নিজেদের বাড়ি। সিড় দিয়ে ওাঠার সময় খালেদ শিরিনকে প্রশ্ন করে, ‘দেশে ফিরতে কেমন লাগছে?’ শিরিন বলে, ‘ভালো লাগছে। ’ সারা ঘরময় বনেদিপনা।

গানের যন্ত্রপাতি, মোটিফ, তৈলচিত্র। বোন ও ভাগ্নেকে নিয়ে খালেদ দোতলার বারান্দায় বসেন। শিরিন পাশের বিল্ডিং দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করে, ওটা কবে উঠলো? খালেদ বলে, এই কিছুদিন, সব হাইরাইজ হয়ে যাবে। সন্ধ্যা ঘনায়, ‘মসজিদের শহর’ ঢাকার দৃশ্য ক্যামেরায় ধরা হয়। খালেদ ব্যাচেলর, বিয়েই করেনি।

লক্ষণ তার সেবাযত্ন করে। সোহেল ল্যাপটপ খুলে বসে। তার ভাবনার প্রকাশ ঘটে ইংরেজিতে: ‘অবশেষে এখন আমি বাংলাদেশে। ভাবিনি কখনো আসা হবে। এসে মনে হচ্ছে দীর্ঘদিন এই ফেরার অপেক্ষায় ছিলাম।

আমার জনক...ঠিক বাবা ভাবতে পারি না...সে আজ মৃত অথচ ঠিক শোক অনুভব করছি না। কী করে করবো? আমার কাছে সে অনেক আগেই মৃত। মা তাকে তো মৃত করেই রেখেছে। এতোদিন এই নিয়ে প্রশ্ন তুলিনি। মেনে নিয়েছি,এটাই স্বাভাবিক।

অনেক কিছুই আমি জানি না! আমি এখন সবকিছু জানতে চাই। অনেক কিছুই বুঝতে চাই। ’ লক্ষণ রাতের খাবার প্রস্তুত করে ডাকে, খালেদ জিজ্ঞেস করে, ‘ভাইগনা আত দিয়া খাইবার অভ্যাস আছেনি। ’ শিরিন বলে: ‘আমরাতো আত দিয়াই খাই’। কিন্তু সোহেল বলে, ‘নো, নট অলয়েজ।

’ যেন তার প্রশ্ন করা শুরু হয়ে গেছে, এতোদিন যা স্বাভাবিক বলে মেনে নিয়েছে, এখন তাকে প্রশ্ন করছে। কথা হয়, পরদিন খালেদ সোহেলকে রফিকের দ্বিতীয় স্ত্রী সালমার বাসায় নিয়ে যাবে। আর যেহেতু সিলেটে সালমাদের সাথে দেখা হবেই, তাই শিরিন পুরনো বন্ধুদের সাথে দেখা করবে, শহর ঘুরে দেখবে। সকালে খালেদ ভাগ্নেকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে, শিরিন রেলিঙে হেলান দিয়ে ওদের যাওয়া দেখে। শিরিন ভাবে: অবাক কাণ্ড, রফিক মারা যাওয়ার কারণে পনেরো বছর বাদে সে দেশে এসেছে কূলখানিতে যোগ দিতে, অথচ মা মারা গেলে বৃটিশ নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য তখন আসতে পারিনি...।

চায়ের কাপ হাতে এইসব ভাবতে ভাবতে তার নজর পরে লক্ষণের দিকে। শিরিন ঘুরেঘুরে ঘরবাড়ি, সামনের বাগান দেখে। এটা ওটা প্রশ্ন করতে করতে সে লনে নামে, ‘তুলসি বেদীটা দেখছি এখনও আছে। ’ লক্ষণ বলে, ‘হ ওই তুলসি ভীটা আর আমি লক্ষণ দাস, আদি বাড়ির ওই দুইটা চিহ্নই এখন টিকে আছে। বাড়ি বেইচা দিয়া বড় কর্তারা সবতো কইলকাতা গিয়া জানে বাঁচলো।

কিন্তু লক্ষণ দাসের কপালে ওই তুলসি গাছের নিয়তিই লেখা আছে। ...’ এক শেকড়-সন্ধানী মানুষের কাছে আরেক শেকড়-উপড়ানো মানুষের টেক্সট এসে হাজির হয়। শিরিন বলে, ‘শুনলাম দাসগুপ্তরা নাকি কোলকাতা থেকে বেড়াতে এসেছিলেন?’ লক্ষণ: ‘মাসিমা হের নাতিনাতনিরে লইয়া আইছিল। পুরান কথা কইতে কইতে হে কাইন্দা শ্যাষ। ’ শিরিন বলে: হু, নিজের ভিটেমাটি আর নিজের দেশ ছেড়ে কেউ কি যেতে চায়!’ এই দেশ থেকে হিন্দু ধর্মীয়দের ভারত গমণের টেক্সট শিরিন-সোহেলের অন্তর্যাত্রা থেকে খুবই ভিন্ন পরিসরের, কিন্তু অনুসঙ্গ হিসেবে এসে হাজির হয়।

মামা প্রশ্ন করে, ঢাকা শহর তোমার কেমন লাগছে? সোহেল বলে, এখানে তো দেখছি লন্ডনের চেয়েও বেশি হাইরাইজ! মামা বলেন, ‘শুনে ভালো লাগছে, আমার ছাত্র-বয়সের লন্ডন এখনও বদলায়নি। আমরা পশ্চিমা শহরগুলোর ভালোটা পাইনি, খারাপটা পেয়েছি। হাইরাইজ, র‌্যাটরেস, দূষণ, যানজট...। ’ গল্পের ছলে বলা হলেও, খালেদের এ-পর্যবেক্ষণের রাজনৈতিক তাৎপর্য গুরুতর। এ যেন ‘ওরিয়েন্টালিস্ট’ চোখে দেখা তৃতীয় বিশ্ব।

‘পশ্চিম দেয় আর আমরা পাই। ’ এ-চোখ পশ্চিমের দায় অস্বীকার করে। একটু আগেই যেমন দেশ-ভাগের প্রসঙ্গ এসেছে, কিন্তু হিন্দু-মুসলিম রক্তারক্তিতে ইংল্যান্ডের দায় অনুল্লেখিত থেকেছে। কেন্দ্র-প্রান্তের দেশের সম্পর্ক অনেক জটিল ও ক্লেদাক্ত। মনে পড়বেই, অন্তর্যাত্রার নির্মাণ-খরচ বৃটিশ কাউন্সিল অনেকখানি বহন করেছে।

সোহেলের দেখা হয় সৎ-বোন রিনির সাথে। সালমা ওদেরকে বসতে দেয়, বলে ‘ও নিশ্চয় সোহেল। ’ তারপর রিনির দিকে ঘুরে বলে, ‘ও তোমার সেই ভাই, বিদেশে থাকে। ’ সালমা প্রস্তাব করে, চাইলে সোহেলরাও কাল তার সাথে এক গাড়িতে যেতে পারে। খালেদ বলে, ট্রেনে বুকিং দেয়া হয়ে গেছে...।

’ সোহেল এই উঁচু ফ্লাটের জানালা দিয়ে ঢাকা শহরকে দেখে। শিরিনও রিক্সায় বেরোয় শহর দেখতে। তার পুরনো স্কুল দেখে, স্টার সিনেমাহল এখনও আছে দেখে খুশি হয়। কিন্তু মুন সিনেমাহলের জায়গায় সুপারমার্কেট উঠেছে। সে এসব দেখে ও স্মৃতি হাতরায়।

বলধা গার্ডেনে তার বান্ধবী বিথীর সাথে দেখা করে। নিজের কাহিনী বলে। স্বামী ত্যাগ করে বিদেশ যাওয়া, ছেলের জন্য আর বিয়ে না করা ইত্যাদি। বিথী জিজ্ঞেস করে এতোকিছুর বিনিময়ে শিরিন কী পেয়েছে? শিরিন বলে, ‘স্বাধীনতা’। বাবার স্মৃতি-সান্নিধ্য থেকে ফিরে সোহেলের মন খারাপ।

তার ইচ্ছে কাল রিনিদের সাথেই সিলেট যাবে। কিন্তু শিরিন বলে ‘তোমার মামাই টিকিট কাটিয়া রাখছে’ এবং সে বুঝিয়ে দেয় যে সালমাদের সাথে এক গাড়িতে যেতে অনিচ্ছুক। তখন ছেলে বলে, ‘তোমার ইচ্ছাই সব!’ খালেদ বোন ও ভাগ্নেকে ট্রেনে উঠিয়ে দেন। শহরের ইট-পাথর পেরিয়ে আদিগন্ত সবুজ বাংলাদেশ দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। সোহেল নিবিষ্টভাবে দেখতে ও ভাবতে থাকে: ‘ক্লাসের বন্ধুরা বাংলাদেশ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে আমি সবসময় বিব্রত বোধ করেছি।

বাংলাদেশ আমার কাছে একটা পোস্টকার্ডের বেশি কিছু ছিল না। অনেকটা বাবার মতো, যিনি আমার কাছে একটা ফ্রেমে বাঁধা ছবি মাত্র। এখন সেই পোস্টকার্ডটি জীবন্ত হয়ে উঠেছে। সবুজ দিগন্ত নিয়ত বদলে যাচ্ছে...’ সোহেলে এ দেখা একার নয়। শেকড় সন্ধানী সোহেলের চোখ যেন পশ্চিমের চোখ হয়ে যায়।

এদেশের বহুরূপতা পশ্চিমের দর্শকদের জন্য উন্মোচিত হয়। এঁকেবেঁকে সবুজ পাহাড় বেয়ে ট্রেন চা-বাগান পেরিয়ে ছুটে চলে... শিরিন ভাবে: ‘রফিকের কাছ থেকে আমি সোহেলরে বহু দূরে সরাইয়া আনছি। কিন্তু আইজ মনে হয়...রফিক মরে গিয়ে উল্টা আমার আর সোহেলের মধ্যে নতুন এক দেয়াল তুলে দিয়েছে। ’ আর সোহেল ভাবে: ‘কেন মা আমাকে বাবার কাছ থেকে দূরে রেখেছিল? আমি বুঝি মা কেন নিজেকে দূরে রেখেছিল...কিন্তু আমাকে কেন? ...আজ সত্যিই মার উপর রাগ হচ্ছে। ’ শিরিনের ননদ নাজমা স্টেশনে এসে তাদের নিয়ে যায়এই যাওয়া সিলেটের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে যাওয়া।

রফিকের বাড়িতে যখন তারা পৌঁছায় তখন মিলাদ চলছে। দাদার সাথে সোহেলের মোলাকাত হয়, যিনি আশা করেন সোহেল একদিন ফিরে এসে বংশের প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখবে। মাওলানা তখন বলছেন, ‘দীনের নবী মদিনায় হিজরতে যান, জন্মভূমির পানে নবী বারে বারে ফিরে চান। ’ এভাবে শেকড়ে ফেরার তাগাদা প্রতীকায়িত হয়ে বার বার ফিরে আসে। সোহেলের ফুপু সালমা ও রিনির সাথে শিরিনের পরিচয় করিয়ে দেন।

দাদা সোহেলের সাথে কোলাকুলি করেন। বলেন, তোমার বয়সে তোমার বাবা ঠিক তোমার মতো ছিল। বিকেলে দাদা নাতি সোহেলকে নিয়ে রফিকের কবর জিয়ারত করেন। তারপর বিকেলের আলোয় দাদা নাতিকে জিজ্ঞেস করেন বৃটিশরা ধর্মকর্ম করে কিনা, চার্চে যাওয়ার টাইম পায় কিনা। বলে, আমি তো বৃটিশ টাইমে চা-বাগানের ম্যানেজার ছিলাম।

তখন প্রতি রবিবার তারা চার্চে যেতো। বৃটিশদের ডিসিপ্লিন নিয়ে তিনি মুগ্ধতা প্রকাশ করেন। নাতিকে নিয়ে বৃটিশদের পুরনো কবরস্থান দেখান। তার মতে ‘তারা [বৃটিশরা] এখানে এসেছিল ভাগ্যান্বেষণে। ’ এ ভিন্ন অন্য কোনো ভাষ্য পাওয়া যায় না।

ভাগ্য অন্বেষণের সাথে সাম্রাজ্যবাদ, ক্ষমতার কী সম্পর্ক তা এই সিনেমায় আমরা দেখি না। নয়া উদারনৈতিক এই কালে পশ্চিমের সাথে আমাদের সম্পর্কও অনুচ্চারিত পুরো সিনেমায়। রাতে সবাই একসাথে খেতে বসে। দাদা বলেন, কোই জানি পড়ছিলাম লাইফ ডিভাইডস আস, ডেথ ব্রিংস আস টুগেদার। কিন্তু সোহেলের ফুফা বলেন, ‘কথাটা সবসময় ঠিক নয় বাবা।

অনেকসময় মৃত্যু আত্মীয়স্বজনের মধ্যে বিরোধও ডেকে আনে। ’ নাজমা বিরক্ত হয় স্বামীকে বলেন, ‘কি সব অলুক্ষণে কথা, থামলাইন!’ দাদা বলেন, আনফরচুনেটলি ইকবাল ইজ নট টোটালি রং। আশা করি আমার মৃত্যু তোমাদের মধ্যে আরও বিভেদ ডেকে আনবে না। ’ সবাই মুখ তুলে তাকায়। সোহেল সালাদ চায়।

ফুফা ইকবাল আগে থেকেই ক্লাবে মদ খেয়ে টলোমলো ছিলেন, সালাদ দিতে গিয়ে পানিভর্তি গ্লাস ফেলে দেয়। নাজমা ক্ষেপে ওঠে, ‘বদ্ধ মাতাল!’ নাজমাকে লক্ষ করেই তার স্বামী ইকবাল বলে, ‘আমি মাতাল হতে পারি কিন্তু অসৎ নই’। নাজমা ও তার স্বামীর মধ্যে ঝসড়া প্রকট হয়। নাজমা বলে, রফিক তোমার ভাই হলে তুমি আজ এসব কথা বলতে না। ইকবালও তাচ্ছিল্য করে বলে, রফিকের জন্য তোমার আজ এতো ভালোবাসা।

রফিক যখন বেঁচে ছিল তখন কোথায় ছিল তোমার এই ভালোবাসা? তুমি তো এটাই চাইছিলে। পরিবারের সংকটের দিকগুলোও উন্মোচিত হয়। বৃহৎ পরিবারের জটিল সম্পর্কসূত্র সোহেলের কাছে পরিষ্কার হতে থাকে। রাতে উরিয়া শ্রমিকরা গান করে। আর সোহেল ল্যাপটপে বসে লেখে: ‘বাবা তুমি কি আমাকে শুনতে পাচ্ছো? আমি তোমাকে অনুভব করতে শুরু করেছি।

কেন তুমি চলে যাবার পরে তোমাকে অনুভব করছি?’ রাতের ট্রেনে সোহেল ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।