আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাইশে শ্রাবণ স্মরণেঃ বিদেশীর রবীন্দ্রসঙ্গীত /ক রু ণা ম য় গো স্বা মী



বাইশে শ্রাবণ স্মরণে বিদেশীর রবীন্দ্রসঙ্গীত /ক রু ণা ম য় গো স্বা মী ======================================== বিদেশীদের কাছ থেকে যে মতামত পাওয়া যায়, তাতে দেখা যায় যে, তাঁরা সকল শ্রেণীর বাংলা গানের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের গানকে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন। এমন কয়েকজন জাপানি, ফরাসি ও ইংরেজের সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে গেল বছর দশেক ধরে, যাঁরা নিয়মিত বাংলা গান শোনেন। এঁরা নানা পেশার মানুষ, শিক্ষাদীক্ষার বিষয়ে এঁরা ভিন্ন ভিন্ন। মিল এক জায়গায়, তাঁরা গান শুনতে ভালোবাসেন। সারা পৃথিবীর গান শোনেন তাঁরা।

সব গানের সঙ্গে তাঁরা বাংলা গানও শোনেন। তাঁরা তাঁদের গীতসংগ্রহের যে পরিচয় আমাকে দিয়ে থাকেন, তাতে বলতে পারি যে, বাংলা গানের সংগ্রহে তাঁরা অনেক বাঙালি সংগ্রাহকের চেয়ে দু'পা এগিয়ে। এর মধ্যে সবাই যে বাংলা জানেন তা নয়। জাপানি যে কয়েকজন বঙ্গসঙ্গীতপ্রেমীর সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে তাঁরা বাংলাভাষা জানেন, বাংলা সাহিত্যেরও কিছু খোঁজ রাখেন। বিদেশীদের বেলায়, বিশেষ করে যে কয়েকজন জাপানির সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়েছে তাঁদের কাছে বাংলা সাহিত্য বলতে রবীন্দ্রিনাথের বাইরে কিছু নয়।

তাঁরা বাংলা শিখেছেন শান্তিনিকেতনে, যা পড়েছেন সবই রবীন্দ্রনাথ। যাঁরা শান্তিনিকেতনে এসে বাংলা শেখেন নি, এমন কি ভারতেও আসেন নি, বাংলাও শেখেন নি, বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্পর্কে যা জানার সবই ইংরেজিতে বা ফরাসিতে তাঁরাও এক বাক্যে রবীন্দ্রনাথের কথাই বলেন। রবীন্দ্রনাথের বিশ্বব্যাপী খ্যাতির জন্যেই এমন হয়ে থাকবে। অবশ্য একজন ফরাসি বঙ্গপ্রেমী আমাকে জানিয়েছিলেন অল্প বাংলা জানা বিদেশীদের অন্যরকম একটি সমস্যার কথাও। তাঁর বক্তব্য ছিল_ রবীন্দ্রনাথের বাইরে যে বাংলা সাহিত্য আছে তা আমি জানি।

কয়েকজন লেখকের লেখা আমি পড়তে চেষ্টা করেছি, যা কঠিন, এগোনো যায় না। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আমার সমস্যা হয় না। যেটুকু বাংলা জ্ঞান তাতেই কুলিয়ে উঠি, বুঝতেও পারি আমার মতো করে। এমন কথা অনেক বিদেশীর কাছে শোনা যায়। বুদ্ধদেব বসু এক জায়গায় মন্তব্য করেছিলেন যে, রবীন্দ্রনাথের প্রকাশরীতিতে যে প্রবল সরলতা, তা প্রতারক।

এই মন্তব্যের আলংকারিক সত্যতা সম্পর্কে একমত হওয়া যেতে পারে, তবে নবীন শিক্ষার্থীদের জন্যে রবীন্দ্রনাথের প্রকাশরীতি যেকোনো প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায় না, সে কথা স্বীকার করতেই হবে। খ্যাতির জন্যে, সহজবোধ্যতার জন্যে, বিশ্বভারতীর কল্যাণেও অনেকটা রবীন্দ্রনাথ বিদেশীদের কাছে আদরণীয় হয়ে ওঠেন। তাঁদের কাছেই শোনা যায়, রবীন্দ্রনাথের গান তাঁরা উপভোগ করেন। বাংলাজ্ঞান যাঁদের আছে তাঁরা তো সঙ্গীতকে গানের পাঠের সঙ্গে মিলিয়ে বুঝতে পারেন। অমূর্ত ও মূর্তে তফাত সেক্ষেত্রে অনেকটা ঘুচে যায়।

কিন্তু যারা বাংলা ভাষা বোঝেন না, তাঁদের কাছে বিমূর্তরূপে ধ্বনিত সঙ্গীত একটা অনুভব জাগিয়ে তোলে। এর ভেতর দিয়েও তাঁরা রবীন্দ্ররচনার মাধুর‌্যকে আস্বাদন করতে পারেন। আমার সঙ্গে একজন ফরাসি সঙ্গীত পিপাসুর যোগাযোগ আছে, যাঁর অনুধাবনকে আমি অত্যন্ত গুরুত্ব দেই। তিনি যে নতুন কথা আমাকে শোনান তা নয়, আমি বিষয়গুলো জানি, কিন্তু তাঁর কাছ থেকে যখন শুনি তখন একটা তুলনামূলক বোঝাবুঝির ভেতর দিয়ে অগ্রসর হতে পারি। সঙ্গীত সৌন্দর‌্যের পৃথক পরিম-লের এক অধিবাসীর পর‌্যবেক্ষণ অত্যন্ত মূল্যবান হয়ে ওঠে।

নীরদচন্দ্র চৌধুরীর একটি অভিমতের উল্লেখ করে তিনি জানান_ নীরদ সি চৌধুরী গির্জার উপাসনা সঙ্গীতের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে চমৎকার ভাষায় ও ভঙ্গিতে বলেন, আমি ইউরোপীয় কোনো সঙ্গীতালোচকের লেখায় এমন পড়িনি, গির্জায় উপস্থাপিত স্তবগান ধূপকাঠি থেকে বেরিয়ে আসা ধোঁয়ার মতো, কু-লী পাকিয়ে তা ধীরে ধীরে ওপরে উঠতে থাকে, অনেকটা ওপরে ওঠার পর কু-লীর পাক খুলে যায়, ধোঁয়ার রেখাগুলোও মিলিয়ে যায়, হালকা হতে হতে তারা ওপরে উঠতে থাকে। এরপর কোথায় যে সেসব মিলিয়ে যায়, তা আর কারো জানা থাকে না। একজন অপাশ্চাত্য বিদগ্ধ শ্রোতার এই প্রতিক্রিয়া একাধিক কারণে অত্যন্ত মুল্যবান। গির্জায় দীর্ঘকাল ধরে সম্মেলক রীতিতে স্তবগান গাওয়ার যে রীতি, তাতে বিশেষ করে সুরের মুভমেন্ট গড়ে তোলার যে ভঙ্গি তার সঙ্গে বাংলা গান বা ভারতে কোনো সঙ্গীতরীতিরই কোনো মিল নেই। উপস্থাপনার সে রীতিতে ঢেউয়ের আছড়ে পড়ার মতো একটা ঘটনা ঘটে।

স্তরে স্তরে বিন্যাসিত কণ্ঠমালা উন্নীত-নমিত রীতিতে ক্রমেই ওপরের দিকে উঠতে থাকে। তেমন উঠে যাওয়াকে ধূপের কু-লীকৃত ধোঁয়ার ওপরে ওঠার সঙ্গে তুলনা করাটা খুবই চমৎকার। অনেকগুলো কণ্ঠস্বর যখন ক্রমে ক্রমে ওপরের দিকে উঠতে থাকে এবং শেষ অবধি সুরের রেশ এমনি হয়ে দাঁড়ায় যে, ওপরে ওঠার চলনটি কোথায় যে অনুভব, নীরদ সি চৌধুরী তা নিজের দেশের গান থেকে অর্জন করতে পারেননি। সেখানকার উপাসনা সঙ্গীত ক্রমে ক্রমে ওপরে উঠে যাওয়ার অনুষঙ্গটি পাওয়া যায় না। আমরা যারা এই গান ছোটবেলা থেকেই শুনে ও গেয়ে আসছি তারা ব্যাপারটা তেমন করে বুঝতে পারি না।

আমরা গীতোপস্থাপনার এই রীতিতে পুরুষানুক্রমে এমনি অভ্যস্ত যে ধূপের কু-লীকৃত ধোঁয়ার সঙ্গে যখন এর তুলনা করা হয়, তখন উপমা রচনার ব্যঞ্জনায় চমকে উঠতে হয়। সত্যিই তো, অনন্তের উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত গান মাটির পৃথিবী থেকে উঠে অনন্তেই যেন মিলিয়ে যাচ্ছে। তবে এখানে একটি বিষয়ের প্রতি অত্যন্ত সতর্কভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে। কাউন্টার পয়েন্ট পদ্ধতিতে হার্মনি রচনা করে সম্মেলক রীতির আধুনিক পাশ্চাত্য উপাসনা সঙ্গীত যেভাবে একটি অসাধারণ ক্রমারোহ শৈলী রচনা করে, তার সঙ্গে নীরদ সি চৌধুরীর পরিচয় নিতান্তই অ্যাকাডেমিক, আগ্রহও অ্যাকাডেমিক, তবে তাঁর কাছে ব্যাপারটা যে এভাবে ধরা পড়েছে সে অত্যন্ত প্রেরণাদায়ক। তবে তার দীর্ঘ আত্মজীবনীর এক জায়গায় রবীন্দ্রনাথের গান সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি অসীমের অভিসারের কথা উল্লেখ করেছেন।

বলেছেন যে, রবীন্দ্রসঙ্গীত অসীমের অভিসারী, এ বিষয়টি কান পেতে তাঁর গান শুনলে বোঝা যায়। তিনি এখানে বক্তব্যের কথা বলছেন না, সঙ্গীতের কথা বলছেন। এই জায়গায়ও নীরদ সি চৌধুরীর সঙ্গে সহমর্মী বোধ করি। এবং এখানেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীত রচনার শ্রেষ্ঠত্বের মাত্রাটি উপলব্ধি করতে পারি। আমি বাংলা জানি না, ফলে গানের নিরিখে রবীন্দ্রনাথ কী বলতে চেয়েছেন তা জানি না, কিছু গানের ইংরেজি অনুবাদ আছে, গীতাঞ্জলির গানের অনুবাদ তো হাতের কাছেই রয়েছে, আমি পাঠ্য বিষয় হিসেবে সেসব পড়ি, কিন্তু গান শোনার সময় আমি ইংরেজি অনুবাদের সঙ্গে সেসব মিলিয়ে নিই না।

এমন চেষ্টা অর্থহীন। গান শোনো আর কথার অনুবাদ অনুসরণ করে যাও, এর কোনো মানে হয় না। এতে শোনাটাই মাটি হয়ে যায়। নীরদ সি চৌধুরী তাঁর সেই অসামান্য পর‌্যবেক্ষণে আমাদের উপাসনা সঙ্গীতের বেলায় যে ধরনের অনভূতিতে তাঁর প্রাণ সাড়া দেয় বলে বলেছেন, অর্থাৎ বোধশক্তি ক্রমে নিজেকে ওপরের দিকে টেনে ওঠায়, তারপর কোথায় যে উধাও হয়ে যায় তার নিশানা জানা থাকে না, আমিও তেমনি বোধ করি রবীন্দ্রনাথ শুনতে গিয়ে। এ রচনা এক রৈখিক, বহু রৈখিক সঙ্গীতের মতো মনকে টেনে তোলার ক্ষমতা এর নেই বলে পশ্চিমের অনেক শ্রোতা ও সমালোচক বলে থাকেন।

ঘটনা আসলে তেমন নয় বলে আমার মনে হয়েছে। অন্তত রবীন্দ্রসঙ্গীত যখন শুনি তখন তেমনি মনে হয় আমার। অন্য ধরনের বাংলা গান বা দক্ষিণ এশিয়ার অন্য অঞ্চলের গান শুনলে তেমন মনে হয় না। অন্যসব গান শুনলে মনে হয় যেন জগতেই আছি, কখনো একটু উঠি কখনো একটু নামি, তবে বসবার আসনটি জগতেই পাতা। কাশ্মির অঞ্চলের গান শুনেছি বেশকিছু, অসামান্য সব রচনা; পাঞ্জাব অঞ্চলের গানও, রাজস্থান অঞ্চলেরও।

এসব অঞ্চলের সুফি বা বৈষ্ণবীর মত প্রভাবিত গানের কথা বলি। এগুলোও এক ধরনের আর্ট সঙ। তবে একেবারে হাল আমলের বা গেল পঞ্চাশ বা পঁচাত্তর বছরকালে রূপ পেয়েছে, এমন যে বিশুদ্ধ আর্ট সঙ তাদের প্রতি আমরা বিদেশীরা মনোনিবেশ করতেই চাই না, মনোনিবেশ করেও প্রাণে কোনো সাড়া পাই না। সব গানই একরকম মনে হয়। মনে হয় মানুষকে খুশি করার জন্যে এসব গান রচনা করা হয়েছে, একেবারেই টিকিট-কাটতি রচনা, এর সঙ্গে সৌন্দর‌্য অন্বেষণের বা বিতরণের কোনো সম্পর্ক নেই।

সবই ফরমায়েসি রচনা। তবে খানিক আগে সুফি বা বৈষ্ণবীয় ভাবপ্রভাবিত গানের কথা বলেছিলাম, তার প্রসঙ্গেই ফিরে আসি। এইসব গানের মধ্যে আমরা প্রাচ্যের স্পন্দন অনুভব করি। প্রাচ্যের স্পন্দন বলতে বোঝাতে চাইছি যে, বৃহৎ কোনো ভাবের সঙ্গে এইসব গানের সম্পর্ক আছে বলে বোঝা যায়। আমরা ভাষা বুঝি না, কিন্তু সঙ্গীত সংগঠন ও উপস্থাপনের মূল যে আবেদন তা থেকে বুঝতে পারি।

তবে একই সঙ্গে একথা বুঝতে পারি যে, এই আবেদন আমাকে বা আমার মতো অনেক প্রাচ্যসঙ্গীতপ্রেমীকে মাটির পৃথিবী থেকে ধীরে ধীরে উপরে বা উপর থেকে উপরে টেনে তুলে নেয় না। এ শুধু ভারতীয় উপমহাদেশের গান বলে নয়, আমরা যখন ইরান, তুরস্ক বা সুদান অঞ্চলের গান শুনি তখনো আমাদের এমনি অনুভূতি হয়। ইরানি গানে একটা আশ্চর‌্য রকমের কম্পন সুরেলাভাবে ধ্বনিত হয়ে ওঠে। ভারতীয় সঙ্গীত শোনার আমাদের যে অভিজ্ঞতা তা থেকে বুঝতে পারি যে, ভারতীয় সঙ্গীতের ক্ষেত্রে বিশেষ করে, গমক, কম্পন বা এই ধরনের কৌশল যখন গায়করা কণ্ঠে প্রদর্শন করেন তখন প্রায়ই স্বপ্রক্ষেপণ সুরছুট হয়ে যায়। সুরে-বেসুরে এই কৌশলগুলো নিষ্পন্ন করা হয়ে থাকে।

সমগ্র উপস্থাপনার পরিসরে এসব হয়তো মানিয়ে যায়। কিন্তু পৃথক করে শুনলে সুরে-বেসুরের ব্যাপারটা ধরা পড়ে। তবে ইরানি গানে কম্পন চমৎকার করে সুরের রেখা ধরে এগোয়। তুর্কি গানে তালের ব্যাপারটা যেমন। তালে গানটি বসানো হয়েছে বলে মনে হয় না।

মনে হয় রচনাটি তালে বসানোই ছিল। তবে এসব গান শুনলেও ধীরে ধীরে আমি আমার ভেতর থেকে ওপরে উঠছি এমন মনে হয় না। সেই একই কথা মনে হয়_ মাটিতেই আছি, একটু হেলছি দুলছি বা চোখবুজে রয়েছি এই যা। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গান শুনলে নীরদ সি চৌধুরীর সেই বিখ্যাত উক্তি মনে পড়ে_ ধূপশলার কু-লীকৃত ধোঁয়া যেন উপর থেকে উপরে উঠছে, একসময় যেন মিলিয়ে যাচ্ছে অনন্ত আকাশে। বহু রৈখিক সঙ্গীতে একটি বিশিষ্ট ক্রমোত্থানের ঢঙে যা অর্জন করা সম্ভব, তা এক রৈখিক সঙ্গীতের ভারতবর্ষীয় উপস্থাপন কলার সীমায় কী করে সম্ভব হয় তা আমি বুঝতে পারি না।

তবে রবীন্দ্রনাথ তাঁর কম্পোজিশনের মর্মে অসীমের সঙ্গ কামনার বীজটি এমন করে রোপণ করে রেখেছেন যে, নিবিষ্ট শ্রোতাকে সেসব রচনা উপরে তুলে নেয়, শুনতে শুনতে মনে হয় যে, মাটির বন্ধন ছিন্ন হচ্ছে। আমার মনে হয় যে, হার্মনি থাকা ও হার্মনি না থাকার ব্যাপার পশ্চিমীদের মধ্যে একটা কুসংস্কারের মতো হয়ে গেছে। হার্মনাইজেশন না থাকলেই যে কোনো রচনা রূপকথার দৈত্যের মতো কাচের বোতলের আটকে থাকবে, সেখান থেকে মুক্ত বাতাসে বেরিয়ে আসতে পারবে না, সে একটা বাড়াবাড়ি। প্রশ্নটা হচ্ছে মহত্ত্ব নিয়ে। রচনা যদি মহৎ হয়, তাহলেই তার মধ্যে অসীমের সঙ্গ কামনার যে স্বপ্নটি জুড়ে থাকে তা কার‌্যত রূপ পায়।

প্রশ্নটি রেখার সামঞ্জস্যকরণ নয়, প্রশ্নটি হচ্ছে ভাবকে মূর্ত করার ব্যাপারে মহৎ দক্ষতা অর্জন করা। আমি ইচ্ছে করেই মহৎ বিশেষণটি প্রয়োগ করেছি। আমি নিজেও জানি না, মহৎ বলতে আমি কী বোঝাতে চাই। তবে এমনি বললে অনেকটা দ্বন্দ্ব মেটে যে, গানে মহত্ত্ব বলতে আমরা সুর রচনা ও প্রয়োগের ব্যাপারে সারাক্ষণ সুরে ডুবে থাকাকে বুঝব। কোনো সুরছুট উচ্ছ্বাস থাকবে না, সুরের রেখাকে কোনোক্রমেই অকারণে দীর্ঘ করা হবে না, এমন সংকল্প এখানে কাজ করতেই হবে, আর পুরো বিষয়টির ভেতর দিয়ে প্রকাশ পাবে রচয়িতার আত্মনিবেদনের ও আত্মকথনের একটি সদাজাগ্রত বাসনা।

সঙ্গীত রচনা ক্ষমতা প্রদর্শনের মঞ্চ নয়, ক্ষমতার তলোয়ারটি সারাক্ষণ খাপে ভরে রাখার সংগ্রাম মাত্র, এমন একটা বোধ কাজ না করলে, তা বড় মাপের বা অসীমের সঙ্গী হতে পারে না। সারাক্ষণ সুরে থাকা, শুধুই সুর এর বাইরে কিছু নয়, রবীন্দ্রনাথের এই বিরল সাফল্য আমাকে অত্যন্ত আপ্লুত করে। একটা ছোট্ট ফুল যেমন নিজের মতো করে তার সুষমাকে বিকশিত করে, রবীন্দ্রনাথের গানও তেমনি, অসীমের সৌন্দর‌্যবাগানে ফোটা এক একটি ছোট ফুল তার বিকশিত পূর্ণ সুষমার দ্বারাই সে অসীমের সঙ্গ পেয়ে যায়। সমগ্র রচনার ভেতরে এমন একটি বিনম্র অথচ প্রবল বেগ কাজ করে যে, তাকে টেনে রাখা যায় না, সে-ই টেনে তুলে নিয়ে যায়। ভারতবর্ষে প্রচলিত অর্থে গান হয়ে ওঠার যে ব্যাপারটি রয়েছে, যা অত্যন্ত মাটির কাছাকাছি হুটোপাটি খাওয়ার বিষয়, তেমনটি না হয়ে ওঠার ভেতর দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ভারতবর্ষের যাবতীয় কাজকে ছাড়িয়ে গেছেন।

তাঁর গান সারাক্ষণ সুরে রয়েছে, আকুলতার মধ্যে রয়েছে এবং এর দ্বারাই শ্রোতৃচিত্তকে আকুল করে তুলছে। এক রৈখিক রচনাও তার ব্যঞ্জনার দ্বারা বহু রেখার সামঞ্জস্যকে অতিক্রম করে যেতে পারে, এ ঘটনাটি রবীন্দ্রনাথের গান না শুনলে বোঝা যাবে না। আমার মনে হয় একটি অতিমাত্রায় অনুপ্রাণিত হৃদয় যখন অতি মাত্রায় পরিশীলিত প্রকাশকলার ভেতর দিয়ে আপন আকুতিকে প্রকাশিত করে, তখন তার মধ্যে আকাশ ও মাটি এসে মিশে যায়। ব্যাপারটিকে আপনারা কেমনভাবে বিচার করেন তা আমরা জানি না। রবীন্দ্রনাথের গানের ওপর কোনো নির্ভরযোগ্য ইংরেজি বই নেই।

আমি কোনো কিছু 'জেনে' বলছি না। সবই বলছি নিজের অনুধাবন থেকে। সত্যি হলে ভালো। বিদেশীরা এভাবে তাঁদের বক্তব্যকে ব্যাখ্যা করেন। আমরা তো ঐতিহ্যের সংস্কারে আবৃত।

বিদেশীরা যখন এর বাইরে থেকে নিজেদের বলবার কথাটি লিখে জানান, তখন মনে হয় কিছু না 'জেনে' শোনার ভেতর দিয়েই সম্ভবত সত্যিকার বোধে পৌঁছানো যায়। ------------------------------------------------------------------- দৈনিক সংবাদ সাময়িকী । ৬ আগষ্ট ২০০৯ প্রকাশিত

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।