যে শিক্ষক বুদ্ধিজীবী কবি ও কেরানী প্রকাশ্য পথে হত্যার প্রতিশোধ চায়না আমি তাদের ঘৃণা করি
বাংলাদেশে বিরোধী দলের ওপর নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা প্রায় প্রথম থেকেই শুরু হয়েছে। যেভাবে এটা হয়েছিল তার তুল্য কোনো ব্যাপার ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগে পাকিস্তানেও দেখা যায়নি। মত প্রকাশের স্বাধীনতা, মিটিং-মিছিলের অধিকার ইত্যাদি দিক দিয়ে বিচার করলে বাংলাদেশের জনগণ গণতান্ত্রিক অধিকারহীনতার মধ্যেই বরাবর বসবাস করে এসেছেন। নিজেদের আন্দোলন ও শক্তির জোরে তারা কোনো কোনো সময় নিজেরা স্বাধীনভাবে কাজ করলেও সরকার যখনই সুযোগ পেয়েছে তখনই জনগণের অধিকারের ওপর হামলা করেছে।
এখনকার অবস্থার দিকে তাকালেও দেখা যাবে, দুই বছরের দখলদারি সামরিক শাসনের পর সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতাসীন হলেও বর্তমান সরকার জনগণের মত প্রকাশের স্বাধীনতা, মিটিং-মিছিলের ওপর যেভাবে হামলা করছে আপাত দৃষ্টিতে এটা এক বিস্ময়কর ব্যাপার।
মিটিং-মিছিলের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্য তারা অনুমতির ব্যবস্থা করেছে। এছাড়া মিছিলের ওপর নানারকম নিষেধাজ্ঞা বজায় রেখে এবং পদে পদে বাধা দিয়ে তারা জনগণের সাংগঠনিক স্বাধীনতাকে বেশ প্রকটভাবে খর্ব করেছে। ফ্যাসিবাদের অর্থ শুধু হত্যাকাণ্ড, জেল-জুলুম নয়। যে কোনো ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থায় সরকারকে দেখা যায় আইনের আওতার বাইরেও জনগণের ওপর জুলুম করতে, তাদের স্বাধীনতা খর্ব ও হরণ করতে। এদিক দিয়ে দেখা যাবে শুধু বর্তমান সরকারই নয়, এ যাবৎকাল বাংলাদেশের প্রত্যেকটি সরকারই ফ্যাসিবাদের এই চরিত্র-লক্ষণসম্পন্ন।
বর্তমানে ঢাকায় যেখানেই মিটিং করা হোক, তার জন্য পুলিশের অনুমতি লাগে। মাইক ব্যবহারের জন্য অনুমতি লাগে(অথচ যৌন রোগের তেল বেঁচতে মাইকের অনুমতি লাগে না!) মিছিল করলে তাতে পুলিশের বাধা এক সাধারণ ব্যাপার। এই নির্যাতনকে পুলিশি নির্যাতন বলা হলেও আসলে এটা হলো সরকারের নির্যাতন। পুলিশ কোনো স্বাধীন সংস্থা নয়। যে সরকার ক্ষমতাসীন থাকে তার নির্দেশ অনুযায়ীই পুলিশ কাজ করে বা কাজ করতে বাধ্য হয়।
কাজেই পুলিশি নির্যাতন বলতে আসলে সব সময়েই বোঝায় সরকারি নির্যাতন।
গত রোববার ভারতীয় দূতাবাসের সামনে তাই যা ঘটেছে, তাতে পুলিশের ভূমিকাকে বাড়াবাড়ি শুধু নয় চরম বাড়াবাড়িই বলা যায়। কেননা ল্যাম্পপোস্ট নামের একটা প্রায় অখ্যাত সংগঠন তার অল্পকয়েকজন তরুন-তরুনী কর্মী নিয়ে ভারতীয় দূতাবাসের জন্য কতখানি হুমকি সৃষ্টি করছিল তা সহজেই অনুমান করা যায়, ছবিতেও দেখা গেছে ছেলে-মেয়েগুলোর হাতে একমাত্র অস্ত্র বলতে ছিল টিপাইমুখ বাধের প্রতিবাদে লেখা কিছু ফেস্টুন আর চোখেমুখে ক্রোধ। এটাকেও অবশ্যি অস্ত্র বলা যায় সরকারী ভাষ্যে!
ওই সংগঠনের দু’জন কর্মীকে পুলিশ রিমান্ডে নিয়েছে, প্রথম আলো ল্যাম্পপোস্ট সংগঠনটির সাথে কোন চরমপন্থি সংগঠনের যোগ আছে, তারা কিভাবে পাঠচক্রের নামে কর্মী সংগ্রহ করে, তার উস্কানিমূলক বর্ণনা তুলে ধরেছে। ল্যাম্পপোস্ট নাকি পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি(এম এল) এর ভগ্নাংশ! ২০০৫ সালে এই অংশের নেতা মোফাখ্খার চৌধুরীকে রেব "ক্রসফায়ারে" হত্যার পর পার্টি ভেঙ্গে গেলে নাকি এরাই পার্টিকে সংগঠিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে! আমরা জানি এই ঢাবি তে শত শত পাঠচক্র আছে।
আছে বিভিন্ন নামে পাহাড়ি ছাত্রদের সংগঠন, আরো আছে উগ্র ধর্মীয় পাঠচক্র। এসবের ভেতর থেকে অনুসন্ধিৎসু প্রতিবেদক ঠিকই নিষিদ্ধ ঘোষিত পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির অস্তিত্ব পেয়ে গেলেন! মারহাবা!!
এখানে সেই বোকা কৃষকের গল্পটা প্রনিধান যোগ্য। চালাক বাঁদর কৃষকের খাবার খেয়ে বোকা ছাগলের মুখে এঁটো মাখিয়ে রাখত। আর কৃষক না বুঝে ছাগলকে ধরে পেটাত। বাস্তবে "সকল শ্রেণীর পত্রিকা" প্রথম আলো দেশের স্বার্থে একটি ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য বিদেশী দূতাবাসের সামনে মিছিলকারী ল্যাম্পপোস্টের কর্মীদের বিরুদ্ধে সরকারকে কানপড়ানি দিচ্ছে।
ঠারে-ঠোরে সরকারকে এও বুঝিয়ে দিচ্ছে যে এরা ভয়ংকর! এরাই সেই মোফাক্কারের চ্যালা। আর সরকার যেন এদের আচ্ছামত টিট করতে পারে সে জন্য আরো বলা হচ্ছে....."এরা নিজেদের সংগঠনের নাম ঠিকানা বলতে রাজি হয়নি। এরা বহিষ্কৃত সদস্য ঋত্তিক ওরফে আত্তাব ওরফে দাউদ,সফি, সুমন। এদেরকে কেন্দ্রীয় কমিটি বহিষ্কার করার কারণে এরা নতুন করে "ল্যাম্পপোস্ট" নামে আত্মপ্রকাশ করতে চাইছে"।
তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়াচ্ছে? টিপাইমুখ ইস্যুটা পুরোটাই হাওয়া! কেন বাংলাদেশের মানুষ টিপাইমুখ বাঁধের বিরোধিতা করছে, কেন এই বাঁধের বিরোধিতার জন্য গুলশানের অভিজাত এলাকায় সুরক্ষিত ভারতীয় দূতাবাসের সামনে তরুন-তরুনীরা মিছিল করতে গেছে, কেন এবং কি কি কারণে টিপাইমুখ আমাদের জাতীয় অস্তিত্বের প্রতি মারাত্মক হুমকি এর কোন কিছুই ওই রিপোর্টে আসেনি।
আসার কথাও নয়। কারণ ওই পত্রিকাটির উদ্দেশ্যই এই ঘটনাটিকে একটি বিশেষ দলের ট্যাগ দিয়ে সরকার এবং সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করা। এবং তারা তাতে সফল(!)। এখন সাধারণ মানুষ টিপাইমুখ বাঁধের ইস্যুর চেয়ে বড় স্ক্রুপ আইটেম মনে করতে থাকবে কারা এই ল্যাম্পপোস্ট ?জামাতীরা নতুন ইস্যুতে কাছা দিয়ে বলবে-মার ব্যাটাদের!
জনাব মতিউর রহমান। কমরেড মতিউর রহমান।
এক সময়কার বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি'র মুখপাত্র সাপ্তাহিক "একতা"র সম্পাদক। সেই দিনগুলির কথা মনে পড়ায় আরো একটি স্মৃতি মনে পড়ে। এখন যে প্রথম আলো নিজেকে "সকল শ্রেণীর পত্রিকা" বলে হাজির হতে চাইছে, ঠিক একই ভাবে ১৯৬০ সালে নিকিতা ক্রুশ্চেভ দ্যুমায়(পার্লামেন্টে) দাঁড়িয়ে বলেছিলেন- সোভিয়েত ইউনিয়ন এখন আর কেবল মাত্র শ্রমিক শ্রেণীর নয়, এটা এখন সমগ্র সোভিয়েত ইউনিয়নবাসীর। এই "সকল শ্রেণীর" কথাটা শুনলেই ভয় লাগে! কেননা, আমরা দেখেছি সোভিয়েত আর সকল শ্রেণীর থাকেনি। হয়ে উঠেছিল ক্রেমলিন দুর্গের বাসিন্দা সকল ক্ষমতাবান বুর্জোয়াদের রাষ্ট্র।
তেমনি এই কাগজটিও হয়ে উঠেছে সকল শ্রেণীর নামে নব্য বেনিয়া পুঁজির সেবাদাস সমাজের প্যারাসাইট বুর্জোয়াদের মুখপাত্র। যাদের কাজই হচ্ছে নিপীড়কের পক্ষে দালালি করা।
মোফাক্কার চৌধুরী এবং ডাক্তার টুটুল মারা যাবার পরও তাদের সংগঠনের কোন কর্মী প্রকাশ্যে মিটিং-মিছিল করেনি। প্রতিবাদ করেনি। এটা তাদের ধারায় নেই।
তারা গণ সংগঠন নয়। আর টিপাইমুখ নিয়ে তারা অবশ্যই প্রতিবাদী, কিন্তু এই ইস্যুতে তারা প্রকাশ্যে একটি দূতাবাসের সামনে অবস্থান করবে, প্রকাশ্যে সংবাদ সম্মেলন করবে, তাদের নাম বলবে, এটা চৈত্র মাসের আঁষাড়ে গল্প। এই কর্পোরেট মিডিয়া গোষ্ঠির এখনকার কাজ হলো, তারা ওই ২ জন কে রিমান্ডে নিয়ে স্বিকারোক্তি আদায়য়ের জন্য সুপারিশ করবে। আর তাতে করে টিপাইমুখ বিরোধিতা যে সামান্য কিছু দলছুট নিষিদ্ধ ঘোষিত ছেলেপুলের কাজ এটা প্রমান করা যাবে। এবং এতে করে ভারতীয় কতৃপক্ষের সাথে সহমতেও থাকা যাবে।
আ.লীগ. বিএনপি, জামাত বা অন্যান্য দল, এমনকি সিপিবিও যদি এই ইস্যুতে সরব থাকত বা থাকার রেকর্ড থাকত তাহলে এদেরকে এমন এঁটো মাখানোর ফাজলামো করতে হতো না।
জীবন-জীবীকার প্রায় প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে ভারতীয় পণ্য ব্যবহার করে, ভারতের উপর অর্থনৈতিক ভাবে প্রায় পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে যেমন ভারত বিরোধিতা করা যায়না, তেমনি কর্পোরেট বাণিজ্যের বেসাতিতে নাক ডুবিয়ে নির্মোহ জনদরদী সাংবাদিকতাও করা যায় না। আমার দিন পনের আগের নিয়মিত পোস্টে(সংবাদপত্রে) লিখেছিলাম---
"টিপাইমুখ বাঁধ এখন রাজনীতির দাবার বোর্ডে আড়াইচালের ঘোড়া"। এই ইস্যু নিয়ে জামাতীরা এক রকম খেলা খেলছে, সরকার এক ধরণের নতজানু মলমপট্টি দিয়ে চলেছে, বিএনপি নিজেদের ঘর গোছানোর অজুহাতে এই ইস্যু থেকে চোদ্দহাত দূরে রয়েছে। অথচ বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে এই টিপাইমুখ বাঁধ আজকের ইস্যু নয়।
১৯৭৪ সালে যৌথ নদী কমিশনের ৭ম, ৮ম, ১০ম ও ত্রয়োদশ বৈঠকে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বরাক নদীর ওপর বাঁধ নির্মাণ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। ২০০৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যৌথ নদী কমিশনের ৩৫তম সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ সম্পর্কে মেজর (অব.) হাফিজ আপত্তি জানালে ভারতীয় দলের নেতা অর্জুন শেঠী আশ্বাস দিয়েছিলেন, ভারত এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা করবে। সর্বশেষ বৈঠকে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের কথা জানানো হয়। কিন্তু কোনো ধরনের বাঁধ নির্মাণ করা হবে না বলে জানানো হয়েছিল।
এরপর প্রতি বছর ৪ বার করে যৌথ নদী কমিশনের বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত আর কোনো বৈঠক হয়নি। এর আগে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ বন্ধের প্রতিবাদ জানিয়ে এবং কী প্রক্রিয়ায় তারা জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ করবে, এ সম্পর্কে জানতে কয়েক দফা চিঠি দেয়া হলেও ভারতের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের জবাব তারা দেয়নি। ’
আমরা জানিনা শেষ পর্যন্ত এই বাঁধ নির্মাণ বন্ধ করার ব্যাপারে আমাদের প্রচেষ্টা সফল হবে কি না, কিন্তু প্রতিবাদ যে করে যেতে হবে সেটা দিবালোকের মত পরিষ্কার। এই প্রতিবাদের ভাষা কেমন হবে, কি কি ভাবে প্রতিবাদ করা যাবে সেটাও যদি কর্পোরেট বেনিয়াদের কাছে শিখতে হয়, তাহলে আমাদের প্রতিবাদের সুরে আর দ্রোহ থাকবে না। হয়ে পড়বে অন্তসারশূণ্য।
আমাদের তথাকথিত জাতির বিবেক সুশীল শ্রেণী কি তাই চাইছেন? তাই যদি না হবে তাহলে তারা একঢিলে দুই পাখি মারতে চাইছেন কেন? কেন তারা গণমানুষের দাবিকে সামান্য কিছু তরুণ-তরুণীর হঠকারিতা আখ্যা দিয়ে দিকভ্রান্ত করতে চাইছে? কেন একটি গ্রুপ বা দলের অংশকে ট্যাগিং করে তাদের বিরুদ্ধে সরকারকে "শক্ত" হওয়ার নসিয়ত করছে? শেষ পর্যন্ত কি এটা প্রগতির বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়ার আস্ফালন নয় !!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।