আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মহামতি ইবনে বতুতা এবং ভ্রমণ বিষয়ক ফাও প্যাঁচাল ...



একটা সময় আমার মাথায় প্রায়ই ইবনে বতুতা চেপে বসতেন এবং ভ্রমণ সংক্রান্ত নানারকম পরামর্শ দিতেন। বয়স্ক লোক কিছু বলাও যেতো না। সব কিছুতে হ্যা হ্যা করে যেতে হতো। তাই আমি তার তালে পড়ে নানা দর্শনীয় স্থানে যাবার বুদ্ধি আটতাম। কিন্তু নানা ধরনের সমস্যায় শেষ পর্যন্ত কিছুই হতনা।

আমি বাড়ির ছেলে বাড়ীতেই পড়ে থাকতাম। তবে মাঝে মাঝে কোথাও না কোথাও ঘুরে ইবনে বতুতা হবার চেষ্টা করতাম। তবে সেটা পর্যটক হিসেবে, ইবনে বতুতার সমপর্যায়ে না নিয়ে গেলেও, শেষ পর্যন্ত ইবনে মিজানের ( আমার এলাকার পরিচিত একজন ভ্রমনবীদ, যে আমার দেখা সেরা পর্যটকদের তালিকায় তেরো নম্বরে আছে) সমপর্যায় পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল। এতেই আমি খুশি হতাম। হয়তো খুশি হতেন ইবনে বতুতাও।

২. ইদানিং ইবনে বতুতার জায়গা দখল করে নিয়েছে 'টুরিজম' প্রতিষ্ঠানগুলো। নানা জায়গায় ঘুরতে যাবার প্রলোভন নিয়ে পত্রপত্রিকায় হাজির হয় আড়ম্বরের সহিত। তারা ইবনে বতুতার চেয়েও শক্তিশালী। তাদের পরামর্শ আরো সমৃদ্ধ। প্রায় অভিভাবক লেভেলের।

এই প্রতিষ্ঠানগুলো ছাড়া পত্রপত্রিকাগুলোও যেভাবে নানা ভ্রমনের হিসাব নিকাশ পাঠকের সামনে তুলে দেন মনে হয়, ঘুরতে না গেলে জীবন বৃথা। তো এমনিতেই 'ইবনে বতুতা মন', তার উপর এরকম খোঁজখবর...। তাই আমরাও, কি আছে জীবনে বলে, ভ্রমনে ঝাপিয়ে পড়ি। ৩. ভ্রমন বলতে আমরা সাধারনভাবে দুরের যাত্রাটাকেই বুঝি। আমিও এটাই বুঝতাম।

কিন্তু গত দুয়েক বছরে ঢাকার বিভিন্ন রুটে ' ... দয়া করে ভাড়ার অতিরিক্ত ভ্রমন করিবেন না ... ' জাতীয় নোটিশ দেখে মনের ভেতর ভ্রমনের সীমারেখা পাল্টালো। বুঝলাম, স্বল্প দুরত্বও ভ্রমনের আওতায় পড়ে। তারপর থেকে আমি প্রায় 'স্বল্প দুরুত্বের বতুতা' হয়ে উঠতে শুরু করলাম। তবে এই স্বল্প দুরত্বতে ভ্রমনের ফিলিংস জোটে না। কারন ঢাকায় আমার মতো স্বল্প দুরুত্বের প্রায় কোটিখানেক বতুতা আছেন।

যারা ভ্রমনের আনন্দ, আলোচনার মাধ্যমে নিয়ে অন্যের আনন্দের 'খবর' করে ছেড়ে দেন। যারা নানা চরিত্রের হয়ে থাকেন। এদের মধ্যে সবচেয়ে কমন স্বভাবের বতুতারা বেশ দেশ সচেতন। তারা বেশিরভাগ সময়ে হাতে পত্রিকা নিয়ে উঠেন এবং কোন প্রকার সুযোগ পেলেই আলোচনায় ঝাপিয়ে পড়েন। সেটা যেমন রাস্তায় জ্যাম দেখেও হয়, সেটা হয় ট্রাফিক পুলিশের আচরন দেখেও।

এমনকি ড্রাইভারের গাড়ী চালানো দেখেও সেই আলোচনার সৃষ্টি হয় ...। একটা কিছু হলেই হয়। শুরু হয়, ভাষন। সেটা প্রথমে দেশ দিয়ে শুরু হয়, শালার কি এক দেশে বাস করি...। ধীরে ধীরে যেটা নানা বিষয়ের উপর সিডর গতিতে প্রদনি করে শেষ পর্যন্ত নিজের উপরে এসে শেষ হয়, আসলে শালার আমরাই ভালোনা, আমরা যদি ঠিক থাকতাম ...।

এর ভেতরে হাসিনা, খালেদা, এরশাদ, তারেকসহ বহুজনের উপর দিয়ে এই ঝড়টা যায়। এ থেকে কখনো কখনো বারাক ওবামাও রেহাই পান না। আর টিকেট সার্ভিস বাস ছাড়া নরমাল অতি লোকাল বাসে তো আরেক ঝামেলা রয়েই যায়। ভাড়া নিয়ে সমস্যা। কিছু কিছু যাত্রী আছে যারা হয়তো ইচ্ছে করেই দুয়েক টাকা কম দিয়ে একটা ক্যাঁচাল বাধিয়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে দেন।

যতটুকু বুঝি, ভ্রমনের একটা প্রধান শর্ত হচ্ছে উত্তেজনা। কে জানে এটা স্বল্প দুরুত্বের যাত্রাকে উত্তেজনায় ভরিয়ে তোলার জন্য এই আয়োজন কিনা? কারন, তাদের পকেটে যে টাকা থাকেনা তা না, কিছূন হইচই এর পর অবশ্য টাকা দিয়েই ভালোভাবে নেমে যান। ৪. বড় দুরত্বটাকেই যেহেতু আমরা ভ্রমনের মূল ধরি, সেক্ষেত্রে ওখানেও বৈচিত্র কম পাওয়া যায়না। রাতের জার্নিতে তো পাবলিক ওঠে প্রথমে তা বাস বাস মনে করলেও কিছুন যাবার পর তার বসার সিটটাকে বাসার বিছানা মনে করে ঘুমানোর আয়োজন শুরু করেন। নিবিষ্ট মনের এই আয়োজন চীনের অলিম্পিক আয়োজনের চেয়ে কোন অংশে কম না।

তবে এখন মোবাইল এবং তার অফ পিক কালচারে এই ঘুমটা হারিয়ে যেতে বসেছে। বিভিন্ন সিটের চিপাচাপা থেকে নিরব গুঞ্জনে মুখর হয়ে ওঠে বাস, ... এই তুমি কি পরশু কলেজে আসবা?...এই তুমি কি গতকাল রাগ করেছিলে? ... আরো কত কি? এগুলোতে অনান্য যাত্রী সাধারনের সাময়িক ঘুমের অসুবিধা হলেও একটা বৃহত্তর কল্যান সাধিত হয়। তা হলো, ড্রাইভারের ভুলেও ঘুমানোর সুযোগ থাকে না। আর দিনের বেলা বড় জার্নির হিসাব আবার অন্যরকম হয়। যেহেতু এটা ভ্রমন, সেহেতু সকলে প্রায় গভীর মনযোগ এবং মুগ্ধতায় বাইরে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে দেখে যায়।

সেক্ষেত্রে তারা সবকিছুতেই কমবেশি মুগ্ধ হবার চেষ্টা করে। এমনকি পথের পাশে কাউকে দাঁড়িয়ে বা বসে 'ইয়ে' করতে দেখলেও তারা মুগ্ধ হবার চেষ্টা করে, ওমা কি সুন্দর দৃশ্য ...। ৫. ভ্রমন যেমন ভালো লাগে, তেমনি ভালো লাগে ভ্রমন কাহিনীও। তবে আমার পরিচিত এক বড় ভাইয়ের বিষয়টা ছাড়া। তার কোথাও ভ্রমন যাত্রা মানে আমাদের জন্য শোকবার্তা।

তিনি কোথাও গেলে আমরা আতঙ্কে থাকি এই বুঝি তিনি এসে পড়লেন। কারন তিনি আসার পর প্রায় জোড় করেই তার ভ্রমন কাহিনী শোনান। বলা যায় বাধ্য করেন। আমরা নিশ্চিত তিনি যদি সন্ত্রাসী হতেন তবে হয়তো অস্ত্র ঠেকিয়ে হলেও ভ্রমন কাহিনী শোনাতেন। শেষবার তিনি ইন্ডিয়া থেকে আসার পর আমরা প্রায় দু তিন দিন গা ঢাকা দিয়ে ছিলাম।

যার ফলশুতিতে তার ইন্ডিয়া ঘুরে আসার এক বছর পরও আমাদের শুনতে হচ্ছে সেই ভ্রমন কাহিনী, আরে ব্যাটা শোন না ... আমি যখন ট্রেন থেকে নামলাম...। আর এমনিতে তো আছেই। যে কোন প্রসঙ্গ, তা যেখান থেকেই শুরু হোকনা কেন, তা অবশ্যই ইন্ডিয়ায় গিয়ে থামবে, বঙ্গবাজারের এই জিনিসটা ইন্ডিয়ায় তো খুবই সস্তা ...। ৬. ভ্রমন বিষয়টায় যদিও কান্তি থাকে তবে সেটা আনন্দের চেয়ে বেশি না। কদিন পরই তিনদিন ছুটি।

এই ছুটিতে অলরেডি অনেকের ভ্রমণ শিডিউলও হয়তো করা হয়ে গেছে। তাই ভ্রমণ নিয়ে পরামর্শ দেয়ার কিছূই নেই। নেই আর কিছু বলারও। একটা ভ্রমণ বিষয়ক গল্প বলে লেখাটা শেষ করি, পথে যেতে যেতে বাস খারাপ হয়ে গেল। সুপারভাইজার এসে হাসি মুখে বলল, প্রিয় যাত্রী সকল ভাইবোনেরা আপনাদের সাময়ীক অসুবিধার জন্য আমরা দুঃখিত।

আমাদের গাড়ী হঠাৎ করে খারাপ হয়ে গেছে। কিন্তু চিন্তার কোন কারন নেই। একটু কষ্ট করতে হবে। ফাষ্ট কাসের যাত্রীরা যেমন আছেন বসে থাকেন। সেকেন্ড কাসের যাত্রীরা নিচে নেমে এসে দাড়াঁন।

আর থার্ড কাসের যাত্রীরা আমার সঙ্গে এসে ঠেলুন।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.