আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্মৃতি আর বিস্মৃতির অংক

... ... ... ...
অনেক অনেক দিন পর পর গ্রামে যাওয়া হয়। আসলে হয় না বললেও চলে। গ্রামের স্মৃতিগুলোও মধুর নয়। তারপরও অল্প স্বল্প যাওয়া হয়। শিকড়ের টান হয়তো...শিকড়ের টানও কিনা কে জানে! শিকড়ের টান আরো জোরালো হয়, এ হয়তো আগাছার টান।

জানি না। খুব জোর করলেও আমি যেতে চাই না, এড়িয়ে চলি আমাদের গ্রামটাকে। কিছুই ভালো লাগে না। সমবয়সী কেউ নেই, বাচ্চা-কাচ্চাগুলো ভয়ে দূরে দূরে থাকতো। বড়রা ঢাকার মেহমান ভেবে অতিরিক্ত খাতির করতো, তাতে আমার অস্বস্তি পৌনপুনিকতায় বাড়তো, বয়সটাই এমন ছিল, মায়া কিংবা ভালোবাসাটা চোখে পড়তো না।

নিজেকে নিয়েই মেতে থাকতাম, প্রায় অজানা অথচ একই আত্মার বাঁধনে বন্দীদের ভালোবাসায় অস্বস্তির রেশটাই বেশি থাকতো। অজপাড়াগাঁ বলতে এক ঝলকে যা মনে হয়, আমাদের গ্রামটা ঠিক সেরকম ছিল। কারেন্টের বালাই ছিল না। খাম্বাও মনে হয় অতিরিক্ত পড়ে ছিল, পুরো দেশে পুঁতে শেষ করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত এ গাঁয়ে কয়েকটা পুঁতে রেখেছিল। খাম্বা তো না, ইলেকট্রিসিটির মুলা।

গাধাদের চোখের সামনে স্বপ্ন হয়ে সে খাম্বা বিদ্যুতহীন হয়েই প্রায় তিন-চার বছর ছিল। শুধু যে এটুকুতেই অজপাড়াগাঁ, তা না। সারা দেশে গ্রামে গ্রামে রাস্তা, আর আমাদের ভরসা তখনো ক্ষেতের আইল। এই ক্ষেতের আইল পানিতে ডুবে গেলে এঁকিয়ে-বেঁকিয়ে ওই ক্ষেতের আইল। এমনি করে চলতো।

বর্ষা এলে আমাদের সে গ্রামের বাড়িটা দ্বীপ...লঞ্চ থেকে নেমে অপেক্ষা করতে হতো নৌকার জন্য। রাত-বিরেতে পৌছাঁনো ঢাকার মেহমানদের নিতে কাকা-চাচারা ছুটে আসতো। ছয় ঘন্টার রাতের লঞ্চ ভ্রমণে আমার ক্লান্ত ঢুলু ঢুলু চোখ। মায়ের কোলে ঘুমে কাদা। কোন ফাঁকে নৌকায় করে বাড়িতে এলাম জানি না।

এসে দেখি আধো আধো অন্ধকার, আমি হেঁটে চলছি। পায়ের নিচে নরম মখমল অনুভূতি। খড় বিছানো পথে হেঁটে যেতে যেতে মাকে জিজ্ঞেস করি, মা, ওরা কি আমাদের জন্য কার্পেট বিছায় রাখছে? আমার কথা শুনে সবাই হাসে...কেন কে জানে! শৈশব এক অন্যরকম বয়স...পঙ্কিলতাগুলো চোখে পড়ে না। কাদাকাদা মাটির ভেজা ভেজা গন্ধ...বেশ ভাল্লাগতো। ঢাকার খুপরি বাসা থেকে মুক্তির স্বাদটাই হয়তো প্রভাবক ছিল।

সারা বেলা পাটখড়ি নিয়ে মুরগী আর হাঁসের বাচ্চার পিছে তাড়া করতাম...কিংবা ছাগলের গলার দড়ি ধরে টানাটানি করতাম...কেন যে ছাগলটা ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে একগোঁয়ার্তুমি করতো! এই করে সারা বেলা পার। সন্ধ্যে নামতেই শীতের রাতে সবাই চুলার কাছে। গনগনে আগুন। তার মধ্যে পিঠার সমারোহ। লাকড়ি পোড়ানো আগুনে এক অদ্ভূত গন্ধ।

আমি যা দেখি তাতেই কেবল অবাক হই। দূরে কোন ক্ষেতের আল বেয়ে ছোট্ট আলো নেচে নেচে ফিরতো। আমি অবাক হয়ে চেয়ে থাকতাম। অন্ধকারের এক অদ্ভূত মায়া আছে, সেই শৈশবে দেখা সে মায়া আজো ভুলতে পারিনি! রাতের নিস্তব্ধতায় অদ্ভূত সব শব্দ হতেই থাকে, আমি ঘুমোতে পারি না...... অবাক হয়ে শুনতে থাকি। রূপকথার গল্পের মতো করেই যেন আগুনের পাখি ছুটে আসে।

মিটিমিটি করে জ্বলে। আমি লাফ দিয়ে ধরতে যাই। নাগাল পাই না। বড় কেউ মাঝে মাঝে এক আধটা জোনাই ধরে দিত...আমি দুহাত গোল করে আলোর পাখি বন্দী করে রাখতাম, আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিয়ে দেখতাম। তারপর মোহভঙ্গের বয়স এলো।

রাতের অদ্ভূত রহস্যময় সব শব্দ এক নিমিষে ঝিঝি পোকা হয়ে গেল। জোনাকিও আর তেমন একটা দেখা যায় না। কারেন্ট এলো, আলোকিত গ্রাম হলো। অন্ধকারের সব মায়া মুহূর্তে উড়ে গেল। আশেপাশের অতিরিক্ত খাতিরকে নিছক স্বার্থ মনে হতে লাগলো।

শেকড়ের টানও ঢিল হতে লাগলো। কমে গেল বাড়ি যাওয়া। ঈদ-উৎসবে যে দুয়েকদিন যাওয়া হতো, তাও বন্ধ হলো। খুব প্রয়োজনে মাঝেসাঝে যেতাম। দিনে যেয়ে দিনেই ফিরতাম, রাতে থাকতাম না।

স্যানিটেশন সমস্যা, ঘুমানোর সমস্যা, ভিলেজ পলিটিক্স ...কতো হ্যাপা! হয়তো মোহমুক্তিই বড় কারণ ছিল, কিংবা শহরের খোয়াড়ে খুব বেশিই মানিয়ে নিয়েছি... ইদানিং তাই আর গ্রামে যাওয়াই হয় না। বহুদিন পর গ্রামে গেলাম, দিনে গিয়ে ফেরার প্লান ছিল, মায়ের ছলনায় দুদিন থাকতে হলো। সবার অনেক অনুরোধ, মান অভিমান...উপেক্ষা করা গেল না। যথারীতি বিরক্তির সাথে থাকলাম। সুযোগমতো রক্তচক্ষু মাকে দেখালাম, কিছু বললাম না।

শহুরে সভ্যতার বিখ্যাত হাসিটা ঠোঁটের কোণায় ঝুলিয়ে পার করে দিলাম দু-দুটা দিন। আবারো খড়ের উপরে হাঁটলাম...শিশির ভেজা খড় বেশ নোংরা মনে হলো। মাটির সোঁদা গন্ধে নাক বন্ধ হয়ে এলো। এদিক সেদিক থেকে পোকার অত্যাচার। রাতে আলোয় আলোময় শহুরে গ্রাম, অন্ধকারের দিন আর নেই।

এবাড়ি ওবাড়ি থেকে উচ্চস্বরে বিজাতীয় বাজনা, নির্জনতার দিনও আর নেই। বিরক্ত হয়েই যেন ঘর ছাড়লাম, আকাশ ভরা নীল তারারাও সে বিরক্তি দূর করতে পারলো না। দুদিন বাদে ফিরে আসার সময় আকাশ জুড়ে কালো মেঘ। ঝড় ধেয়ে আসছে, বেশ বুঝা গেল। আমি টললাম না, ঢাকা ফিরবোই ফিরবো।

ঘাড়ের কয়েকটা রগ বাঁকা, মা জানতো। সবার প্রশ্নোত্তর সামাল দিল, আমরা ফিরে আসতে লাগলাম। আহ...ঘরে ফেরা যেন শান্তি। পথেই নামলো বৃষ্টি। তাতে আমি হঠাৎ করেই নস্টালজিক হয়ে পড়লাম।

বাসের খোলা জানলা দিয়ে আসা বৃষ্টির ছাট একটু একটু করে ভেজাচ্ছিল। একটু একটু করে আমি যেন বর্ষার প্রমত্তা মেঘনার উত্তাল খালে চলে গেলাম। সেখানে নৌকায় আমরা পিচিপাচ্চা কজনা বৃষ্টিতে ভিজে চুপচুপা। স্রোতস্বী খালের পানিতে নেমে নৌকা ঠেলছে গ্রামের চাচাতো ভাইয়েরা। এদিক সেদিক আমাদের হারিয়ে যাবার খবরে তুলকালাম কান্ড।

সবাই খুঁজতে বেরিয়ে পানির কিনারে এসে থেমে যাচ্ছে। ভীষণ সে স্রোতটাকে ভয় না পেয়ে সাঁতরে এল ফুফু। আমরা ডুবিনি, তা দেখেই হু হু করে সে কি কান্না। আমাদের তখন বৃষ্টিতে মহা উল্লাস...কারো কান্না দেখার সময় নেই। সবার ভালোবাসার সবটুকু নিছক স্বার্থ ছিল না, তা বোঝার বয়স তখনো হয় নি, এখনো যেন হয় নি।

নাকে অদ্ভূত বাজে গন্ধ ঠেকতেই স্মৃতির পাতা উলটে ফেললাম। হুমম...শহরে এসে পড়েছি, প্রিয় শহরে। এখানে বৃষ্টিতে মাটির সোদা গন্ধ নেই। নর্দমার পুতিগন্ধময় পানিতে পুরো রাস্তা সয়লাব...স্ট্রিট ল্যাম্প আর এলোমেলো গাড়ীর হেডলাইটে আলোর মেলা। জোনাকি তো দূরের কথা, ধোঁয়ার মেঘে তারার ম্লান হয়ে যায়।

এই আমার প্রিয় শহর। জোর করেই আবার স্মৃতিতে নাক ডুবালাম...কার্পেটের উপর গুটি গুটি পায়ে হাঁটছিলাম। মা, ওরা কি আমাদের জন্য কার্পেট বিছায় রাখছে? আবারও সবার হো হো হাসি...এতো হাসির কি আছে? কে জানে!
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.