:)
১৬ জুলাই পঞ্চগড় সীমান্তবর্তী ভারত থেকে মা রাফিয়া খাতুনকে এই চিঠি লিখেছিলেন ৬ নম্বর সেক্টরের সি কম্পানির আব্দুর রউফ ওরফে ববিন। মায়ের আঁচলঘেঁষা এই মানুষ্টির বাংকার জীবনের বর্ণনা পড়ার পর না-দেখা সেই মা ও তাঁর ছেলের জন্য মনটা কেমন হু হু করে উঠে।
১৬.৭.১৯৭১
মা,
মুক্তিসেনাদের ক্যাম্প থেকে লিখছি। এখন বাইরে বেশ বৃষ্টি হচ্ছে। তাঁবুর ফাঁক দিয়ে দেখতে পাচ্ছি সমস্ত দিগন্ত মেঘলা মেঘলা।
মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সকাল থেকে বৃষ্টি হচ্ছে কিনা, তাই মনটা ভাল না। আচ্ছা মা, সারা রাত এমনি চলার পর পূর্বয়াকাশে যে লাল সূর্য উঠে, তার কাঁচা আলো খুব উজ্জ্বল হয় তাই না? এই মুহূর্তে আমার ছোতবেলার কথা মনে পড়ছে। বর্ষা এলে তুমি বাইরে যেতে দিতে না, একদিন তোমার অজান্তে বাইরে আসতেই পিছলে পড়ে পায়ে চোট লাগে, তখন তুমি চিৎকার করে কেঁদে উঠেছিলে। ওষুধ দিয়ে ভর্তি হয়েছিল টেবিলটা, আমার বেশ মনে আছে।
তখন থেকে একা বাইরে যেতে সাহস পেতাম না। ভয় লাগত, বাইরে গেলেই পড়ে যাব। কিন্তু আজ! আজ আমার অনেক সাহস হয়েছে, রাইফেল ধরতে শিখেছি। বাংকারে রাতের পর রাত কাটাতে হচ্ছে, তবু ভয় পাই না। শত্রুর আক্রমণের মুখে দাঁড়িয়ে প্রচণ্ড পাল্টা আক্রমনে শিরায়-উপশিরায় রক্তের চাপ সৃষ্টি হচ্ছে।
মা, সত্যি তোমাকে বঝাতে পারবনা। ছোটবেলার কথা মনে পড়লে কেমন যেন লাগে। কিন্তু আমার একি আশ্চর্য পরিবর্তন, কারণ আমি আমার স্বদেশ, আমার বাংলাকে ভালবাসি। মা, কৈশরে একদিন আব্বা আমাকে সৈয়দপুরে নিয়ে গিয়েছিল, স্পেশাল ট্রেন দেখাতে। সেখান থেকে আমি হারিয়ে যাই।
তখন একলা একলা অনেক্ষন ঘুরেছিলাম। ধীরে ধীরে সন্ধ্যার ঘনঘটা নেমে এসেছিল, আমার কেমন যেন কান্না পাচ্ছিল। মনে হয়েছিল, আমি হারিয়ে গাছি। তখন মনে হয়েছিল, আর কনো দিনই হয়তো তোমার কাছে ফিরে যেতে পারবনা। তখন কাঁদতে কাদতে স্টেশনের দিকে আস্তে শুরু করেছিলাম।
রাস্তায় হাজারী বেলপুকুরের হাই-ই আমাকে নিয়ে গিয়েছিল। দেখি সেখানে কিছুক্ষন পর আব্বা গালেন। পরদিন এসে সমস্ত কথা শুনতে না শুনতে আমাকে বুকে জড়িয়ে তুমি কাঁদছিলে। অথচ সেদিন তুমি তো কাঁদলে না মা! আমি রণাঙ্গনে চলে এলাম। গুলি, শেল, মর্টার নিয়ে আমার জীবন।
ইয়াহিয়ার জঘন্যতম অত্যাচারের বিরুদ্ধে দাঁরাবার জন্য দুর্জয় শপথ নিলাম। এখন বাংকারে বাংকারে বিনিদ্র রজনী কাটাতে হয়। কখনো বা রাতের অন্ধকারে শত্রুর ঘাঁটির ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালাই। এ যুদ্ধু ন্যায়ের যুদ্ধ, মা, জয় আমাদের হবেই হবে।
মাগো, সেদিনের সন্ধ্যাটাকে আমার বেশ মনে পড়ছে।
আজকের মত মেঘলা মেঘলা আকাশ সেদিন ছিল না। সমস্ত আকাশটা তারায় ভর্তি ছিল। তুমি রান্না ঘরে বসে তরকারি কুটছিলে। আমি তোমাকে বললাম, 'মা,আমি চলে যাচ্ছি। ' তউমি মুখের দিকে তাকালে।
আমি বলেছিলাম, 'মা, আমি মুক্তি বাহিনীতে চলে যাচ্ছি। ' উনুনের আলোতে তোমার মুখটা স্পষ্ট দেখতে পেলাম। তোমার চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। তুমি দাঁরিয়ে আশীর্বাদের ভঙ্গিতে তাকালে। আমার ঘরের পেছনে বেলগাছটার কিছু পাতা বাতাসে দোল খেয়ে আবার স্থির হয়ে গেল।
মা, সেদিন সন্ধ্যাতেই তুমি আমাকে হাসিমুখে বিদায় দিয়েছিলে। মা, মনে হচ্ছে কত যুগ পাড়িয়ে গেছে, আর একটি দিন ইতিহাসের পাতার মত রয়ে গেছে। কত আশা, কত আকাঙ্খা অন্যায়ের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কিন্তু মা দিনান্তের ক্লান্তে নিত্যকার মতো সেই সন্ধ্যাটা আবার আসবে তো?
ইতি
তোমার স্নেহের
ববিন
একাত্তরের চিঠি সংকলনের টেক্স্ট কন্টেন্ট রিভার্সিং: একটি প্রকল্পের প্রস্তাবনা
৭১ এর চিঠি (চিঠি নং ২)
একাত্তরের চিঠি (চিঠি নং ৩)
১৯৭১ এর চিঠি (চিঠি নং ৬)
একাত্তরের চিঠি (পৃষ্টা নং ১৫)
একাত্তরের চিঠির ডিজিটাইজড্ কন্টেন্ট -১
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।