পুনরায় রৌদ্রহীন রৌদ্রে আমি, পথহীন পথে
কেনেডি স্পেস সেন্টার নিয়ে বেশী কিছু লিখব না ভেবেছিলাম। কিন্তু আগের পর্বে পাঠকদের নিরাশ হতে দেখে ভাবলাম কিছু লিখি।
আমি থাকি হিউস্টনের নাসা সেন্টারের পাশেই। কিন্তু জনসন স্পেস সেন্টারে কন্ট্রোল টাওয়ার ছাড়া শুনেছি কিছু নেই। নাসার নভোযানগুলো মূলতঃ ফ্লো্রিডার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকেই উৎক্ষেপণ করা হয়।
তাই ভেবেছিলাম এই স্পেস সেন্টারটা অন্যগুলোর চেয়ে আকর্ষণীয় হবে।
কেনেডি স্পেস সেন্টার ফ্লোরিডার টিটাসভিল শহরের পাশে একটা ছোট্ট দ্বীপে অবস্থিত। অরল্যান্ডো থেকে টিটাসভিল উওর-পূব দিকে প্রায় ৪০-৪৫ মিনিট গাড়ী দুরত্বে অবস্থিত। আমরা যখন টিটাসভিলে পৌঁছালাম, তখন রাত বাজে প্রায় বারটা। ছোট শহর, রাতের অন্ধকারে কেমন যেন ভূতুড়ে মনে হচ্ছিল।
যাই হোক, শহরে ঢোকার মুখেই একটা ডে'জ ইনে থাকার জায়গা পাওয়া গেল।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে নাশতা সেরে হাঁচর-পাচর করে বেরোতে বেরোতেই এগারোটা বেজে গেল। রিসেপশনের কাউলা আপাকে ডিসকাউন্ট টিকেটের কথা বলতেই পাশের মোটেলে খোঁজ নিতে বলল। গিয়ে দেখি এক বুড়ি রিসেপশনের পাশে টেবিল পেতে টিকেট বেচছে। ফারাক বেশী না, গেটে হয়ত জনপ্রতি ৪৫, বুড়ির কাছে ৩৮ করে কর সহ।
টিকেট নিয়েই ছুটলাম।
আমরা ফ্লোরিডা আসার পর থেকে প্রতিদিনই বৃষ্টি হচ্ছে। এখানেও দেখলাম সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার। স্পেস সেন্টারের গেটে পৌঁছাতেই ঝুম বৃষ্টি নামল। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতেই পার্কিং লট থেকেই ভিজিটর কমপ্লেক্সের ভেতরে ঢুকলাম।
গেটে টিকেট দেখানোর পর যে সূচী ধরিয়ে দিল তাতে দেখলাম সাড়ে বারটা থেকে একটা আই ম্যাক্স মুভি শুরু হবে। অগত্যা তাই সই। এখানে বলে রাখি আই ম্যাক্স-এর ওই দুটি ত্রিমাত্রিক ছবি ছাড়া স্পেস সেন্টারের আর কোন কিছুই আমার ভাল লাগে নি। কিন্তু, নাসায় এসে যদি কেবল আই ম্যাক্স দেখতে হয়, তবে আর এখানে আসা কেন?
যাই হোক, প্রথম ছবিটি ছিল মহাশূণ্য বিশেষ করে আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্র নিয়ে। ধারা বর্ণনায় টম ক্রুজ।
দুই ছবিতে দুই টম ধারাভাষ্যে- ক্রুজ আর হ্যাংকস। একটা নতুন তথ্য জানলাম। আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্রের সাথে বিশ্বের ১৬ টি দেশ জড়িত। এতগুলো দেশ মহাকাশ গবেষণা করে আগে জানতাম না। রাশিয়ার ব্যাপারে আমেরিকান বিজ্ঞানীদের বেশ গদ্গদ দেখলাম।
আসলে মহাকাশ বিজ্ঞানটা তো ওরা রাশানদের কাছ থেকেই শিখেছে। ত্রিমাত্রিক ছবি বেশ মজার। মনে হল, আমিই মহাকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছি। একটা নভোযান উৎক্ষেপণের দৃশ্য দেখানো হল। পাথরগুলো যেন পর্দা ফেঁড়ে আমার মুখে এসে পড়ল।
প্রথম আইম্যাক্স মুভি দেখার পর গেলাম 'শাটল লঞ্চ এক্সপেরিয়েন্সে'। ভাবলাম এবার বোধহয় একটু মহাশূণ্যের ভার্চুয়াল অভিজ্ঞতা হবে। আমাদের সবাইকে বলল আলগা জিনিষপত্র পকেটে না রাখার জন্য, শুণ্যে ভেসে বেড়াতে পারে। কিসের কি। একটা রোলার কোস্টারের মত যন্ত্রে তোলা হল।
ওইটাই আমাদের নভোযান। রোলার কোস্টার এমনি ভয় পাই। একদিন আগে ভুল করে ইউনিভার্সাল স্টুডিওতে উঠে পড়েছিলাম 'রিভেঞ্জ অফ দ্য মামি' দেখতে গিয়ে। ওটা যে রোলার কোস্টার সেটা তখন বুঝিনি। এখানে আবার দেখি একই মামলা।
কিন্তু বাঁচলাম। যন্ত্রটা আমাদের নিয়ে শুধু উপরেই উঠল, নভোযান উৎক্ষেপণের অভিজ্ঞতা দিতে, নীচে আর নামল না। নাসার চৌদ্দ গুষ্ঠি গালি দিতে দিতে ওই খান থেকে বের হলাম।
এরপর গেলাম দ্বিতীয় ছবি দেখতে। এবারের বিষয় চাঁদে অভিযান।
মজা পেলাম, যখন নীল আর্মস্ট্রং-এর চাঁদে পা রাখার দৃশ্যটা বিভিন্নভাবে শ্যুটিং করে দেখানো হল। কারণ, মানুষ চাঁদে গেছে এটা অনেকেই এখনো বিশ্বাস করে না। তাই নানাভাবে চিত্রায়ণ করে দেখানো হল এবং বলা হল কেউ যদি চাঁদে যাওয়াটাকে এরকম সিনেমার দৃশ্য মনে করে, তাতে আমাদের কিছু আসে-যায় না। এখানেও একটা নতুন তথ্য জানলাম। চাঁদে যে খাদ্গুলো রয়েছে তার গভীরতা অনেক বেশী- দশ-বারটা হিমালয় তাতে ঢুকে যেতে পারে।
কিন্তু খালি চোখে এই গভীরতা বোঝা যায় না, মনে হয় সামান্য গর্ত। তাই চাঁদে নভোচারীদের খুব সাবধানে পা ফেলতে হয়। গর্ত মনে করে একবার খাদে পা দিলেই আর ফিরে আসতে হবে না।
এরপর গেলাম 'ম্যাডনেস ইন মার্স' নামে একটা শো তে। ওহ, এটা ছিল একটা পুরা যন্ত্রণা।
দুটো মহিলা নেচে-কুঁদে আমাদের মহাকাশ নিয়ে জ্ঞান দিল। অন্ধকারে বসে ছিলাম। শো শেষ হওয়ার পর আলোতে দেখি আমাদের চারপাশে সব কাচচা-বাচচা আর তাদের অভিভাবকরা। বুঝলাম এটা একটা বাচচাদের শো ছিল। আমরা অতি উৎসাহে আগেই জায়গা নিয়ে বসে পড়ায় কিছু বুঝতে পারি নি।
এছাড়া আয়োজন বলতে ওখানে আর যা ছিল তা হল- একজন নভোচারীর সাথে সাক্ষাৎ। একটা লোককে দেখলাম স্পেস স্যুট পরে একটা হলের দিকে যেতে। তা স্যুটের নীচে যে আসল নভোচারী আছে তার গ্যারান্টি কি? ব্যাটা তো নাসার জেনিটরও হতে পারে। ওই দিকে আর পা বাড়ালাম না। এছাড়া আছে রকেট গার্ডেন- একটা জায়গায় কিছু রকেটের কংকাল ছড়ানো আছে আর আছে স্পেস শপ- স্যুভেনির কিনে আরো কিছু পয়সা ফেলবেন।
কিনব না কিনব না করেও নাসার লোগো দেয়া একটা কলম দানী কিনে ফেললাম। বেকুব হলে যা হয়!
এর মধ্যে পাঁচটা বেজে গেল। ছুটলাম বাস ট্যুর দিতে। বাসে করে নাসার বিভিন্ন অংশ ঘুরিয়ে দেখাবে। বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছি, একটা বাসও এসে থামল।
কিন্তু ড্রাইভার ব্যাটা প্যাঁচার মত মুখ করে বলল বাস ট্যুরের সময় শেষ হয়ে গেছে, আর কোন বাস যাবে না। আবার ধাপ্পাবাজি! সূচীতে পরিষ্কার লেখা আছে সাতটায় নাসা বন্ধ, পাঁচটায় বাস ট্যুর বন্ধ এটা তো কোথাও লেখা নেই। ব্যাটার সাথে তর্ক করে তো কোন লাভ নেই। কমপ্লেক্সের বাইরে একটা 'হল অফ ফেম' মিউজিয়াম ছিল। ওটা দেখারো আর রুচি হল না।
আরো দু'তিন ঘণ্টা আলো থাকার কথা। এখান থেকে ডেয়টোনা বিচ যেতে এক ঘন্টা লাগে। ঠিক হল এখন ডেয়টোনা গিয়ে সমুদ্র দেখব। মহাশুণ্য নিপাত যাক।
বিঃ দ্রঃ - কেনেডি স্পেস সেন্টার নিয়ে বাংলা উইকিপিডিয়ায় আমি একটি প্রবন্ধ শুরু করেছি।
আপনি চাইলে এটি সম্পূর্ণ করতে পারেন। এইখানে লিঙ্কঃ
http://tinyurl.com/2wgz7f
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।