আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিশ্বের ধর্মীয় সংঘাত আদতে ইব্রাহিমের উত্তরাধিকারিত্বের লড়াই যেখানে অযথাই অন্য সবাই জড়িয়ে পড়েছে



ইতিহাস অদ্ভুত বৈপিরিত্বময় বর্ননা আমাদের সামনে নিয়ে আসে। আমাদের ধর্মীয় বিদ্বেষ এবং ধর্মীয় হানাহানি এবং পরস্পরকে ধর্মান্তরিত করবার প্রক্রিয়াগুলো অদ্ভুত সব বিশ্বাসের উপরে দাঁড়িয়ে। ইব্রাহিম, তার বৃদ্ধা এবং সন্তানধারণে অক্ষম স্ত্রীর অনুরোধে একজন দাসীর গর্ভে তার বংশধরের জন্ম দেন। দাসিপূত্র ইসমাইল এবং হাজেরাকে সন্তনসহ নির্বাসন দেন আরবের মরুভুমিতে। তৃষ্ণার্ত ইসমাইলের কষ্টে কাতর হাজেরা পানির খোঁজে যখন সাত বার দৌড়াচ্ছেন এ মাথা ও মাথা তখনই ইসমাইলের পায়ের আঘাতে মাটি ফেটে পানি বের হলো, পবিত্র জমজম কুপ।

তবে ইব্রাহিমের স্ত্রী যখন ইসহাকের জন্ম দিলেন কিংবা যখন ইসহাক সারাহর গর্ভে তখনই আদতে পারিবারিক গোলোযোগ শুরু হলো। আমাদের ইহুদি মুসলিম বিদ্বেষ এবং হানাহানি সেই পারিবারিক গোলোযোগের পরবর্তী প্রতিক্রিয়া। একটা সামান্য পারিবারিক গোলোযোগের কারণে ইতিহাসে কতজন নিহত হয়েছে? অলৌকিকত্ব আরোপ না করে সাধারণ ভাবেই বিষয়টা বিবেচনা করা যাক, ইব্রাহিমের স্ত্রী যখন ইব্রাহিমকে দাসীসঙ্গমের এবং তার গর্ভজাত সন্তানকে নিজের উত্তরাধিকারী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার অনুমতি দিলেন, তখনও তার ধারণা ছিলো তিনি বন্ধ্যা। পুরুষের বংশলতিকা অব্যহত রাখতে হবে সুতরাং দাসীগর্ভের সন্তানও বৈধ অধিকারী হতে পারে। এবং এর কিছু দিন পরেই সারাহ যখন গর্ভবতী হলেন তখন মূলত দ্বন্দ্বটা হলো ইব্রাহিমের উত্তরাধিকারী কে হবে সেই নিয়ে দুই মহিলার মনোমালিন্য এবং দাসী হওয়ায় প্রথম সন্তানের মাতৃত্ব সত্ত্বেও হাজেরাকেই প্রভুর গৃহত্যাগ করতে হলো।

সম্ভবত পারিবারিক শান্তির খোঁজেই হাজেরাকে নির্বাসন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ইব্রাহিম। ঘরে দুইজন মহিলা, যাদের দুজনের গর্ভেই উত্তরাধিকারী বিদ্যমান, তাদের চুলোচুলি ঠেকানোর এক বিকল্প কোনো উপায় সম্ভবত খুঁজে পান নি ইব্রাহিম। জমজমের আশে পাশে একটা বসতি পত্তন হলো, সেটা পবিত্র মক্কা নগরী হতে আরও অনেক সময় লাগবে। সারাহ অবশ্য নির্বাসিত হাজেরার সংবাদ পেয়ে উৎফুল্ল হন নি, তারা বহাল তবিয়তেই ইব্রাহিমের উত্তরাধিকারী হিসেবে জীবিত এটা মেনে নেওয়ার মানসিকতাও সারাহর ছিলো না, সুতরাং ইব্রাহিম দ্বীতিয় বারের মতো প্রথম সন্তানকে হত্যা করবার একটা সিদ্ধান্ত গ্রহনে বাধ্য হলেন। ইসমাইলকে কুরবানী দেওয়ার একটা বাস্তবতা তৈরি হলো।

তবে ইব্রাহিম ততটা পাষান হয়ে উঠতে পারেন নি। ইব্রাহিম ইসমাইলকে নিয়ে পরবর্তীতে গড়ে তুললেন কা'বার কাঠামো। এবং এই প্রথা অনেক পরে একটা ধর্মীয় উপাদান হিসেবে ঢুকে গেলো মুসলিমদের অবশ্যপালনীয় কর্তব্যাদির ভেতরে। ইহুদীদের বিশ্বাস তাদের পূর্বপুরুষ ইসহাক, সারাহর গর্ভজাত সন্তানই তাদের পূর্বপুরুষ। তারা এই বংশগর্বে বিশ্বাসী।

এবং ইহুদিদের ত্রাতা হিসেবে যারাই আবির্ভুত হয়েছে কিংবা যারাই পরবর্তী সময়গুলোতে অন্তত বাইবেলে বর্ণিত সময়ে ইহুদীদের ত্রাতা হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছে, তারা সবাই কোনো না কোনো ভাবে ইসহাকের বংশধর। অন্য সন্তান ইসমাইল- তার বংশধর মুহাম্মদ এবং বংশগৌরবে সেও কুলীন। ইসমাইল এবং ইসহাকের সন্তানদের ভেতরে এখনও প্যালেস্টাইন এবং আল আকসা মসজিদ দখলের লড়াই চলছে। অন্য একটি পারিবারিক গোলোযোগ এবং ইতিহাস বিকৃতির উৎস শিয়া এবং সুন্নীদের ভেতরে। এটা অবশ্য মুহাম্মদ, ইব্রাহিমের দাসীপূত্রের পরবর্তী কোনো এক বংশধরের বৈধ জামাই হওয়ার লড়াই।

সুন্নী ইতিহাস বলছে বিবি খাদিজার সাথে মুহাম্মদের বিবাহের পরে তাদের ৬/৭টি সন্তান হয়, এর ভেতরে রয়েছে উম্মে কুলসুম এবং রোকাইয়াহ, মুহাম্মদের উপরে ওহী নাজেল হওয়ার আগেই মুহাম্মদ উম্মে কুলসুম এবং রোকাইয়াকে বিবাহ দেন আবু লাহাবের দুই পূত্রের সাথে। সম্পর্কে আবু লাহাব মুহাম্মদের পিতৃব্য। ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার সময়, আবু লাহাব তার দুই পূত্রকে বাধ্য করেন মুহাম্মদের দুই কন্যাকে পরিত্যাগ করতে। সেসময়ই উসমান, মোবাইয়ার গোত্রের একজন, ইসলাম ধর্ম গ্রহন করবার পরে স্ত্রীকতৃক পরিত্যাক্ত হন। এবং এর সমাধান হিসেবে মুহাম্মদ তার কন্যা রোকাইয়াকে উসমানের সাথে বিবাহ দেন।

সে সূত্রে উসমান মুহাম্মদের বড় জামাই। এরপরবর্তীতে রোকাইয়ার মৃত্যুর পরে অন্য কন্যা উম্মে কুলসুমের বিবাহ হয় উসমানের সাথে এবং হাদিসের ভাষ্য অনুসারে মুহাম্মদ বলেছেন তার যদি আরও কন্যা থাকতো তবে তাদেরও উসমানের সাথে বিবাহ দেওয়া হতো। সুন্নী ঐতিহাসিকগণ এটাকেই শুধু বিশ্বাস করেন না, তাদের বিশ্বাস খাদিজা ইতিপূর্বে দুইবার বিবাহ করেছিলেন এবং তার পূর্বের স্বামীরও সন্তান ছিলো। তাদের একজন হিন্দ, যিনি উটের যুদ্ধে শহীদ হন। এবং তিনি বদর এবং উহুদের যুদ্ধে একজন অগ্রগামী যোদ্ধা ছিলেন।

এবং মুহাম্মদের সাথে তার জন্ম নেওয়া সন্তানদের ভেতরে পূত্র দ্বয় পূর্বেই মৃত্যু বরণ করেন। এবং খাদিজা তখন সান্তনার জন্য কা'বার অধিকারী দেবতা হুবালের কাছে গিয়ে প্রার্থনা করতেন। শি'য়াদের মতে, খাদিজা বিবাহের সময় মোটেও ৪০ বছর বয়স্ক এবং দুই বার বিবাহিত এবং অন্তত ২টি পূত্রের জননী ছিলেন না, এবং এ সময়ে খাদিজার গর্ভে দুই পূত্র এবং এক কন্যার জন্ম হয়, সেই কন্যা ফাতিমা। উম্মে কুলসুম, রোকাইয়া এবং জয়নব আদতে খাদিজার বোনের কন্যা, যাদের খাদিজা মাতৃস্নেহে লালন-পালন করেছিলো। সে সুবাদে একমাত্র আলীই মুহাম্মদের বৈধ জামাই।

এবং যেহেতু মুহাম্মদের কোনো পূত্র নেই সুতরাং তার কন্যার জামাই এবং তাদের বংশধরেরাই মুসলিম উম্মাহকে নেতৃত্ব দিবে। এই পারিবারিক গোলোযোগে ইতিহাস বিকৃতি হয়েছে এবং অনেক রক্তপাত হয়েছে এবং সে রক্তপাত এখনও চলছে। ইব্রাহিম, তার দুই স্ত্রী এবং দুই স্ত্রীর গর্ভের দুই সন্তান, এবং তাদের অসংখ্যা বংশধর এবং তাদের বংশধরদের কন্যাদের স্বামী এই ইব্রাহিম পরিবারের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বই এখন বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ দিনের চলমান দ্বন্দ্ব, সেই উত্তরাধিকারী একবার নির্দিষ্ট হয়ে গেলে পৃথিবীতে অন্তত বহুলাংশে ধর্মীয় হানাহানি থেমে যাবে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.