আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নারীর দারিদ্র্য নিয়ে বই এবং সেই বইয়ের দরিদ্রতম আলোচনা

আদর্শটাকে আপাতত তালাবন্ধ করে রেখেছি
স্টিফেন হকিং ‘অ্যা ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ বইতে যতদূর সম্ভব কম সমীকরণ ব্যবহার করেছেন; কারণ তিনি জানতেন সমীকরণের সাথে পাঠকপ্রিয়তার সম্পর্ক ব্যস্তানুপাতিক। এই ব্যস্তানুপাত প্রযোজ্য তথ্য-উপাত্ত সম্পর্কেও। একই বিষয়ে গবেষণা রিপোর্টের চাইতে পত্রিকার কলাম সুখপাঠ্য। আর এই ‘ব্যস্তানুপাতিক’ শব্দটি চিররঞ্জন সরকারের বই ‘নারী ও দারিদ্র্য’ সম্পর্কেও সমানভাবে প্রযোজ্য। কেন- সে প্রসঙ্গে আসি একটু পর।

দরিদ্র শব্দটিও যদিও লিঙ্গ-নিরপেক্ষ, কিন্তু আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে পুরুষের তুলনায় নারী একটু বেশি-ই দরিদ্র। এই দরিদ্রতা শুধু যে অর্থনৈতিক তা নয়; অধিকাংশ ক্ষেত্রে সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, এবং ক্ষেত্রবিশেষে অবস্থানগত। বিশেষ করে ক্ষমতায়নের দিক দিয়ে আমাদের দেশের নারীরা অবশ্যই দরিদ্রতম কিংবা অতিদরিদ্রের কাতারে পড়ে। সিদ্ধান্তগ্রহণের নারীর কার্যকর অংশগ্রহণ যে কারণে এখনো স্বপ্নমঙ্গলের কাব্যের মতো! বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নারীর অর্থনৈতিক উন্নতি ও ক্ষমতায়নের বিষয়টি এখন প্রাধান্য পাচ্ছে বেশ গুরুত্বসহকারেই। জাতিসংঘ উন্নয়ন কার্যক্রমের ‘মানব উন্নয়ন সূচক’ বা Human Development Index, সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য বা Miillenium Development Goals, CEDAW, এবং অধুনা দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্র বা পিআরএসপিতে এ দুটি দিককে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।

ফলে দারিদ্র্যের সাথে নারীর সম্পর্ক এবং এই সম্পর্কের নানা ডিসকোর্স এখন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের অপরিহার্য অংশ। পাশাপাশি নারীর অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে দারিদ্র্যের সংজ্ঞাটিকেও সাজাতে হচ্ছে নতুন করে। শুধু একক কোনো সেক্টর বা ক্ষেত্র নয়; জীবনযাপনে প্রভাব বিস্তারকারী একাধিক ক্ষেত্রকে সমন্বিতভাবে বিচার করে বিভিন্ন পরিমাপকের সূচকে ফেলে বিচার করা হচ্ছে নারীর সঙ্গে দারিদ্র্যতার সম্পর্কটিকে; যাতে ছদ্ম দারিদ্র্যতার মাঝখান থেকে বের করে সত্যিকার অর্থেই নারীর দারিদ্র্যতাগুলো দূর করা যায়। পুঁজিবাদী সমাজে এটা কতোটুকু সম্ভব কে জানে, কিন্তু উন্নয়ন কর্মকাণ্ডগুলোতে এই বিষয়টির প্রাধান্য অবস্থা পরিবর্তনের দিকে কিছুটা আশান্বিত করে। চিররঞ্জন সরকার তাঁর ‘নারী ও দারিদ্র্য’ বইটিতে সাতটি অধ্যায়ে এই বিষয়গুলো নিয়েই কাজ করেছেন।

প্রথম অধ্যায়ে তিনি দারিদ্র্যের নানা সংজ্ঞা, রূপ ও পরিমাপক দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। দ্বিতীয় অধ্যায়ে সরাসরি দারিদ্র্যের সঙ্গে নারীর সম্পর্কযুক্ত বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলেছেন এবং ধারাবাহিকভাবে তৃতীয় অধ্যায়ে সমাজ ও অর্থনীতিতে নারীর ভূমিকাগুলো নিয়ে দারিদ্র্যের সাথে সমন্বয়ের চেষ্টা করেছেন। চতুর্থ অধ্যায়ে দেখিয়েছেন দারিদ্র্যের এই চক্র থেকে থেকে উত্তরণের উপায় ও প্রতিবন্ধকতাগুলো কী কী। পঞ্চম ও ষষ্ঠ অধ্যায়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন কর্মসূচিগুলোতে নারী ইস্যুগুলো কীভাবে দেখা হচ্ছে তার একটি বর্ণনা দিয়েছেন এবং সবকিছুর জের হিসেব করে হালখাতা মিলিয়েছেন শেষ অধ্যায়টিতে। দুটো কারণে এই বইটি পড়তে হয়েছে।

প্রথমটি ব্যক্তিগত, দ্বিতীয়টি প্রফেশনাল। মনোদৈহিক কারণে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি যে আগ্রহ একসময় একরৈখিক ছিলো, অ্যাকাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ডের কারণে সেই আগ্রহ আস্তে আস্তে বহুরৈখিক হতে থাকে। ফলে নারীর বাহ্যিক এক্সপ্রেশনের দিকগুলোর পাশাপাশি একটি আলাদা প্লাটফর্ম হিসেবেও নারীর সামাজিক-অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডগুলোও অ্যাকাডেমিক্যালি মিশে যেতে থাকে ব্যক্তিগত কারণগুলোর সাথে। আর প্রফেশনাল কারণে এই ধরনের বইগুলো নিয়ে নড়াচড়া করতে হয় প্রায়ই। ফলে দুটি কারণ একসাথে মিলে যাওয়ায় একবার উড়ন্ত পর্যটক পাখির চোখে, আরেকবার তীক্ষ্ম শিকারী পাখির চোখ- দুভাবেই পড়তে হয়েছে।

প্রথমবারের দেখার অনুভূতিই আগে বলা যাক। জার্নালে যে সব গবেষক লেখা পাঠান, তারা নাকি ধরে নেন গবেষক এবং সম্পাদকমণ্ডলীর বাইরে লেখাটি সর্বোচ্চ ১০ জন পাঠক পড়বেন এবং তাতেই এটি সফল। যদিও বলাটা শোভন নয়, তারপরও বলতে হয়- এই দিক দিয়ে বইটি অবশ্যই সফল। কারণ ওই ব্যস্তানুপাতিকের সূত্র। তথ্যের অধিক ভার সাধারণ পাঠককে বইতে না দিলে পাঠক যে সেই বইয়ের সাথে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে, এই বোধ পুরোপুরি অনুপস্থিত এই বইতে।

প্রশ্ন উঠতে পারে, সাধারণ পাঠক কি এই ধরনের বই পড়ে? বইমেলা এবং শাহবাগের আজিজ মার্কেটে ঘুরাঘুরি করার অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়- শহুরে মধ্যবিত্ত নাগরিক জীবনের মানুষগুলো এ ধরনের বই নিয়ে এখন মাঝেমাঝে নড়াচড়া করেন। ফলে একজন সাধারণ পাঠক হিসেবে এই বইটি আমার ভালো লাগে নি, এটা আমি দ্বিধাহীনভাবেই বলতে পারি। আবার ভালো লেগেছে প্রফেশনাল কাজের সময় বইটিকে হাতের কাছে রেখে। যদিও আমাদের দেশে নারীর উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রচুর কাজ হচ্ছে, কিন্তু সেগুলোর আইডিয়া এবং বাস্তব অবস্থানকে পাশাপাশি রেখে তথ্য ও বিশ্লেষণ উপস্থাপনের মতো উপকরণ আমাদের হাতে খুব একটা নেই। যে কারণে বইটি এই সেক্টরের প্রফেশনালদের কাছে গুরুত্ব পাবে।

যে অধ্যায়গুলোর কথা উপরে বলা হয়েছে, তার সবগুলোতেই লেখক পর্যাপ্ত তথ্য দিয়ে সেগুলো বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছেন। যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে মনে হয়েছে, লেখক নিজস্ব বিশ্লেষণের চাইতে উপাত্ত বিশ্লেষণকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তাছাড়া তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের ক্ষেত্রগুলো নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায়। লেখক নিজেই স্বীকার করেছেন, বেশিরভাগ তথ্যই দৈনিক পত্রিকা থেকে সংগৃহীত, ‘ফলে যথাযথ ও আনকোড়া (ফার্স্টহ্যান্ড) পরিসংখ্যানের ঘাটতি থেকেই যাবে’। কিন্তু পত্রিকাগুলো যে উৎস থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছে- যেমন, এডুকেশন ওয়াচ গবেষণা, বিভিন্ন প্রকাশিত সরকারি প্রতিবেদন, সিপিডি, বিআইডিএসসহ অন্যান্য গবেষণা সংস্থার গবেষণা প্রকাশনা ইত্যাদি- লেখক ইচ্ছে করলে সরাসরি সেগুলো থেকেই তথ্য সংগ্রহ করতে পারতেন, সে পথে কেন যান নি বুঝা যাচ্ছে না।

অবশ্য সংশ্লিষ্ট কেস স্টাডিগুলো পত্রিকা থেকে সংগ্রহ করায় সেগুলো বইটির আকর্ষণ বাড়িয়েছে অনেকটাই। পাশাপাশি বিভিন্ন সংজ্ঞা ও বর্ণনার মধ্যে তথ্যের বিপুল উপস্থাপনা সে আকর্ষণকে কমিয়ে দিয়েছে সাথে সাথেই। লেখক ইচ্ছে করলেই অনেক তথ্যকে পরিশিষ্টে যুক্ত করে দিতে পারতেন। বইটির কলেবর ছোট, কিন্তু বিষয়বস্তুগত উপস্থাপনায় বড়। কোনো সন্দেহ নেই, সাধারণ পাঠক এ থেকে রস না পেলেও অ্যাকাডেমিশিয়ান এবং প্রফেশনালরা এ থেকে কিছু না কিছু নির্যাস খুঁজে নিতে পারবেন।

সেই অর্থে এটিকে এক ধরনের রেফারেন্স বইও বলা যায়। রেফারেন্স ছাড়া শুধু নিজস্ব ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ ও চিন্তাচেতনার দ্বারা যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে পৌঁছা যেখানে অধিকাংশ মানুষের কমন ট্রেন্ড, সেখানে পাঠকপ্রিয়তা না পেলেও এই ধরনের রেফারেন্স বই কথা বলার শক্তি হিসেবে কাজ করে। এখানেই বইটির সার্থকতা, হয়তো। বইটি সম্পর্কে তথ্য নাম: নারী ও দারিদ্র্য লেখক: চিররঞ্জন সরকার প্রকাশক: স্টেপস্ টুয়ার্ডস্ ডেভেলপমেন্ট, ৩/৪, ব্লক-ডি, লালমাটিয়া, ঢাকা-১২০৭ প্রকাশকাল: ২০০৭ প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: মনন মোর্শেদ মুদ্রণ: মা মূদ্রণ, আজিজ সুপার মার্কেট, শাহবাগ, ঢাকা দাম: ১০০ টাকা
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।