আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভাষা সৈনিক মমতাজ বেগম

জীবন বুনে স্বপ্ন বানাই মানবজমিনে অনেক চাষ চাই

ভাষা সৈনিক মমতাজ বেগম : আমরা যাঁর গর্বিত উত্তরাধিকার রফিউর রাব্বি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে নারায়ণগঞ্জের ভূমিকা সর্বজন বিদিত। ’৪৮ সাল থেকেই এ নারায়ণগঞ্জে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীটি জোরালো হচ্ছিল। ঢাকার নিকটবর্তী হওয়ায় সেই সময়ের দিনগুলো ছিল আন্দোলনে উত্তাল। ভাষা আন্দোলনে সে সময় যাঁরা যুক্ত ছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন নারীর ভূমিকা গোটা দেশকে তখন আলোড়িত করেছিল। তিনি মমতাজ বেগম।

তিনি তখন মর্গ্যান গার্লস হাই স্কুলের প্রধান শিকিক্ষা। ’৫২র একুশে ফেব্রুয়ারিতে রহমতউল্লাহ মুসলিম ইনিস্টিটিউটের সামনে এক প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। মুসলিম লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিম ছিলেন ঐ সমাবেশের প্রধান অতিথি। সভা চলাকালীন সময়েই নারায়ণগঞ্জবাসী জানতে পারে ঢাকার ছাত্র মিছিলে গুলি হয়েছে এবং ছাত্র মারা গেছে। মুহূর্তেই জনতা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।

চারদিকে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। সেখান থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। মর্গ্যান স্কুলের ছাত্রীদের বিশাল মিছিল নিয়ে মমতাজ বেগম যোগ দেন সে মিছিলে। শহর উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। তৎকালীন মাহকুমা প্রশাসকের নির্দেশে মমতাজ বেগমকে গ্রেফতার করা হয়।

২৯ ফেব্রুয়ারি তাঁকে আদালতে হাজির করা হলে সরকারের নির্দেশে মমতাজ বেগমের জামিনের আবেদন বিচারক না- মঞ্জুর করেন। আদালতের রায় শোনার সাথে সাথে নারায়ণগঞ্জবাসী উত্তেজনায় ফেটে পড়ে। মমতাজ বেগমকে বহনকারী ঢাকাগামী পুলিশের গাড়িটি চাষাড়া মোড়ে এলে হাজার হাজার জনতা গাড়িটি আটকে দেয়। শত শত গাছ কেটে রাস্তায় ব্যারিকেড সৃষ্টি করে। পুলিশ-জনতার ব্যাপক সংঘর্ষ শুরু হয়।

চাষাড়া বাইতুল আমানে সভা বসে। পুলিশ সে সভাতেও আক্রমণ করে। শত শত লোক আহত হয়। বহু লোককে গ্রেফতার করা হয়। সন্ধ্যার পর মমতাজ বেগমকে নিয়ে পুলিশ ভ্যানটি ঢাকায় রওনা হয়।

পরে সরকার মমতাজ বেগমকে মুচলেকার মাধ্যমে মুক্তির প্রস্তাব দেয়। মমতাজ বেগম তা প্রত্যাখান করেন। তাঁর স্বামী ঢাকার খাদ্য পরিদর্শক আব্দুল মান্নাফ তাঁকে মুচলেকা দিয়ে বেরিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানালে তিনি তাতেও অস্বীকৃতি জানান। এ ঘটনায় আব্দুল মান্নাফ মমতাজ বেগমকে ডিভোর্স দেন। ১৯৫৩ সালের শেষদিকে দেড় বছর কারাভোগের পর মুক্ত হন মমতাজ বেগম।

মমতাজ বেগম-এর প্রকৃত নাম কল্যাণী রায় চৌধুরী। তিনি বাংলা সাহিত্যে অন্যতম পথিকৃৎ প্রমথনাথ বিশীর বোনের মেয়ে। ১৯২৩ সালে কলকাতায় এক প্রগতিশীল পরিবারে তাঁর জন্ম। কল্যাণী রায় চৌধুরী রণশীলতার শিকল ভেঙে ভালোবেসে বিয়ে করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র গোপালগঞ্জের আব্দুল মান্নাফকে। কল্যাণী রায় চৌধুরী হয়ে ওঠেন মমতাজ বেগম।

মমতাজ বেগম এম. এ. এম. এড. পাশ করে নারায়ণগঞ্জ মর্গ্যান গার্লস হাই স্কুলে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৫৩ সালে জেল থেকে বেরিয়ে তিনি আনন্দময়ী গার্লস স্কুল ও আহমেদ বাওয়ানী একাডেমিতে আবার শিক্ষকতা শুরু করেন। নারী ও শিক্ষকদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে আমৃত্যু যুক্ত ছিলেন এ মহিয়সী নারী। ১৯৬৭ সালের ৩০ মার্চ তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ভাষা আন্দোলনে যেসকল নারীদের নাম আমরা জানি তাঁদের মধ্যে নিঃসন্দেহে মমতাজ বেগম একটি অনন্য নাম।

ভাষার জন্য, দেশের জন্য যিনি তাঁর পরিবারকে, সংসারকে বিসর্জন দিয়েছেন। যে ভালোবাসার জন্য তিনি সমাজকে, পরিবারকে বিসর্জন দিয়েছিলেন তিনি সে ভালোবাসাকেও বিসর্জন দিলেন। অথচ এ ভাষা সৈনিকের প্রতি আমাদের কী নিদারুণ অবহেলা। কোথাও তাঁর স্বীকৃতি নেই, নামটিও নেই। একুশের এত পদক দেয়া হচ্ছে, এত সংবর্ধনা অনুষ্ঠান হচ্ছে - কোথাও তাঁর নাম উল্লেখ নেই।

আজকের এ প্রজন্ম যে জানবে মমতাজ বেগম নামে একজন ছিলেন - যিনি আমাদের শিখিয়েছেন দেশের জন্য, মানুষের জন্য কিভাবে সবকিছু ত্যাগ করতে হয়- তারও অবকাশ নেই। এ লজ্জা আজ আমাদের- গোটা জাতির। অথচ আমরাই তাঁর গর্বিত উত্তরাধিকার। বিশেষ দ্রষ্টব্য : এই লেখাটি আমার নয়। লিখেছেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বি।

আপনারদের সাথে শেয়ার করার লোভ সামলাতে পারলাম না।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.