তুমি মুক্ত মানুষ, তুমি ওখানে বসে আছ কি করতে- চলে এসো আমার দিকে। সত্যি কাহিনী।
আমার যাবার সময় হলো। দাও বিদায়।
তার সাথে আমার পরিচয় স্কুলে।
তার বাড়ি পেরিয়ে কয়েকটি বাড়ি পরই আমাদের বাড়ি। স্কুলের আগে কখনোই তার সাথে আমার কথা হয়নি। পাশাপাশি বাড়ি হওয়াতে আমি প্রায়ই তাকে বাড়ি পৌঁছে দিতাম। বয়স্করা বলেন “ তুমি যদি কাউকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দাও, তবে বুঝায় যে তুমি সত্যই তাকে পছন্দ কর”। ভাল কথা।
কে জানত যে সেটাই সত্য ছিলো। একটা সময় পর্যন্ত আমি তাকে বাড়ি পৌঁছে দিতাম শুধু এমনিতেই। আমি তাকে পছন্দ করতে শুরু করি টেন এ উঠার পর। সে আমার সাথে অন্য আর দশজনের মতো ব্যবহার করতো না। সে আমার প্রতি ছিল অনেক বেশী সহৃদয়।
অন্যরাও আমার সাথে কথা বলত কিন্তু তা শুধু “তুমি এতো চুপচাপ কেন? “তোমার নোটটা কি একটু কপি করতে পারি? এ জাতীয় কথাবার্তা। কিছু মেয়ে ছিলো যারা আমাকে নিয়ে চুপিচুপি কথা বলতো। তারা মনে করতো আমি হয়ত বিষয়টা জানি না, কিন্তু আমি জানতাম। আমার সঠিক মনে নেই, আমাদের মধ্যে কে সর্বপ্রথম কথা বলা শুরু করেছিলো। যাতে আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব শুরু হয়েছিলো।
আমি শুধু খুশি যে আমরা বন্ধু ছিলাম। আমি তার সাথে যেকোন বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারতাম। আমি তার সাথে এমনকি সেক্স’ নিয়েও (তাকে নিয়ে আমার স্বপ্ন দেখার) কথাও বলেছি। এটা সত্যিকার অর্থে কোন স্বপ্ন ছিলো না। এটা ছিলো কল্পনা।
সে এতে কিছু মনে করেনি, রাগও করেনি। সে শুধু এটা শুনে হেসেছিল। তারপর আমরা অন্য প্রসঙ্গে চলে যাই।
আমি তাকে ভালবাসি, এটা প্রথমবার বুঝতে পারি যখন আমরা স্কুল থেকে পিকনিকে যাই। আমি পরিকল্পনা করি সেখানে পৌছার আমি তাকে সবকিছু খুলে বলে জানতে চাইব সে আমার প্রেমিকা হবে কি না।
কিন্তু এমনটা ঘটে নি। আরেকটা ছেলেও থাকে পছন্দ করতো আর আমি এতটাই ভীতু ছিলাম যে কিছু বলতে পারি নি।
আমি সারাক্ষণ যারপনাই নির্বোধের মতোই সেখানে ছিলাম। আমি দেখলাম কিভাবে সে ছেলেটা তার সাথে কথা বলছে, ঘুরছে। আর শুধু দেখেই গেলাম।
সে ছেলেটা সারাক্ষণই তার সাথে সাথে ঘুরছে। যখনই আমি তাদের একসাথে দেখতাম, আমার শরীরে যেন আগুন লাগতো আবার একই সাথে বরফের মতো কঠিন শীতল হয়ে যেত। বরফের মতো শীতল কঠিন এবং আগুনের মতো রাগান্বিত। সকালবেলা আমার এক বন্ধু তার ছবি তুলেছিলো কারন আমি তার ছবি তুলতে ভয় পাচ্ছিলাম।
প্রতিরাত্রে ঘুমুতে যাবার আগে আমি ছবিটা একবার করে দেখতাম আর চিন্তা করতাম ঐ দিন সময়ে যদি একটু সাহস করতাম, তাহলে মনে জীবনটা অন্য রকম হতে পারত।
আমার দুচোখ বেয়ে কান্না আসতো তারপর শুয়ে পরতাম।
দুপুরে আমি ছাড়া সবাই মিলে খাচ্ছিল। সবাই মনে করেছিলো হয়ত আমার শরীর খারাপ। আমি তাদেরকে বলেছিলাম যে আমার ক্ষিদে নেই আমি খাব না। এটি সত্যি! আবার অসত্যও!
আমি দেখেছিলাম আমার প্রিয়তমা আর সে ছেলেটা খাবার টেবিলে পাশাপাশি বসা এবং আমি সেটা দেখতে চাই নি।
আমার প্রিয়তমা আমাকে প্রশ্ন করেছিলো সে আমার জন্য প্লেটে করে খাবার বেড়ে দেবে কিনা। অবশ্যই! কেন নয়? আমি বলতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু আমি বললাম ‘না লাগবে না। আর তাতে আমি খুশিই হয়েছিলাম। সে নিজে থেকেও তো আমার জন্য খাবার নিতে পারতো।
তার জন্য আমাকে জিজ্ঞেস করারতো দরকার ছিলো না।
কিন্তু আমার চরম আঘাত লেগেছিলো যখন বিকেলে আমরা সাইট দেখতে বের হলাম। দেখলাম আবার ওরা একসাথে। আমরা বিকেলে নাস্তার জন্য একটা বিশাল বিল্ডিং এ গিয়েছিলাম। আমার কাছে মনে হয়েছিলো ওটা একটা শপিং মল।
কিন্তু ওটা শপিং মল ছিলো না। এখনও চিন্তা করলে ওটাকে আমার কাছে শপিং মলই মনে হয়। কিন্তু আমি নিশ্চিত নই।
সবাই মিলে স্যান্ডউইচ খাচ্ছিল। আমি ক্ষুধার্ত ছিলাম কিন্তু লাইনটা বেশ অনেকটা লম্বা ছিলো।
তাই আমি বসে অপেক্ষা করছিলাম। আমার প্রিয়তমা আর তার সেই তথাকথিত বন্ধু আমার পাশের টেবিলে বসেছিলো। সে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, কেন আমি খাচ্ছি না। আমার একবার মনে হলো বলি আমার ক্ষিদে নেই। সে আমার ক্যামেরা দেখতে চাইলো।
আমি ক্যামেরাটা তার হাতে দিলাম। সে আমার কাছে জানতে চাইলো সে যদি ক্যামেরাটা দিয়ে ছবি তুলতে চায় তবে কিভাবে তুলবে। কিন্তু আমি নিজেইতো জানি না, আমিতো একটাও তুলি নি। সে কিভাবে যেন বের করে ফেললো কিভাবে ছবি তুলতে হয়। সে আমার ছবি তুলতে চাইলো কিন্তু আমি তার কাছ থেকে ক্যামেরাটা কেড়ে নিলাম।
নাস্তার পরে টিচাররা বললেন আমাদের বীচে গিয়ে সামুদ্রিক প্রাণী, উদ্ভিদ ইত্যাদির নমুনা সংগ্রহ করতে হবে। আমরা ইচ্ছে করলে গ্রুপ আকারে করতে পারি অথবা একা একাও করতে পারি। আমার খুব ইচ্ছে করছিলো সে আর আমি দুজন মিলে একটি গ্রুপে থেকে জেলি ফিস, স্টার ফিস সংগ্রহ করি। কিন্তু আমি বলার আগেই সেই ছেলেটি তার হাত ধরে টান দিয়ে তার সাথে গ্রুপ করতে বলে। আমার মেজাজটা একেবারেই খারাপ হয়ে যায়।
আমি কারো সাথে কোন কথা না বলে একা একাই সামনে হাঁটতে থাকি। কেউ জানেনি তখন আমার চোখ বেয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছিল। আমি আবিস্কার করলাম আমি কাঁদছি। হঠাৎ টের পেলাম কেউ একজন নিঃশব্দে আমার পেছন পেছন আসছে। চোখ মুছে পেছনে তাকিয়ে দেখি সে।
আমার এত বেশী আনন্দ হচ্ছিলো। জীবনে এত বেশী আনন্দিত আমি আর কখনো হইনি। কখন যে সে সবাইকে ফেলে আমার পেছনে আসে দাঁড়িয়েছিলো। এখনও মাঝে মাঝে স্বার্থপরের মতো ইচ্ছে করে সে যদি এভাবেই আর একটিবার সবকিছু পেছনে ফেলে আমার পাশে আসে দাঁড়াত। জানি এখন তাকে টিচার আর ব্যাচমেইট নয়, অনেক বেশিকিছু পেছনে ফেলে আসতে হবে।
যা তার জন্য সম্পূর্ণরূপে অসম্ভব।
যাই হোক আমার আনন্দ বেশিক্ষন স্থায়ী হয়নি। কি কারণে জানি সবাইকে হোটেলে ফেরার নির্দেশ দেন টিচাররা। আর আমরা সবাই হোটেলে চলে আসি। তখন আমি আবিস্কার করি যে বিশাল বিল্ডিং এ আমরা বিকেলে নাস্তা করতে এসেছিলাম সেটা হোটেল এবং এখানেই আমাদের রাত কাটাতে হবে।
আমি আমার বন্ধুকে নিয়ে আমাদের রুমে চলে যাই। রুমে ব্যাগ রেখে বের হই তার রুমটা কোথায় জানার জন্য। রুম থেকে বের হয়েই দেখি সে লিফটের কাছে করিডোরে দাড়িয়ে আছে। আমি তার কাছে যাব বলে এগুচ্ছি, এমন সময় কোথা থেকে সে ছেলেটি এসে হাজির হয়। অগত্যা ঐ সময়ে তার সাথে আর কোন কথা হয়নি।
রাত্রে খাবার টেবিলে সে আমার পাশে এসে বসে। নিজেকে ধন্যবাদ দেই আগে খাবার টেবিলে এসে বসার জন্য। কারন সে আগে এসে বসলে কখনোই আমি তার পাশে বসার সাহস পেতাম না। খাবার টেবিলে বসেই সে তাড়াহুড়া করে বলে “রাত্রে ঘুমুতে যাবার আগে অবশ্যই আমার সাথে কথা বলবে। এটা জরুরী।
আমি প্রথমে বিশ্বাস করতে পারি নাই, আমি কি শুনেছি। আমি এবার স্মরণ করার চেষ্টা করলাম। হ্যাঁ আমি এটাই শুনেছি। আমার পেট দিয়ে আর খাবার ঢুকে না। সবকিছু কিরকম জানি হাওয়ায় ভাসতে থাকে।
আমি নিজেও। পুরো খাবার সময়ে সে আর কি কি বলেছে, আর কে কে খাবার টেবিলে ছিলো আজ আর কিছুই মনে নেই। সেই ছেলেটি এসেছিলো কি না। কিছুই না। শুধু মনে আছে সে আমার সামনে বসতে বসতে বলেছিলো “রাত্রে ঘুমুতে যাবার আগে অবশ্যই আমার সাথে কথা বলবে।
এটা জরুরী।
আমি খাওয়া শেষ করে লিফটের পাশে করিডোরে এসে দাড়াই। প্রথম কয়েকজন লিফটে উঠার পর আমাকে উঠতে বললেও উঠিনা। তারপর অপেক্ষা। তারপর সে এসে আমার সাথে লিফটে উঠে।
আমরা লিফট থেকে নেমে করিডোরে দাড়াই। সে কিছুক্ষন চুপ করে থেকে প্রশ্ন করে তুমি কি আমাকে কিছু বলতে চাও? ছোট্ট একটা প্রশ্ন। কিন্তু আমার কাছে মনে হচ্ছিল নাগাসাকি শহরে অ্যাটম বোমা ফেলতে পারব কিনা? অথবা আমি তৃতীয় আরেকটা বিশ্ব যুদ্ধ শুরু করতে চাচ্ছি কিনা? মনে মনে ভাবছিলাম, আমি সাহস করে বলে দেব? হোক না সারা দুনিয়ার মানুষ বিরক্ত। কিন্তু আমি মাথা নিচু করে চুপ। এবার সে সরাসরি প্রশ্ন করে তুমি কি আমাকে ভালোবাসো? এবার মনে হলো আমি জলোচ্ছ্বাসের স্রোতে একদম তলিয়ে গেছি।
হাবুডুবু খাচ্ছি। সাঁতরাতে পারছি না। আমি শুধু মাথা উপর-নিচে করছি। ভাগ্যিস মাথা উপর-নিচে করার অর্থ হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ। হ্যাঁগো আমি তোমাকে ভালবাসি।
ধন্যবাদ সেই অজানা মানুষটিকে যে এই সাইন ল্যাংগুয়েজটি আবিস্কার করেছিল। লক্ষ্য করি আমি কাঁপছি। সে শুধু বলে আমিও। ছোট্ট একটা উত্তর। কিন্তু আমার কাছে পরম আরাধ্য।
যে উত্তরটার মধ্যে নির্ভর করেছিল আমার পুরোটা পৃথিবী। এবার আসি। বলে সে চলে যায়।
আমার তখন মনে হয়েছিলো ঐ মুহূর্তটা কেন কয়েক হাজার বছর স্থায়ী হলো না। কেন আনন্দের মুহূর্তগুলি এতো অল্প সময় স্থায়ী হয়।
সকালবেলা সবার চিৎকার চ্যাঁচামেচিতে ঘুম ভাঙ্গে। ঘুম থেকে উঠে দেখি সবাই রেডি হয়ে গাড়িতে বসে আছে। শুধু আমি বাকি। করিডোর থেকে রুমে যাবার পর সারারাত আমার একফোঁটাও ঘুম হয়নি। শুধু স্বপ্ন বুনেছি।
কত রকমের, কত ধরনের স্বপ্ন। হাজার হাজার স্বপ্ন, লক্ষ লক্ষ স্বপ্ন, কোটি কোটি স্বপ্ন। হয়ত সকালবেলাই একটু ঘুমিয়েছিলাম।
পর্ব-১
চলবে
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।