মৌচাকে প্রথম ঢিল।
সকাল বেলাতেই মেজাজটা 'জগা' হয়ে গেল। বউটা উঠেছে ভোর ৫টায়। ওর আবার স্কুল সকাল ৭টায়। ঘরের যাবতীয় কাজ সেরে সাড়ে ৬টায় আমাকে ধাক্কা দিয়ে ঘুমটা দিল ভাঙিয়ে।
বলেন মেজাজ খারাপ হয় কিনা! শুনলাম যেতে যেতে মাষ্টার মশাই বলছেন, 'তোমার বড় মেয়েকে বাবা এসে স্কুলে নিয়ে যাবে, ছোটটাকে তুমি স্কুলে নিয়ে যেও। ওর আবার ৯টা থেকে পরীক্ষা'।
'সকাল ৯টায় মেয়ের স্কুলে যেতে হলে আমি অফিসে যাব কখন? কেউ কি সেই কথা মনে রেখেছে?' কিন্তু কাকে বলবো একথা। যাকে শুনাতে চাই সেতো এখন আরেক স্কুলে পন্ডিতি করতে গেছে। জীবনটা আমার ফালা ফালা হয়ে গেল।
বাবা কেন চাকর?
আরো কিছুক্ষণ বিছানায় গড়াগড়ি করে থেকে প্রায় পৌনে ৭টায় উঠে বড় মেয়েকে বললাম, 'ওঠ, টয়লেট, ব্রাশ শেষ করে এসো। তোমার শেষ হলে আমি ঢুকবো। ' মেয়ে বললো, 'আচ্ছা'। ওমা সোয়া ৭টা বাজে, মেয়েতো বেরোচ্ছেনা। আটটার আগেই ওকে স্কুেল ঢুকতে হবে।
আমার মেজাজ ৬ষ্ঠতে। এক্ষুণি আমার শ্বশুর আসবেন ওকে নিতে। হায় হায় আমি কি করি। দিলাম দরজায় ধাক্কা, 'বেরোও এক্ষুণি'। বের হলো।
বললাম, 'ঝটপট তৈরী হও'। ওতো তৈরী হচ্ছে তো হচ্ছেই। এদিকে দরজায় কলিংবেল বাজলো। ভাবলাম শ্বশুর বাবাজি এসেছেন। না, পত্রিকা দিয়ে গেল হকার।
মেয়েকে বললাম নাস্তা করে নাও। সে পত্রিকা পড়ছে, আর নাস্তা খাচ্ছে। বিলাসিতার চূড়ান্ত।
আবার কলিংবেল । না, এবার আকাঙ্খিত জনই।
ঢুকেই, 'কই, তোমরা রেডি তো?' মেয়েকে বললাম, 'নাস্তা করেছো, কুলি করে নাও। নানাভাই এসে গেছে। বইয়ের ব্যাগ তৈরী তো?' সে বললো, 'হ্যাঁ সব রেডি, তুমি আমার জুতার ফিতা লাগিয়ে দাও'। 'দশ বছরের মেয়ে, জুতার ফিতা লাগাতে তোমার দশজন দাস-দাসী লাগবে', আমি গজরাই আর ফিতা লাগাই। 'যাই বাবা', বলে বেরিয়ে গেল।
দু'মিনিট বাদে আবার কলিং বেল। দেখি শ্বশুর মশাই দাঁড়িয়ে, 'তোমার মেয়ের নেমপ্লেটটা দাওতো, ওটা লাগাতে ভুলে গেছে। ’ বলেন কি করি! কোনমতে নেমপ্লেটটা তাঁর হাতে গুঁজে দিয়ে দরজা বন্ধ করে সশব্দে উচ্চারণ করি 'শ্যালকের জীবন'।
চিলড্রেন মে বি ওয়াইজার.....!
আসল বিপদতো এখনো মাথার উপর রয়ে গেছে। ছোটটাকে স্কুলে নেওয়া।
এটা একটা কুঁড়ের রাণী। ঘুমাতে পারলে খাওয়া দাওয়া লাগেনা। সকাল পৌণে আটটা বাজে । কোনরকমে আদর-সোহাগ করে তুললাম। নিজে পারে টয়লেটের লাইট জ্বালাতে কিন্তু বলবে 'সুইচটা পাচ্ছিনা বাবা, একটু কষ্ট করে অন করে দাওনা।
' দিলাম অন করে। যাহোক ওকে ব্রাশে পেষ্ট দিয়ে নিজে ঢুকলাম বাথরুমে। সকালে গোসল না করলে আমার সাইনাস চরম বেয়াদবী করে। পানির কল ঘুরিয়ে দেখি পানি পড়ছে টিপটিপিয়ে। এ আরেক সমস্যা।
সকাল বেলা সবার অফিস আদালত আছে। পানি লাগবে । কিন্তু বাড়িওয়ালার কর্মীরা নবাব। যতক্ষণ না তারা সমস্যায় পড়ছে ততক্ষণ পানি ছাড়বেনা। আমি অপেক্ষা করি ।
মেজাজ সত্যিকারের সপ্তমে। যত প্রকারের গালি জানা আছে মনে মনে আওড়াই। জোরে বলিনা, কারণ মেয়েটা শুনে ফেলবে।
পানির সমস্যা দেখে এর আগে বৌকে বলেছিলাম কয়েকটা বড় বালতি ব্যবস্থা করতে । সে করেছেও কিন্তু সেগুলোও অনেকটাই খালি।
আমার আগে যারা বেরিয়ে গেছেন এবাড়ি থেকে তারাই সেগুলোর সদ্ব্যবহার করেছেন। কোন রকমে 'কাউয়া গোসল' সেরে বেরোলাম। দেখি ছোটমেয়ে হাতমুখ ধুয়ে তৈরী। ভাবলাম ভালো হয়েছে। বললাম, 'মামনি দাঁত দেখাও।
' যা দেখালো তাতে আমি হতবাক। কোন দাঁত পরিস্কার হয়নি বরং পেষ্ট লেগে আরো 'ছ্যাড়াব্যাড়া' অবস্থা। গলার স্বর বেড়ে যাচ্ছিল আমার। কোনমতে সামলে নিয়ে ওকে নিয়ে গিয়ে ভাল করে ব্রাশ করিয়ে কুলি করিয়ে এনেছি। মেয়ে বলে 'বাবা আমি কুলি করতে শিখিনি তো, তাই মুখে ময়লা রয়ে গেছে'।
হাসবো না কাঁদবো বুঝছি না।
চাচা হাইকোর্ট কতদূর.....?
সিঁড়ি দিয়ে নামছি তখন সকাল ৮:৩০টা। হাতে মেয়ের স্কুলের ব্যাগ, পানির বোতল, নিজের ব্যাগ এসময় বাড়িওয়ালার দারোয়ানটা হাতে ধরিয়ে দিল একটা হলুদ খাম। পড়ার তখন সময় কোথায়। কোন রকমে পকেটে গুঁজে রওয়ানা হলাম মেয়ের স্কুলের দিকে।
রাস্তায় এসে একটা রিক্সাওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করলাম, যাবেন বি-ব্লক? উত্তর এলো - 'না স্যার, খেপ আছে'। মেজাজ এমন চড়ে গেল, ইচ্ছা করছিল .....। ইচ্ছাটা মনে চেপেই আরেকটাকে মধুর স্বরে জিজ্ঞাসিলাম, 'ভাই যাবেন?' 'যাইতারি, ২৫টেকা লাগবো’ -উত্তর এলো। আমি অবাক। যেখানে ১৫ টাকা ভাড়ায় যাওয়া যায় সেখানে ২৫ টাকা? একটু আগের ইচ্ছেটা প্রায় বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছিল।
কোনমতে সামলে নিয়ে বলি 'চলেন'। আবারও অসহায় আত্মসমর্পণ বাস্তবতার কাছে। প্রায় পৌণে নয়টা বাজে, মেয়েটার পরীক্ষার না দেরী হয়ে যায়।
শত্রু তুমি বন্ধু তুমি.....!
মেয়েকে স্কুলে নিয়ে যাওয়ার পথে হঠাৎ ডাক, 'বস্, কই যান?' দেখি আমার এক কলিগ। 'কেন তুই বুঝস না কই যাই? মাইয়া লইয়া শ্বশুরবাড়ি যাইতাছি বুঝছস?' কিন্তু বলতে পারিনা।
থার্টি-টু অলআউট করে থাকি। রিক্সা চলতে থাকে । মাথা ঘুরিয়ে, হাত নাড়িয়ে বুঝাই, পরে কথা হবে। বুঝলাম আজ কপালে খারাপি আছে। বসরে ধুনপুন দিয়া যে দেরীর কারণ বুঝাবো সেই উপায় আর নাই।
বেটি আমার আগেই বসরে মালিশটা দিয়া দিবো। মনটা বড়ই বেচায়েন হইয়া গেল।
কপালে থাকলে ঠেকায় কোন হালা?
অফিসে এলাম ৯:২০ মিনিটে। দেখি আমার কলিগ হাসে। মেজাজটা এমন 'বিলা' হলো কি বলবো।
কিছুণ পরেই বসের কাছ থেকে এত্তেলা এলো। ডাক পেয়েই 'আমার হইয়ে গিয়েছে'। রুমে ঢুকেই একটু চিনি মেশানো হাসি দিয়ে বললাম, 'আপা ডেকেছেন?' (ম্যাডাম বা স্যার বলার নিয়ম নেই)। 'হ্যাঁ, বসুন। আগামী পরশু আমরা দিনাজপুর যাবো, গাড়ি ভাড়া করা হয়েছে।
এই নেন আপনার দাওয়াতের কার্ড'। ভাবলাম ফাঁড়া কাটলো। আপা বোধ হয় আমার দেরির ব্যাপারটা টের পাননি। উঠতে যাবো, আবার শুনি আপা বলছেন, 'আপনি ঐদিন ইসি মেম্বারদের সকাল ৮:০০ টার মধ্যে অফিসে আনার ব্যবস্থা করবেন, শার্প এইট। ৮:০০টা মানে ৮:২০ না।
' ঠোঁট দুটোকে যতটা সম্ভব ডানে বামে ছড়িয়ে, ঘাড় যতটা সম্ভব হেলিয়ে আস্তে বের হয়ে আসলাম। মুখ খুললাম না ভয়ে, যদি শব্দজনিত কোন দূর্ঘটনা ঘটে বসে!
কে বলে রিক্সায় রিস্ক নেই?
অফিস থেকে বেরিয়েছি ৫টার আগেই (আমাদের অফিস ৪টা পর্যন্ত। বড় ভাল পাই অফিসকে এজন্য) । রাস্তায় কিছুই পাচ্ছিনা। না রিক্সা, না বাস।
বাসা এমন কিছু দুর না যে হেঁটে যাওয়া যাবেনা। আগে কতই গেছি। কিন্তু কি যে ভ্যাপসা গরম ক’দিন ধরে। ঠান্ডা অফিস থেকে বেরিয়ে আরো গরমে, ঘামে ভিজে জবজবে অবস্থা। হাঁটার কথা চিন্তাই করা যায়না।
পাক্কা ৪০মিনিট অপো করে, একটা রিক্সা নিয়ে নিলাম পকেটের দূর্দশার কথা না ভেবেই। 'চলে আমার রিক্সা হাওয়ার বেগে উইড়া উইড়া'- মনে মনে গাইতে গাইতে চলেছি। হঠাৎ টং করে একটা শব্দ হলো। রিক্সাওয়ালা দেখলাম গোমরা মুখে বলছে,' মা...... রিক্সার চেনটা ভাইঙ্গা গেছেগা। ' একেতো ভ্যাপসা গরম, তার উপর এ অবস্থা।
মাঝপথে রিক্সা কোথায় পাই? বলতে গেলাম, 'ভাই, সামনের গোলচক্কর পর্যন্ত একটু হেঁটে হেঁটে নিয়ে যেতে পারো?' কিন্তু রিক্সাওয়ালার চেহারা ও তনুটা দেখে আর রিস্ক নিলাম না। ভাড়াটা দিয়ে হেঁটে হেঁটেই বাসায় ফিরলাম (ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ, হাটিয়া চলিল টাইপ)।
শেষের কবিতা
বাসায় এসেছি প্রায় রাত ৮:০০ টায়। মেয়েগুলোকে দেখে (নিন্দুকেরা মেয়ের মাকে দেখে পড়তে পারেন) সারাদিনের কষ্ট ভোলার চেষ্টা। জুতা খুলে শার্ট খুলতে যাবো, দেখি পকেটে একটা খাম।
মনে পড়লো সকালে বাড়িওয়ালার দারোয়ানের দেয়া খামটি সারাদিনে আর খোলা হয়নি ব্যস্ততায়। থাক, পরে খুলে পড়বো, মনে করে খামটা টেবিলে রেখে, বাথরুমে ঢুকে ঝপাঝপ মাথায় পানি ঢালছি, আর মনে মনে বলছি, 'আমার সারা শরীর জুড়িয়ে দাও ইশ্বর, মনটা ভরিয়ে দাও শান্তিতে'। প্রার্থনায় বোধহয় কাজ হলো। অনেকক্ষণ গোসল করে শরীর, প্রাণ জুড়িয়ে, কাপড় জামা পরে, ফুলবাবুটি হয়ে, চেয়ারে বসে, মেয়েদের মায়ের সাথে একটু হালকা আলোচনার শুরুতেই প্রথম যে কথাটি শুনলাম তাতে আমার চেয়ার থেকেই পড়ে যাওয়ার দশা। বাড়িওয়ালা বিল দিয়েছে।
মে মাসের বিদ্যুৎ বিল। এপ্রিলের শেষ তিন দিন এবং মে মাসের প্রথম বাইশ দিন আমরা বাসায় ছিলাম না একটানা। আমার শ্বশুরবাড়িতে 'মধুমাসের দাওয়াতে' বেড়াতে গিয়েছিলাম। এরপর মাত্র ৯ দিনে ৬৯৩/- টাকা বিদ্যুৎ বিল!!
আমি জ্ঞান হারাবো, মরেই যাবো, বাঁচাতে পারবেনা কেউ!!!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।