আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মহাপ্রলয়ের দিন- কল্প গল্প



অবশেষে দিনটি এসেই গেলো। ঠিক যেভাবে বলা হয়েছিলো। সকালে সূর্য্যটা পশ্চিম দিগন্ত থেকে উঠে মাঝপথে এসে ঝুলে থাকলো। উত্তাপের তীব্রতা বাড়ছে দ্রুত গতিতে। তার সাথে তাল মিলিয়ে সাইরেণের মতো তীব্র এক সুতীক্ষ্ণ শব্দ বাড়তে থাকলো।

যে শব্দে মানুষের কান ঝালা পালা হয়ে যাবার কথা ছিল। কিন্তু....! তবে, তারা কাজ শুরু করলো। ঠিক যেভাবে ভেবে রাখা হয়েছিল- তিন লক্ষ সতের হাজার বছর পেছনের সময়ে। মহাথেরো ঠিক ইশ্বর বিশ্বাসী ছিলেন বল্‌লে ভুল হবে। তার বায়োলজিক্যাল পূর্বপুরুষ (তার জন্ম হয়েছিলো পুরুষ ভ্রুণ থেকে) বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী ছিলেন বলেই হয়তো, সন্তানকে- ভদ্রলোক তার কিছুটা সেটার আঁচ দেয়ার চেষ্টা করতেন সবসময়।

আইন না ভেঙ্গে যতটুকু পারা যায়, ততটুকু ইচ্ছা মোটামুটি প্রকাশ্যেই দেখাতেন। যাইহোক, মহাথেরো ধর্ম নিয়ে মাথা ঘামায় নি। তার জন্য নির্ধারিত ছিল মহাকাশ শিক্ষা বিভাগের 'ব্ল্যাক হোল' শাখায়। সেটা নিয়েই মেতে ছিলেন সবসময়। বোধকরি নামের প্রভাবের কারণেই বৌদ্ধ ধর্ম তথা, সব ধর্ম নিয়ে কিছুটা আগ্রহ জন্ম নিয়েছিলো।

এক পর্যায়ে যখন ' ব্ল্যাক হোলের' সাথে ধর্মের যোগসূত্রের ফর্মুলাটা আবিষ্কার করলেন; সবাই খুব হতচকিত হয়ে পড়লেও মহাথেরো নিজে কেন যেনো বিস্মিত হননি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সেই দিনটার কথা ভুলতে পারেননি। তার প্রতিরূপ এন্ড্রোটিও সক্রিয় থাকার শেষ দিন পর্যন্ত সেই স্মৃতি বহন করে চলেছিল। তার ল্যাবটা করা হয়েছিলো খুব মূল্যবান একটা জায়গায়। প্রকৃতির স্বাভাবিকত্বের মাত্রা এখানে ১৮শ শতাব্দীর পৃথিবীর প্রেক্ষাপটে রাখা হয়েছিলো (এই বাজারের সবচেয়ে দামী সেটআপ)।

সময়টা ছিল ভোরের ঠিক আগে করে। খুঁজে না পাওয়া ফ্লোটিং পয়েন্ট টার উপর সারারাত কাজ করেছেন তিনি। শেষমেষ হাল ছেড়ে উঠে পড়বো পড়বো করছিলেন। চারদিকে ঘন গাছগাছালির ভেতর থেকে পাখীদের সদ্য ঘুম ভাঙা শোরগোল শোনা যাচ্ছিল; বাতাসে আর্দ্রতা চমৎকার আবেশ মাখিয়ে দিচ্ছিল শ্রান্ত দেহে। ঠিক তখনই ভেসে এলো প্রার্থনার আহ্বান ধ্বনি।

অন্যমনষ্কভাবেই তিনি ডাটা ইনপুটে ' ইভানের রিলিজিয়ন ইকুয়েশন'টা প্রবেশ করিয়ে দিলেন। বোধহয় কিছুটা তন্দ্রামতো এসেছিলো। রুইবা'র চিৎকারে থতোমতো খেয়ে উঠে দাড়ালেন। রুইবা তার এন্ড্রো সহকারী; বাজেট সীমিত রাখার জন্য ল্যাবে মানুষের সংখ্যা সব সময় কম রাখা হয়। এন্ড্রোরা মানুষের সব অনুভুতি নকল করতে পছন্দ করে; তাই মহাথেরো বুঝতে পারছিলেন, কোন একটা আনন্দময় ঘটনা ঘটেছে কোথাও।

"ইকুয়েশন মিলে গেছে!! মহাথেরো, আপনার ইকুয়েশন মিলে গেছে!!" মহাথেরো দ্রুত ডাটাবেজ ঘেটে নিলেন। হ্যাঁ! তাইতো! ইকুয়েশন সমাপ্তির সংকেত দিচ্ছে। সর্বশেষ ফ্লোটিং পয়েন্ট টা তাহলে 'রিলিজিয়ন ইকুয়েশন'?! মহাথেরো দ্রুত সম্ভাব্যতা ভবিষ্যতবাণীর দিকে চোখ রাখলেন। স্ষ্পষ্ট করেই বোঝা যাচ্ছে, সবগুলি ধ্বংস মুহুর্ত (ডেস্ট্রাকশন পয়েন্ট) মুলত এক ও অবিচ্ছিন্ন ঘটনা! "মহাথেরো! " রুইবা শত চেষ্টা করেও গলার স্বর স্থির রাখতে পারছিলো না-"আমরা মহাপ্রলয়ের দিন খুঁজে পেয়েছি! আমরা এখন নিশ্চিত ভাবে জানি মহাপ্রলয় হচ্ছে এবং কবে হচ্ছে!" মহাথেরো কোন জবাব দিলেন না। কেন যেন তার পিতা(!)র কথা খুব মনে পড়লো।

"আমি 'নির্ভানা'র দিকে যাত্রা শুরু করেছি, মহাথেরো! তুমিও যেন পথ চিনে নিতে ভুল না করো। " মৃত্যু শয্যায় এটাই ছিল তার শেষ কথা। যাইহোক, বেশীক্ষণ ভাবনার ডুবে থাকার অবকাশ পাওয়া গেলো না। ইতিমধ্যেই সংক্ষিপ্ত তম সময়ের ভেতরে অভিবাদন আর অনুসন্ধানের পালা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। মহাথেরো তার পরবর্তী কর্ম পন্থার ছক এঁকে ফেলা শুরু করলেন ডাটাবেজ এ।

দিনের শেষভাগে এসে সব সিদ্ধান্ত পেয়ে গেলেন তিনি, সেই সাথে অনুমতিও। অনুমতির জন্য প্রায় পাঁচ দশক ধরে বিতর্ক চললো। আগ্রহী কর্তৃপক্ষের সংখ্যা নিতান্তই কম। শেষ মেশ জাতিসংঘ থেকে দুহাজার বছর মেয়াদী একটা পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল। মহাথেরোর সংরক্ষিত এন্ড্রোকে সক্রিয় করে দেয়া হলো পরবর্তী কয়েক হাজার বছরের জন্য।

মানব জাতি বিবর্তনের ধারায় আরো লক্ষাধিক বছর টিকে ছিল। এর পর সভ্যতা মোড় নিতে শুরু করে ক্ষয় এর দিকে। মূল্যবোধ, অনুশাষণ, নীতিজ্ঞান- সব কিছু হারিয়ে যাবার সাথে সাথে মানব জাতি ফুরিয়ে গেলো অবশেষে, সাথে করে নিয়ে গেলো প্রাণী জগতের অধিকাংশ সদস্যকে। থেকে গেলো কেবল মহাথেরোর এন্ড্রোর সর্বশেষ ভার্সান আর তার গড়ে তোলা সিস্টেম। শেষ দিবসের অপেক্ষায়।

তারা তাদের কাজ শুরু করলো। কেউ কেউ তাপমাত্রার ডাটা সংগ্রহ করে এন্টিম্যাটার এটমে সংরক্ষণ করে রাখছিলো। সারা বিশ্বের অসংখ্য স্থানে ছবি তোলা হচ্ছিলো। সেগুলিও স্বয়ংক্রীয় ভাবে যোগ হতে থাকলো পরম ভর এ। যেভাবে ভাবা হয়েছিলো ঠিক সেভাবেই সব ডাটা পুঞ্জীভূত হতে থাকলো একক বিন্দু নিউক্লিয়াসে।

এর ভেতরে ধ্বংস শুরু হয়ে গেছে। ক্ষয়ে ক্ষয়ে পড়ছে বিশ্ব ব্রম্মান্ড। সংকুচিত হতে শুরু করেছে বস্তু জগত- অমোঘ কোন আকর্ষণে কিংবা কারো ইশারায়। সবকটা দল নিজেদের সাথে বিলীন করে নিলো সব ধ্বংসপ্রাপ্ত বস্তুকণাকে। একটু একটু করে সৃষ্টি হতে থাকলো একমাত্র এটমটি- যেভাবে ভেবেছিলো তিন লক্ষ বছর পূর্বে বিলুপ্ত পাওয়া মানব জাতির প্রথম সারির একজন বিজ্ঞানী- মহাথেরো।

ঠিক সেভাবেই সব তথ্য পুন্জীভূত হয়ে সৃষ্টি হতে থাকলো পরম একক কণা, বিগ ব্যাং এর আগে যেমনটি ছিল। পার্থক্য একটাই; এখানে সঞ্চিত হলো মানুষের রেখে যাওয়া সব তথ্য- যা তারা সংরক্ষণ করতে চেয়েছে। মানুষের রেখে যাওয়া রোবটেরা অনুভুতিহীন কর্মযজ্ঞে সূচারুভাবে সম্পন্ন করেছে তাদের কর্তব্যগুলি। মহাবিশ্ব এখন একটি পরম কণায় কেন্দ্রিভূত,আরেকটি বিগ ব্যাং এর জন্য কিংবা ঈশ্বরের মুখোমুখি হবার অপেক্ষায়-পুরনোত্থানের। পরিশিষ্ঠ দিগন্ত বিস্তৃত প্রান্তর।

মহাথেরোর দৃষ্টির সীমানায় কেবলই শূন্যতা। অথচ তিনি অযুত, সহস্র ক্রোড় মানুষের উপস্থিতি টের পাচ্ছেন তার চারপাশে। আবার ভালো করে মনকে অনুভুতির মাত্রায় কেন্দ্রীভূত করার চেষ্টা করলেন তিনি। না, তার কোন ইন্দ্রিয়ই কাজ করছে না- সঠিক ভাবে বলতে গেলে তার ভেতরে কোন ইন্দ্রিয়ের অস্তিত্ত্বই নেই এখন আর। এটাই কি তবে পুনরোত্থান? কিংবা নির্ভানা? প্রাণপণে তিনি তার সূত্রের স্মৃতিতে ফিরে যাবার চেষ্টা করলেন।

প্রবল বিস্ময়ে তিনি আবিষ্কার করলেন, এই সহস্র ক্রোড় মানুষের ভেতর থেকে নিজেকে আলাদা করতে পারছেন না। আলাদা করতে পারছেন না বস্তু থেকে, ত্রিমাত্রিয় জগত থেকে। সমগ্র মানবজাতি, বস্তুজগত আজ একক একটি সত্ত্বায় একটি কণায় পরিণত হয়ে, মুখমুখি হয়েছে তার স্রষ্ঠার। এখানে মানব তিনি একজনই, বহন করে নিয়েছেন সকল প্রজন্মের সকল অস্তিত্বকে। মহাথেরোর অপেক্ষা শুরু হলো অসীমের জন্য।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।