আমি চাই শক্তিশালী স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ
আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেছেন, হাইকোর্ট বিভাগের দেয়া পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের রায় বহাল থাকলে সংবিধান থেকে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম উঠে যাবে না। একদলীয় শাসনব্যবস্থাও চালু হবে না। আইনমন্ত্রীকে ধন্যবাদ। সংবিধানে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম থাকা না থাকা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে যে সন্দেহ ও সংশয় ছিল তিনি তা খানিকটা অপনোদন করতে পেরেছেন। আইনমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে, সংবিধানে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম শব্দমালা থাক, এটা সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষা এবং সরকার এ ব্যাপারে কোনো ব্যত্যয় ঘটাতে চায় না।
সংবিধানে এই শব্দমালা সংযোজিত হয়েছিল পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে আর এটি করেছিলেন সামরিক শাসক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান।
পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের রায়ে সামরিক আইন ও ফরমানকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু বিসমিল্লাহির রাহমানির থাকবে কী থাকবে না সে ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি। যদিও এ শব্দমালা সংবিধানের অংশ কি না তা নিয়ে বিতর্ক আছে। কারণ, সংবিধানের প্রস্তাবনার ওপর এই শব্দমালা রয়েছে।
আইনমন্ত্রী বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিমের মতো আরেকটি বিষয় নিয়ে যদি তার বা সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করতেন তা হলে সাধারণ মানুষের মনে এ নিয়ে সন্দেহ আর অবিশ্বাস থাকত না। আমরা সে দিকটি নিয়ে আলোচনা করব।
সংবিধান শুধু একটি রাষ্ট্র পরিচালনার মূল ভিত্তি নয়। একটি স্বাধীন-সার্বভৌম জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস, আকাঙ্ক্ষা ও জাতিসত্তার পরিচয়ের প্রতিফলন থাকে সংবিধানে। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের রায়ে রাষ্ট্র পরিচালনার মূল নীতিসংক্রান্ত ঘোষণার ৮ নম্বর ধারাটি বাতিল করা হয়েছে।
এ ধারায় উল্লেখ আছেঃ ‘৮(১) সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস জাতীয়তাবাদ গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র অর্থাৎ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচার এই নীতিগুলো এবং তৎসহ এই নীতিগুলো থেকে উদ্ভূত এই ভাগে বর্ণিত অন্য সব নীতি রাষ্ট্র পরিচালনার মূল নীতি বলিয়া পরিগণিত হইবে।
১(ক) সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসই হইবে যাবতীয় কার্যাবলির ভিত্তি। ’
পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের রায় কার্যকর হলে এই শব্দমালা আর সংবিধানে থাকবে না। রাষ্ট্র পরিচালনার মূল নীতিসংক্রান্ত এ ধারা বাতিলের ব্যাপারে আইনমন্ত্রী এবং সরকারের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল কোনো মন্তব্য করেছেন বলে আমাদের জানা নেই। আমরা ধরে নিতে পারি, তারা এই ধারাটি বাতিলকে সমর্থন করেন।
কারণ, পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের রায়ের ব্যাপারে বিগত সরকারের সময় করা আপিল থেকে সরকার নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এখনো বিষয়টি বিচারাধীন সে কারণে এ নিয়ে বিতর্কে যাওয়া ঠিক হবে না।
আমরা আবার আইনমন্ত্রীর বক্তব্যে ফিরে যাই। তিনি বলেছেন, পঞ্চম সংশোধনী সম্পর্কে হাইকোর্টের দেয়া রায়ে সংবিধানের চার মূলনীতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই চার নীতি হচ্ছে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ।
আইনমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন, সংবিধানের এই ৮ নম্বর ধারাটি বাতিল হলে প্রকৃতপক্ষে এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষের বিশ্বাসের যে কথাটি সংবিধানে উল্লেখ আছে তা আর থাকছে না। আর এর ফলে আল্লাহর ওপর পূর্ণ বিশ্বাস বা আস্থার কথা না থাকায় এটি একটি প্রকৃত অর্থে ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান হিসেবে পরিগণিত হবে। এ কথাটি আইনমন্ত্রী বলেছেন। কিন্তু তিনি বলেছেন, বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম উঠে যাবে না। এখানে আইনমন্ত্রী কিছুটা চতুরতার আশ্রয় নিয়েছেন।
প্রথম কথা হলো, বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম শব্দমালার অর্থ হচ্ছে দয়াময় পরম দয়ালু আল্লাহর নামে। বাংলাদেশের মানুষ সাধারণত কোনো কাজ শুরু করার আগে আল্লাহর নামে শুরু করে। সংবিধানের শুরুতেই এই দৃষ্টি থেকে এ শব্দমালা বসানো হয়েছে। বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম আর সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসই হবে যাবতীয় কার্যাবলির ভিত্তি। এই দুই বাক্যের তাৎপর্য বা গুরুত্ব এক নয়।
দ্বিতীয় বাক্যের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের বিশ্বাস এবং চেতনার প্রতিফলন ঘটেছে। পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের মাধ্যমে মানুষের বিশ্বাসের এই মর্মমূলে আঘাত করা হয়েছে। এ ছাড়া যেহেতু বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম সংবিধানের প্রস্তাবনার বাইরে রয়েছে সে কারণে যে কেউ এ প্রশ্ন তুলতে পারেন, বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম সংবিধানের অংশ নয়।
এখন প্রশ্ন হলো সরকার কেন হাইকোর্টের একটি রায়ের মাধ্যমে ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে যেতে চাইছে? আমরা জানি সর্বোচ্চ আদালত আইনের ব্যাখ্যাদাতা। আইন প্রণয়ন করে সংসদ।
দেশের মানুষ নির্বাচনে ভোট দিয়ে আইন প্রণয়নের জন্য সংসদ সদস্য নির্বাচিত করে। বর্তমান সরকার সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। তারা সংসদে যেকোনো ধরনের আইন পাস করতে পারে। সরকার যদি মনে করে তারা সংবিধানে ৮ নম্বর ধারা বাতিল করে বাংলাদেশকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশে পরিণত করবে তা তারা সংসদে করতে পারে। কিন্তু তা না করে হাইকোর্টের রায়ের মাধ্যমে কেন করতে চাচ্ছেন সেটি একটি বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।
পঞ্চম সংশোধনীর রায়ে সামরিক আইন বা ফরমানগুলোকে বাতিল করা হয়েছে। গণতন্ত্রকামী কোনো মানুষ সামরিক শাসন সমর্থন বা পছন্দ করতে পারে না। কিন্তু যেকোনো পরিস্থিতিতে হোক বাংলাদেশে দীর্ঘ সময় সামরিক শাসন বলবৎ ছিল। সেই সামরিক শাসকদের একজন এখনো রাজনীতি করছেন এবং সরকারের অংশীদারও বটে। এ দীর্ঘ সামরিক শাসনে অনেক খারাপ আইন যেমন হয়েছে, তেমনি কিছু ভালো আইনও হয়েছে।
এমনকি এমন অনেক চুক্তি হয়েছে যা অন্যরা বিরোধিতা করলেও তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হয়েছে।
পরবর্তী সরকার সাধারণভাবে পূর্ববর্তী সরকারের আইন বা কর্মকাণ্ডের বৈধতা প্রদান করে থাকে। কোনো আইন ক্ষমতাসীনদের কাছে অগ্রহণযোগ্য বিবেচিত হলে সেগুলো সংসদে বাতিল হবে। অর্থাৎ গ্রহণ বর্জনের কাজটি করবে সংসদ। আমরা উদহারণ হিসেবে বলতে পারি প্রথম আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের সাথে ২৫ বছর মেয়াদি মৈত্রী বন্ধুত্ব চুক্তি করলেও জিয়াউর রহমান, এরশাদ, বেগম খালেদা জিয়ার সরকার এর তীব্র বিরোধিতা করলেও তা বাতিল করেনি বা করতে পারেনি।
আবার ’৯৬ সালে গঙ্গার পানি চুক্তি বা পার্বত্য শান্তি চুক্তি নিয়ে তারা বিরোধিতা করলেও সে চুক্তি এখনো বহাল আছে। একইভাবে সামরিক শাসনামলে অনেক আইন হয়েছে যেগুলো এখনো বহাল আছে। এই ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য সরকারের উচিত ছিল আপিল প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা। সরকার সম্ভবত এই বিবেচনায় এটি প্রত্যাহার করেছে , ’৭২-এর ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানে ফিরে যাওয়ার যে ঘোষণা দিয়েছে তা এই রায়ের মাধ্যমে পূরণ হচ্ছে।
কিন্তু কী ধরনের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান তারা চান তা স্পষ্ট করতে পারছে না।
আইনমন্ত্রীর বক্তব্যে বুঝতে পারছি বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম নিয়ে তাদের কোনো আপত্তি নেই। তা হলে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসই হইবে যাবতীয় কার্যাবলির ভিত্তি’ এ বাক্য নিয়ে আপত্তি কেন? এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা বা বিশ্বাস নেই এমন কথা তো বলা যাবে না। এখন আইনমন্ত্রী যদি মনে করেন এবারের নির্বাচনে দেশের মানুষ সংবিধানের এই ধারাটি বাতিল করে ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান প্রণয়নের জন্য ভোট দিয়েছে। তা হলে তাদের উচিত হবে সেই আইন সংসদে প্রণয়ন করা।
’৭২-এর সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার এ ধারাটি নেয়া হয়েছে ভারতীয় সংবিধানের আদলে।
আমরা লক্ষ করছি সরকারের মন্ত্রীরা সংবিধানে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসের মাধ্যমে এ জনগোষ্ঠীর মানুষের যে আইডেন্টিটি বা পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে তা তারা অস্বীকার করতে চাইছেন। সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিদেশী রাষ্ট্রদূতদের উপস্থিতিতে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ মুসলিম দেশ নয়, সেক্যুলার দেশ। সরকার যদি নীতিগতভাবে মনে করে, এ দেশের মানুষের মুসলিম পরিচয় তারা মুছে ফেলতে চান সে সিদ্ধান্ত তাদের সংসদে নিতে হবে। কারণ সংসদ সদস্যরা জনগণের প্রতিনিধি। তবে ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাপারে যারা অতি উৎসাহী তাদের শুধু একটি বিষয় মনে করিয়ে দিতে চাই, স্বাধীনতার পর দেশী-বিদেশী নানা চাপ উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানে ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন।
সদ্য স্বাধীন এই রাষ্ট্রকে পরিচয় করে দিয়েছিলেন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে। তিনি বলেননি যে এটি বিশ্বের দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থ সেক্যুলার রাষ্ট্র।
যা হোক আইনমন্ত্রী পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের মাধ্যমে সংবিধানে চার মূল নীতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে যে মন্তব্য করেছেন আদালতের ওপর তা এক ধরনের চাপ প্রয়োগের শামিল। যদি তারা সংসদের মাধ্যমে এ আইন প্রণয়ন বা সংবিধান সংশোধনে সাহসী না হন তা হলে আদালতের ওপর ভর করে কেন এই রাজনৈতিক অভিলাষ পূরণ করতে চাইছেন? এ কারণে কী? জনগণের কাছে এই ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠার এজেন্ডা গ্রহণযোগ্য হবে না বরং এর পরিণতি হবে ভয়াবহ। আর এ কারণে আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে তা বাস্তবায়ন করতে চাইছেন।
লেখকঃ আলফাজ আনাম।
Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।