মিলে মিশে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ!
মূল লেখা এইখানে
[ডিস্ক্লেইমারঃ আমি বুঝতে পারছি না এটা কপিরাইট আইন ভঙ্গ করে কিনা, যদি করে তাহলে বলবেন প্লীজ, আমি এটা ড্রাফট করে ফেলব। লেখাটা খুব ভাল লেগেছে, তাই ব্লগে দিলাম। চমৎকার বর্ণনা আমাদের দেশীয় খাবারের। ]
আমার অনুভূতি এইখানে
ইংরেজের অন্যতম নিত্যনৈমিত্যক প্রাতঃরাশ-সামগ্রী 'ওট' সম্পর্কে মুজতবা আলী একজায়গায় বলেছেন:
'ওট' নামক বস্তুটি স্কটল্যান্ডে খায় মানুষ, ইংল্যান্ডে খায় ঘোড়া, কিন্তু ওই আমলে লন্ডনের পোষাকী খানা স্কটল্যান্ডের ঘোড়া পর্যন্ত খেতে রাজি হত না – এই আমার বিশ্বাস। তাই আমি লন্ডনের lunch-কে বলতুম লাঞ্ছনা, আর supper-কে বলতুম suffer!
আলী-সাহেব বিলিতি ব্রেকফাস্ট চেখে হতাশ হওয়াতে খুব আশ্চর্য লাগেনা, বিশেষতঃ যখন খেয়াল করি মানুষটি খাস-সিলেটি।
আসাম-সংলগ্ন সিলেট বা শ্রীহট্ট বিভাগের ঢাকা-দক্ষিণে ছিল বাঙালীর যুগাবতার শ্রী চৈতন্যদেবের পূর্বপুরুষের বাস। কথিত আছে যে মহাপ্রভুই পরবর্তীকালে নিত্যানন্দের পানিহাটির বাড়িতে রাধাবল্লভের ভোগ হিসেবে নির্মাণ করেন মৌরি-বাটার পুর দেওয়া এক মুখরোচক কচুরি – নাম রাখেন রাধাবল্লভী। অতএব, যে লেখকের দ্যাশের মাইনষে হাফ-ডজন রাধাবল্লভী, চা আর জিলাপি সাবড়ে প্রাতঃরাশ সমাধা করায় অভ্যস্ত, সু-রসিক তিনি খামকা oat-এর মতন পানসে বস্তু নিয়ে উচ্ছ্বসিত হবেনই বা কেন!
আর শুধু প্রাতঃরাশেই তো থেমে থাকা না, দুপুরে ও রাতে কব্জি ডুবিয়ে সিলেটি কায়দায় পাকানো পাতিহাঁসের মুসাম্মান (মুসল্লম), আনারসের টুকরো দিয়ে রাঁধা ইলিশ, অথবা জয়ন্তী পাহাড়ের ধানি লংকাগুঁড়ো আর বাগানের হাটকড়া (ষাটকড়াই)-টি দিয়ে সযত্নে জারিত গোশ্্ত যে খেয়েছে তার কাছে হড়হড়ে স্যুপ, আলুনি সেদ্ধ তরকারি বা মাংসের বিলিতি বিস্বাদ নিতান্তই তুশ্চু! এরপর যদি শেষপাতে থাকে গরমাগরম চই, চিতোই, ধুপি বা চুঙ্গি পিঠা, বা নরমপাকের হন্দেশ (সন্দেশ), তাহলে ঐ আংরেজি লাঞ্ছনার উৎসটুকু বুঝতে আর কষ্ট হয় না।
কথার বলে, মাছেভাতে বাঙাল-ই। পদ্মাপারের জলমাটির দ্যাশের রান্নার কথা উঠলে চারটি সামগ্রীর উল্লেখ প্রথমেই আসে – মিষ্ট ও নোনা জলের মাছ, সেদ্ধ চালের ভাত, উৎকৃষ্ট গোশ্্ত, আর সর্ষের তেল।
আর, মাছের মধ্যে জনপ্রিয়তার নিরিখে আসবে কই, ইলিশ, পাবদা, ট্যাংরা, মৌরলা, রুই, কাচকি – প্রভৃতি মিঠে ও নোনা জলের মাছ। নদী-নালা-জলাভূমির ও বাৎসরিক বন্যায় কবলিত সমতলভূমির আরও কিছু ভৌগোলিক প্রতিফলন অনিবার্যভাবে রান্নায় ধরা পড়ে – এক, প্রভূত পরিমাণে মূল-জাতীয় তরকারি (গাঁটিকচু, মানকচু, মুলো, ওল ইত্যাদি)-র ব্যবহার, ও দুই, উপকূলবর্তী অঞ্চলে শুঁটকি মাছের জনপ্রিয়তা। ঘটি-বাঙলার নিরিখে, পুব-বাঙলার রান্নাঘরে দুধ-ঘিয়ের ব্যবহার কম (রংপুর-রাজশাহী বাদে), ও মশলার ব্যবহার বেশী। বাঙাল রন্ধনশৈলীকে অঞ্চলভেদে বেশ কিছু ঘরানায় ভাগ করা যায় – এক একটি ঘরানার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে সেই অঞ্চলের ভূগোল ও ইতিহাস।
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত সিলেটের কথা আমরা আগেই বলেছি।
এরপর আসা যাক রাজধানী ঢাকায় (বাঙালে কয় ঢ্যাহা)। ঢাকার রান্না বাকি পূর্ববঙ্গের থেকে অনেকটাই স্বতন্ত্র। ঢাকাইয়া মানেই চিতলের মুইঠ্যা, মানকচু-বাটা, ইলিশের মুড়ো দিয়ে কচুর শাক বা মোহনভোগ-প্রিয় বাঙাল। তার ওপর সতের’শ খ্রীষ্টাব্দের গোড়া থেকে পলাশীর যুদ্ধ অবধি দেড়শো বছরের সময়কালে সুবে-বাঙলার মুঘল-অধিকৃত রাজধানী হওয়ার সুবাদে ঢাকার লোকাচার ও রান্নায় প্রভূত পারসি ও আরবি প্রভাব পড়ে। বাঙালীসুলভ মাছভাত ছাড়াও গোশ্্তের বিরিয়ানি, বাখরখানি, ঢাকাই পরোটা প্রভৃতি মুঘল খাবারও সমান্তরালভাবে ঢুকে পড়ে বাঙালের রান্নাঘরে।
আজকের দিনে প্রতিবছর পয়লা বৈশাখে ঢাকা শহরের রমনা বটমূলে যেমন মাটির পাত্রে পান্তা-ইলিশ খাওয়ার ভিড় জমে, তেমনই রমজানের মাসে চকবাজারের রাস্তার দু’পাশে সন্ধ্যে হলেই গমগমিয়ে চলে কাবাব-বিরিয়ানি-হালিমের ঢালাও ইফতারি সওদা। ইফতার-সামগ্রী হিসেবে চকবাজারের পঁিয়াজি-বেগুনি-ছোলার ঘুগনি-শাহী জিলিপি-বোরহানি-খাজা/শুটি কাবাব বা ‘বড়ো বাপের পোলা’-র জনপ্রিয়তা একান্তভাবে ঢাকার স্বাক্ষর বহন করে।
যে কোনো জনপ্রিয় লোকরীতির মতই বাখরখানি নিয়েও প্রচলিত আছে শহুরে উপকথা। নাজির হোসেন তাঁর ‘কিংবদন্তীর ঢাকা’ বইতে গল্পটি বলেছেন। দ্বিতীয় মুর্শিদকুলি খাঁ (রুস্তম জং)-এর জামাতা মির্জা আগা বাখর আরামবাগের নর্তকী খানি বেগমের প্রেমে পড়েন।
ওদিকে কোতোয়াল জয়নুল খাঁ’রও নজর ছিল খানির ওপর; ফলতঃ, বাখর আর খানির প্রেমের পথে আসে বাধা। ধূর্ত জয়নুল প্রথমে খানি-কে অপহরণের নাটক মঞ্চস্থ করে মিথ্যা ষড়যন্ত্রে আগা বাখরকে ফাঁসিয়ে তাঁকে কারারুদ্ধ করান, ও পরে, আগার প্রেয়সীকে বলপূর্বক তুলে নিয়ে দক্ষিণবঙ্গের জঙ্গলে পালিয়ে যান। বাখর বীর যোদ্ধা ছিলেন, তিনিও অবরোধ থেকে পালিয়ে চন্দ্রদ্বীপ অবধি জয়নুলকে ধাওয়া করেন। খানি-কে আর আটকে রাখা যাবেনা বুঝতে পেরে নিষ্ঠুর জয়নুল আগা বাখর পৌঁছবার আগেই বুকে ছুরি বঁিধিয়ে তার প্রিয়তমাকে হত্যা করেন। ক্রোধে, দুঃখে প্রায়োন্মাদ বাখর চন্দ্রদ্বীপেই থেেক যান।
আশেপাশের কয়েকটি জঙ্গল (সেলিমবাগ ও বুজুর্গ-উমিদপুর, যেটি অধুনা বরিশাল বিভাগের বাকরগঞ্জ নামে পরিচিত) তাঁর শাসনে আসে। বিবাহও করেন, কিন্তু, শোনা যায়, খানিবেগমকে ভুলতে পারেননি কোনোদিনও। তাঁর নাম ও খানি-র নাম মিলিয়ে ঢাকার জনপ্রিয় রুটির নাম হয় বাখরখানি। রুপাই-সাজুর নকশিকাঁথার মতই বাখর-খানির বিরহাত্মক প্রেমের মর্মন্তুদ পরিণতি এইভাবে লোকায়ত হয়ে রয়ে গেছে।
যা বলছিলাম তাতে ফিরে আসি আবার।
এত জম্পেশ মাছ-ভাত মোগলাই খাবারের কথার পরে, শেষপাতে তরিজুৎ করে পিঠে খেলে তবেই না পেটে সইবে! পিঠে খাওয়ার প্রতুল আয়োজন বাঙালের রসুইঘরে। তা সে ভাপা (steamed), পাকানো (fried), বা পুলি (dumplings) – যে ধরণেরই হোক না কেন। চন্দ্রপুলি, গোকুল, চিতোই, চই, চুঙ্গা পিঠা, পাটিসাপটা, মুগের পুলি, দুধপুলি, চুষির পায়েস ছাড়াও বিবিয়ানা, জামাই-ভুলানা প্রভৃতি আরো হরেকরকম মনোহারী আঞ্চলিক পিঠার চল গোটা পূর্ববঙ্গ জুড়ে। হেমন্তের শেষে অঘ্রাণের ফসল কাটার সময় এলে কাটা ফসলের গন্ধে নতুন চালের গন্ধ মিশে নবান্নের শাঁখ বেজে ওঠে ঘরে ঘরে, সেই আবহমান কাল থেকে-
এইখানে নবান্নের ঘ্রাণ ওরা সেদিনও পেয়েছে;
নতুন চালের রসে রৌদ্রে কত কাক
এ-পাড়ার বড়ো, মেজো, ও-পাড়ার দুলে বোয়েদের
ডাকশাঁখে উড়ে এসে সুধা খেয়ে যেত।
প্রসঙ্গতঃ, চালের পিঠেপুলি ব্যতিরেকে মধুরেণ সমাপয়েৎ বিভাগের অন্য সদস্যদের মধ্যে অবশ্য-উল্লেখ্য: চমচম, জিলাপি, অমৃতি, মিষ্টান্ন (পায়েস), মালপোয়া, ফির্ণি, মোরোব্বা, বরিশালের ঈচার মুড়া, নারকোলের দুধের পায়েস, বরিশাল-খুলনার রাঙা আলুর পুলি, বা রংপুরের পাত-ক্ষীর।
বাঙাল চিরকালই তার রান্নাঘরটি নিয়ে গর্বিত। ময়মনসিংহের বিখ্যাত রায়বাড়ির স্বনামধন্যা মেয়ে লীলা মজুমদারের লেখা একটি ভারি সুন্দর রান্নার বই আছে, যার কথা হয়তো অনেকেই জানেন না। সেই বইয়ের ভূমিকায় উনি বলেছেন: “সারা জীবন দেখে দেখে এটুকু বুঝেছি মানব-জীবনের কেন্দ্র হলো গিয়ে ঐ রান্নাঘরটি। রান্নাঘর যে চালায় সে পৃথিবীর কলকাঠিটিও ঘোরায়। কারণ, যে যাই বলুক, শতকরা ৭৫ জন লোক খেয়ে দেয়ে যেমন আনন্দ পায়, তেমন আর কিছুতে নয়।
” এই আপ্তবাক্যটি মনে রেখেই বোধকরি বাঙালের রান্নার এত আয়োজন, এত জাঁকজমক। আয়োজন ও শ্রমসাধ্য রান্নার কথা উঠলেই একটি খাবারের কথা সামনে আসবে – কাসুন্দি। কাসুন্দির চল ছিল দুই বঙ্গেই – পশ্চিমে মালদা মুর্শিদাবাদ গৌড়ীয় বঙ্গে আর পূর্বের রাজশাহী বিভাগে, যেখানে আম-জাম-কাঁঠালের মতো ফল-পাকুড়ের ফলন-প্রাচুর্য। মায়েদের মুখে শুনেছি, কাসুন্দি বানানো প্রায় একটি বারোয়ারি উৎসবের মত সারাদিনব্যাপী কর্মকান্ড ছিল। পাড়ার বৌয়েরা জড়ো হয়ে এক উঠানে বসে বানাতেন, বহু নিয়ম, নিষ্ঠা, আচার মেনে (প্রধানতঃ স্বাদ ও সংরক্ষণযোগ্যতার খাতিরে) কাসুন্দি তৈরীর রীতি ছিল।
আজও রাজশাহী অঞ্চলে (এবং অন্যত্রও) পয়লা বৈশাখে কাঁচা আম ও কাসুন্দি সহকারে নতুন বছরকে স্বাগত জানাবার চল আছে। রাজশাহী ঢাকার উত্তর-পশ্চিমে, এখানে মোঘলাই প্রভাব রান্নায় বড় একটা পড়েনি। রাজশাহীর জমি ঊর্বর, বাংলাদেশের ৮০% আলু, প্রভূত পরিমাণে ফল-তরকারি, গোশ্্ত ও দুধ উৎপন্ন হয় এই অঞ্চলে, তাই রাজশাহীকে পুববাংলার খাদ্যভান্ডারও বলা হয়।
সিলেট, ঢাকা, রাজশাহী পেরিয়ে অবশেষে আসা যাক দক্ষিণদিকে – উপকূলবর্তী চট্টগ্রাম, নোয়াখালি, বরিশাল ও খুলনা বিভাগে। জল-জঙ্গল-সমুদ্র মোড়া এই অঞ্চলের মানুষের লৌকিক আচারগুলি একটু স্বতন্ত্র।
এই এলাকায় বিশেষভাবে কুমীরের প্রাদুর্ভাব নিয়ে গৃহস্থের বড়ো বালাই ছিল। এই প্রসঙ্গে একটি ছড়া শুনেছিলাম, বাড়ির বউ দুপুরের খাওয়াটি সেরে কলতলায় হাত ধুতে ধুতে স্বামীকে বলছেন:
ভালো কথা মনে পড়সে আঁচাইতে আঁচাইতে
ঠাকুরঝি’রে লইয়া গ্যালো নাচাইতে নাচাইতে।
কুমীরের মাংস দক্ষিণবঙ্গের বাঙালে খেত কিনা জানা নেই, তবে নোয়াখালির হরিয়াল-খাশিহাঁস-বনমুরগী বা নোনা ইলিশ, চট্টগ্রামের শুঁটকি, পোস্ত বা মেজবান গোশ্্ত, আর বরিশালের নারকোল দিয়ে ডাল, কচুর লতি, কচুর শাক, শোল-মূলো বা তেল-কই উপকূলবর্তী বিস্তৃত এলাকার রন্ধনশিল্পের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। দক্ষিণবঙ্গে শুঁটকির মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হল লইট্যা, ছুড়ি, পঁুটি, চাপিলা, লাখুয়া, রূপচাঁদা, চিংড়ি, কাসকি (কাঁচকি) ও নাইল্যা। আবার কিশোরগঞ্জ, মৈমনসিংহ, সিলেট, কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ জেলায় এ-ছাড়াও ফলন আছে চাপা শুঁটকির, যা প্রধানতঃ লবণাক্ত পুঁটিমাছ রোদে শুকিয়ে ও চাপে রেখে প্রস্তুত করা হয়।
যাঁকে দিয়ে এ-বৃত্তান্ত শুরু করেছিলাম, তাঁর গল্প দিয়েই শেষ করি। আলী সাহেব তাঁর বেহিসেবি জীবনে balancing of the budget কলাটি কোনও কালেই রপ্ত করতে পারেননি। শস্যশ্যামলা বঙ্গভূমিতে মাছভাত খেয়ে থাকাকালীন যা অর্থ তিনি সঞ্চয় করেছিলেন, বিলেতে গিয়ে লাঞ্ছনা ও suffering-এর ঠ্যালায় প্রায় সবটাই উবে যায়। এই দৈন্যদশা নিয়ে প্রায়শঃই আত্মীয়বন্ধুদের স্নেহগঞ্জনা তাঁকে শুনতে হত। সেই স্বীকারোক্তি, সম্পর্কে-বৌদি শ্রীমতী সুনন্দা সেন-কে লেখা একটি চিঠির ছত্রে-
যত টাকা জমাইয়াছিলাম
শুঁটকিমৎস্য খাইয়া
সকল টাকা লইয়া গেল
গুলবদনীর মাইয়া!
লিখেছেন – সোহিনী
কৃতজ্ঞতা –
১।
উইকিপিডিয়া, ২। বাংলাপিডিয়া, ৩। এরশাদ আহমেদ, ৪। জিয়াউদ্দিন চৌধুরি – Regional Cuisines of Bangladesh – A Food Lover’s Journal ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।