আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ট্রাফিক সার্জেন্ট আবদুল বাসেদের করুণ মৃত্যু এবং আমাদের দীর্ঘশ্বাস



কিছুদিন আগে (১৯ মে, ২০০৯) সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের সামনে মিরপুর রোডের ওপরে দায়িত্বরত অবস্থায় ট্রাফিক পুলিশ সার্জেন্ট আবদুল বাসেদ তালুকদারকে একটি বাস চাপা দিয়ে মেরে ফেলে। এ খবর কমবেশি আমরা সবাই শুনেছি, টিভি সংবাদে দেখেছি। হালকা-পাতলা দুঃখ প্রকাশও করে ফেলেছি। তারপর সবকিছু আগের মত চলছে। অনেকটা "তবুও জীবন যাচ্ছে কেটে জীবনের নিয়মে" টাইপের।

এবার মূল প্রসঙ্গে আসি। পুলিশের কথা আসলেই ঘেন্নায় আমরা মুখ ফিরিয়ে নেই। মনে মনে অথবা মুখে অমুকের বাচ্চা তমুকের বাচ্চা বলে গাল দিয়ে দেই। পুলিশ মানেই জঘন্য এক শ্রেনী। অমুকের বাপ পুলিশ হলে তার সাথে হয় মেশা যাবে না নয় বেশি করে মিশতে হবে বিপদে সাহায্য পাওয়ার আশায়।

বাস্তবতা অনেকটাই এমন। অন্যন্য অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠানের মত পুলিশ বিভাগ একটি সমাজ বা রাষ্ট্রের অপরিহার্য প্রতিষ্ঠান। বিশ্বের এমন কোন রাষ্ট্র নেই যেখানে কোন পুলিশ বাহিনী (নিয়মিত বা অনিয়মিত) নেই। তবে বেশ কিছু রাষ্ট্র আছে যাদের সামরিক বাহিনী নেই। বাংলাদেশ পুলিশে কারা যায়? আমাদের সমাজেরই অনন্যোপায় মানুষ পুলিশে যোগ দেয়।

আমরা কি কখনও ভেবে দেখেছি কেন পুলিশে গেলে মানুষ দুর্নীতিবাজ বা খারাপ হয়ে যায়? কেন সেখানে বেশিরভাগ সদস্যই নোংরা বলে আমরা মনে করি? পুলিশ একটি "আইন প্রয়োগকারী" সংস্থা। আইন প্রয়োগকারী শব্দটিতে জোর দিলাম এ কারণে যে, এই আইন প্রয়োগকারী শব্ফটির মধ্যেই অনেক তাৎপর্য নিহিত। আইন প্রয়োগকারী যেমন আছে তেমন আইন প্রণয়নকারী, আইনজীবি, আইন নিয়ন্ত্রনকারী সংস্থাও রাষ্ট্রে রয়েছে। আমরা জানি, পুলিশ বাহিনী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের নির্দেশে কাজ করে। ম্যাজিস্ট্রেট বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ে দায়িত্বরত আমলা বা রাজনীতিবিদদের নির্দেশে তাদের কাজ করতে হয়।

কোন সমস্যা, সংকট বা ঘটনায় পুলিশ সম্পূর্ণ উপর মহলের নির্দেশে কাজ করে থাকে। পুলিশের কাজ অনেকটাই যা বলা হয় তা সরেজমিনে না রাস্তায় নেমে পালন করা। তাহলে প্রশ্ন হলো কেন মিছিলে লাঠিচার্জ করলে শুধুমাত্র পুলিশ বাহিনীকে দোষারোপ করা হয়? ক''দিন আগে বিএনপির শান্তিপূর্ণ (?) মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশে পুলিশের লাঠিচার্জের তীব্র নিন্দা জানায় বিএনপি নেতা কর্মীরা। ইটিভির একজন সাংবাদিককে লাঠিচার্জ করারও তীব্র নিন্দা জানানো হয় এবং পুলিশকে ক্ষমা চাইতে করতে বলা হয়। আমার প্রশ্ন হলো পুলিশের এমন কোন ক্ষমতা নেই যে তারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় বা ম্যাজিস্ট্রেটের পূর্ব নির্দেশ ব্যতীত কোনরকম একশনে যাবে।

ইতিহাসে এ পর্যন্ত যতগুলো মিছিল মিটিংয়ে লাঠিচার্জ বা গুলি ছোঁড়া হয়েছে সবগুলোতেই উপরের নির্দেশ ছিল। কিন্তু আমরা আইনের চাকর পুলিশকেই শুধুমাত্র গালমন্দ করেছি, ফাঁক গলে রুই- কাতলাগুলো বেঁচে গেছে বারবার। আপনারা কি জানেন যে মাঠ পুলিশ (কনস্টেবল থেকে এস.আই) যতটা না উর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দেশে চলে তার চেয়ে অনেক বেশি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের রাজনীতিবিদ ও আমলাদের নির্দেশে। পুলিশ হলো অনেকটাই ম্যাজিস্ট্রেট বা আমলা বা মন্ত্রী-এমপিদের চাকর (বিগত দুই বছর আর্মির চাকরগিরিও করেছে তারা। মনিবকে না দোষিয়ে শুধুমাত্র হুকুমের গোলামকে গালানোটা তো যুক্তি সংগত নয় কখনই।

আমি পুলিশের পক্ষে সাফাই গাইছি না, আমি পুলিশের সন্তান বা নিকট আত্নীয়ও না। আমি শুধু ক্ষুদ্র জীবনে যা দেখছি, যা বুঝছি তাই বলার চেষ্টা করেছি। এবার আসি সার্জেন্ট আবদুল বাসেদের কথায়। আমি জানি না সে সৎ ছিল নাকি অসৎ ছিল। আমি শুধু জানি সে দুর্ঘটনায় মরার পর সরকার তাকে ক্ষতিপূরণের নির্ধারিত কয়েকটা টাকা দিবে, প্রতি মাসে চল্লিশ হাজারও দিবে না, ফ্ল্যাটও দিবে না, দিবে না শহীদের মর্যাদা।

ওয়ান টাইম বিগ একটা এমাউন্টও জুটবে না তার পরিবারের ভাগ্যে। আমি আরও জানি বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর একজন কর্মকর্তা আমাকে যে সার্ভিস দিয়েছে তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি সার্ভিস দিয়েছে পুলিশ সার্জেন্ট আবদুল বাসেদ। পুলিশের জীবনের ঝুঁকি আর্মির চেয়ে যেকোন হিসেবে অনেক বেশি। একজন সারা বছর বসে বসে ভাতা খায় আর আরেকজন ওভার ডিউটি করে খায় গালি। একজন হয় হ্যান্ডসাম অফিসার আরেকজন হয় রোদে পোড়া চোরের মত চেহারার অধিকারী।

একজনের আছে চাকুরি শেষে ঢাকা শহরের মনোরম স্থানে নামমাত্র মূল্যে প্লট,আরেজনের আছে চাকুরি শেষে পেনশন নেওয়ার জন্য সচিবালয়ের লাইন দেওয়ার তাড়া। যাই হোক,রাস্তায় গাড়ি আটকিয়ে কাগজপত্র চেক করার সময় অন্য এক বাস এসে পিষে দিয়েছে আবদুল বাসেদকে ,পরোক্ষভাবে তার স্ত্রী এবং পাঁচ বছর ও মাত্র তিন মাসের দুই সন্তানের ভাগ্যকেও। সার্জেন্ট আবদুল বাসেদের বড় ভাই মোহাম্মাদ রায়হানও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক সার্জেন্ট থাকা অবস্থায় দায়িত্ব পালনকালে একইভাবে গাড়ির চাকায় পিষে মৃত্যুবরণ করেন, তিনিও ফ্ল্যাট বাড়ি পেয়েছিলেন কিনা জানা নেই। শেষ কথা দিয়ে শেষ করি। আবদুল বাসেদ যেদিন মারা যান অর্থাৎ ১৯ শে মে, সেদিন তার বিবাহবার্ষিকী ছিল।

তার স্ত্রী তার জন্য নিশ্চয়ই অন্য দশটা দিনের মত করে অপেক্ষা করে ছিল না, একটু বিশেষভাবেই অপেক্ষা করে ছিল সন্তানদের নিয়ে। হ্যাঁ, একটু বেশিই বিশেষ হয়ে গেল সেদিনটা তার জীবনে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।