অনিকেত
বিড়াল বলছে মাছ খাবো না!
অনিকেত চক্রবর্তী
বিধানসভায় প্রেস গ্যালারিতে বসা দলমতনির্বিশেষে সব মিডিয়ার প্রতিনিধিরাই সেদিন হেসে ফেলেছিলেন তৃণমূল পরিষদীয় দলনেতা পার্থ চ্যাটার্জির কাণ্ড দেখে।
হয়েছিলো কী, ওইদিন বিধানসভার অধিবেশনের মধ্যেই মঙ্গলকোটের পরিস্থিতি নিয়ে বিশেষ আলোচনা হচ্ছিল। সবার বক্তব্য শেষে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ভাষণ দিচ্ছিলেন। মঙ্গলকোটে গিয়ে কারা কারা অবরোধের মুখে পড়েছিলেন, সেই বিবরণ দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মঙ্গলকোট সংক্রান্ত অন্য একটি বিষয় নিয়ে তাঁর ভাষণে আলোকপাত শুরু করতেই আচমকা নিজের আসনে দাঁড়িয়ে পড়েন পার্থ চ্যাটার্জি। মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলতে থাকেন, ‘কই, আমার নামটাতো বললেন না! আরে আমিও তো মঙ্গলকোটে গিয়ে অবরোধের মুখে পড়েছিলাম!’ মুখ্যমন্ত্রী কিন্তু পার্থ চ্যাটার্জির সেই তথ্য মেনে নিয়েই বলেছিলেন, ‘আপনার নাম বলিনি তো কী হয়েছে, ঠিকই আপনিও অবরোধে পড়েছিলেন.....।
’ কিন্তু তৃণমূল পরিষদীয় দলনেতা তাতে শান্ত না হয়ে বলে উঠলেন, ‘না হবে না! আমার নাম যখন আপনি আপনার ভাষণে বললেন না, তাহলে আমরা কেউ সভায় থাকবো না......। ’ তারপরই তৃণমূলের বিধায়কদের নিয়ে তিনি বিধানসভার অধিবেশন থেকে বেরিয়ে গেলেন আলোচনার মাঝপথেই!
এই যে, তাঁর নাম কেন মুখ্যমন্ত্রী বললেন না, সেই অজুহাত দেখিয়ে বিধানসভার অধিবেশন কক্ষ থেকে তৃণমূল দলনেতার বেরিয়ে যাওয়া — এটা দেখেই দলমতনির্বিশেষে উপস্থিত সব মিডিয়া প্রতিনিধিই হেসে ফেলেছিলেন! ‘এই হচ্ছে তৃণমূল! এরা নাকি সরকার চালাবে.....’ বিবিধ এমন মন্তব্যের সমাহারে সেদিন বিধানসভার অলিন্দে ঠাট্টা মশকরাও চললো!
আসলে, যাই হোক না কেন, বিধানসভায় সেদিন মঙ্গলকোট নিয়ে ওয়াকআউট করতেই হবে বলে তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জি নির্দেশ দিয়েছিলেন পার্থ চ্যাটার্জিকে। কেননা, আগেরদিনই মঙ্গলকোটে গিয়ে কংগ্রেসী বিধায়করা বেশি প্রচার পেয়ে গিয়েছেন। তাই তৃণমূলের বিধায়কদের উপর নির্দেশ ছিলো কিছু করে দেখানোর! কিন্তু আলোচনা পর্বে সেই সুযোগ পাচ্ছিলেন না তৃণমূলীরা। এমনকি কংগ্রেসী বিধায়করাও মন দিয়ে শুনছিলেন সবার ভাষণ।
অতঃপর কী আর করা! মুখ্যমন্ত্রী যেই নাম নিলেন না পার্থ চ্যাটার্জির, অমনি তাকেই অজুহাত করে কিছু করে দেখানো তৃণমূলের!
ঘটনাটা ছোট হলেও, আসলে তৃণমূল দলটা যে কত দায়িত্বজ্ঞানহীন, তার প্রমাণ এটা। এই ঘটনা ১৬ই জুলাইয়ের। আর ঠিক পাঁচদিন বাদেই তৃণমূল ধর্মতলায় ২১শে জুলাই তাঁদের বাৎসরিক সমাবেশ করলো এবং তাতে মমতা ব্যানার্জি যে ভাষণ-টাষণ শোনালেন, তা প্রচার করে মিডিয়া এখন বলতে শুরু করেছে, মমতার মধ্যেও পরিবর্তন হয়েছে! ....তিনি দায়িত্বশীল ও পরিণত হয়ে উঠেছেন....কর্মীদের ভদ্র ও বিনয়ী হতে বলেছেন...গণতন্ত্র মানার কথা বলেছেন..... অবরোধ বন্ধ ইত্যাদি পরিহার করার কথা বলে দক্ষ প্রশাসক হিসাবে প্রমাণ দিচ্ছেন.....ইত্যাদি ইত্যাদি। যা দেখে, পড়ে ও শুনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখার একটি মন্তব্য অনেকের মনে পড়তে পারে। তিনি লিখেছিলেন, ‘‘বিবাহের প্রথম রাত্রে যে রাগিনীতে বংশীধ্বনি হয়, সেই রাগিনী চিরদিনের জন্য নহে।
’’
কিন্তু প্রশ্ন হলো, এটাই কি প্রথম রাত্রি? এর আগেও কি বহুবার এমন প্রথম রাত্রি আসেনি? এমন ভাবে বাজেনি বংশীধ্বনি? কোনও বারেই তা এমনকি এক-দুই বছরও স্থায়ী হয়নি ঠিকই। কিন্তু বিভিন্ন সময় ফের নতুন করেই বংশীধ্বনির পুরানো রাগ বাজিয়ে এটাই প্রথম রাত্রি বলে বোঝানোর চেষ্টা কি হয়নি? যেমন আরেকবার নতুন করে হলো এবার ২১শে জুলাইয়ের সমাবেশের পর।
একদম গোড়ায় ফিরে যাওয়া যাক। ১৯৯৭ সালের ২৩শে ডিসেম্বর। তৃণমূল কংগ্রেসের ব্যানারে মমতার প্রথম জনসভা।
সেই ‘প্রথম’-এর পর আনন্দবাজার লিখেছিল, ‘....বেলা ১১টায় হাজরা মোড়ের সমাবেশে সমর্থক যুবরা রক্ত দিয়ে লিখে ফেললেন নেত্রীর বিজয়-স্লোগান। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে এলেও শতশত মানুষ নেত্রীর বাড়িতে অপেক্ষা করেন গভীর আগ্রহে। হাজরা রোডের সমাবেশে মমতাকে দেখতে না পেয়ে যাঁরা হতাশ হয়েছেন, তাঁরা অনেকেই উঁকি দিয়ে গিয়েছেন হরিশ চট্টোপাধ্যায় স্ট্রিটের বাড়িতে। ’ কিন্তু তিন-চার মাস যেতে না যেতেই বংশীধ্বনি উধাও! ১৯৯৮ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি আনন্দবাজার লিখেছিলো, ‘.....এরাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেস দল পুরোদস্তুর একটি সার্কাসে পরিণত হয়েছে। চরম বিশৃঙ্খলা আর মাৎস্যন্যায়ের মধ্য দিয়ে চলা এই সংগঠনে সবাই রাজা।
নতুন দল গঠন করে বাংলার অগ্নিকন্যা সেখানে যে অবাধ গণতন্ত্র কায়েম করেছেন, শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, ভূভারতে তার কোনও নজির নেই। ’
১৯৯৮ সালের মে মাসে ফের বংশীধ্বনি। লোকসভার ভোট। তৃণমূলও ভোটে। বি জে পি-র সঙ্গে জোট বেঁধে।
আনন্দবাজার মমতার হয়ে লিখতে গিয়ে এমন দাবি করলো যে, তাঁর ছেঁড়া পার্সে সাড়ে সাতচল্লিশ টাকা থাকে। তা সম্বল করেই তিনি রাজ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন সর্বত্র। ভোট হয়ে গেল। তৃণমূল জিতল ৭টি আসনে। কিন্তু মমতা কেন্দ্রের সরকারে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় বংশীধ্বনি ফের বেসুরো।
আনন্দবাজার লিখলো, ‘সরকারে যাওয়ার দায়িত্ব নেব না অথচ বাইরে থেকে সরকারকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করবো, এমন অবস্থান দ্বিচারিতা ছাড়া কিছু নয়। ’ মিডিয়ার মমতাপ্রেমীদের কাছে মমতা তখন ফের শুধুই ‘পটুয়াপাড়ার কন্যা’ হিসাবে প্রচারিত। ১৯৯৯ সালের মে মাসে ধর্মতলায় লাগাতার অবস্থানে বসলেন মমতা। আনন্দবাজার তখন মমতাকে তাঁদের লেখায় তুলোধনা করছে। ১৬ দিনের মাথায় ২৯শে মে মমতা ‘আচমকা’ অবস্থান তুলে নিলেন।
দেখা গেল, সেইদিন পর্যন্ত যাঁকে ‘পটুয়াপাড়ার দায়িত্বজ্ঞানহীন কন্যা’ বলে লিখেছে আনন্দবাজার, তারাই ৩০শে মে ‘মমতা পরিণত জননেত্রী হইলেন’ বলে ফের বংশীধ্বনি শুরু করলো। ১৯৯৯ সালের অক্টোবরে লোকসভা ভোট অবধি চললো সেই বাঁশীর সুর। ওই ভোটে জিতে মমতা ব্যানার্জি যখন কেন্দ্রের এন ডি এ সরকারে রেলমন্ত্রী হলেন, তখন আনন্দবাজার গোষ্ঠীর ‘দেশ’ পত্রিকায় বংশীধ্বনি আরো বাড়িয়ে লেখা হয়েছিল, ‘‘...মমতাই বোধহয় কেন্দ্রীয় সরকারের ইতিহাসে প্রথম কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, যিনি তাঁর প্রাপ্য বাঙলোয় থাকেন না, সরকারের দেওয়া লালবাতির গাড়ি ব্যবহার করেন না...। ’’ এই ধ্বনি চলতেই থাকলো। ২০০০ সালের জুন মাসে প্রথমে পাঁশকুড়া লোকসভা উপনির্বাচন ও পরে কলকাতা কর্পোরেশনের ভোটে জিতে তৃণমূলের হয়ে বাঁশির জোর আরো বাড়লো মিডিয়ায়।
এমনকি পাঁশকুড়া লাইনে খুনখারাবি লুঠতরাজ-এর সন্ত্রাস চালাচ্ছিল যে তৃণমূল নেতা-কর্মীরা মেদিনীপুরে, তাদের কাউকে ‘ক্ষুদিরাম’, কাউকে ‘মাস্টারদা’ বিশেষণে ভূষিত করতেও হাত কাঁপল না বংশীবাদক আনন্দবাজারের। ২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে সি আই আই-এর সভায় গিয়ে মমতা ব্যানার্জি বলে এলেন, তিনি কোনও বন্ধ বা ধর্মঘট করতে দেবেন না। প্রচুর তালি জুটল। রেলমন্ত্রীকে রাজ্যের ‘ভাবী মুখ্যমন্ত্রী’ আখ্যা দিয়ে আনন্দবাজার লিখল, ‘মমতা পরিণত ও দায়িত্বশীল প্রশাসকের প্রমাণ দিলেন। ’ ২০০১ সালের বিধানসভা ভোটে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধে তৃণমূল তাদের ইশ্তেহারে মিছিল মিটিঙে নিয়ন্ত্রণের চার-পাঁচ দফা আচরণবিধি ঘোষণা করার পর মিডিয়া ফের বংশীধ্বনি শোনালো।
২০০১ সালের সেই বিধানসভার ভোটের ৯ দিন আগে ২রা মে বড়বাজারে নির্বাচনী জনসভায় মমতা বলেই দিলেন, ক্ষমতায় এলে বন্ধ-ধর্মঘট নিষিদ্ধ করবো! ব্যস। আর পায় কে! ভোটের ঠিক আগের দিন আনন্দবাজার প্রথম পাতায় আট কলম জুড়ে বড় বড় শিরোনাম করলো, ‘মমতার হাতে মহাকরণের চাবি!’ ঠিক যেমন এবার ২১শে জুলাইয়ের পর আনন্দবাজার লিখেছে, ‘জনজোয়ারে মহাকরণের বার্তা’! কিন্তু ২০০১ সালের সেই ভোটে তৃণমূল ধরাশায়ী হওয়ার পর কী হলো? বংশীধ্বনি বেসুরো হয়ে গেল। যে আনন্দবাজার মমতা ব্যানার্জির আচরণবিধির প্রশংসায় মত্ত হয়ে তাঁকে ‘ভাবী মুখ্যমন্ত্রী’ ‘দক্ষ প্রশাসক’ ‘পরিণত নেত্রী’ বলে চেঁচিয়ে এসেছে, তারাই সেই ভোটের ফলাফল বের হওয়ার পর মমতা ব্যানার্জির পরাজয়কে ব্যাখ্যা করে ১৬ই মে ’০১ তারিখে লিখেছিল, ‘‘...নির্বাচনী ফলাফল প্রকাশিত হইবার দীর্ঘ একদিন পরে বিরোধী জোটের সর্বাধিনায়িকা প্রকাশিত হইলেন। প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা কেন তিনি অপ্রকাশ ছিলেন, তাহার ব্যাখ্যা হিসাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানাইয়াছেন, তিনি বিভিন্ন কেন্দ্র হইতে ভোটের খবর সংগ্রহে ব্যস্ত ছিলেন। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
তৃণমূল কংগ্রেসের নেত্রী সর্বদা সমাজে প্রচলিত আচরণবিধি মানিয়া চলেন, এমন অপবাদ তাঁহার সম্পর্কে কেহ দিতে পারিবে না। তাঁহার রাজনীতির ভাব ও ভাষা চিরকালই স্বকীয়। ’’
সেই ‘স্বকীয় ভাব ও ভাষা’ দিয়েই এবার ২১শে জুলাইয়ের সমাবেশে তৃণমূল নেত্রী ও রেলমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি দলীয় কর্মীদের ভদ্র ও বিনয়ী হওয়ার আহ্বানসহ একগুচ্ছ আচরণবিধি ঘোষণা করেছেন। তা শুনে আনন্দবাজার সহ অনেক মিডিয়া ফের ‘প্রথম রাত্রি’র বংশীধ্বনি পুরানো রাগেই শুরু করেছে নতুন করে বাজাতে। যেমন, ২১শে জুলাই-এর সমাবেশের পরদিন খবর লিখতে গিয়ে আনন্দবাজার লিখেছে, ‘তিনি এখন সত্যিই পরিবর্তন পন্থী।
’ ‘সত্যিই’ কেন শব্দটা জুড়তে হলো কে জানে ! আনন্দবাজার লিখেছে, ‘তিনি কিন্তু একান্তভাবেই প্রশাসক। পুরনো ভাবমূর্তির ধ্বংসাত্মক ও ভাঙচুরের আন্দোলনের বিরোধী নেত্রী নন। ’ লেখার ভাঁজে ওরা ফের গুঁজে দিয়েছে সেই ‘ভাবী মুখ্যমন্ত্রী’ বিশেষণও, যা ২০০১ সালের বিধানসভার ভোটের আগে এই আনন্দবাজারই লিখেছিল। যা ২০০০ সালে সি আই আই-র সভায় মমতা ব্যানার্জি বন্ধ বিরোধী বক্তব্য রাখার পরও লিখেছিল আনন্দবাজার। কেন মমতা ব্যানার্জি তাঁর কর্মীদের ‘ভদ্র ও বিনয়ী’ হতে বলেছেন, তারও ব্যাখ্যা হাজির করে আনন্দবাজার লিখেছে, ‘সি পি এমের কর্মী সমর্থকদের জরিমানা করা, সি পি এমের সংগঠনের বোর্ড নামিয়ে অফিস দখল করা, হুমকি ও মারধর — এসব আচরণ বন্ধ করতে তাই রাশ ধরতে চেয়েছেন নিজেই।
’ তারপর আনন্দবাজার লিখেছে, ‘নেত্রীর নির্দেশ তৃণমূল স্তরে যায় কীনা, দেখার সেটাই। ’
তা যে যাওয়ার নয়, সেটা তৃণমূল কর্মীরাই আনন্দবাজারকে দেখিয়ে দিয়েছেন নির্দেশ জারির ২৪ ঘণ্টার মধ্যে। কেমন ভদ্র ও বিনয়ী হচ্ছে ওরা ? আনন্দবাজার পত্রিকাই ২৩শে জুলাই ছয়-এর পাতায় আগেরদিন সংসদে তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ ব্যানার্জি কীভাবে স্বর চড়িয়েছিলেন সেই খবর পরিবেশন করতে গিয়ে লিখেছে, ‘‘পরিস্থিতি সামলাতে ডেপুটি স্পিকার ইন্দর সিংহ নামধারী বলেন, ‘আপনি শান্ত হোন। আপনার নামটি (কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়) তো কত সুন্দর! সংসদের মর্যাদা রক্ষা করুন। ’ এহেন সতর্কবার্তায় থামানো যায়নি সাংসদকে।
’’ একইদিনে আনন্দবাজার ওই ছয়ের পাতায় ভদ্র ও বিনয়ী হতে ‘মমতার নির্দেশ’ কীভাবে ‘পালন করতে শুরু করেছেন তৃণমূল নেতারা’ তা জানিয়ে হাড়োয়ায় ও নানুরে গিয়ে তৃণমূলের নেতা-সাংসদ-মন্ত্রীরা যে কোনও অপ্রীতিকর আচরণ করেননি, বরং ‘বিনয়ী’ হয়েছেন, তা তুলে ধরেছে। কিন্তু আসলে যে এসব তৃণমূলের লোক দেখানো গুণ, সেটাই আনন্দবাজারের ওই পাতায় একেবারে পাশেই আরেকটি খবরে ধরা পড়ে গিয়েছে! হুগলীর পুড়শুড়ার ওই খবরটি আনন্দবাজার বোধহয় বুঝতে পারেনি যে মমতার নির্দেশ অমান্য করারই ইঙ্গিতবাহী। তাতে বলা হয়েছে, প্রয়াত এক সি পি আই (এম) নেতার উদ্যোগে পার্টির শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে যে শহীদ বেদী হয়েছিল পুরশুড়ায় শ্যামপুরে, সেই শহীদবেদী দখল করে, রঙ পালটে, তৃণমূলের পতাকা দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছে তৃণমূলীরা।
কেমন ‘ভদ্র ও বিনয়ী’ হচ্ছেন তৃণমূলীরা, তার প্রমাণ এভাবেই মিলেছে ‘মমতার নির্দেশ’-এর ২৪ ঘণ্টা পার না হতেই। ‘ভদ্র ও বিনয়ী’ হওয়ার নির্দেশ শুনে সমাবেশ থেকে ফেরার পথে তৃণমূলীরা কাঁথিতে কালীনগরে সি পি আই (এম) অফিস ভাঙচুর করে ‘গণতন্ত্র’ দেখিয়েছে।
বরানগরের টবিন রোডে সি পি আই (এম)-র এক অবস্থান কর্মসূচী ভাঙচুর করে ‘গণতন্ত্র’ দেখিয়েছে।
আসলে বিড়ালকে মাছ না ছোঁয়ার উপদেশ দিলেও যা হয়, তাই হচ্ছে ! জুনের ১০ তারিখ থেকে ধরলে দখলদারির পর গত দেড় মাসেই শুধু খেজুরিতে তৃণমূলীরা চারশোরও বেশি মানুষের হয় হাত, নয় পা, নয়তো শরীরের কোন না কোনও অংশে মেরে কার্যত ঘরে বসিয়ে দিয়েছে। তারা কেউ থানায় অভিযোগ জানাতে পারেননি কারণ, গেলে এলাকাতে থাকতেই পারবেন না! এগারোশো’র বেশি বাড়ি লুঠ অথবা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পাঁচ হাজারের বেশি ঘরছাড়া। তমলুক ও হলদিয়ায় ত্রাণ শিবিরে ছ’শোরও বেশি মানুষ।
নন্দীগ্রাম ও খেজুরি মিলিয়ে ১৫০০ মামলা। খুন, ধর্ষণ, ঘর পোড়ানোর মামলা করা হয়েছে ৮৬ জনের বিরুদ্ধে। পার্টির জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর স্তরের সদস্য থেকে শুরু করে স্থানীয় লোকাল কমিটির সদস্য — এমন একজনও ওই এলাকায় বাদ নেই যার বিরুদ্ধে ওইসব সাজানো অভিযোগের মিথ্যা মামলা হয়নি। নির্বাচিত পঞ্চায়েত সদস্যদের পদত্যাগ করানো হচ্ছে! কেড়ে নেওয়া হচ্ছে গরিব মানুষের জমি।
এটা একটা জায়গা উদাহরণ।
এমন বিড়ালকে বলা হচ্ছে ভদ্র হও, বিনয়ী হও, গণতন্ত্র মানো! বিড়ালকে যিনি উপদেশ দিচ্ছেন, তিনি? শুধু গত তিনটে বছরেই মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বে কীভাবে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় কোথাও দিনের পর দিন অবরোধ, কোথাও অবস্থান, কখনও কখনও ঘনঘন বন্ধ, এমনকি হিংসাশ্রয়ী প্ররোচনায় রাজ্যের প্রায় সব উন্নয়নমূলক কাজ আটকে দেওয়া হয়েছে, তা তৃণমূল কর্মীরাও দেখেছেন। শুধু দেখেছেন নয়, ওই ধ্বংসাত্মক ভূমিকায় অংশও নিয়েছেন। যে কাজে বেকারদের কর্মসংস্থান যুক্ত ছিল, যে কাজ রাজ্যের এগিয়ে যাওয়া যুক্ত ছিলো, যে কাজে গরিবের উপকার সম্পৃক্ত ছিল, সেইসব কাজে বন্ধ অবরোধ হামলা করেই বন্ধ করেছেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রীর আবাসন ঘিরে রাস্তা অবরোধেও নেমেছিলেন তিনি। বারবার আলোচনায় ডাকা সত্ত্বেও বয়কট করেছেন সেই ডাক।
বিড়ালের সেই মা এখন তার ছানাদের বলছে মাছ না খেতে!
পুনশ্চ: এত অবধি পড়ে কারো কারো মনে হতে পারে, তাহলে কি বন্ধ ধর্মঘট-এই অস্ত্রগুলির বিরুদ্ধে আমরা? না। মোটেও না। এক্ষেত্রে তৃণমূল নেত্রীর সঙ্গে তফাৎ বোঝাতে একদা মমতা ঘনিষ্ঠ কলকাতার তৎকালীন মেয়র সুব্রত মুখার্জির ২০০১ সালের ২৩শে সেপ্টেম্বরের একটি মন্তব্য শোনানো যেতে পারে। টালিনালার সংস্কারের কাজে বাধা দিয়েছিলেন মমতা। অবস্থানে বসেছিলেন।
সুব্রত মুখার্জিও যাতে মমতার সঙ্গী হন, তা চাইছিলেন তিনি। সুব্রত মুখার্জি সেই সময় মমতাকে কটাক্ষ করে বলেছিলেন, টালিনালায় জবরদখল সরাতে গেলে উনি এমন করছেন! কই, গেল সপ্তাহে যে সংগঠিত ক্ষেত্রে কয়েক লক্ষ মানুষ কাজ হারালেন, তখন তো তাঁর চোখের জল দেখিনি! তখন কোথায় ছিলেন?
মন্তব্য অতএব নিস্প্রয়োজন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।