আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রগতিশীলতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতা



প্রগতিশীল এবং প্রতিক্রিয়াশীল শব্দদুটির ভেতরে প্রভেদ খুব কম। মূলত প্রগতিশীল মানুষেরাই একদিন প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে উঠতে পারেন। কোনটা প্রগতিশীলতা এবং কোনটা প্রতিক্রিয়াশীলতা- এটা নির্ধারণ করবে ব্যক্তির অবস্থান এবং ক্ষমতার প্রতিসাম্যতা। বাংলাদেশে মধ্যবিত্তের বিকাশ ঘটেছে কোম্পানীর আমলে, সিপাহী বিদ্রোহের পরে যখন ইংরেজ শুধুমাত্র ব্যবসায়ী চরিত্র হারিয়ে নিছক শাসক চরিত্র গ্রহন করলো, ঠিক তখনই বাংলাদেশে মধ্যবিত্তের উদ্ভব ঘটেছে। প্রাসাদ ষড়যন্ত্র কিংবা উত্তরাধীকারিদের ভেতরে ক্ষমতা ও শাসনের লড়াই খুবই স্বাভাবিক একটা বিষয় রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায়।

এমন কি বর্তমানের গণতান্ত্রিক সময়েও ক্ষমতার হানাহানির ভেতরে সেই প্রাগৈতিহাসিকতা বিদ্যমান। সিরাজউদদৌলাকে যখন মুর্শিদকুলি খান ভবিষ্যত উত্তরাধিকারী ঘোষণা করলেন ১৭৫২ সালে ঠিক তখনই সিরাজউদদৌলার ক্ষমতা আরোহনের বিরোধিতা করলেন তারই ভাই আক্রামউদদৌলা, সৌলতজঙ্গ, এবং তার পূত্র শওকত জঙ্গ, এবং তার কিছু দিন পরেই মৃত্যু বরণ করেন আক্রামউদদৌলা, সৌলত জঙ্গ। ঘষেটি বেগম এবং তার দেওয়ান হোসেন কুলী খানের সম্পদ ও ক্ষমতাও সিরাজউদদৌলাকে শংকিত করেছিলো, সুতরাং সিরাজউদদৌলা চেয়েছিলেন হোসেন কুলী খানের মৃত্যু, এবং ১৭৫৪ সালে সিরাজউদদৌলা মুর্শিদকুলী খানের অনুমতি নিয়েই হোসেন কুলি খানকে হত্যা করেন। সিরাজউদদৌলা ১৭৫৭ সালে ঢাকার তৎকালীন নায়েব তথা শাসককে বলেছিলেন ঢাকার সমস্ত ইংরেজদের হত্যা করতে হবে, একজন শিশুও যেন রেহাই না পায়, জেরাসত খান, যিনি ছিলেন তখন ঢাকার শাসনকর্তা তিনি এমন নিষ্ঠুরতায় সায় দেন নি, তিনি বরং ঢাকার ফরাসী বণিকদের সম্মতি নিয়ে ইংরেজদের প্রাণরক্ষা করেন। এ সময়েও বাংলাদেশে মূলত শাসক এবং শাসকের সহায়ক মানুষদের সাথে সাধারণ মানুষদের জীবনযাত্রার মানের তারতম্য ছিলো অনেক বেশী।

আমরা মধ্যবিত্তকে যে আবহে চিনি, তার ছিটে ফোঁটা ছিলো না এই রাজতান্ত্রিক প্রশাসনিক কাঠামোর অন্তর্গত মানুষদের ভেতরে। ইংরেজ বণিক থেকে শাসক হয়ে উঠবার পরে প্রাক্তন শাসকশ্রেণী এবং নিজস্ব লোকবল দিয়ে উপমহাদেশ শাসন করবার প্রচেষ্টা গ্রহন করেন, তারা মানুষকে ধর্মশিক্ষায় শিক্ষিত করেন, অর্থ্যাৎ তারা খ্রীষ্ট ধর্ম প্রচারণা শুরু করেন ব্যপক ভাবে, এবং এই নিবেদিতপ্রাণ মিশনারীরা নিজেদের সংস্কৃতি ও রুচি ছড়ানোর মাধ্যম হিসেবে নিজস্ব শিক্ষালয় খুলেন, সেখান থেকে কেরানী তৈরি হতে থাকে, এবং এইসব কেরানি, দারোগা, বিচারক, এরাই বর্তমান বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রতিভু। এরাই বাংলাদেশে প্রগতীশীল আন্দোলনের সূচনা করে। ইংরেজদের অবদান হয়তো বাংলাদেশে কিংবা উপমহাদেশে একটা শিক্ষিত শ্রেণী নির্মাণ করা, যারা এই দেশের জনগণকে শাসন করবে, এবং শোষণে সহায়তা করবে, তাদের সাধারণ মানুষদের সাথে বিচ্ছিন্ন রাখবার যাবতীয় বন্দোবস্তই ছিলো। বিভিন্ন রকম নিয়ম-নীতির বেড়াজালে আটকে থাকা ইংরেজি কোম্পানীর কর্মকর্তা এবং কোম্পানী শাসকদের কর্মকর্তাদের সাথে যুক্ত ছিলেন আমাদের জমিদারবর্গ।

সম্ভোগ এবং উল্লাস ও বিলাসিতা, আমরা বর্তমানে যেসব আচরণকে অশোভন নারীলিপ্সুতা বলি, সেসব অশোভন নারীলিপ্সুতাকে খুব স্বাভাবিক বিবেচনা করা হতো সেই সময়টাতে। ঢাকা শহরের মধ্যবিত্তের বিকাশ ঘটেছে গত শতকের শুরুতে। সে সময়ই ইংরেজী সংস্কৃতিতে ভিক্টোরিয়ান মানসিকতার জয়জয়াকার। জাহাজবাহিত সেই সংস্কৃতিতে আচ্ছন্ন আলোকিত প্রগতিশীল সমাজ, নিজেদের ভোগের জীবন অব্যহত রেখেও সমাজসংস্কারকের ভুমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন সে সময়ে। একজন দুজন রক্ষিতা না রাখা যেখানে অশোভন বিবেচিত হতো, নিয়মিত বাঈজীবাড়ী যাওয়া এবং গণিকাগমনকে যে সময় পৌরুষ ও ক্ষমতা প্রদর্শনের মাধ্যম ধরা হতো সে সময়েই ইংরেজী মিশানরীদের শিক্ষায় আলোকিত কতিপয় জমিদারনন্দন সমাজসংস্কারকের ভুমিকা গ্রহন করলেন।

তাদের দ্বারাই বিকশিত হলো ব্রাহ্ম ধর্ম। সে সময়ে প্রগতিশীলতার লক্ষণ ছিলো ব্রাহ্ম হয়ে যাওয়া। রুচিশীলতা এবং প্রগতিশীলতার মিলমিশ বেশী দিন থাকে নি। বরং একটা পর্যায়ে ব্রাহ্মবাদীরা নিজেরাই প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে উঠলেন, সমাজ সংস্কারের দায়টা মাথায় নেওয়ার পরে সেটা তাদের জন্য ঠিক কোন পর্যায়ে বোঝা হয়ে উঠলো এটা নির্ধারণ করা কঠিন, তবে মাত্র ২০ বছরের ব্যবধানেই আনুষ্ঠানিকতা এবং ধর্মাচার ও শুদ্ধাচার নিয়ে ব্রাহ্মবাদীদের ভেতরে সংঘাত শুরু হলো, এবং নিয়মনিষ্ঠা, মূলত সনাতনধর্মের অনুসারী গোঁড়া শিক্ষিত মানুষ, যারা ব্রাহ্ম ধর্মকে প্রগতিশীল মনে করে নিজেদের সংস্কার চাপিয়ে দিতে চাইছিলেন সাধারণ মানুষের জীবন যাপনে, তারাই চরম প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে উঠলেন। এখানেই প্রগতিশীল এবং প্রতিক্রিয়াশীলদের ভেতরে ঐক্য- উভয় মতবাদই মনে করে সাধারণ মানুষ মোটেও সচেতন নয়।

তাদের আলোকিত করতে হবে, এবং আলোকিত করবার পন্থা হিসেবে সংস্কারকৃত ধর্মমত প্রাধান্য পাবে না কি গোঁড়া ধর্মবাদীতাই হবে সাধারণ মানুষকে আলোকিত করবার অন্যতম পন্থা এই বিষয়ক সংঘাতই সাধারণ ভাবে প্রগতিশীল ও প্রতিক্রিয়াশীলদের ভেতরের সংঘাত। ঢাকা শহর কোনো সময়ই কোলকাতার মতো বিলাসী নটি ও নটরঙ্গীণীভারাক্রান্ত ছিলো না, তবু একটা সময়ে ঢাকা শহরের মোট জনসংখ্যার ৩ শতাংশ ছিলো বারবণিতা। এবং ঢাকা শহরের প্রতিটা সম্ভ্রান্ত পরিবারেই এক কিংবা একাধিক রক্ষিতা রাখবার প্রচলন ছিলো, এবং সে সময়ের সমাজঅধিপতিরা বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানেও এইসব বাঈজি এবং বারবণিতাদের সঙ্গ ও রঙ্গ উপভোগ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা বোধ করতেন না। তবুও ঢাকা শহরে যখন কোলকাতা থেকে নাটকের দল নাটক করতে আসলো ১৮৭৯ সালে, সে নাটকের দলের অংশ হিসেবে এসেছিলো একজন বারবণিতা এবং ঢাকাস্থ ব্রাহ্ম সমাজ যুবসমাজ উচ্ছন্নে গেলো বলে হাহাকার করে নাটকের প্রদর্শনী বন্ধ করে দিলেন, তারা জনমত সংগঠিত করে বললেন এই বেলেল্লাপনা মেনে নেওয়া যায় না। সাধারণ মানুষ বারবণিতাকে নিয়ে প্রকাশ্য রঙ্গমঞ্চে নাটক উপভোগ করতে পারছেন এবং পয়সা দিয়ে টিকেট কেটে বাবু-বিবিরা বারবণিতার সাথে বসে নাটক দেখতে পারলেও, ব্রাহ্মবাদীদের উপলব্ধি যদি বারবণিতা স্টেজে উঠে অভিনয় করে, সে দৃশ্য দেখে সাধারণ মানুষের চরিত্রস্খলিত হয়ে যাবে।

অন্য কোথাও তারা প্রতিরোধ করেছে এমন নজির নেই, কিন্তু নাটকে নটি অভিনয় করবে এটা নিয়ে তাদের যেমন ব্যপক প্রতিক্রিয়া তাতে আশ্চর্য হতে হয়। ঢাকার আনাচে কানাচে এমন কি তারা যে অঞ্চলে বসবাস করেন, সে অঞ্চলের প্রায় প্রতিটা গৃহে রক্ষিতা থাকলেও তারা রক্ষিতাদের একঘরে করেন নি, কিন্তু পতিতাদের উপাসনালয়ের প্রাঙ্গনে এমন কি তার আশেপাশের রাস্তায় হাঁটতে বারন করেছেন বিজ্ঞপ্তি দিয়ে। অথচ এই মানুষগুলোই সে সময়ের ঢাকার সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত এবং আলোকিত প্রগতিশীল মানুষ, যারা নিজগৃহে গানবাজনার চর্চা করছেন, কাব্য করছেন, নটকের দল করছেন, কিন্তু শূঁচিবাইয়ের মতো তাদের ভেতরেও প্রতিক্রিয়াশীলতা বিদ্যমান ছিলো। সে সময়েই ঢাকা শহরের শিক্ষিত মানুষেরা কোম্পানির চকুরির সুবাদে থিতু হয়ে বসতে শুরু করেছে, তারাই স্থানীয় অধিবাসীদের পিঠে ছুড়ি মেরে তাদের স্থাবর সম্পত্তি হাতিয়ে নিচ্ছে। সরকারী কর্মচারীদের চরিত্র বিগত ১০০ বছরে তেমন পরিবর্তিত হয় নি, তারা পরস্বঃলুণ্ঠন করে নিজেদের আখের গোছানোর সংস্কৃতি অদ্যাবধি অব্যহত রেখেছেন।

গ্রাম থেকে আসা তরুণ, যে জায়গীর ছিলো ঢাকার কোনো পরিবারে, সেই মানুষটাই কোম্পানী কিংবা সরকারী কর্মচারী হয়ে জায়গীর পরিবারের কন্যাকে বিবাহ করে, তাদের স্থাবর সম্পত্তি নিলামে উঠাচ্ছেন কিংবা সরকারী ক্ষমতার বদৌলতা জবরদখল করছেন, এমন অনেক উদাহরণ আছে। বর্তমানে যে স্থানটিকে কাঁঠালবাগান বলা হচ্ছে, গ্রীণ রোড থেকে শুরু করে সার্কফোয়ারা পর্যন্ত অঞ্চলটি যার সম্পত্তি ছিলো, সে মানুষটা প্রায় ৬০০ বিঘা জমি হারিয়েছে, এবং বিনিময়ে কিছুই পায় নি, যে ক্ষতিপূরণ তার প্রাপ্য ছিলো, সেটা না পেয়েই তাকে মৃত্যু বরণ করতে হয়েছে। ওয়ারী তৈরি হয়েছে সরকারী কর্মচারীদের আবাসস্থল হিসেবে। একই ভাবে গেন্ডারিয়াতে বসত গড়েছে সম্পন্ন মধ্যবিত্ত পরিবারেরা। তাদের সংস্কৃতি আলাদা।

তারা নিজস্ব মধ্যবিত্ত সুশীল সংস্কৃতির চর্চা করেছেন সেখানে। এবং সেটা স্থানীয় অধিবাসীদের লুণ্ঠন করেই। তাদের তথাকথিত প্রগতিশীলতা এবং অগ্রসরমানসিকতা তাদের দস্যুমনোবৃত্তিকে দমন করতে পারে নি। প্রায় ১০০ বছর পরে, যখন পুনরায় প্রগতিশীলতার চর্চা শুরু হয়েছে, যারা বর্তমানে আমাদের সংস্কৃতি নির্মাণের ও সংস্কৃতি চর্চার দায় কাঁধে গ্রহন করেছেন, তাদের প্রতিক্রিয়াশীলতার প্রমাণও আমরা পাচ্ছি। তারাও নিজস্ব ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি প্রকাশের জন্য পারস্পরিক সংঘাতে লিপ্ত।

তারাও নিজস্ব নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে পরস্বলুণ্ঠন এবং তাবেদারীতে লিপ্ত। বর্তমানের ক্ষমতাবানদের নতুন সংস্কৃতি ডেভলপার হয়ে উঠা, ঢাকা শহরের জলনিষ্কাশনভুমি দখল করে সেখানে সাধের স্টেডিয়াম নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাহবা কুড়ানো মানুষটাও নিজের স্বার্থই দেখেছে। স্থানীয় অধিবাসীদের দুর্ভোগের কথা তারা বিবেচনাও করে নি। এবং তাদের সাথ তাল মিলিয়ে চলছে প্রগতিশীল বাহিনী। একই সাথে আমরা যাদের প্রতিক্রিয়াশীল বলছি, সেইসব কাওমী মাদ্রাসার অধিপতি, যারা বৈদেশিক অনুদান ও সম্পদের লোভে মাদ্রাসা গড়েছেন, তাদের ওখানে ন্যুনতম খরচে শিক্ষিত হতে আসা ছেলেদের নিয়েও রাজনীতি চলছে , যেহেতু তারা একেবারে নমঃশুদ্র সুতরাং তাদের প্রতিক্রিয়াশীল বলে দেওয়া যায় অনায়াসে, এবং এই উভয় প্রকারের ব্যবসায়ীরাই মনে করে সাধারণের রুচি নষ্ট হচ্ছে।

সাধারণের রুচি নির্মাণে প্রগতিশীলেরা একের পর এক কর্পোরেট সংস্থাকে বাংলাদেশের সংস্কৃতির চিহ্ন হয়ে উঠা এক একটা উৎসবকে স্পন্সর করবার দায়িত্ব দিচ্ছে, এবং যাদের তারা প্রতিক্রিয়াশীল বলছে, তারা সাধারণ মানুষের রুচির এই বিকৃতিকে দমন করতে গিয়ে প্রাণসংহারী ভুমিকা নেওয়ার প্রচেষ্টা করছে। এবং উভয়পক্ষই উভয়পক্ষকে ঘৃণা করে। এবং তাদের একই রকম মনোবৃত্তি দেখে এখন প্রগতিশীল এবং প্রতিক্রিয়াশীলদের সংজ্ঞা নিয়ে চিন্তিত আমি।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.