মাহবুব লীলেন
বাড়িটা খাওয়ার পর বুঝলাম আমি রাস্তার মাঝখানে। ধাঁধালো লাইটের ইন্টারসিটি বাস। প্রথমে ধাক্কা মেরে অনেকদূর পর্যন্ত আমাকে উড়িয়ে নিয়ে গেলো। তারপর ঢুকুস করে সামনের চাকা আর ঢ্যাপ করে পেছনের দু চাকা চলে গেলো পিঠের উপর দিয়ে...
ওজন-টোজন কিচ্ছু না। মনে হলো একটা আগুনের ব্লেড দিয়ে কেউ ঘ্যাঁস করে পিঠে দুটো পোচ দিলো আমার
মুখ থুবড়ে শুয়ে আছি আমি রাস্তার উপরে।
উঠতে গিয়ে দেখি পা নড়ে না। হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে টের পেলাম মাজার নিচের কোনো অংশই আর আমার সাথে নেই...
এরমধ্যে আরেকটা আগুনের ব্লেড চলে গেলো ঘাড়ের উপর দিয়ে। মাথাটা সেভ করা দরকার। চুলে ধরে টান দিতেই মাথাটা হাতের কাছে চলে এলো। আলগা হয়নি কিন্তু কোনো হাড্ডি নেই ঘাড়ে।
থ্যাৎলানো চামড়া দিয়ে মাথাটা আটকে আছে শরীরে...
ঢ্যাপাস ঢ্যাপ করে আরেকটা শব্দের সঙ্গে আমার দুইটা পা উড়ে এসে চোখের সামনে পড়ল বাড়ি খেয়ে। ডান পকেটে সিগারেট আর পেছনের বাম পকেটে লাইটার। একটা বিড়ি খাওয়া দরকার...
কিন্তু দুদিক থেকে একই টাইমে দুটো গাড়ির একটা আমাকে ধাক্কা মেরে একটু এগিয়ে নিলো আর আরেকটা ফিরতি ধাক্কায় দিলো পিছিয়ে। এই ধাক্কায় আমার বাম চোখটা রাস্তা পার হয়ে গেলো টুস করে কোটর থেকে উড়ে এসে ঘাসের মধ্যে পড়ে। এখন মাছির মতো চারপাশ এক সঙ্গেই দেখতে পাচ্ছি আমি...
দুপাশে মাঠ ছাড়া কিছু নেই।
ঘুটঘুটে অন্ধকার। এখানে কী করতে এসছিলাম আর কী করতে রাস্তা পার হবার দরকার পড়ল মনে পড়ছে না কিছুই...
আধা ঘণ্টার মধ্যে শরীরটা অনেকদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে গেলো। এখন আর মাংসগুলো মাংস-রং নেই। রক্তগুলোও লাল নেই। গাড়ির চাকার ধুলোর সাথে মিলেমিশে একটা ভেজা রাস্তার রং হয়ে গেছে।
শুধু হাড়গুলো মাঝে মাঝে সাদা ঝিলিক দিচ্ছে
অতগুলো হাড় ছিল নাকি আমার?
প্রথমে দূরে পরে কাছে এগিয়ে এলো হুক্কাহুয়া। ডান-বাম তাকিয়ে পুরো একটা দল উঠে এলো রাস্তায়। গাড়ি আসলে ওরা সাইডে নেমে দাঁড়ায়। গাড়ি চলে গেলে আবার রাস্তায় মুখ দেয়। কোনো কামড়া-কামড়ি নেই।
চিল্লাচিল্লিও নেই। খাওয়া নিয়ে হাউকাউ করে কুকুরেরা। বহুদিন মানুষের সাথে থাকতে থাকতে অন্যদের খাওয়া দেখলেই কুকুরদের গায়ে জ্বলে। কিন্তু শিয়াল কিংবা জংলি রামকুত্তা কোনোদিন খাওয়া নিয়ে ঝগড়া করে না। কারণ ওরা থাকে নিজেদের সমাজে।
আর কুকুর থাকে মানুষের সমাজে...
আমার চোখটা ওদের কারো চোখে পড়েনি। হাড্ডি-টাড্ডির দিকে শিয়ালের খুব একটা মনোযোগ নেই। দুয়েকবার কেউ কেউ নেড়েচেড়ে দেখেছে। কিন্তু এর বেশি না
যে পার থেকে রাস্তা পার হতে গিয়ে আমি গাড়ির নিচে পড়েছি; খেয়েদেয়ে শিয়ালেরা সেই পারের অন্ধকারে মিশে গেলো। এরপরে ভুসভাস গাড়ি ছাড়া আর কিছু নেই অনেকক্ষণ...
এভাবে সূর্যের দিকে তাকিয়ে সূর্য উঠা দেখিনি কোনোদিন।
এখন চোখ বন্ধ করতে পারছি না বলে পুরোটাই দেখতে হচ্ছে। খারাপ না। বেশ আস্তে আস্তেই উঠে সূর্য...
কা কা। ঘেউ ঘেউ। কাক আর কুকুর একসাথে হাজির।
যা খাওয়ার শিয়ালরাই শেষ করে গেছে। এখন কুত্তা কামড়ায় হাড্ডি আর কাউয়া ঠোকরায় চুল। আর মাঝখানে কাঘেউ কাঘেউ...
আমার চোখটা একটা কাকের চোখে পড়ে যায়। খপাস করে ঠেঁটে তুলে দেয় উড়াল। পেছনে ধাওয়া করে আরো কয়েকটা।
নিচে দৌড় লাগায় দুতিনটা কুকুর
উড়ে যাওয়াটা সাঁতার দেয়ার মতো। সাঁতারে ঠেলতে হয় পানি এখানে বাতাস
একটা হাফ সার্কেল দিয়ে কাকটা আমার চোখ নিয়ে গিয়ে বসে একটা গাছে। বসেই ঠকাস ঠকাস ঠকাস। ডালের সাথে তিনটা আছাড় মেরে থেঁতলে নিয়ে পায়ে চেপে ধরে ঠোঁট দিয়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে গিলতে শুরু করে আমাকে। মুখের মধ্যে ঢুকিয়েই দেয় একটা ধাক্কা।
এক ধাক্কার আমি এসে পড়ি পুকুরের মতো একটা জায়গায়। জায়গাটা অনেক গরম। আর চারপাশ থেকে পিছলা কীসব রস আস্তে আস্তে এসে ঢুকতে শুরু করে আমার ভেতর। আমি ভাসতে ভাসতে ঘুরতে থাকি। আমি এখন হজম হতে যাচ্ছি।
কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। শুধু মনে হচ্ছে আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ছি আমি...
২০০৮.০৭.১০ বিষুদবার
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।