বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
একটা সময় ছিল-যখন বিশ্বজুড়ে মানুষ ইস্টারদ্বীপের কথিত ‘রহস্যময়তা’ নিয়ে মেতে থাকত। এখন আর সেই ঘোর নেই! এখন কথিত ‘রহস্যময়তা’র ব্যাখ্যা গেছে বদলে, বদলে গেছে ইস্টার দ্বীপ সংক্রান্ত অতীতের দৃষ্টিভঙ্গিও। পরিবেশের ক্ষতি করলে তার পরিনাম কি ভয়ঙ্কর হতে পরে- ইস্টার দ্বীপের রাপানুই আদিবাসীরা সে শিক্ষাই আমাদের জন্য রেখে গেছে ।
আমরা যেন ইস্টার দ্বীপের মর্মান্তিক ইতিহাস পাঠ করে সর্তক হই ...
দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের লাভানির্মিত বৃক্ষশূন্য একটি আগ্নেয় দ্বীপ। আয়তন : ৬৪ বর্গমাইল। নাম ইস্টার দ্বীপ। ত্রিভূজ আকারের দ্বীপটির অবস্থান দক্ষিণ আমেরিকার চিলি উপকূলের ২৩০০ মাইল পশ্চিমে।
প্রশান্ত মহাসাগরে ইস্টার দ্বীপ
ইস্টার দ্বীপে সারা বছরই গরম থাকে।
আছড়ে পড়ে পাগলাটে বানিজ্য বায়ূ । দ্বীপটি এক সময় উদ্ভিদশূন্য হয়ে পড়েছিল। (কেন? সেটিই এই নিবন্ধের মূল আলোচ্য বিষয়)
এখন অবশ্য দ্বীপটিতে বিস্তর ঘাস, আলু, আখ, টারো নামে এক ধরনের শিকড়, তামাক আর ক্রান্তিয় ফল জন্মায়। দ্বীপটির পানির অন্যতম উৎস আগ্নেয় হ্রদের বৃষ্টিজল ।
ইস্টার দ্বীপটি সৃষ্ট হয়েছে আগ্নেয় শিলা দ্বারা ।
দ্বীপটির (মৃত) আগ্নেয়গিরির নাম রানো রারাকু। এখন অবশ্য জায়গাটি ঘাস রয়েছে। উপকূলে আছে আগ্নেয় গুহা। আর লাভার সুড়ঙ। সৈকতে আছে প্রবাল।
উত্তরপুবের বালিয়াড়িটি বালিময় । দ্বীপজুড়ে সামুদ্রিক পাখির অভয়ারণ্য।
ইস্টার দ্বীপের আকার ত্রিভূজের মতন। এককালে রাপানুইরা তাদের দ্বীপটিকে বলত, তে পিটো ও হেনুয়া; ... এর মানে-পৃথিবীর নাভি। স্প্যানিশ ভাষায় ইস্টার দ্বীপের নাম অবশ্য -ইসলা দে পাসকুয়া।
ইস্টারদ্বীপের আরেক নাম রাপানুই। রাপানুই। কেন? ইস্টার দ্বীপের অবস্থান তাহিতি দ্বীপের ২,৫০০মাইল দক্ষিণ পুবে । তো, উনিশ শতকে তাহিতি দ্বীপের এক পর্যটক নাকি ইস্টার দ্বীপে এসে বলেছিল: “বাহ্, এ তো দেখছি তাহিতি দ্বীপের রাপার মতন দেখতে। তবে ‘নুই’।
নুই মানে বড়। সেই থেকেই ইস্টার দ্বীপের আরেক নাম রাপানুই। দ্বীপবাসীরও ঐ নাম। কিন্তু, দ্বীপের নাম ইস্টার কেন হল?
বলছি।
১৭২২ সাল।
ইস্টার-এর দিন। দিনটি ছিল রোববার। দ্বীপটিতে একটি ওলন্দাজ (হল্যান্ড) জাহাজ ভিড়ল। নাবিক জ্যাকোব রোগগেভিন রাপানুই ঘুরে অবাক। উপকূল জুড়ে দেড় মাইল পর পর পাথরের মূর্তি ...পুরুষমুখ ...
রাপানুই ভাষায় মূর্তির নাম: মোয়াই।
মোয়াইগুলি প্ল্যাটফর্মের ওপর দাঁড়ানো । প্ল্যাটফর্মকে রাপানুই ভাষায় বলে: আহু।
ওলন্দাজ নাবিক জ্যাকোব রোগগেভিন রাপানুই দ্বীপে ১৭২২ সালের ইস্টার-এর দিন অবতরন করেছিলেন বলেই রাপানুই দ্বীপের আরেক নাম ইস্টার আইল্যান্ড। তখনও ইস্টার দ্বীপে কিছু রাপানুই বাস করত। এরা আসলে পলেনিশিয় ।
প্রশান্ত মহাসাগরের দক্ষিণ অংশের বিশাল জলঅঞ্চল নিয়ে ছড়ানো দ্বীপ ও দ্বীপবাসীকে পলিনেশিয়া বলে। অসুখ ও দাস ব্যবসা দ্বীপটির জনসংখ্যা কমিয়ে দিয়েছিল। ওলন্দাজ নাবিক জ্যাকোব রোগগেভিন এর সময়ে ইস্টার দ্বীপের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ২০০।
১৯৮৮ সালে চিলি সরকার দ্বীপটিতে নিজস্ব অধিকার প্রতিষ্ঠিত করে।
ইস্টার দ্বীপ পৃথিবীর সবচে বাসযোগ্য (পরিত্যক্ত নয়-এই অর্থে) বিচ্ছিন্ন দ্বীপ।
রহস্যময়ও বটে। কেন রহস্যময়? কেননা, ইস্টার দ্বীপজুড়ে বিশাল বিশাল সব পাথরের মনোলিথ মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। মনোলিথ মানে গোটা একটা পাথর চেঁছে তৈরি।
রহস্য এই। মোয়াইগুলি সব উপকূলে এবং মুখ সমুদ্রের দিকে ফেরানো ।
কেন? উত্তর মেলেনি। বরং ঘনীভূত হয়েছে রহস্য। কোনও কোনও মূর্তির মুখ অবশ্য দ্বীপের দিকে ফেরানো। মূর্তিগুলির কোনও কোনওটির উচ্চতা ১৪ ফুট ৬ ইঞ্চির মতন। ওজন? প্রায় ১৪ টন! সব মিলিয়ে ২৮৮ টি মূর্তি।
আরও প্রায় ৬০০টি। কেনও কোনওটি অসমাপ্ত ... কোনও কোনওটি ৩৩ ফুট। ৮০ টন। মোয়াই এর নিচে প্ল্যাটফর্ম আছে। সেই প্ল্যাটফর্ম কে বলা হত- আহু।
দ্বীপ ঘিরে দেড় মাইল পরপর ১৫০টি আহু আছে।
কারা বানাল ওসব ভারী মনোলিথ মূর্তি?
রহস্য এ জন্যই। তবে সে রহস্যের মিলেছে উত্তর।
পাথর বলতে আমরা আসলে ‘ঘনীভূত আগ্নেয় ছাই’ বুঝব। রাপানুইরাই ‘ঘনীভূত আগ্নেয় ছাই’ থেকে গড়েছিল সে সব মূর্তি।
তো, কারা এই রাপানুই?
এককালে ধারনা করা হত। রাপানুইরা দক্ষিণ আমেরিকার ইনকা সভ্যতা। তারাই সুদূর অতীতে জলপথে ইস্টার দ্বীপে এসেছিল-অথবা তারা সমুদ্রে হারিয়ে ফেলেছিল পথ। ইনকারা পেরুতে বড় বড় নগর তৈরি করেছে। তাদেরই এক শাখা ইস্টার দ্বীপে পৌঁছে ‘ঘনীভূত আগ্নেয় ছাই’ থেকে মনোলিথ মূর্তি তৈরি করেছে-এই তো স্বাভাবিক।
বর্তমানে এই ধারনা বাতিল হয়ে গেছে।
বর্তমানে প্রমাণ মিলেছে: রাপানুইরা ইনকা ছিল না। রাপানুইরা পলেনেশিয়। ডি এন এ পরীক্ষ করেই তবে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো গেছে। রাপানুইরা এসেছিল মারকোয়েসাস দ্বীপ থেকে।
দ্বীপটি প্রশান্ত মহাসাগরের দক্ষিণে- ইস্টার দ্বীপের পুবে।
তবে রাপানুইরা কবে ইস্টার দ্বীপে এল-তা নিয়ে বিতর্ক আছে। কারওকারও মতে তারা ১২০০ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ইস্টার দ্বীপে আসে। তবে এখন ধারনা করা হচ্ছে রাপানুইরা এসেছিল ৪০০ খ্রিস্টাব্দ। কার্বন ডেটিং পদ্ধতির মাধ্যমে ৩১৮ খ্রিস্টাব্দের কবরের সন্ধান মিলেছে ।
রাপানুইদের আগমনকালে দ্বীপটি বৃক্ষপূর্ন ছিল। সমুদ্রপাখি বিচরন করত। মাছ,পাখি উদ্ভিজ খাদ্যের কারণে উচ্চতর ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছিল। রাপানুইরা বলে ওদের পূর্বপুরুষের নাম হুটু মাতুয়া। মোয়াই এর আরাধনা সম্ভবত তার সময় থেকেই আরম্ভ হয়ে যায়।
সময়টা পুরাতাত্ত্বিকগন ৫০০ খ্রিস্টাব্দ বলে নির্ধারন করেছেন। বেশির ভাগ মোয়াই ও আহু ১০০ থেকে ১৬৫০ এর মধ্যে দাঁড় করানো হয়েছিল। কেন গড়েছিল? এর উত্তর আরেকটি প্রশ্নে নিহিত। আদিকালে মানুষ মূর্তি কেন গড়ত? মূলত ধর্মীয় উদ্দেশ্যেই।
মোয়াই নির্মানই রাপানুইদের পতনের কারণ হয়ে উঠেছিল!
আমি আগেই বলেছি রাপানুইরা ‘ঘনীভূত আগ্নেয় ছাই’ থেকে মোয়াই ও আহু তৈরি করত ।
রানো রারাকু তে ‘ঘনীভূত আগ্নেয় ছাই’ ছিল। রানো রারাকু থেকে মোয়াই উপকূলে নিয়ে যেতে কাঠের রোলার বা শ্লেজ তৈরি করতে হয়েছিল। যা ঠেলত ৫০ থেকে ১৫০ জন । রোলার তৈরি করতেই গাছ কাটতে হয়েছিল। আ তাতেই কয়েক শ বছরে ইস্টার দ্বীপের গাছপালা উজার হয়ে গিয়েছিল।
ব্যাপারটা রাপানুইরা লক্ষ করেনি। যে মূর্তি গড়তে বন উজার হয়ে যাচ্ছে। তা ছাড়া গাছ কেটে রাপানুইরা বাড়ি বানাতো। ক্যানৌ তৈরি করত। দ্বীপের গাছ ছিল অনেকটা চিলির ওয়াইন পাম গাছের মত।
চিলির ওয়াইন পাম গাছের ছবি। এ ধরনের গাছে পরিপূর্ন ছিল ইস্টার দ্বীপ। যখন রাপানুইরা ৪০০ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ইস্টার দ্বীপে গেল। চিলির ওয়াইন পাম সাধারনত ৮ ফুট উঁচু হয়। পরিধী ৬ ফুট।
কাজেই ক্যানৌ তৈরি করতে সুবিধে।
ক্যানৌ ...
তারপর যা হয়। দ্বীপের গাছ নিঃশেষ হয়ে গেলে দ্বীপের উপরিতলের মাটিও ক্ষয়ে যেতে থাকল দ্রুত। বাতাস উড়িয়ে নিল। খাদ্যে টান পড়ল।
ক্ষুধার্ত রাপানুইরা একে অন্যেকে আক্রমন করতে লাগল। মোয়াই মূর্তিগুলোও ধ্বংসলীলা থেকে রক্ষা পেল না। কেন? দেবতা উর্বরতা দান করেননি বলে। ক্রোধান্বিত রাপানুইরা মূর্তির চোখ চোখ উপড়ে ফেলল। সবচে ভয়ঙ্কর হল: ইস্টার দ্বীপজুড়েই মানুষের হাড়গোর পাওয়া গিয়েছে।
এ থেকে ধারনা করা হয়: রাপানুইরা পরাজিত রাপানুইদের খেয়ে ফেলত। এভাবে বনভূমি উজার হয়ে উদ্ভব হয়েছিল ক্যানিবালিজম এর । যে কারণে বলছিলাম: ইস্টার দ্বীপের রাপানুই-সংস্কৃতি: মানবজাতির জন্য অশনি সংকেত ...গাছ ছিল না বলে কাঠও ছিল না। কাজেই তারা ক্যানৌও তৈরি করতে পারেনি। পালাতে পারেনি।
রাপানুইরা এভাবেই ধ্বসে পড়ে। কেবলমাত্র নির্বিচারে গাছ কাটার কারণে! তখন আমি বলছিলাম যে: পরিবেশের ক্ষতি করলে তার পরিনাম কি দাঁড়ায় ইস্টার দ্বীপের আদিবাসীরা সে শিক্ষাই রেখে গেছে আমাদের জন্য। আমরা যেন ইস্টার দ্বীপের ইতিহাস পাঠ করে সর্তক হই ...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।