.... তবুও আমি স্বপ্ন দেখি ... (স্বপ্ন, বাস্তব এবং ব্লগের সর্বস্বত্ব ব্লগার কতৃক সংরক্ষিত)
লন্ডনের সবচেয়ে বড় এবং জনপ্রিয় শপিং এলাকা হিসেবে অক্সফোর্ড স্ট্রিট সমাদৃত। সম্ভবত যারাই এ শহরে আসে, তারা অন্তত একবার চেষ্টা করে এখানে কেনাকাটা করে যেতে। অক্সফোর্ড স্ট্রিটে পরপর সাজানো রয়েছে পৃথিবীর খুব নাম করা ব্র্যান্ডের দোকানগুলো। আকাশ ছোঁয়া দাম আর জৌলুসের সাথে ঐতিহ্যের মিশ্রনে অক্সফোর্ড স্ট্রিট যেন স্বমহিমায় উজ্জ্বল। মানুষের উপচে পড়া ভিড় তাই এখানে এক চিরচেনা দৃশ্য।
গতকাল সকাল থেকে পরিকল্পনা করছিলাম কিছু কেনাকাটা করতে যাবার। বিশেষত আমার খালাতো ভাই, পাভেল ভাইয়ার জন্য কিছু গিফ্ট কেনার। কিন্তু সমস্যা হলো, অচেনা শহরে একা গিয়ে দোকান খুঁজে পাওয়াটা যন্ত্রনার বিষয় হয়ে দাড়াতে পারে। তাই ঠিক করলাম ভাইয়ার বন্ধু মনির ভাইয়াকে সাথে নিয়ে যাবো। কথাটা মনির ভাইয়াকে বলতেই স্বানন্দে রাজী হলেন।
ফলে বিকেল বেলা ম্যাকডোনাল্ডস-এ ছোটখাটো একটা পার্টি করেই আমি আর মনির ভাইয়া বের হয়ে পড়লাম কেনাকাটার জন্য।
যাবার পথে মনির ভাইয়া ঠিক করলেন আমরা ১৫ রুটের বাস ধরে যাবো। লন্ডনে এসেই আমি আনলিমিটেড বাস টিকেট করে নিয়েছিলাম। ফলে বাসে করে যে কোন স্থানে যেতে আমার রয়েছে পূর্ন স্বাধীনতা। পনেরো পাউন্ড দিয়ে সারা সপ্তাহে যত খুশি ঘোরো।
অনেকটা যেন পয়সা উসুল করার জন্য ইচ্ছে করে বেশি ঘোরার চেষ্টা করছিলাম গত কিছুদিন। যাইহোক, আমরা খানিকটা হেটে একটা স্টপেজে এসে দাড়ালাম। প্রতিক্ষনে আশা করছি এখনই বাস আসবে। কিন্তু বৃথা আশা। বাসের আর দেখা মেলে না।
প্রায় পনের মিনিট অপেক্ষা করার পর মনির ভাইয়া বললেন খাটিকটা হেটে সামনে থেকে ২৫ রুটের বাস ধরার কথা। যেমন কথা তেমন কাজ! আমরা আবার হাটা দিলাম। হাটছিতো হাটছি, কিন্তু কোথাও বাস স্টপেজ চোখে পড়েনা। হঠাৎ মনির ভাইয়া বললেন দৌড় দিতে। তাকিয়ে দেখি আমরা যে ১৫ নাম্বার বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলাম, সেটা আসছে।
দৌড় দিয়ে রাস্তা পার হবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু অর্ধেক গিয়েই থেমে যেতে হলো। লাল সিগনাল। এদিকে বাস চলে এসেছে। এটা মিস করলে আবার কখন আসে কে জানে। তাই দুজন হঠাৎ লাল সিগনালের মধ্যেই দিলাম দৌড়!
অল্পের জন্য বাসটা ধরে উঠে বসে তখন হাপাচ্ছি আর মনেমনে ভাবছি এবার শান্তিমত গিয়ে পৌছাতে পারলেই হলো।
কিন্তু বিধিবাম। রাস্তায় এত জ্যাম যে বাস আর চলছেই না। বাংলাদেশের জ্যামকে হার মানায় লন্ডনের জ্যাম। মনে হচ্ছিল কচ্ছপের পিঠে চড়ে গেলেও হয়তো আরো আগে পৌছানে যাবে। সামনে ট্রাফেলগার স্কয়ার।
বলা যেতে পারে লন্ডনের জিরো পয়েন্ট। সবচেয়ে ব্যাস্ততম রাস্তা। মনির ভাইয়া বললেন নেমে ট্রাফেলগার স্কয়ার হেটে পার হতে। অন্য দিক থেকে আমরা অনেক বাস পাবো। পরিকল্পনা মত বাস থেকে নেমে রাস্তা পার হবার সময় দেখি ১৫ রুটের আরা তিনটা বাস আমাদেরটার পেছনে।
এত জ্যাম যে ৮ মিনিট পর পর ছাড়া চারটা বাস এক হয়ে গিয়েছে!
আমরা রাস্তাটা পার হয়ে ট্রাফালগার স্কয়ারের মধ্য দিয়ে হেটে দ্রুত ব্যাস্ত এলাকাটা ছেড়ে চলে এলাম। ভাবছি এবার আর একটা রাস্তা পার হলেই অনেক বাসের অপশন থাকবে আমাদের হাতে। সিগনালে দাড়ানো। হঠাৎ দেখি যেন মিছিল করে ১৫ রুটরে চারটা বাস আমাদের দিকে আসছে। অবস্থা দেখে আমরা হায় হায় শুরু করলাম।
কি দরকার ছিল নামার! বাসগুলো আমাদের চোখের সামনে দিয়ে শো শো করে চলে গেলো আর আমরা "অতি চালাকের গলায় দড়ি"র মত তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম।
আরো খানিকক্ষন স্টপেজে অপেক্ষা করে, অন্য একটা বাস নিয়ে আমরা যখন কাঙ্খিত গন্তব্যে এসে পৌছালাম, তখন ঘড়িতে বাজে সোয়া আটটার বেশি। নয়টায় দোকান বন্ধ হয়ে যাবে, হতে সময়ও খুব একটা নেই। আগেই পরিকল্পনা করে রেখেছিলাম প্রাইমার্ক-এ যাবো। এটা একটা আইরিশ ব্র্যান্ড।
ডাবলিনে ওদের প্রধান ব্রাঞ্চে আমি প্রায় প্রতি সপ্তাহেই কিছু না কিছু কিনতে যাই। অবিশ্বাস্য কম দামে অসাধারন পন্য বিক্রি করে এরা। দেড় বছর আগে অক্সফোর্ড স্ট্রিটে তাদের শোরুম খোলার পর থেকে বাঘা বাঘা ব্র্যান্ডের বিক্রী কমে গিয়েছে। শ্যাল্ফরিজ, জন লুইস, মর্কস এন্ড স্প্যানসর, গ্যাপ, fcuk (frence connection uk), নেক্সট, টপ-শপ, জারা, bhs (ব্রিটিশ হোম স্টোর), ডেভেনহ্যাম, নাইকি, এডিডাস ইত্যাদি স্বনামধন্য ব্র্যান্ডের পাশে আয়ারল্যান্ডের এই নগন্য ব্র্যান্ডটা এখন লন্ডনের সেরা আকর্ষন। অন্য স্টোরগুলোর জনমানব শূন্যতা আর প্রাইমার্কের "তিল ঠাই আর নাহি রে" দৃশ্য মনে করিয়ে দিচ্ছিল বার্নার্ড শ-এর একটা উক্তি - "England had conquered Ireland, so there was nothing for it but to come over and conquer England."।
আয়ারল্যান্ড যেন সত্যিই পোশাকের বাজারে ইংল্যান্ড দখল করে রেখেছে। খোদ লন্ডনের মূল বিপনিকেন্দ্রে মধ্যবিত্তের প্রধান আকর্ষন আজ প্রাইমার্ক।
পরবর্তি বেশ কিছু সময় ধরে চললো আমাদের কেনাকাটা। পাভেল ভাইয়ার জন্য জ্যাকেট কিনলাম। মনির ভাইয়াও একটা ওভারকোট কিনলেন।
প্রাইমার্কের চেনা পরিবেশে হাটছিলাম আর শপিং করছিলাম। হাটতে হাটতে আমার থেকে থেকেই মনে হচ্ছিল আমি যেন ডাবলিনেই বসে আছি। বুঝতে পারছিলাম ডাবলিন শহরটা আমার হৃদয়ে অন্যরকম একটা জায়গা করে নিয়েছে। লন্ডন এসেও আমি তাই ডাবলিনকে মিস করছি ভিষন ভাবে।
কেনাকাটার পর ফেরার পালা।
রাস্তা তখন বেশ ফাকা। প্রাইমার্কের কাছেই একটা বাস স্টপেজ থেকে আবার ১৫ রুটের বাস ধরে চলতে শুরু করলাম। ডাবল ডেকারের আপার সেলুন প্রায় ফাকা। মনির ভাইয়ার সাথে বেশ খোশ মেজাজে গল্প করছি তখন। হঠাৎ একটা মেয়ে আপেলে কামড় দিতে দিতে এসে আমাদের দুই সিট সামনে বসলো।
কয়েকটা স্টপ পরে আরেকটা এশিয়ান ছেলে এসে উঠলো। অনুমান করতে পারছিলাম ছেলেটা সম্ভবত বাংলাদেশী অথবা ভারতীয়। আঁড় চোখে আমি তাদের লক্ষ্য করছিলাম। ছেলেটা খানিকক্ষন বাসের মধ্যে এলোমেলো হাটলো। তারপর মেয়েটার উল্টাদিকের সারিতে বসলো।
আমি মাত্র চোখ সরিয়ে মনির ভাইয়ের সাথে কথা বলতে যাচ্ছি, হঠাৎ শুনি মেয়েটা পরিচয় দিচ্ছে - "আই এ্যাম রাশিয়ান"! ছেলেটা ততক্ষনে মেয়েটার সাথে কথা বলা শুরু করে দিয়েছে। দুই মিনিটের মধ্যে মেয়েটা হাসতে শুরু করলো। বাঁকা ভাবে সিটে বসে আপেলে কামড় দিতে দিতে গল্প করে চলেছে ছেলেটার সাথে। আমরা পেছন থেকে রীতিমত স্ববিস্ময়ে তাকিয়ে আছি। মেয়ে পটানোর অসাধারন কায়দায় ছেলেটা কথা বলে যাচ্ছিল ক্রমাগত।
হঠাৎ বলল, "ক্যান আই সিট বিসাইড ইউ?" মেয়েটা হেসে সিওর বলে পাশে বসতে বললো। দুই মিনিট পর মোবাইল ফোন নাম্বারও এক্সচেঞ্জ হয়ে গেলো। মাত্র পনেরো মিনিটের মধ্যে একটা ইউরোপিয়ান মেয়েকে একটা বঙ্গদেশীয়/ভারতীয় ছেলে পটিয়ে ফেললো। আমরা পেছন থেকে তখন রীতিমত বাংলায় চিৎকার করছি - "মামা, এটা কি খেলা দেখাও?"
মনির ভাইয়া একসময় বললেন ছেলেটা হয়তো এখন উঠবে। আমি সাথে সাথে টিজ করে বলি, এই বেলায় পৃথিবী উল্টে গেলেও মামা উঠবে না! একসাথে দুজন হেসে উঠি আর পেছন থেকে বলতে থাকি, "আপামনি, বুঝে শুনে প্রসিড করেন", সাথে চলছিল মামার প্রতি বাঁকা খোঁচা।
যাইহোক, আরো কিছু সময় পর মামা উঠে নামার জন্য বেল বাজালো। আমরা দুইজন আরেক দফা টিজ করতে শুরু করলাম - "মামা, মাঠ এখন আমাদের"। কিন্তু তখনও বুঝিনি আমাদের 'মামা' আসলে আমাদের সব কথাই বুঝতে পারছিল। নামার সময় আমাদের দিকে যে লুকটা দিল তাতে বুঝতে পারলাম আসলে মাহাশয় বঙ্গদেশীয়! তবে যে খেলা তিনি দেখিয়ে গেলেন, তা অতুলনীয়।
এভাবেই সারা সন্ধ্যা কেনাকাটা আর মজা করে আমরা যখন বাসার কাছে এসে বাস থেকে নামলাম, রাত তখন অনেক।
লন্ডন শহর নির্জন হয়ে এসেছে। প্রাইমার্কের বড় বড় কাগজের প্যাকেট হাতে আমরা দুজন হেটে চলছিলাম একাকী রাস্তা দিয়ে। ভাবুক মন আবিষ্কার করে নেয় আজ ১৬ই ডিসেম্বর। নিজেদের অজান্তেই ঠোটে চলে আসে গান। সেদিন দেশ থেকে হাজার মাইল দূরে ইংল্যান্ডের রাজধানী লন্ডনের ফাকা রাস্তায় দুটো ছেলে হাটছিল আর গাইছিল - "প্রতিদিন তোমায় দেখি সূর্য রাগে, প্রতিদিন তোমার কথা হৃদয়ে জাগে, ও আমার দেশ, ও আমার বাংলাদেশ।
"
১৭ ডিসেম্বর ২০০৮
লন্ডন, ইংল্যান্ড।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।