গতকাল থেকে টানা খেলা দেখে যাচ্ছি,না,রূপকার্থে না,আক্ষরিক অর্থেই। এমনিতেই কাজকর্ম ফেলে খেলা দেখার ঘটনা কম নেই,আর এখন বেকার জীবন কাটানোর জন্য ভাল একটা বুদ্ধি,অন্তত খেলা দেখার জন্য পিতৃদেব তাঁর হোটেলের অন্ন বন্ধ করবেন না এই ভরসা আছে। আগে দলবল নিয়ে দেখা হতো,ইদানিং অন্যরা কেজো হয়ে যাওয়াতে বাসায় অত্যাচার কমেছে,মাঝে মাঝে একা একাই "ঈঈঈ হাহাহা হো হো ইয়াহু ঈঈঈয়াহহহ খাউ খাউ" জাতীয় বিচিত্র চিৎকার করে মাতৃদেবীর আত্মার পানি শুকিয়ে দিই,তবে অভ্যস্ত বলে একবার ভ্রুকুটি ছাড়া তেমন একটা তিরস্কার জোটে না।
টানা অত্যাচারের শুরু গতকালকের বিশ্বকাপ ফুটবলের এশিয়ান কোয়ালিফায়ার দিয়ে। স্বাভাবিক সময়ে অবশ্যই দেখতাম না,তবে ম্যাচটা উত্তর কোরিয়ার সাথে ইরানের,আর উত্তর কোরিয়ানরা কিভাবে ফুটবল খেলে সেটা নিয়ে একটা কৌতুহল আছে।
এমন এক দেশ যাদের দেশে কোন লীগ হয় কিনা,কিভাবে তারা খেলোয়ার বাছাই করে সেটাই বাইরের দুনিয়ার কাছে একটা রহস্য। শুধু খেলার সময় হলে দেখা যায় একটা দল পাঠিয়ে দেয় আর সেই দলটা মন্দ খেলে না। মোটামুটি তাদের পাগলা প্রেসিডেন্টের মতই কাজকারবার,এরা আবার বিচিত্র জাতি,নিজেদের হোম ম্যাচও মাঝে মাঝে বাইরে খেলে। কালকে অবশ্য নিজের মাঠেই খেলেছে,পুরো লালে লাল গ্যালারি দেখে ২০০২ বিশ্বকাপের দক্ষিণ কোরিয়ার কথা মনে পড়লো। মোটের উপর ম্যাড়ম্যাড়ে খেলা,০-০ ড্র করে ইরান বাদ,কোরিয়ানদের সুযোগ আছে এখনো বিশ্বকাপ খেলার।
মাঝে দুপুরে একটা ঘুম দিয়ে বসলাম টি-২০ তে অস্ট্রেলিয়া আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলা দেখতে। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে এই খেলাটায় ঠিক অভ্যস্ত হতে পারিনি,ক্রিকেটের সৌন্দর্য হরণের জন্য এমন আদর্শ কোন কিছু আর আসেনি বলেই মনে করি। কোথায় লারা'র সেই কভার ড্রাইভ আর এক পা তুলে পুল,কোথায় সৌরভের সেই অফড্রাইভ,কোথায় মার্ক ওয়াহর সেই ফ্লিক? লেট কাট,গ্ল্যান্স,এমন অনেক অপূর্ব শট হারিয়েই যাচ্ছে,বদলে দেখা যাচ্ছে জানোয়ারের মত গায়ের জোরে মারার চেষ্টা। ক'দিন পরেই রেসলাররা ক্রিকেটে ভাল একটা জায়গা করে নিতে পারে, যার গায়ে যত জোর সে তত দূরে বল পাঠাবে। চিয়ারলিডারদের নাচানাচি নিয়ে কথা না-ই বা বললাম,একটা টেবিলের উপর যথেষ্ট বাজে ভঙ্গিতে একদল মেয়ে শরীর দেখাচ্ছে,এটা নারীবাদীদের আনন্দ তো দেবেই না,জিনিসটা যথেষ্ট হাস্যকরও বটে।
ক্যাবারে দেখতে বারে যাওয়াই উচিত,সেটাকে ক্রিকেট মাঠে আনার দরকার ছিল না,কর্পোরেট থাবা কি অশ্লীল জিনিস এটা তার একটা ভাল উদাহরণ হতে পারে। তারপরেও দেখি কাজ না থাকলে,কালকেও দেখলাম,২-১ ওভারেই এখানে খেলার নিষ্পত্তি হয়ে যায়,কাল অস্ট্রেলিয়া ১ম ওভারেই ২ উইকেট হারিয়ে খেলাটা হারিয়ে বসেছিল,আর ফিরতে পারেনি। আর গেইলের দানবীয় ব্যাটিং সেই হারটাকে ত্বরান্বিতই করেছে।
তবে যে কোন ক্রিকেটেই যে দলের কোন বদল হয়না তার নাম বাংলাদেশ,ম্যাচ হারার চেয়ে যাদের কাজকর্ম দেখেই মেজাজ খারাপ হয় বেশি। মাশরাফি দিন দিন শ্রদ্ধা হারাচ্ছে ভক্তদের,একটা দলের সবচেয়ে সিনিয়র (এবং সেরা,অন্যদের দাবীমতে) বোলার হয়ে স্লগ ওভারে বল করার সাহস হয় না,মাত্রই কয়েকটা ম্যাচ খেলা রুবেলকে সোজা বাঘের মুখে ছেড়ে দেয়ার পরেও মাশরাফি মুখ দেখায় কিভাবে কে জানে! ফাস্ট বোলার গতি দিয়ে হয় না,হয় সাহস আর অ্যাটিচুড দিয়ে,আর মুরগির কলজে নিয়ে নিজেকে পেসার দাবী করা যায়না,এটা মাশরাফি যত তাড়াতাড়ি বুঝবে ততই মঙ্গল।
বাংলাদেশের ২ জন এ+ গ্রেড(চুক্তি অনুযায়ী) খেলোয়ারের উপরই মেজাজ খারাপ,আশরাফুল বরাবরের মতই গাধার মত খেলে আউট,তামিমও মাথা খাটাতে পছন্দ করে বলে মনে হয় না,সাথে গতকাল সাকিবও যোগ দেয়াতে এই ফলই যথেষ্ট ভাল বলতে হবে। মুশফিকুর রহিমের নামের বালকটার কানে ধরে দু'টো চটকানা দেয়ারও সময় হয়েছে,এমন কোন ম্যাচ স্মৃতিতে আনতে পারি না যে ম্যাচে মুশফিক গুরুত্বপূর্ণ সময়ে কোন ক্যাচ বা স্ট্যাম্পিং করতে ব্যর্থ হয়নি। গতকাল ২ রানে যুবরাজের স্ট্যাম্পিং মিসের মূল্য বাংলাদেশকে ম্যাচটা হেরেই দিতে হলো।
বাংলাদেশের খেলা দেখার পরই বসেছিলাম ব্রাজিল বনাম উরুগুয়ের খেলা দেখতে। বেশ কিছুদিন পর ব্রাজিলকে তাদের মত খেলতে দেখলাম, ফ্রি ফ্লোয়িং আক্রমণাত্মক ফুটবল,ফলাফলও সেটাই বলে,৪-০।
তবে রাত ৩টায় খুব আশা নিয়ে আর্জেন্টিনার খেলা দেখতে বসে আশাহত হয়েছি,১-০ তে জিতলেও খেলা ছিল চরম এলোমেলো,উল্টো গোলকিপার ভাল না খেললে হেরেও যেতে পারতো কালকে। মেসি আর তেভেজ তাদের লীগের খেলার দশমাংশও দেখাতে পারেননি,গোলটাও যে একেবারে চাপিয়ে খেলার ফল তাও না। আগুয়েরোকে এখনো খুব ভাল খেলতে দেখিনি কখনো, খানিকটা ওভাররেটেডই মনে হয় এটাকে। সারা ম্যাচ সাইডলাইন ধরে হাঁটাহাঁটি করা ম্যারাডোনার দুশ্চিন্তার কারণ আছে বৈকি। তবে শত্রুও কখনো কখনো উপকার করে,আর্জেন্টিনার গায়ে লেগে থাকা উরুগুয়েকে ধোলাই দিয়ে ব্রাজিল আর্জেন্টিনাকে নিরাপদ করে দিয়েছে কালকে।
সারারাত খেলা দেখার ফল হলো একেবারে সকালে নাস্তা করে ঘুম,সেটাও শান্তির হলো না মায়ের কারণে। যতই বেকার থাকো সারাদিন ঘুমানো চলবে না,উঠতে হলো। গরমটাও পড়েছে সেরকম,হাঁসফাঁস করছি আর ভাবছি কি করা যায়। কিভাবে জানি না,দুপুরে ১০ মিনিটের মাঝে ঝড়ো বাতাস শুরু হয়ে গেল,আস্তে আস্তে শিশিরকণার মত টুপটাপ থেকে ঝিরঝির আর তারপরেই মুষলধারে নেমে গেল বৃষ্টি। হাত দু'টো বাড়িয়ে পানি নিচ্ছি,পাশের বাসায় বছর দু'য়েকের ১টা বাচ্চা আছে, চেঁচাচ্ছে,পানি! পানি!! এখনো বৃষ্টি বলতে শেখেনি,কিন্তু বর্ষার দেশের মানুষ তো,আনন্দ দেখে কে! পাশের ছাদের আণ্ডাবাচ্চাগুলোকে ভিজতে দেখে হঠাৎই নেমে গেলাম নিচে,বাসার ট্রাউজার আর টিশার্ট গায়েই।
পেছন থেকে মা হইহই করে উঠলো,ঠাণ্ডা লাগবে,ঠাণ্ডা লাগবে। লাগবে তো জানিই,তো? ভিজে আসি,পরে দেখবো। এই শহরে ভেজার মাঠ কোথায়? সদর রাস্তাই ভরসা। ফুটপাথ ধরে হাঁটছি অবশ্য,নয়তো বেরসিক বাস কোনটা চাপা দিয়ে বসতে পারে। লোকজনের অত রং নেই,কোনমতে দোকানের সানশেডের নিচে জায়গা করে নেয়ার জন্য ঠাসাঠাসি,এটিএম বুথগুলোও সাময়িক আশ্রয়ের জন্য মন্দ না।
এই দুপুরে কেজো লোকজনের জন্য বৃষ্টি একটা যন্ত্রণা,স্বীকার করি। রিকশাওয়ালারা নবাব বনে যায়,আর বাসে ওঠা মুশকিল,উঠলেও ছাতার ঝরা পানি নিয়ে নিত্য ঠোকাঠুকি,ছাতায় ছাতায় মারামারি,এতো নিজের চোখেই দেখা। হিম বাতাসে গায়ে কাঁপ ধরে যাচ্ছে,এই গরমকালের বৃষ্টিও এত ঠাণ্ডা কিভাবে হয়? ফেরা দরকার,বেশি রোমান্টিসিজম ভাল না। ফেরার পথে দেখি কয়েকটা স্কুলের ছেলেমেয়ে ব্যাগ সমেত কাকভেজা হচ্ছে মহানন্দে,আহা,কি জীবন ছিল একটা,ওদের মতই কতদিন ব্যাগের বইখাতা ভিজিয়ে বাড়ি ফিরে চুলার উপর নিউজপ্রিন্ট শুকিয়েছি। দীর্ঘশ্বাস সামলাই,ব্যস্ত শহরে স্মৃতিকাতর হবার সময় নেই।
মজা লাগলো দেখে,আরো কয়েকজন শুধুশুধুই ঘোর বৃষ্টিতে নেমে গেছে ভেজার জন্য,চুপচুপে হয়ে গিয়েও তাদের মুখে আনন্দের ঝিলিক।
সুমন চ্যাটার্জি,আপনার শহরে রিয়েলিস্টিক মেঘমল্লার শোনে কিনা জানি না,আমার পাথরের শহরে কিন্তু এখনো বাস্তববাদীরা বৃষ্টিতে ভেজে,ভিজবে আরো অনেকদিন। যতদিন বৃষ্টি হবে, আমাদের মনেও সবুজ লতার ফসল ফলবে, কথা দিচ্ছি সুমন,দেখে নেবেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।