আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সুদূরের যাত্রী

আস সালাম - আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক

দেশে যাওয়াটা আমার জন্য সবসময়েই বেশ ঝামেলাপূর্ন। ছেলে মেয়ে কর্তা এবং আমার নিজের - সবার সব রকম ব্যবস্থা ঠিক আছে কিনা তা নিশ্চিত করাটা এক ব্যপক আয়োজনের বিষয়। কতদিন বাচ্চাদের ক্লাশ মিস যাবে, সেটার পূরন কি করে হবে - এটা যেমন একটা বড় মাথাব্যথা, অন্যদিকে টিকেট ঠিক আছে কিনা, ব্যগেজ গোছানো - এসব আরেক ঝক্কি। সবকিছুর আয়োজন সুচারুভাবে সম্পন্ন করার পেছনে থাকে একটাই উদ্দেশ্য। কিছু দিনের জন্য আমাদের প্রিয়জনদের সংগ লাভ।

আর আমার সন্তানদের জন্য উৎসের সন্ধান। সেবার বাংলাদেশে যাওয়ার পথে ঘটল বিপত্তি। যখন বোর্ডিং পাস নিলাম তখন দেখলাম দুবাই থেকে আমরা আলাদা হয়ে গেছি। মানে, সবার সিট একসাথে হয় নি। একজনকে আলাদা বসতে হবে।

আমার ছেলে মেয়ে দুটোই খুব বেশী রকম বাবা ভক্ত। বিশেষত মেয়ের ভক্তি অতিরিক্ত। সেজন্য আমি কর্তাকে বললাম, প্লেনে তো এরা সবসময় বিরক্ত হয়ে থাকে। সেজন্য এরা না হয় তোমার সাথে থাকুক। আর আমি এই পাশের সিটে বসি।

সেভাবেই ফয়সালা হল। লাগেজ ব্যাগ মাথার উপরে উঠিয়ে সুস্থির হয়ে বসে পাশ ফিরে তাকিয়ে প্রতিবেশী যাত্রীকে দেখতে চাইলাম এবার। আপাদ মস্তক বোরখা এবং নেকাবে আচ্ছাদিত একজন। আমি তার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলাম। পশ্চিমে থেকে থেকে পশ্চিমের কালচারে খুব বেশী রকমের অভ্যস্ত হয়ে গেছি।

পরিচিত অপরিচিত সবার দিকে হাসি ছুড়ে দেই। আমার হাসিতে অবগুন্ঠন ধারিনী বোধকরি আশ্বস্ত হলেন। নেকাব সরালেন তিনি। দেখলাম শ্যামলা বর্নের মাঝবয়েসী নারী। তিনিও হাসছিলেন।

আমি অবাক হলাম। কারন, তার সে হাসি চেহারা থেকে বিষাদের ছায়া দূর করতে পারেনি। তিনি কিছু বলার আগেই আমি বুঝলাম তিনি আসলে একা। খুব বেশী একা। এই বিষন্নতা তার একাকীত্বের বিষন্নতা।

নীরবতা আমিই ভাংগলাম। "দেশে যাচ্ছেন কি অনেক দিন পরে?" "হ্যা। এই আমার প্রথম দেশে যাওয়া। " "দুবাইতে আছেন কতদিন। " "এগার বছর।

" "এগার বছরে একবারও দেশে যান নি। " "ভিসা নিয়ে ঝামেলা হচ্ছিল। তার পরে জেল খাটলাম। " "জেল? কেন, জেল খাটতে হল কেন?" "পার্লারে কাজ করতাম। সেই পার্লারের মালিক মহিলা আমাকে জেলে দিয়ে দিল।

" "কিন্তু কেন?" "অনেক রকম কাজ করতে বলত। সেসব কাজ আমি করতে চাইতাম না। চুক্তিতেও সেটা ছিল না। " আমি আরেকবার বুঝলাম মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশীদের মানবাধিকার কতটা লংঘিত। পশ্চিমে এরকমভাবে বিদেশীদের বৈষম্য দেখাতে সাহস করে না কোন এমপ্লয়ার।

"তারপরে দেশে আপনার কে কে আছে?" আমি কথোপকথন চালিয়ে গেলাম। "ছেলে আর মা। ছেলে এখন ফাইভে পড়ে। " "ছেলের বাবাও কি আপনার সাথে দুবাই থাকে?" "না, তিনি আমাদের সাথে নেই। অনেক আগেই আলাদা হয়ে গিয়েছেন।

" "কবে ছাড়াছাড়ি হল?" "বিয়ের খুব বেশীদিন পরে নয়। আমি গ্রামে থাকতাম। তিনি শহরে চলে গেলেন। সেখানে এক মেয়ের সাথে পরিচয়। সেই মেয়েকে বিয়ে করল।

" আমি কিছুক্ষন চুপ করে রইলাম। আমার প্রতিবেশীনি নিজে থেকেই শুরু করলেন, "তার বিয়ের খবর পেয়ে আমি আর দেশে থাকিনি। তখন দুবাইতে নারী শ্রমিক নিচ্ছিল। আমি তাদের সাথে চলে এলাম দুবাই। ছেলেকে রেখে এলাম মায়ের কাছে।

এরপর তো ভিসা সমস্যাতে আটকে গেলাম। অবশেষে ভিসা ঠিক হল এই কয়দিন আগে। সেজন্য গত এগার বছরে আর দেশে যাওয়া হয় নি। " আমি এক মনে তার কথা শুনছিলাম। আস্তে আস্তে তিনি যখন তার বিদেশ আসার কাহিনীটি বলছিলেন তখন আমার মনে পড়ছিল ফরেস্ট গাম্প ছবির কথা।

ছবির ফরেস্ট গাম্প, মানে টম হ্যাংকসকে ছেড়ে তার বাল্য বান্ধবী জিনি যখন চলে যায়, ফরেস্ট তখন সে প্রত্যাখ্যান সহ্য করতে পারেন নি। পালিয়ে যেতে চান শহর ছেড়ে, নিজের জীবনের আজন্ম পরিচিত সবকিছুকে পেছনে ফেলে। দৌড়ুতে শুরু করেন। দৌড়ুতে থাকেন, দৌড়ুতে থাকেন। তার দাড়ি গোফ বড় হয়ে জংগল হয়ে যায়।

তিনি তবু দৌড়ুতে থাকেন। বিশাল দাড়িতে আচ্ছাদিত এই ফরেস্টকে মানুষ দেখে বিষ্ময় প্রকাশ করে। তবু ফরেস্ট থামে না। এই বোরখাবৃত নারীও যেন তার সবকিছুকে পেছনে ফেলে প্রবাসে এসেছেন সে প্রত্যাখ্যানকে বিস্মৃতির গহ্বরে ঠেলে দেবার জন্যে। কল্পনা ছেড়ে আমি আবার ফিরে আসি বর্তমানে।

জানতে চাইলাম, "আর বিয়ের কথা ভাবেন নি। " "না। আর কখনও ভাবি নি। " "এখন তো বিয়ে করতে পারেন। " "এখন? ছেলে তো অনেক বড় হয়েছে।

আসলে আর ইচ্ছে নেই। " তিনি চুপ করলেন। নীরবতা নেমে এল আমাদের মাঝে। বলার মত আমি কিছু পেলাম না। অবগুন্ঠন ধারিনীও নির্বাক।

সিটের পাশে ছোট্ট জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আমি দেখতে চাইলাম চলমান মেঘগুলোকে। কিন্তু বাইরের সিটে থাকায় আমার পক্ষে তা সহজ হল না। মেঘের রাজ্যে হারিয়ে যাবার পথে তা কাটা হয়ে রইল। কতক্ষন এভাবে পার করলাম জানি না। হঠাৎ সম্বিত ফিরে পেলাম কর্তার ডাকে।

"আসো এদিকে। একটা ব্যবস্থা হয়েছে। পাশের সীট খালি হয়েছে। এখানে চলে এসো। " দেখলাম মেয়ের পাশের সীটটা খালি হয়েছে।

কি করে কি ব্যবস্থা হল, সেখানকার প্যাসেন্জ্ঞার কোথায় গেলেন, তা আর জানতে চাইলাম না। আবারও মিষ্টি হেসে অবগুন্ঠন ধারিনীর কাছ থেকে বিদায় নিলাম। ঘুমন্ত মেয়ের পাশে গিয়ে বসলাম। খুটিয়ে দেখতে শুরু করলাম সবার সব কিছু ঠিক আছে কিনা। সব দেখা শেষ করে সুস্থির হয়ে বসতেই আমারো পেল ঘুম।

একঘুমে আমিও আমার মেয়ের মত কাটিয়ে দিতে চাইলাম বিরক্তিকর যাত্রাপথের ক্লান্তি। ঘুম ভাংগল অনেক দেরীতে। গন্তব্যে প্রায় পৌছে যাবার সময়ে। প্লেন যখন রানওয়ে স্পর্শ করল আমরা তখন উৎফুল্ল। নামার সময় মনে চলে এল ক্ষনিক আগের পরিচিত সেই শ্যামলা অবগুন্ঠন ধারিনীর কথা।

মাথার উপর থেকে লাগেজ নামাতে নামাতে এপাশ ওপাশ ফিরলাম। নাহ, কোথাও তিনি নেই। হায়, কি ভুল করলাম। তার নামটাও তো আমার জানা হল না। আই ডিতে প্রকাশিত (Click This Link)


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।