হঠাৎ দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। একের পর এক খুন, ডাকাতি, ছিনতাই, অপহরণসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধ আকস্মিক বেড়ে যাওয়ায় আতঙ্ক ছড়িয়েছে মানুষের মধ্যে। অপরাধীদের হাতে হাতে আগ্নেয়াস্ত্র, রাজনৈতিক সহিংসতার আশঙ্কা ও উগ্রপন্থি জঙ্গি সংগঠনগুলোর নব উত্থান- এই আতঙ্কের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ। এমন এক পরিস্থিতিতে দেশের মানুষের জান ও মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছে, সরকারের মেয়াদের শেষ সময়ে সব সেক্টরের মতো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যেও 'দেখে শুনে চলা'র মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
গোয়েন্দাদের সরবরাহ করা তথ্যেও অনেক সময় থাকছে গরমিল। পুলিশের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা এই সময়ে কোনো ধরনের রিস্ক নিয়ে কাজ করতে চান না। গা বাঁচিয়ে চলার প্রবণতা থাকে তাদের। এ সুযোগে পালিয়ে থাকা অপরাধীরা আবারও প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রিত অবৈধ ব্যবসাগুলো হাতবদল হতে থাকে এই সময়েই।
এতে করে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে তারা। রক্ত ঝরে, লাশ পড়ে। সরকারের মেয়াদ যত কমতে শুরু করে, লাশের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। হালে উগ্রপন্থি সংগঠনগুলোর তৎপড়তা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। অপরাধের লাগাম টেনে ধরতে না পারলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হওয়ার আশঙ্কা অপরাধ বিশেষজ্ঞদের।
পুলিশের এক পদস্থ কর্মকর্তা জানান, সরকারের মেয়াদের প্রায় শেষ সময়ে নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে পুলিশের সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তিরা পর্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। পুলিশ সদর দফতরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও নিরাপত্তা বিষয়ক সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে নিয়মিত। এতে জনজীবনে বিঘ্ন সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেওয়া হয়। গত কয়েক মাস ধরেই পুলিশের সবগুলো শাখা এখন নিরাপত্তা ইস্যুতে কাজ করছে। হালে তাদের কাজের পরিধি বাড়ানো হয়েছে।
দেশব্যাপী সন্ত্রাসী হামলা মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতিটি সদস্যকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এ সুযোগে দুর্বৃত্তরা সরব হয়ে ওঠেছে। ছিঁচকে চোর, ডাকাত, ছিনতাইকারী ও পেশাদার খুনিদের কাছে নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ছে সাধারণ মানুষ। সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) আজিজুল হক জানান, প্রতিটি সরকারের শেষ সময়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কিছুটা খারাপ হয়ে থাকে। তবে দুই দলের নেতা-কর্মীদের ক্ষমতার অতিমাত্রায় লালসা, এবং নিজেদের মধ্যে আধিপত্যের দ্বন্দ্বের কারণেই হয়তো পরিস্থিতি একটু বেশি খারাপ হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, আইনশৃঙ্খলা অবনতির পিছনে মাদকের ভয়াবহতাও কম দায়ী নয়। মাদকের ছোবল থেকে মুক্তি পেতে প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি খুব দরকার। এ ছাড়া বর্তমান সময়ে তত্ত্বাবধায়ক ইস্যু নিয়ে দুই দলের মধ্যে জটিলতাও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির অন্যতম একটি কারণ হতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকার সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানান, রাজধানীতে সম্প্রতি এক পুলিশ কর্মকর্তাসহ পরপর কয়েকটি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এটা খুবই দুঃখজনক।
সারা দেশেই বিচ্ছিন্নভাবে কিছু অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে। এ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের উপায় খোঁজা হচ্ছে। আশা করি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দ্রুত অপরাধীদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনতে পারবে। সামনে রাজনৈতিক সংঘাতের আশঙ্কা রয়েছে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কঠোরভাবে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রাখবে।
র্যাবের মহাপরিচালক (ডিজি) মোখলেছুর রহমান বলেন, 'সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি খুনের ঘটনা ছাড়া সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তো ভালোই আছে। কয়েকটি ঘটনা তো দলীয় অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে।
গোয়েন্দা তথ্যের ঘাটতির বিষয়টি অস্বীকার করে তিনি বলেন, গোয়েন্দারা চাইলেও রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডগুলো ঠেকাতে পারবে না। হঠাৎ করেই এসব ঘটনাগুলো ঘটে থাকে। সামনে নির্বাচন উপলক্ষে রাজনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও র্যাব সদস্যরা তা মোকাবিলা করতে প্রস্তুত।
কোনো পরিস্থিতিতেই অপরাধীদের ছাড় দেওয়া হবে না। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার জানান, ফায়দাতান্ত্রিক রাজনীতিতে ফায়দার মাত্রা সীমিত হওয়ার কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দিনকে দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আদর্শবিহীন এবং সুবিধাবাদী রাজনীতি পরিহার না করতে পারলে এর মাত্রা আরও বাড়বে। কোনোভাবেই তা ঠেকানো সম্ভব হবে না। চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বে দেশের মানুষ।
পুলিশ সদর দফতরের হিসেব অনুযায়ী সারা দেশে বিগত ছয় মাসেই আড়াই হাজারের বেশি খুনের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন শতাধিক ব্যক্তি। তবে গত এক মাসে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা খুনের শিকার হন সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া শেষ ছয় মাসে ডাকাতির ঘটনা ঘটে সহস্রাধিক। ৫ শতাধিক অপহরণের ঘটনা ঘটেছে এই সময়ে।
প্রায় ছয়শ পুলিশ হামলার শিকার হন সন্ত্রাসী হামলায়। পুলিশের সূত্র জানায়, গত এক মাসে শুধু রাজধানীতেই ২০টিরও বেশি খুনের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে অধিকাংশ খুনের ঘটনা ঘটে এলাকা ও ব্যবসার আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে। এদের মধ্যে আবার অন্তত ৫ জন রয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী। এ ছাড়া খুনের তালিকায় রয়েছেন পুলিশ দম্পতি, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী।
পুলিশের সাবেক এক কর্মকর্তার বাসভবনে ঢুকে অস্ত্রধারীরা গুলি করে হত্যার পর আবার অস্ত্র হাতেই পালিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটে। একই পরিস্থিতি দেশের অন্যান্য জেলাগুলোতেও। সর্বশেষ গত রবিবার ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা খুন হন প্রতিপক্ষের হামলায়।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।