সব কিছুর মধ্যেই সুন্দর খুঁজে পেতে চেষ্টা করি............
নদীর সঙ্গে আমাদের নাড়ীর বাঁধনঃ
আমাদের তথা বাংলাদেশী বাংগালীদের বাঁচামরা নদী/ পানির সঙ্গে জড়িত। আমাদের কথা সাহিত্যে কৃষির প্রভাবের চেয়ে নদীর প্রভাব অনেক বেশি। বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলো নদীভিত্তিক। যেমন রবীন্দ্রনাথের "নৌকাডুবী", মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের "পদ্মানদীর মাঝি", তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের "হাসুলি বাঁকের উপকথা", সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর "কাঁদো নদী কাঁদো", অদ্বৈত মল্ল বর্মণের "তিতাশ একটি নদীর নাম", শহীদুল্লাহ কায়সারের "সারেং বৌ"। আরো অনেক আছে।
নদী আমাদের অর্থনীতি, কৃষিনীতি এমনকি রাজনীতি ও নিয়ন্ত্রণ করে। নদীর বুকে সমস্ত অর্থনৈতিক সূত্র নিহিত আছে। নদীর পাড়েই মানব সভ্যতা গড়ে উঠেছিল।
উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের অগ্নিগর্ভ মুহূর্তে বড়দরে সাথে আমরা ছোটরাও স্লোগান দিয়েছি- "তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা"। আমাদের সেই শ্লোগান হারিয়ে গেছে! হারিয়ে যাচ্ছে আমাদরে অহংকার পদ্মা-মেঘনা-যমুনাও!
ধান, চাল, ডাল, তেল, লবণ বিদেশ থেকে টাকা দিয়ে আমদানি করা যায়, কিন্তু পানি আমদানি করা যায় না।
নদীর স্রোতধারা কেনা যায় না। "তিতাশ একটি নদীর নাম" ও "কাঁদো নদী কাঁদো" উপন্যাসে দেখেছি, নদীতে চরা পড়লে, নাব্যতা হারালে, নদী তার দীপ্ত যৌবন হারালে, নদী তীরের মানুষেরা নিদারুন বিপর্যের মুখে পড়ে। তাদের জীবনে সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি, আমোদ উৎসব কিছুই থাকে না। কৃষক ফসল ফলাবে নদীর পানি দিয়ে, সৃষ্টিকূল বেঁচে থাকবে নদীর পানি পান করে, মাছতো নদীতেই পাওয়া যায়, মৎস্যজীবীরা নদীতেই বসবাস করে।
নদীমাতৃক দেশের গণতান্ত্রিক সরকার নদী সম্পর্কে তাদের সরকার পরিচালনার প্রারম্ভকালে সচেতন হয়েছে।
নদীর মত সর্বাংশে প্রাকৃতিক মূল্যবান সম্পদকে লোভী, দখলদার মানুষেরা দখল করে নিচ্ছে। কল-কারখানার মালিকেরা কারখানার বর্জ্য অবাধে নিক্ষেপ করছে নদীতে। এতে নদীর পানি দূষিত হয়ে পড়ছে। দখলদাররা প্রতিটি নদী পাড়ে উপনিবেশ গড়ে তুলেছে। তারা নদীর পাড় বানাতে বানাতে, ঘর-বাড়ি ভিটা স্থাপন করতে করতে নদীর বুকের ভেতর এগিয়ে গেছে।
এতে নদীর স্বাভাবিক স্রোতধারা হ্রাস পেয়ে ক্ষীণধারা সম্পন্ন হয়েছে। এর ক্ষতির প্রভাব কৃষি, বিদ্যুৎ, দৈনন্দিন পানি ব্যবহারের ওপর যেয়ে পড়ছে। পানির আরেক নাম জীবন, সেই জীবন নদী দখলের কারণে, নদীকে দূষিত করার কারণে বিপন্ন হবার উপক্রম হয়েছে।
টেলিভিশনের খবরে দেখেছি, ওয়াসা কর্তৃপক্ষ পর্যবেক্ষণ করে দেখেছেন যে, বুড়িগঙ্গা নদীর তলদেশ গভীরতা হারিয়েছে, নদির তলায় ১০ ফুট পরিমান পলিথিনস্তর জমেছে, তলায় ঘাস জন্ম নিয়েছে, নাব্যতা কমেছে, লবণাক্ততা বেড়েছে। নদীর প্রতি আমাদের দায়িত্বহীনতা, লোভী মনোবৃত্তি, দখলদারী দৃষ্টিভঙ্গি এর জন্য দায়ী।
হয়ত এমন একদিন আসবে যেদিন আমাদের নতুন প্রজন্মের সন্তানেরা আবু জাফর আর ফরিদা পারভীনের -"এই পদ্মা, এই মেঘনা, যমুনা সুরমা নদি তটে......আমার রাখাল মন গান গেয়ে যায়"-শুনে পদ্মা, মঘনা যমুনা নদি খুঁজেও পাবেনা! কবি নজরুলের- "পদ্মার ঢেউরে....... মোর শুণ্য হৃদয় পদ্ম নিয়ে যা যারে..."-শুনে পদ্মার ধুধু বালুচরে দাঁড়িয়ে একবুক দীর্ঘশ্বাস ছাড়বে!
১৯৭১ সালে পাক হানাদাররা নারীধর্ষণ করে ক্ষ্যান্ত হয়নি, নর-নারী হত্যা করে নদীতে নিক্ষেপ করেছে, তাতে নদীর পানি দূষিত হয়েছে। তারা নদী ও নারী দুটোই দখল করেছে। স্বাধীন দেশের মুনাফাখোর, লোভী চক্র নদী দখল করে দেশের অর্থনীতির মেরুদন্ড ভেঙে ফেলবার উপক্রম করেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খুব জোর দিয়ে বলেছেন যে, তুরাগ নদীর পাড়ে গড়ে ওঠা স্থাপনা অবশ্যই উচ্ছেদ করবেন। নদী দখল মুক্ত করবেন।
এই দৃঢ়তাব্যঞ্জকে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হোক, আমরা তা চাই। কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর কথা কোন প্রতিফলন বাস্তবে দেখছিনা!
একই সঙ্গে বলা দরকার যে, নদীগুলো সংস্কার করা জরুরি প্রয়োজন। খুব সহসা কোন সরকার পরিকল্পনা মাফিক নদী খননের বা ড্রেজিং এর কাজ হাতে নিয়েছেন, তা মনে পড়ে না। এরফলে অসংখ্য শাখা নদী, ছোট নদী, উপনদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে। তাতে দখলদাররা ক্রমশ নদীর ভেতরে যেয়ে অনায়াসে স্থাপনা গড়ে তুলছে।
এক শতাংশের দাম ৫ লাখ / ১০ লাখ-এই লোভে নদীর মধ্যে স্থল সীমানা বাড়িয়ে ফেলেছে।
বুড়িগংগাতো এখন সত্যিকারের বুড়ি হয়ে গিয়েছে। মাইকেল মধুসূদন দত্তের কপোতাক্ষ নদ নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। চাঁদপুরের ডাকাতিয়া নদীটির পানি বেগবানতা হারিয়েছে, নাব্যতা হ্রাস পেয়েছে। সিলেটের সুরমা-কুশিয়ারা, ফরিদপুরের মধুমতি এখন আর নদি নয়-মরা খাল! বরিশালের র্কীতনখোলা, ঝালকাঠীর সন্ধ্যা এবং সুগন্ধা, বরগুনার বিষখালী, পিরোজপুররে পায়রা, বলশ্বের নদী এখন নাব্যতা হারিয়ে খালে রুপান্তরতি হয়ছে।
সরকার যদি জরুরিভিত্তিতে নদীগুলো খনন না করে, সার্বিক সংস্কার না করে, আমরা খরা, বন্যা, প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাবো না। নদীর সঙ্গে আমাদের নাড়ীর বাঁধন। সেই বাঁধন ছিন্ন হলে আমাদের অস্তিত্ব বিপণ্য হতে বাধ্য। আসুন আমরা অন্তত যারযার অবস্থানে থেকে আমাদের নদী রক্ষার জন্য সাধ্যমত চেস্টা করি।
(আমার এই লেখাটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।