চিত্ত যেথা ভয়শূন্য
প্রগতির ধারণার জন্ম মানুষের ইতিহাসে এক নতুন ধারণার সংযোজন। প্রগতির ধারণা থেকেই আগামী দিন নিয়ে স্বপ্ন শুরু। প্রগতির সংজ্ঞা দিয়েছেন একজন দার্শনিক।
“মুলত প্রগতির ধারণা মনে করে যে বর্তমান অতীতের চেয়ে শ্রেয় এবং বিশ্বাস করে যে ভবিষ্যৎ আরো ভালো হতে পারে এবং হবে”।
প্রগতির এই ধারণার ব্যাপক প্রসার ঘটে সতের দশকে।
ওই সময় ফ্রান্সে শুরু হয় প্রাচীন ও আধুনিকের লড়াই। চার্ল পেরো বিশ্বাস করতেন যে, প্রাচীন যুগ আধুনিক যুগের চাইতে শ্রেয়, অর্থাৎ যত সময় যাচ্ছে মানুষের অবস্থার তত অবনতি ঘটছে। প্রগতির পক্ষে বক্তব্য রাখেন বিখ্যাত ফরাসী লেখক বার্নাড দ্য ফতনেল। তাঁর মতে আধুনিক যুগে মানুষের পার্থিব ও মানসিক অগ্রগতি ঘটেছে। ইংল্যন্ডে এই বিতর্ক ব্যাটেল অব দ্য বুকস নামে পরিচিত ছিল।
প্রগতির ধারণা কারা জন্ম দিয়েছে এ সম্পর্কে সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে বিতর্ক হয়েছে। রবার্ট নিসবেট মনে করেন যে, সমাজবিজ্ঞানীরা প্রগতির ধারণার জনক। আবার ঐতিহাসিক কার্ল বেকার বিশ্বাস করেন যে, প্রগতির ধারনার উদ্ভাবক হোল ইউরোপের এনলাইটেনমেন্ট আন্দোলনের লেখকরা। তাঁরা কেউ দার্শনিক ছিলেননা; কিন্তু তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে, আধুনিক কালে মানুষের ইতিহাসে নবযুগের সুচনা হয়েছে এবং মানুষের সভ্যতা উত্তরোত্তর প্রগতির পথে এগিয়ে যাবে। প্রথমদিকে অনেক সমাজবিজ্ঞানী এ মতবাদের বিরোধিতা করেছেন, তবে পরবর্তীকালে সমাজবিজ্ঞানীরাই প্রগতির সবচেয়ে বড় প্রবক্তা হয়ে দাঁড়ান।
সতের দশকে প্রগতির ধারণাকে উজ্জীবিত করেছে আধুনিক বিজ্ঞানের জয়জাত্রা। বিজ্ঞানের জয়জাত্রার সাথে সাথে শিল্পবিপ্লব-উত্তর-ইউরোপে অর্থনৈতিক অগ্রগতি প্রগতির ধারণাকে আরো জনপ্রিয় করে তোলে।
প্রগতির উল্টোটা প্রতিক্রিয়া। প্রতিক্রিয়া সেই দর্শন বা মতবাদ যা মনে করে মানুষের ইতিহাস ক্রমাবনতিশিল। মানুষ এবং সভ্যতা ক্রমেই অবক্ষয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
ধর্ম আর ধর্ম দর্শনে এই প্রতিক্রিয়া গভীরভাবে প্রোথিত হয়ে আছে।
ধর্মমত সমুহের মধ্যে মানুষের মুক্তির পথ নিয়ে মতপার্থক্য থাকলেও একটা বিষয় নিয়ে আছে অদ্ভুত মিল, সেটা হচ্ছে মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়ে। সব ধর্মই বিশ্বাস করে মানুষের ইতিহাসে ক্রমাবনতি হচ্ছে। সেমেটিক তিনটি ধর্মই বিশ্বাস করে, জে আদমের স্বর্গ থেকে নির্বাসন থেকে শুরু করে মানুষের ইতিহাসের ক্রমেই অবনতি ঘটছে। কখনো কখনো ইতিহাসে স্বর্ণ যুগ দেখা দিলেও তা হবে অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী।
অবক্ষয় ও অবনতির মধ্যে দিয়েই মানুষের ইতিহাস শেষ হয়ে হবে কেয়ামত। এবং কেয়ামতের আগে মানুষ তার অবক্ষয়ের শেষ সীমায় পৌঁছাবে। হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী, সকল মৃত্যুপ্রাপ্ত ব্যক্তি ৪টি সময়ের মধ্যে দিয়ে যায়। এই চক্র পুর্ণ হয় যখন এক কল্প শেষ হয়। এক কল্প ১০,০০০ ঐশ্বরিক বৎসর অথবা ১০,০০০,০০০ বছর।
এটাকে চার ভাগ করে তৈরি হয়েছে চারটি যুগ। এই চার যুগের নাম, সত্য যুগ, ত্রেতা যুগ, দ্বাপর যুগ এবং কলি যুগ। সত্য যুগ চলেছে ৪০০০ ঐশ্বরিক বছর ধরে। তারপরে ত্রেতা ৩০০০ ঐশ্বরিক বৎসর। দ্বাপর চলে ২০০০ ঐশ্বরিক বৎসর এবং কলি চলবে ১০০০ ঐশ্বরিক বৎসর ধরে।
প্রথম তিনটি চলে গিয়েছে। এই চার ভাগে দেখা গিয়েছে কিভাবে মানুষের পরিবর্তন হয়েছে। তাদের নিজেদেরকে ভুলে গিয়ে তারা পাপের দিকে ধাবিত হয়েছে। তারা বিশ্বাস করে সত্য যুগে পুর্ণ সত্য ছিলো। ত্রেতাতে ১/৪ হারিয়েছে।
তারপর দ্বাপরে ১/২ হারিয়েছে এবং কলিতে ১/৪ বাকি আছে। পাপ দিয়ে পুর্ণ করা হবে এই যুগে। হিন্দুদের মত গ্রীক দার্শনিক রাও বিশ্বাস করতেন যে মানুষের ইতিহাসের উন্নতি হচ্ছে না। বৌদ্ধ ধর্ম মতে জীবন দুঃখপূর্ণ। দুঃখের হাত থেকে কারও নিস্তার নেই।
জন্ম, জরা, রোগ, মৃত্যু সবই দুঃখজনক। মানুষের কামনা-বাসনা সবই দুঃখের মূল। মাঝে মাঝে যে সুখ আসে তাও দুঃখ মিশ্রিত এবং অস্থায়ী। অবিমিশ্র সুখ বলে কিছু নেই। নিবার্ণ লাভে এই দুঃখের অবসান ঘটে।
কামনা-বাসনার নিস্তারের মাঝে অজ্ঞানের অবসান ঘটে। এতেই পূর্ণ শান্তি অর্জিত হয়।
তাই ধর্ম মতে যে দিনটা অতিক্রান্ত হোল সেই দিনটি অনাগত দিনের চাইতে ভালো ছিল। “যায় দিন ভালো, আসে দিন খারাপ”। অথবা “আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম”।
পশ্চাতে যাওয়াটা একজন ধর্মপ্রাণ মানুষের জন্য আদর্শ, একান্ত কাম্য, কারণ পশ্চাতেই সে ফেলে এসেছে আলোকিত সময়, শুদ্ধ সময়, পবিত্র সময়। যত পিছনে তত আলোকিত সময়। ধর্ম সেকারণেই মানুষকে অতীত মুখিন করে আর প্রগতি আমাদের ভবিষ্যৎ মুখিন করে। ধর্মের মর্মার্থকে আত্তস্থ করলে প্রগতির পক্ষে থাকা অসম্ভব হয়ে ওঠে। এখানেই প্রগতির ধারণার সাথে ধর্মের বিরোধ উপস্থিত হয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।