আজ একটা স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে লিখব। বাংলাদেশে দেখা কোন পুরনো দৃশ্য আজ আবার নতুন করে আপনাদের সামনে তুলে ধরা আর বিবেককে একটু নাড়া দেবার জন্য আজ আমার এই লেখা। হয়তো ভাবতে পারেন কাদের নিয়ে লিখব?কে সেই দুইজন?তারা আর কেউ নয়,আপনার অতি পরিচিত এক শ্রেনির মানুষ। যারা প্রতিদিন আপনাকে তাদের তিনচাকার বাহনে করে পৌছিয়ে দেয় আপনার গন্তব্যে। হ্যা,আপনি ঠিক ধরেছে।
তারা “রিকশাওয়ালা”। তবে আজ আমি যে দু’জন রিকশাওয়ালা নিয়ে বলব তারা আর দশ জনের মত নয়। এরা আমাদের মত স্বাভাবিক নয়। জীবিকার তাগিদে এদের এই পথ ধরতে হয়েছে। ভাবতে পারিনি এক দিনে এই রকম দুটি নির্মম বাস্তবের ঘটনা করুন চিত্র দেখতে হবে।
সকালে পারিবারিক কাজে টাকা পাঠানোর জন্য কাকরাইলের এস.আলম পরিবহনে গিয়েছিলাম। টাকা পাঠিয়ে যখন ফিরছি তখন দুপুর ২.০০টা বাজে। আমার বাসা শাহজাহানপুর। তাই কাকরাইল থেকে শাহজাহানপুর আসার জন্য রিকশা খুজছিলাম। কিন্তু কোন রিক্সা যেতে চাচ্ছিল না।
তবে এটা কোন নতুন ব্যপার না। কারন শাহজাহানপুর বা খিলগাও কোন রিক্সা সহজে আসতেও চায় না। অনেক্ষন দাঁড়িয়ে ছিলাম। কোন রিক্সা ওয়ালা যেতে চাচ্ছে না। অনেক ক্লান্ত লাগছিল।
হঠাত একটা রিক্সাওয়ালা আমাকে দূর থেকে ইশারায় ডাকল। আমি তার কাছে গিয়ে বললাম “শাহজাহানপুর যাবেন?”রিক্সাওয়ালা কিছুই বলল না,শুধু ইশারা করে বোঝালো সে বলতে ও শুনতে পারে না। আমার মন তখন ছলকে উঠলো। যে মানুষ বলতে ও শুনতে পারে না সে কি করে রিক্সা চালায়?আমি তাকে ইশারায় রাস্তা দেখিয়ে রিক্সায় উঠে পড়লাম আর তাকে লক্ষ্য করতে লাগলাম। সে কোন হর্ন শুনতে পায় না।
বারবার পেছনে সামনে দেখে রিক্সাচালায়। আমি কাকরাইল থেকে থেকে শাহজাহানপুর আসার পথে তিনবার সে গাড়ির সাথে বারি খেয়েছে। এইটুকে সময়ে যে এতবার দুর্ঘটনা করতে গিয়ে বেচে গেছে সে রিক্সা কি করে চালায়। আমি তার বয়স লক্ষ্য করলাম। বয়স আনুমানিক ২৩-২৪ হবে।
জীবনের ঝুকি নিয়ে সে কি করে রিক্সা চালায়?বারবার রাস্তার মোরে গিয়ে তাকে পথ দেখিয়ে দিতে হয়। কারন সে জানেনে আমি কোথায় যাব,শুধু বুঝতে পারে আমাকে তার পৌছে দিতে হবে। শাহজাহানপুর যখন আমি আসলাম তখন তাকে কিছু ভাড়া বেশি দেই। সে আমাকে ইশারায় বোঝায় আর কিছু টাকা বেশি দিতে। সকাল থেকে সে খায়নি।
কেউ তার রিক্সায় উঠেনা। আমিই তার রিক্সায় প্রথম উঠেছি। আমার মনটায় মোচড় দিয়ে উঠল। আমি তাকে কিছু বলতে পারিনি। শুধু পকেটের অবশিস্ট টাকা গুলো দিয়ে দিতে পেরেছি।
আর তার বিনিময়ে তার মুখে আমি যে সুখের ছাপ দেখেছি তা দিয়ে আমার বিবেককে আমি কিছুটা সান্তনা দিলাম। কিন্তু এভাবে সে কতদিন চলবে?যে রিক্সায় শুধু বসে থাকতে আমি ভয় পাচ্ছিলাম সে রিক্সা এই বাক ও শ্রবন প্রতিবন্ধি ব্যক্তি কি করে চালায়। কতদিন সে চালাতে পারবে। আমার বিবেককে এই প্রশ্ন বার বার আঘাত করছে। আমরা কি পারিনা এদের জন্য কিছু করতে?
বিকেল ৫.০০টা।
একটা বিশেষ কাজে চকবাজার যাব। শাহজাহানপুর থেকে রিক্সা ঠিক করছি। কেউ যেতে চাচ্ছিল না। অনেক রিক্সার মাঝে একজন তার মুখটা গামছা দিয়ে ঢেকে রেখেছে। নাকের নিচ থেকে গলা পর্যন্ত পুরটা গামছে পেচানো।
আমি তাকে চকবাজার যাবে কিনা তা জিজ্জেস করলাম। সে আমাকে অস্পস্ট ভাষায় কি যেন বলল। আমি বুঝলাম না,তাকে আবার জিজ্জেস করলাম। সে এবার তার গামছাটা সরাল কথা বলার জন্য। কিন্তু এরপর আমি যা দেখলাম তা যে কোন হরর ফিল্ম এর ভৌতিক কোন চরিত্রকে নির্দিধায় হার মানাবে।
তার মুখের নিচের অংশটা মানে নাকের নিচের অংশটা নেই বললেই চলে। শুধু আছে বলতে কয়েকটা দাত যা নাকের নিচে লাগনো বলা চলে। মুখ বলতে কোন অংশ তার নেই। গলনালির অংশটা সুস্পস্ট। আমি দেখে থমকে গেলাম।
সোজা ভাবে সে তাকাতে পারে না। বয়স খুব বেশি না। আনুমানিক ১৭-১৮ হবে। আমি তাকে চকবাজার যাবার কথা জিজ্জাসা করলে সে যেতে রাজি হয়। রিক্সায় উঠলাম।
কিন্তু আমার মন তার রিক্সায় বসতে চাইছে না। বিবেক বলছে,এইরকম একজন মানুষ এত কষ্ট করবে আর আমি সেই আরাম উপভোগ করবো?লোকটির কথা বলতে অনেক কষ্ট হয়। বেশিরভাগ ইশারায় বুঝায়। সে শিশু একাডেমি পর্যন্ত গিয়েছিল। তারপর বলল সে আর পারছে না চালাতে।
আমিও নেমে গেলাম পুরো ভাড়া দিয়ে। তাকে অনুমতি নিয়ে জিজ্জাসা করলাম কিভাবে হয়েছে এ রকম। কিন্তু সে যা বলল তার বেশির ভাগ আমি বুঝতে পারি নি। শুধু এতটুকু বুঝতে পেরেছি কোন কাজ করার সময় এসিড যাতিয় কিছু থেকে এ রকম হয়েছে। আমাকে নামিয়ে লোকটি রাস্তার পাশের চায়ের দোকান থেকে পানি খাচ্ছিল।
সে পানি খাবার দৃশ্য যে দেখেছে সে তা কোন দিন ভুলতে পারবে না। আমার চোখ এই দৃশ্য সহ্য করতে পারছিল না। আমি ওখান থেকে চলে গেলাম। কিন্তু আমার বিবেক আমাকে মুক্তি দিচ্ছে না।
এই মানুষগুলোর ভবিষ্যত কি?কি হবে তাদের পরিনতি?এদের জন্য কি আমরা কিছুই করতে পারিনা?আমি পারিনি।
কারন আমার সে ক্ষমতা নেই। কিন্তু কেউই কি পারে না?জীবিকার তাগিদে শুধু ঠিক মত অন্ন যোগাতে যে মানুষ গুলো তাদের জীবন মায়া ত্যাগ করে এই পথ বেছে নিয়েছে আমরা তাদের জন্য কি করতে পেরেছি?একবার সেইসব মানুষগুলোর দিকে ভালো করে চেয়ে দেখুন। তাহলে বুঝতে পারবেন তারা কি পরিমান অসহায়। আজ আমাদের দেশে বড় বড় মাল্টি স্টোরেড বিল্ডিং হচ্ছে। কিন্তু এইসব অসহায় প্রতিবন্ধিদের পাশে দারানোর মত কেউ নেই।
প্রশ্ন রইল সমাজের উচু স্তরের সেই মানুষদের কাছে,কি করেছে তারা এইসব অসহায়ের জন্য?শুধু নিজের ভোগের জন্য ব্যয় করে কি লাভ?সরকার আমাদের জন্য ছায়া স্বরুপ। সরকার আমাদের অবশ্যই সাহায্য করবে। কিন্তু এই ছায়ার নিচের মানুষ গুলো একে অন্যর জন্য কি কিছুই করতে পারেনা?রাস্তায় যখন হাটবেন তখন একটাবার মুখতুলে আপনার আশে পাশে তাকিয়ে দেখুন,এ রকম হাজারো ঘটনা আপনার চোখে পরবে। একটাবার বিবেককে প্রশ্ন করুন আমরা কি করছি?হয়তোবা আমার এই কথাগুলো সমাজের সেই সব উচুস্তরের মানুষের কানে পৌছবে না। কিন্তু আপনাদের মাঝে কি কেউ নেই যে এই কথাগুলো তাদের কানে পৌছে দেবে?একটা বার চেষ্টা করে দেখুন।
কিছু করে দেখানোর চেষ্টা করুন। আপনার বিবেককে কাজে লাগান। তাকে আর ঘুম পাড়িয়ে রাখবেন না। তাকে জেগে তুলুন।
আমার এই লেখা যদি আপনাদের মাঝে একফোটা আলোড়ন তুলতে পারে তাহলেই আমার স্বার্থকতা।
সকলকে ধন্যবাদ।
মিজানুর রহমান।
ই-মেইলঃ
ওয়েবসাইটঃ www.helenclub.webs.com
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।