চতুর্মাত্রিক.কম (choturmatrik.com)
আজকে বড় অসময়ে ঘুমালাম। কয়েকদিন ধরে কাজের চাপ বাড়ছে। সাথে পাল্লা দিয়ে আমার আলস্যও বাড়ছে। সাধারণত যে সময়ে আমি লিখতাম, লেখার চিন্তাগুলো পিঁপড়ার মত আসত, সেই সময়গুলো হারিয়ে গেছে। অথবা সময় সময়ের জায়গাতেই আছে, আমি ব্যস্ত হয়ে পড়ছি।
বা হয়তো আমি আরো আলসে হয়ে পড়ছি। ঠিক জানি না, বিষয়গুলো ঘোরালো প্যাঁচালো।
তো, আজকে আমি অনেক সকালে উঠেছি, প্রায় সাতটার দিকে। এটা আমার জন্য অস্বাভাবিক, কারণ বেশি রাত জাগি। সকালের সময়টায় গাঢ় ঘুম হয়।
কিছুদিন ধরে সেই শিডিউলটা ভাঙার চেষ্টা করছি। কিন্তু প্রায় দুই বছরের অনায়াসে গড়ে তোলা অভ্যাস বাগ মানছে না। রেগে ওঠা বেপরোয়া ঘোড়ার মত ফোঁস ফোঁস করে দাপাদাপি করছে। হয়তো শুয়ে পড়লাম বারোটা বাজতেই, কিন্তু হালকা ঘুম ঘুম ভাবটা কর্পুরের মত উড়ে গেল। মানসিক ও শারীরিক ক্লান্তি উপেক্ষা করে আমি কড়কড়ে চোখ নিয়ে জেগে থাকি! তাই ঘুমটা ঝাপিয়ে আসে ভোরের কাছাকাছি সময়ে।
কিন্তু আজকে আমার ক্লাস ছিল নয়টায়, তাই উঠতেই হলো। ক্লাসের মধ্যে বিজ্বিজে এ.সি.র কারণে শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আসে, আমি হেঁটে হেঁটে ঘুম আর জড়তা কাটানোর চেষ্টা করতে থাকি। তারপরে লম্বা, একঘেঁয়ে ক্লাস শেষ হয়। দুপুরে বের হয়ে বাসায় ফিরছি যখন, তখন কোষে কোষে ঘুমের প্লাবন! মোটামুটি জামা-কাপড় না ছেড়েই, আমি তলিয়ে যেতে থাকি। আমার ভালো লাগে এভাবে ঘুমিয়ে পড়তে।
মনে পড়ে রাতের বেলা জেগে থাকা মুহূর্তগুলো। আর সেটা মনে করতে করতেই আমার মনে আর কোন চিন্তা চলে না!
ঘুম যখন ভাঙলো, তখন প্রায় পাঁচটা বাজে। সারা বাসা নিঝুম। যখন ঘুমিয়েছি তখনও কেউ ছিল না। এর মাঝে সবাই ফিরেছে, আমাকে ডাকাডাকি করে তোলার চেষ্টাও করেছে খাবার জন্য।
কিন্তু কী অতলঘুমে ডুবেছিলাম আমি! এখন আবার 'সারা-পাড়া-শুনশান'! ঘুম ভেঙে এমন একা লাগলে আমার মন বিষণ্ণ হয়ে যায়। মনে হয় আমার কাছেপিঠে কেউ নেই। একটা নীরব পাথর বুকের উপরে চেপে বসে থাকে, আমি শ্বাস নিতে পারি না। উঠে দেখি টেবিলা খাবার ঢাকা রয়েছে। টের পেলাম সাথে সাথেই যে কী ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে! খেতে খেতেই ড্যানির ফোন আসে।
আগামিকাল (ইতিমধ্যে সেদিনটা শুরু হয়ে গেছে) আমাদের ব্যাচের রিইউনিয়ন/গেট-টুগেদার। বুয়েট ছাড়ার প্রায় দু'বছর হতে চললো। এবারে মোটামুটি ঢাকা আর বাংলাদেশ খালি করে আমাদের ব্যাচের ভালো ভালো ছাত্র-ছাত্রীগুলো, প্রকৌশলীগুলো মার্কিন নয়তো কানাডা মুল্লুকে চলে যাচ্ছে। চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি, ধীরে ধীরে পরিচিত মুখ, চেনাশোনা মানুষগুলো ছুঁড়ে দেয়া গুলতির ঢিল হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে। আমি জানি তারা সবাই জড়িয়ে থাকবে... কিন্তু আবার কবে এভাবে একসাথে হওয়া হবে, কে জানে! সেজন্য একটা জড়ো হওয়ার প্রচেষ্টা কালকে দুপুরের পর থেকে।
দুপুরের রোদ নেমে গেলে আমার তাদের অনেকের সাথে সম্ভাব্য শেষ দেখা হচ্ছে-- এটা ভাবতে মন অযথাই খারাপ হচ্ছে। এটাই জীবন, যাপন কষ্টকর এবং অনস্বীকার্য রকমের বাস্তব!
সেই গেট-টুগেদার উপলক্ষে গান-বাজনা হবে, গেঞ্জি-বিতরণ হবে, খাওয়া-দাওয়া তো হবেই। গান-বাজনা'র অংশে আমার একটুখানি কাজ। সেই প্র্যাকটিসের জন্যেই ড্যানির ফোন। দুপুরে পেরিয়ে বিকেল পাঁচটার সময়ে আমি বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ি।
গাড়িতে করে বিরক্তিকর জমাট বরফের মত জ্যাম ঠেলে ঠেলে যাবার সময় আমার দু'বছর আগে র্যাগের কথা মনে পড়ে যেতে থাকে। কী সময়ই না ছিল, আনন্দবিষাদের ঘোলাটে স্মৃতিগুলো বোয়াল মাছের মত ঘাই তুলতে থাকে। অনুভূতি প্রকাশের সময়ে আমার জড়তা বেড়ে যায়। গ্র্যাজুয়েশন পার্টিতে ভিডিওতে সবার পুরনো চেহারাগুলো দেখে সবাই যখন একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করছে, আমি তখন হাজার চেষ্টা করেও এক ফোঁটা পানি আনতে পারিনি। শুধু গলার ভিতরে, ঠিক বুকের উপরে একটা দলা-পাকানো বাষ্প জমে ছিল পাহাড়ের মত ভারি হয়ে! আমি বার বার ঢোঁক গিলে সেটাকে পেটের ভেতর পাচার করতে কতই না চেষ্টা করলাম।
জড়িয়ে ধরে বন্ধু কয়েকজন যখন ফোঁপাচ্ছে বা কাঁদছে, আমি অনুভব করি আমার ভেতরে দলার বাষ্পটা সারা শরীরে হিমবাহের মত ছড়িয়ে গেছে, তারপরেও বর্ষণ হয়নি! আজকে এই ক্ষয়া-বিকেলে জ্যামের মধ্যে সেই বাষ্প আমার কাছে ফিরে এলো।
মগবাজারের গলির ভেতরটা পরিচিত আগে থেকেই। সেটার মুখে চা-ওলার কাছ থেকে গরমের মধ্যেও এক কাপ চা খেলাম। মুখে চিনি'র ঘন স্বাদ মিশে গেল। ভিতরে ঢুকে একটু পরে গানের প্র্যাকটিসও কোনমতেই সেই স্বাদটাকে কমাতে পারলো না।
প্রায় দু'বছরের আড়ষ্টতা এসে গলায় চেপে বসলো। আমার সময় লাগছিল সামলে নিতে। শেষপর্যন্ত একেবারে খারাপ হয়নি পুরোটা। কালকে সন্ধ্যায় অনুষ্ঠানের আগে হয়তো আরেকটু মহড়া করা যাবে। রাতে বেরিয়ে এসে আরেক-কাপ চা পেটে পুরে নিলাম।
জানি, এই মোড়ে দাঁড়িয়ে সবার সাথে আর চা-খাওয়া হবে না। কিছু চিনির মিষ্টি গরম তরলের মূল্য কত তা হয়তো জীবন পেরিয়ে গেলে আমি বুঝে উঠবো!
ফেরার পথেও সপ্তা'শেষের ভীড়। গাড়ি, ট্রাক, বাস, টেম্পো, সিএনজি এগুলোকে আমার আচমকাই ভালো লেগে গেল! কী নিদারুণ ঘামেভেজা, ধুলোমাখা জীবন আমাদের। ধুলোতেই মিশে যাবে নিশ্চিত ভাবেই। আমাদের এই স্মৃতি মৃত্যুবধি বয়ে নিয়ে বেড়ানোর দায় থেকে একটা সময়ে আমরা মুক্তি পাবো, তারপরে এই সব অতীত ও তুচ্ছ।
তার আগে আমি এগুলো জড়িয়ে থাকতে চাই, এদের প্রয়োজন আমার কাছে অসীমের চেয়েও বেশি।
***
২৩.৭.৯
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।