আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাবা বুল্লে শাহের সেই কবিতা, রাব্বি শেরগিলের সেই গান ...

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
বুল্লে শাহ। (১৬৮০-১৭৫৭) অস্টাদশ পাঞ্জাবের মরমী কবি। এঁকে পাঞ্জাবের লালন হিসেবে চিহ্ণিত করা যায়।

মরমী কবি সুফিসাধক ছাড়াও বাবা বুল্লে শাহ ছিলেন একালের নিরিখেও পরম মানবতাবাদী। বুল্লে শাহের সময়কালটা মুসলিম ও শিখ দাঙ্গায় দুঃখজনকভাবে ছিল লাঞ্ছিত । সে ভয়াবহ সময়টায় দু-পক্ষেরই বিপুল মানুষ নিহত হচ্ছিল। সে সময়ই একবার একদল শিখ দ্বারা কয়েকজন মুসলিম নিহত হয়। মুসলিমরা বদলা নেবে সিদ্ধান্ত নেয়।

প্রতিশোধ হিসেবে মুসলিমরা একজন নিরীহ শিখকে হত্যা করে। মুসলিম হলেও বাবা বুল্লে শাহের নিরীহ শিখ হত্যার বিরোধীতা করেন। তিনি দুহাত তুলে বললেন - স্বন্ত্রাস কখনেই স্বন্ত্রাসের জবাব নয়। এভাবে নিহত শিখের পক্ষ নেওয়ায় মোল্লারা বাবা বুল্লে শাহের ওপর ক্ষেপে যায়। ক্ষেপে গেলেও বাবা বুল্লে শাহ সেই হন্যমান সময়ে পাঞ্জাবের জনগনের জন্য হয়ে উঠেছিলেন শান্তির প্রতীক।

বাবা বুল্লে শাহের জন্মসাল ধরা যেতে পারে ১৬৮০ খ্রিস্টাব্দ। পাঞ্জাবের ভাওয়ালপুরের উচ গ্রাম- গ্রামটি ভারতবিভাগের পর পাকিস্তানে পরেছে। বাবা বুল্লে শাহের পূর্বপুরুষ বুখারা থেকে এসেছিলেন। জায়গাটা বর্তমান উজবেকিস্থান। বুল্লে শাহের বাবার নাম শাহ মোহাম্মদ দরবেশ।

ছিলেন গ্রামের মসজিদের একজন ইমাম। বুল্লে শাহের শিক্ষক হিসেবে তিনজনের নাম পাই। গুহলাম মুরতাজা, মাওলানা মহিউদ্দীন এবং বিশিষ্ট সুফিসাধক শাহ্ এনায়েৎ কাদরী। এদের কাছেই বুল্লে শাহ জেনেছিলেন তুরস্কের বিশিষ্ট সুফিকবি মাওলানা জালালউদ্দীন রুমির কথা। হয়তো গুহলাম মুরতাজা সাহেব বলতেন, মাওলানা জালালউদ্দীন রুমি ৬ খন্ডের মহাকাব্য মসনভীও লিখেছেন।

জামি, আরেকজন বিশিষ্ট সাধক, যাকে বলেছেন ‘পারস্যের কোরান। ’ হয়তো বলতেন, মাওলানা মহিউদ্দীন সাহেব বলতেন, রুমির অধিবিদ্যা নিয়ে বইয়ের নাম- ফিহি মা ফিহি। হয়তো শাহ্ এনায়েৎ কাদরী তাঁর মেধাবী শিষ্যকে বলতেন, একজন ভ্রাম্যমান দরবেশ রুমিকে বিস্মিত করেছিল। তাঁর নাম শামসুদ্দীন তাবরিজ। শামস এ তাবরিজ মারা গেলে শোকার্ত রুমি লিখলেন-‘দিউয়ানি শামসী তাবরিজি।

’ যাক। তখন আমি বলছিলাম ছবি। বুল্লে শাহ অস্টাদশ পাঞ্জাবের মরমী কবি। এঁকে পাঞ্জাবের লালন হিসেবে চিহ্ণিত করা যায়। বুল্লে শাহ কবিতা লিখতেন।

সে সময়কার মরমী কবিতাকে বলা হত কাফি। কাফি আসলে কবিতার পাঞ্জাবিশৈলি বা ফর্ম। মুসলিম পীরেরাই শুধু না -শিখ ধর্মগুরুরাও লিখতেন কাফি। বাবা বুল্লে শাহের কবিতাজুড়ে কট্টর মোল্লাতন্ত্রের বিরুদ্ধে ধিক্কার। নিচের কবিতাই সে প্রমান দেবে।

Na maen momin vich maseet aan Na maen vich kufar diyan reet aan Na maen paakaan vich paleet aan Na maen moosa na pharaun. Bulleh! ki jaana maen kaun মসজিদের ভিতরের বিশ্বাসী নই ভ্রান্ত রীতির পৌত্তলিকও নই নই দুষিতদের মধ্যে নির্মল মুসাও নই ফেরাউনও নই বুল্লে, আমাকে আমি জানি না। Na maen andar ved kitaab aan, Na vich bhangaan na sharaab aan Na vich rindaan masat kharaab aan Na vich jaagan na vich saun. Bulleh! ki jaana maen kaun. পবিত্র বেদেও নই কিংবা আফিমে কি মদে আমি নেই মাতালের মাতলামিতে জাগ্রত অবস্থায় কি ঘুমের ঘোরে বুল্লে, আমাকে আমি জানি না। Na vich shaadi na ghamnaaki Na maen vich paleeti paaki Na maen aabi na maen khaki Na maen aatish na maen paun Bulleh!, ki jaana maen kaun সুখে কি দুঃখেও নেই আমি স্বচ্ছও নই নোংরা কাদাও নই পানি থেকে কিংবা পৃথিবী থেকে আগুনও কিংবা বাতাসে আমার জন্ম হয়নি। বুল্লে, আমাকে আমি জানি না। Na maen arabi na lahori Na maen hindi shehar nagauri Na hindu na turak peshawri Na maen rehnda vich nadaun Bulla, ki jaana maen kaun আমি আরব নই, লাহোরবাসীও নই হিন্দুস্থানের নই, আমি নাগরিক নই হিন্দু নই, তুর্কি মুসলিম কি পেশওয়ারেরও নই আমি নাদায়ূনেও ( এই শব্দটা বুঝতে পারি নি ) বাস করি না।

বুল্লে, আমাকে আমি জানি না। Na maen bheth mazhab da paaya Ne maen aadam havva jaaya Na maen apna naam dharaaya Na vich baitthan na vich bhaun Bulleh , ki jaana maen kaun ধর্মের গূহ্যকথা আমি জানিনি আদম হাওয়া থেকে আমি উত্থিত নই যে নাম আমার, সে আমি নই স্থিরতা কিংবা গতিতে আমি নেই বুল্লে, আমাকে আমি জানি না। Avval aakhir aap nu jaana Na koi dooja hor pehchaana Maethon hor na koi siyaana Bulla! ooh khadda hai kaun Bulla, ki jaana maen kaun আমিই প্রথম আমিই শেষ এ ছাড়া আমি কিছুই জানি না। আমিই সবচে জ্ঞানী। বুল্লে, আমি কি একা দাঁড়িয়ে? বুল্লে, আমাকে আমি জানি না।

বাবা বুল্লে শাহের কাফি কবিতাটির দার্শনিক ভিত্তি আমার কেন যেন মনে হয়, বাবা বুল্লে শাহের এই কাফি কবিতার দার্শনিক ভিত্তিটি রচে দিয়েছেন ত্রয়োদশ শতকের তুরস্কের আনাতোলিয়ার মিস্টিক মাওলানা জালালউদ্দীন রুমি। আমরা তাঁকে আজ সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করতে পারি। রুমির জন্ম বর্তমান তাজাকিস্থানে; ১২০৭ খ্রিস্টাব্দের ৩০ সেপ্টেম্বর। পরিবারটি বিদগ্ধ। বাবা বাহাউদ্দীন ছিলেন বিশিষ্ট ইসলামী পন্ডিত।

সে সময়টায় বলখ্, তাজাকিস্থান ইত্যাদি মধ্যএশিয়ার রাজ্যগুলির দিকে চেঙ্গিশ খানের নেতৃত্বে মঙ্গোলরা তেড়ে আসছিল । বাহাউদ্দীন সিদ্ধান্ত নিলেন পশ্চিমযাত্রার। মক্কায় হজ করলেন সপুত্রক। শেষে তুরস্কের আনাতোলিয়ায় স্থায়ী বসবাসের সিদ্ধান্ত নিলেন। আনাতোলিয়ার কোনিয়ায়।

জায়গাটা সে সময় ছিল সেলজুক তুর্কিদের সাম্রাজ্য । ওখানেই মাদ্রাসায় বাহাউদ্দীন শিক্ষকতার কাজ পেলেন। ১২৩১ সালে বাহাউদ্দীন মারা গেলেন। রুমির বয়স সবে ২৪। বিদগ্ধ ছিলেন।

বাবার পদটি অনায়াসে পেলেন। রুমি; একালের শিল্পীর কল্পনায় যাক। তার আগেই একজন ভ্রাম্যমান দরবেশ রুমিকে মুগ্ধ করে ফেলেছিলেন। ভ্রাম্যমান দরবেশের নাম- শামসুদ্দীন তাবরিজ। শামস মানে সূর্য।

শামসুদ্দীন তাবরিজ-এর ভাব তেমনই ছিল হয়তো। যা হোক। শামসুদ্দীন তাবরিজ মারা গেলেন। রুমি শোকার্ত হলেন। শোকার্ত রুমি লিখলেন-‘দিউয়ানি শামসী তাবরিজি।

’ এই গ্রন্থেরই একটি কবিতাকে বাবা বুল্লে শাহের কাফি কবিতাটির দার্শনিক ভিত্তি হিসেবে চিহ্ণিত করতে পারি। What is to be done, O Moslems? for I do not recognize myself. I am neither Christian, nor Jew, nor Gabr, nor Moslem. I am not of the East, nor of the West, nor of the land, nor of the sea; I am not of Nature's mint, nor of the circling' heaven. I am not of earth, nor of water, nor of air, nor of fire; I am not of the empyrean, nor of the dust, nor of existence, nor of entity. I am not of India, nor of China, nor of Bulgaria, nor of Saqsin I am not of the kingdom of 'Iraqian, nor of the country of Khorasan I am not of the this world, nor of the next, nor of Paradise, nor of Hell I am not of Adam, nor of Eve, nor of Eden and Rizwan. My place is the Placeless, my trace is the Traceless ; 'Tis neither body nor soul, for I belong to the soul of the Beloved. I have put duality away, I have seen that the two worlds are one; One I seek, One I know J One I see, One I call. He is the first, He is the last, He is the outward, He is the inward; I know none other except 'Ya Hu' and 'Ya man Hu.' I am intoxicated with Love's cup, the two worlds have passed out of my ken ; I have no business save carouse and revelry. If once in my life I spent a moment without thee, From that time and from that hour I repent of my life. If once in this world I win a moment with thee, I will trample on both worlds, I will dance in triumph for ever. O Shamsi Tabriz, I am so drunken in this world, That except of drunkenness and revelry I have no tale to tell. (বাংলা তর্জমা আর করলাম না) রুমির কথাগুলিই বাবা বুল্লে শাহের কাফি কবিতায় ধ্বনিত হয়েছে। সুফিজগতে রুমির প্রভাব এমনই অপ্রতিরোধ্য। কবিতা থেকে গান: এক বিস্ময়কর রুপান্তর ও উপস্থাপনা ধারনা করি। বাবা বুল্লে শাহের কাফি কবিতাগুলি তাঁর স¤প্রদায়ের মধ্যে আর পাঞ্জাবেই সীমাবদ্ধ ছিল।

বৃহৎ পরিসরের গোচরে আসেনি। মনে থাকার কথা, ২০০৫ কিংবা ২০০৬ সাল। আমরা সবাই একটি পাঞ্জাবি সুফি পপ শুনে থমকে গিয়েছিলাম। বুললা কি জানা ম্যায় কৌন । গায়ক রাব্বি শেরগিল।

রাব্বি শেরগিল এর জন্ম ১৯৭৫ সালে। দিল্লি। বাবা দিল্লিরই এক শিখ ধর্মবেত্তা। মা কলেজ অধ্যক্ষ। তিনি কবিও।

মায়ের কাছেই শেরগিল সম্ভবত বাবা বুল্লে শাহের সেই কাফি কবিতাটি শুনে থাকবে। যে কবিতায় বাবা বুল্লে শাহের এক তুরীয় মুহূর্তে লিখেছিলেন - Bulla, ki jaana maen kaun রাব্বি শেরগিল পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে শেরগিল-এর গান চলছিল। লোকে বলে: গলা ভালো। তেজ আছে। একটা অ্যালবাম করার কথা ভাবলেন শেরগিল।

কাজে নামলেন। অ্যালবামের নাম দিলেন: রাব্বি। ভাবলেন, বাবা বুল্লে শাহ কে কি পৃথিবীর মানুষ চিনবে না? বাবা বুল্লে শাহ মুসলিম কর্তৃক এক নিরীহ শিখের হত্যার সমালোচনা করেছিলেন। মুসলিম হলেও বাবা বুল্লে শাহের নিরীহ শিখ হত্যার বিরোধীতা করেছিলেন। তিনি দুহাত তুলে বলেছিলেন - 'স্বন্ত্রাস কখনেই স্বন্ত্রাসের জবাব নয়।

' এভাবে নিহত শিখের পক্ষ নেওয়ায় মোল্লারা বাবা বুল্লে শাহের ওপর ক্ষেপে যায়। এমন মানুষকে বিশ্ব চিনবে না? তা কি হয়? ২০০৪। শেরগিল তাঁর অ্যালবাম বের করলেন। Bulla, ki jaana maen kaun হিট! হিট! হিট! এক শিখ মিউজিশিয়ান বাবা বুল্লে শাহের কবিতা গানরুপে বিশ্বের কাছে তুলে ধরলেন! যে কবিতার পটভূমিতে নিহিত মাওলানা রুমি । ইতিহাস পাঠে মাঝে মাঝে আমি এভাবেই শিহরিত হই! একা।

কবিতাটির ইংরেজি তর্জমার লিঙ্ক ... Click This Link
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.