কেউ কেউ একা
সুনামি আসে, সিডর আসে, বন্যা হয়, খরাতে পুড়ে যায় দেশ। মারা যায় মানুষ, ক্ষতিগ্রস্থ হয় ফসলের মাঠ। ঘরবাড়ি মিশে যায় মাটির সাথে। কেন এই প্রকৃতির রুদ্্রমূর্তি? নেপথ্যের কারণগুলো খুঁজতে গেলে প্রকৃতির এই আচরণের জন্য আমরা আমাদেরকেই দায়ী করতে পারি। আমরা প্রকৃতির সাথে যেমন ব্যবহার করছি তেমনি প্রকৃতি সে ব্যবহারের হিসেব নিকেশ কড়ায় গণ্ডায় আমাদের ফিরিয়ে দিচ্ছে।
প্রতিশোধ নিচ্ছে প্রকৃতি। তারপরও সচেতনতার অভাবে আমরা প্রতিনিয়ত নানাভাবে পরিবেশকে দূষিত করছি। বাসের অযোগ্য করে তুলছি নিজের চারপাশ, দেশ তথা বিশ্বকে।
বিগত শতাব্দীগুলোতে পরিবেশ নিয়ে তেমন চিন্তা-ভাবনা করা হয়নি। কিন্তু এ শতাব্দীর ষাট দশকে পানি, বায়ু ও সামুদ্রিক দূষণ, ভূমিক্ষয়, বন ধ্বংস ও মরুকরণ ইত্যাদি সমস্যা বিশ্ব পরিবেশের স্থিতিশীলতাকে হুমকির সন্মুখীন করে তুলছে।
জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব উ থান্ট ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত এক রিপোর্টে পরিবেশগত সমস্যার তিনটি প্রধান কারণ শনাক্ত করেন : ১. জনসংখ্যা বৃদ্ধি, ২. নগরায়ন ও ৩. নতুন প্রযুক্তির প্রভাব। পরবর্তী সময়ে কানাডার ভ্যাংকুবারে গ্রিন পিস নামক পরিবশে সংস্থা সমস্যার কারণসমূহ শনাক্ত করে বিশ্বজুড়ে অভিযান চালায়। এভাবে বহু আন্তর্জাতিক ফোরামের সহযোগিতায় বিশ্বব্যাপী পরিবেশ সমস্যা ও এর করুণ পরিণতি সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে।
জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন পরিবেশ সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। বায়ু, পানি ও শব্দদূষণ, ভূমিক্ষয় এবং অন্যান্য মাধ্যম কর্তৃক পরিবেশের দ্রত ক্ষয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি হওয়ায় জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ১৯৬৮ সালে এ সংক্রান্ত একটি সম্মেলনের গুরুত্ব অনুভব করে।
সে অনুযায়ী ১৯৭২ সালের জুন মাসে সুইডেনের স্টকহোমে অনুষ্ঠিত মানব পরিবেশের উপর ১ম জাতিসংঘের সন্মেলনে এ অবস্থার উপর আলোচনা শুরু হয়। এ সম্মেলনে ১১৩টি দেশ অংশগ্রহণ করে। সম্মেলনে গৃহীত ঘোষণায় বলা হয়, সব রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব রয়েছে সে তাদের কার্যকলাপ অন্যান্য রাষ্ট্রের পরিবেশ নষ্ট করছে না সে ব্যাপারে নিশ্চয়তা দেয়। এরপর বিশ্বব্যাপী জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২৭তম অধিবেশনে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে, প্রতি বছর ৫জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস হিসেবে পালিত হবে। এই সিদ্ধান্তর ভিত্তিতে গঠিত হয় জাতিসংঘ কর্মসূচি।
১৯৭৫ সালের প্রতিটি দেশের উপযোগিতা অনুযায়ী নির্ধারিত হয় বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয়।
পৃথিবী আজ নানাবিধ প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি। বিভিন্ন কারণে দূষণ পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চলেছে। এই পরিবেশ দূষণের ফলে কোন দেশে চলছে অবিরাম খড়া। ফসল হচ্ছে না।
দিন দিন মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে। আবার কোন দেশে বন্যার ফলে ভেসে যাচ্ছে মানুষ, ঘরবাড়ি, ফসলের মাঠ। কোন কোন দেশে আবার ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে মানুষ হচ্ছে বিপর্যস্ত। প্রকৃতির এই যে রুদ্রমূর্তি তার জন্য আমরা আমাদের দায়ী করতে পারি। কেননা, প্রকৃতি আজ মানুষের ব্যবহারের উত্তর দিচ্ছে এইভাবে।
আমরা নানাভাবে প্রকৃতিকে দূষিত করে তুলছি। কখনও সচেতনতার অভাবে, কখনও সচেতন অবস্থাতেই। সচেতনতার সাথেই হোক আর অসচেতনতাতেই হোক প্রতিনিয়ত আমরা পরিবেশকে দূষিত করছি। ভুল করছি। আর এই ভুলের মাশুল দিচ্ছি আমরা সাইক্লোন, অতিরিক্ত বন্যা, অতিবৃষ্টি, কখনওবা অনাবৃষ্টি ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে দিনপাত করে।
আমরা সচেতনতার দৃষ্টি নিয়ে যদি আমাদের আশেপাশে তাকাই তাহলেই দেখতে পাব পরিবেশ দূষণের নমুনা। আমাদের বাংলাদেশকে নদীমাতৃক দেশ বলা হয়ে থাকে। নদী বাঁচলে মানুষ বাঁচবে। অথচ ঢাকার নদীগুলোকে নদী না বলে চলমান বর্জ্যরে প বললে অত্যুক্তি হবে না। জিনজিরা থেকে হযরতপুর কলাতিয়া এবং নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা পর্যন্ত বুড়িগঙ্গার পানি কালো বিবর্ণ রূপ ধারণ করেছে।
নদীর পানি সকল কাজের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। পচা পানির দুর্গন্ধের পাশাপাশি রোগ-জীবণু ছড়াচ্ছে। প্রতিদিন লালবাগ, কামরাঙ্গিরচর, পাগলা, ফতুল্লা, নারায়ণগঞ্জ শহর ও শহরতলীতে গড়ে ওঠা শিল্প-কারখানা, শাড়ির ডায়িং, ট্যানারী এবং সার কারখানার শত শত টন তরল বর্জ্য, বৈধ অবৈধ হাজার হাজার কল-কারখানা ও জাহাজের বিষাক্ত বর্জ্য প্রতিদিন বুড়িগঙ্গায় নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। এছাড়া রাজধানীর বর্জ্যও এর পাড়ে ফেলা হচ্ছে। এর কারণে নদীর পানি পচে গিয়ে পরিবেশকে মারাত্মকভাবে ক্ষতি করছে।
রোগ-জীবণু ছাড়াচ্ছে মানুষের মাঝে। বুড়িগঙ্গার মতো এমনি বাংলাদেশের নদীগুলো বিভিন্ন বর্জ্যরে কারণে মঙ্গলের বদলে বয়ে আনছে অমঙ্গল।
রাজধানীর আশেপাশে তাকালেই আমরা অসংখ্য ইটের ভাটা দেখতে পাই। শুধু রাজধানীর আশপাশ নয়, গ্রামাঞ্চলেও আমরা দেখি- ইটের ভাটায় প্রচুর পরিমাণে গাছের গুঁড়ি ব্যবহার হচ্ছে। এতে ইটভাটার কালো ধোঁয়া যেমন বায়ু দূষিত করছে অন্যদিকে সবুজের বেষ্ঠনী উজার হয়ে যাচ্ছে।
আমরা যে কার্বন-ডাই-অক্সসাইড ছাড়ছি তা গাছ গ্রহণ করে অক্সিজেন ছাড়ে। তাই পরিবেশ স্বাভাবিক থাকে। কিন্তু নানাভাবে গাছ উজার হয়ে যাওয়ার কারণে আমরা নানামুখী ক্ষতির স্বীকার হচ্ছি। ভূমির ক্ষয় বাড়ছে। বাড়ছে প্রাকৃতিক নানামুখী দুর্যোগ।
পরিবেশ দূষণের ফলে মানবজাতি, প্রাণীজগত ও জীব-বৈচিত্র আজ হুমকির সন্মুখীন।
বাড়ছে জনসংখ্যা। অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ সামাল দিতে বন-বাদাড় উজার হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। পরিবেশ হচ্ছে হুমকির সন্মুখীন। শহরের শব্দ দূষণ আর বায়ু দূষণের কারণে কারণে দিন দিন মানুষ স্বাভাবিক মুত্যুর আগেই বিভিন্ন অসুখ-বিসুখে ভুগে মারা যাচ্ছে।
বিশুদ্ধ পানি ও পয়োঃনিষ্কাশনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থা খুবই শোচনীয়। দেশের ভূগর্ভস্থ পানি আর্সেনিক দূষণে আক্রান্ত। দেশের বিভিন্ন এলাকার ধান, চাল, তরকারিসহ খাদ্যচক্রে মারাত্মক আর্সেনিক দূষণ দেখা দিয়েছে। বর্তমান দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৬০টি জেলার পানিতেই গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশিমাত্রায় অর্সেনিকের উপস্থিতি ধরা পড়েছে। এর ফলে দেশের মোট জন্যসংখ্যার অর্ধেকই আর্সেনিক বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
রাজধানীতে বসবাসকারী ৩০ লক্ষ মানুষ বিশুদ্ধ পানি থেকে বঞ্চিত। রাজধানীতে ৭০ শতাংশ লোকের সুষ্ঠু পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেই। এর ফলে রাজধানীতে প্রতি বছর ১০ হাজারেরও বেশি শিশু পানিবাহিত রোগে মৃত্যুবরণ করে। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির সহায়তায় পরিচালিত এক জরিপ রিপোর্ট মতে, পরিবেশ দূষণের ফলে দক্ষিণ এশিয়ার আকাশে তিন কিলোমিটার পুরু ধোঁয়াশার মেঘ জমেছে। এ মেঘ থেকে ঝড়তে পারে এসিড বৃষ্টি।
যা বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় হতে পারে। ছাই, এসিড, দাবানল, অ্যারোসল অনিয়ন্ত্রিত জ্বালানির ব্যবহার, যানবাহনের কালো ধোঁয় ও কল-কারখানার বিষাক্ত গ্যাস মিলে বাদামী মেঘের আস্তরণ তৈরি হয়। এ বাদামী মেঘের জন্যই এ এলাকাতে বৃষ্টিপাত দীর্ঘস্থায়ী ও অনিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। এতে ডেংগু ও ম্যালেরিয়ার মত মারাত্মক রোগ হচ্ছে।
এদিকে ফসল উৎপাদনের জন্য কৃষক নানা কীটনাশক মাঠে ছড়াচ্ছে কোন আইন-কানুন না মেনে।
ফলে বাতাসের সাথে স্প্রে করা ক্ষুদ্রকণা তার যেমন নাকে-মুখে যেয়ে অসুখের স্বীকার হচ্ছে অন্যদিকে অন্যরাও কীটনাশক মিশ্রিত বাতাসে হচ্ছে অসুস্থ্য। ঘটছে পরিবেশের দূষণ। অতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহারে মাটি তার স্বাভাবিকতা হারিয়ে পরিণত হচ্ছে অনাবাদিতে। ফলে ফসল উৎপাদন কমে যাচ্ছে।
পলিথিন আইন করে নিষিদ্ধ করা হলেও নানাভাবে আবার আমাদের মাঝে তা ফিরে এসেছে।
শুধু পলিথিনের ব্যাগ বাজারে প্রকাশ্যে বিক্রি হয় না। কিন্তু চিনি, ডাল, লবণ নানা ধরনের জিনিস-পত্র আনা-নেওয়াতে অহরহ পলিথিন ব্যবহৃত হয়। নানা রূপে নানা আকারে আমাদের মাঝে ফিরে এসেছে আবার সেই পলিথিন। এই পলিথিন আমাদের পরিবেশকে করে তুলছে বিষাক্ত।
প্লাস্টিকের বোতলও পরিবেশ দূষণে কম ভূমিকা রাখে না।
পলিথিন, প্লাস্টিকের বোতল মাটিতে মিশে যায় না। যার ফলে মাটি উর্বরতা হারিয়ে হয়ে যায় বন্ধ্যা।
পরিবেশ দূষণের ফলে দিন দিন বিশ্বের তাপমাত্রা ক্রমশ বাড়ছে। সেই সাথে গলে যাচ্ছে মেরু অঞ্চলের বরফ। সেই বরফ নদীর পানির সাথে মিশে অতিরিক্ত বন্যার সৃষ্টি হচ্ছে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে পরিবেশ সংরক্ষণে চলমান আছে বিভিন্ন কার্যক্রম। পরিবেশ অধিদপ্তর পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ এবং পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা ১৯৯৭ এর আওতায় নিয়মিতভাবে পানি, মাটি, বায়ু দূষণ এর মনিটরিং এর কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। বাংলাদেশে ১৯৯২ সালে প্রণীত হয় পরিবেশনীতি এবং পরিবেশ সংরক্ষণ আইন কার্যকর হয় ১৯৯৫ সালে। ১৯৯৭ সালে জারীকৃত বিধিমালার অধীনে দূষণকারী শিল্প প্রতিষ্ঠান চিহ্নিতকরণ ও সে সবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং নতুন শিল্প-কারখানার ক্ষেত্রে পরিবেশ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণে ছাড়পত্র গ্রহণ প্রথা একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। শুধু শিল্পক্ষেত্রেই নয়, সরকারি ও বেসরকারি যে কোন উন্নয়ন প্রকল্পের ক্ষেত্রেই ছাড়পত্র গ্রহণ পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর ৪টি শিল্প সেক্টরের জন্য পরিবেশ ব্যবস্থাপনা নির্দেশিকা প্রণয়ন করেছে। অত্যাধিক জনসংখ্যা, সম্পদের সীমাবদ্ধতা, অভিজ্ঞতা, নদ-নদীর পানি দূষণ রোধ, প্রাকৃতিক মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রচেষ্টাই পরিবেশকে করতে পারে সুন্দর। অর্থনৈতিক উন্নয়নকে দীর্ঘমেয়াদী ও টেকসই করতে হলে প্রয়োজন পরিবশেকে দূষণমুক্ত রাখা। আর এ লক্ষ্যেই একটি প্রতিপাদ্য বিষয়ের আলোকে জনসচেতনতার আহ্বান জানায় বিশ্ব পরিবেশ দিবস।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।