সঙ্গে সাহিত্যের সুবাস ...
পর্ব ২: Click This Link
ইংল্যান্ড: ফ্যানি হিল ও ভিক্টোরীয় যুগের পর্নোসাহিত্য
ইংরেজরা ফরাসিদের বৈপ্লবিক রাজনীতি ও পর্নোসাহিত্যকে ভয় পেত। তবে ১৭৪৮ সালেই তারা তাদের প্রথম উল্লেখযোগ্য পর্নোসাহিত্য পেয়ে যায়। জন ক্লেল্যান্ডের মেমোয়ার্স অব এ ওম্যান অব প্লেজার, পরে ফ্যানি হিল নামে পরিচিত এ-হলো হলো সেই উপন্যাস যা ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশিবার পুনঃমুদ্রিত ও অনূদিত হয়। তবে দুই শতক ধরে এটার প্রকাশনা বেআইনী ছিল, ইংল্যান্ডে কেবল ১৯৭০ সালে প্রথম উপন্যাসটি আইনী আওতায় প্রকাশিত হয়। ১৭৪৮ সালে এটা প্রকাশিত হবার পর তার প্রতিক্রিয়া এতই ব্যাপক হয় যে তার নমুনা হিসেবে বলা যায়, লন্ডনের বিশপ ইংল্যান্ডে দু'-দু'বার ভূমিকম্পের জন্য এই বইটিকেই দায়ী করেন।
বইটি প্রকাশের কয়েক মাসের মধ্যেই ক্লেল্যান্ড ও তার প্রকাশক গ্রেফতার হন। কারামুক্তির পর ক্লেল্যান্ড বইটির এক-তৃতীয়াংশ ছেঁটে ফেলেন -- যার মধ্যে যৌনসংক্রান্ত আপত্তিকর বিষয়ই বেশি ছিল -- পুনর্লিখিত বইটির নাম দেয়া হয় ফ্যানি হিল। এটি প্রকাশের পর ক্লেল্যান্ড আবার গ্রেফতার হন, তবে এবার কোনো সাজা হয়নি।
প্রকাশক ফ্যানি হিল-এর প্রকাশনা চালিয়ে যান কিন্তু অকর্তিত মেমোয়ার্স-এর পাইরেটেড সংস্করণের চাহিদাই ইউরোপজুড়ে বেশি ছিল। যুগ যুগ ধরে, এমনকি দুই শতক জুড়ে এই সংস্করণটি আন্ডারগ্রাউন্ড-সংস্করণ হিসেবে গোপনে প্রকাশিত হয়েছে।
উপন্যাটি যৌনতার জয়গান করে আর সমাজ ও ধর্মের চাপিয়ে দেয়া নৈতিকতার পাহাড়কে আঘাত করে। উপন্যাসটি মূলত জনৈক 'ম্যাডাম'-এর কাছে উত্তম পুরুষে লেখা ফ্যানির পত্রাবলি, যাতে ফ্যানির নানা যৌনকেলেঙ্কারির স্বীকারোক্তি বিধৃত রয়েছে। কিন্তু তার এই দুঃসাহসিক দুষ্কর্মের স্বীকারোক্তিতে ফ্যানির কোনো অনুশোচনা নেই, বরং পাঠককে যৌনপুলক দেবার মাধ্যমে সেসবের জয়গান গাওয়া হয়েছে। ক্লেল্যান্ড অবশ্য তার উপন্যাসে যৌনাত্মক পরিভাষা নির্মাণের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক বা পথের-মুখের ভাষা ব্যবহার না করে রুচিবান ও সৃষ্টিশীল শব্দাবলি ব্যবহার করার চেষ্টা করেছেন। এক পুংদণ্ডেরই তিনি ৫০টি পরিভাষা ব্যবহার করেন।
যেমন, তুষ্টির যন্ত্র (ইন্সট্রুমেন্ট অব প্লেজার)। আর স্ত্রীলিঙ্গের পরিভাষা হিসেবে তিনি ব্যবহার করেছেন 'প্রেমের নরম পরীক্ষাগার'-এর (সফট ল্যাবরেটরি অব লাভ) মতো পরিভাষা।
ঊনবিংশ শতাব্দিতে পর্নোসাহিত্যের কেন্দ্র ফ্রান্স থেকে ইংল্যান্ডে স্থানান্তরিত হয় এবং একটি বাণিজ্যিক চেহারা পায়। তবে সাদপ্রদর্শিত পথেই ইংরেজি পর্নোসাহিত্য বিকশিত হতে থাকে। ঊনবিংশ শতাব্দি হলো ভিক্টোরীয় নৈতিকতার শতক, অথচ এই শতকেই সবচেয়ে বেশি পর্নোসাহিত্য বিকাশ লাভ করে।
এই শতকে সামাজিক-সংস্কৃতিক নৈতিকতার একটি মানদণ্ড ঠিক করে দেয়া হয়, যে-নৈতিকতা ছিল রক্ষণশীল ও নিরাপদ। নারী ও কমবয়েসীদের সমস্ত কলুষতা থেকে রক্ষা করার জন্য সাহিত্যকে সকল ধরনের 'অনিরাপদ' উপাদান থেকে মুক্ত করার প্রচেষ্টা চালানো হয়। এমনকি ১৮১৮ সালে থমাস বোডলার নামের এক ডাক্তার শেক্সপিয়রের পারিবারিক সংস্করণ প্রকাশ করেন যা দি ফ্যামিলি শেক্সপিয়র নামে পরিচিত ছিল। আপত্তিকর অংশগুলো বাদ দিয়ে একটি 'পরিশুদ্ধ' শেক্সপিয়র প্রকাশ করা হয়, এবং মনে করা হয় এ হলো এমন এক শেক্সপিয়র, যা একজন বাবা তার মেয়েকে নিয়ে উচ্চস্বরে আস্থার সঙ্গে পড়তে পারবেন। বোডলারের এই সংস্করণ খুব জনপ্রিয় হয় এবং পাশাপাশি 'বোডলারীকরণ'ও জনপ্রিয় হয়।
নিরাপদ সাহিত্য দিয়ে কতটুকু নারী ও কমবয়েসীদের নিরাপদ রাখা গিয়েছিল তা প্রশ্নসাপেক্ষ, তবে পুরুষদের জন্য এই যুগেই ব্যাপকমাত্রায় পর্নোসাহিত্য রচিত হতে থাকে। তাই এটা একটা পরিহাস যে, নিরাপদ সাহিত্য সৃষ্টির সচেতন প্রচেষ্টার বিপরীতে এই সময়েই সবচেয়ে বেশি অনিরাপদ সাহিত্য রচিত হতে থাকে। ১৮৩৪ সালের একটি পরিংখ্যান বলে যে, লন্ডনের কেবল একটি রাস্তাতেই ৫৭টি পর্নোবিক্রয়কেন্দ্রের অস্তিত্ব ছিল।
এই সময়ের একটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হলো দি লাস্টফুল টার্ক এবং এর লেখক ছিলেন মহাজনপ্রিয় জনৈক (এনোনিমাস)। সাদবাদ প্রভাবিত এই উপন্যাসে দেখা যায় এক কুমারি ধর্ষিত হবার পরে ব্যাপকভাবে যৌনক্ষুধায় তাড়িত হয়ে পড়ে থাকে।
কুমারিদের এরকম কামক্ষুধায় তাড়িত হয়ে পড়া এই শতাব্দির পর্নোসাহিত্যের একটি সাধারণ থিমে পরিণত হয়। এরকম আরও কয়েকটি উপন্যাস হলো এ সিক্রেট লাইফ, দি রোমান্স অব লাস্ট, দি অ্যামাটরি এক্সপেরিয়েন্সেস অব এ সার্জন, দি অটোবায়োগ্রাফি অব ফ্লিয়া ইত্যাদি।
ঊনবিংশ শতকের পর্নোসাহিত্য আর রাজনৈতিক ও সামাজিক ধারণাগুলোকে আঘাত করে না, কিন্তু যৌনতা সম্পর্কিত ধারণায় প্রবলভাবেই আঘাত করে। ভিক্টোরীয় যুগের সামাজিক সংস্কার বিষমকামকেই একমাত্র যৌনতা-রীতি বলে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে। বিশেষত সমকামিতাকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন করা হয়না।
কিন্তু সাদ-প্রভাবিত পর্নোসাহিত্যে যৌনতার সম্ভাব্য সকল ধরনের দেখা মেলে। আর এই সময়ের পর্নোসাহিত্যেও নারীচরিত্রগুলোকে খুব যৌনতা বিষয়ে আগ্রাসী ও প্রবলভাবে কামতাড়িত দেখা যায়।
বিংশ শতাব্দির পশ্চিমা পর্নোসাহিত্য
বিংশ শতাব্দিতে ভিক্টোরীয় নৈতিকতার মতো কোনো আরোপিত বিধিনিষেধ পশ্চিমে ছিলনা। তবুও অশ্লীলতার দায়ে ডি এইচ লরেন্স, হেনরি মিলার, নরমান মেইলার, ভ্লাদিমির নবোকভ, জেমস জয়েস, র্যাডক্লিফ হলের মতো অনেক লেখককেই আইন-আদালতে বিচারাধীন থাকতে হয়েছে। 'অশ্লীল' সাহিত্যের এই ধারায় ডি এইচ লরেন্সের লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার (১৯২৮) কিংবা ভ্লাদিমির নবোকভের লোলিতা সবচাইতে আলোচিত।
জেমস জয়েসের মাস্টারিপস ইউলিসিসও (১৯২২) অশ্লীলতার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছে। নবোকভের লোলিতা (১৯৫৫) হলিউডে দুইবার চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে, একবার স্ট্যানলি কুব্রিক (১৯৬২) এবং আরেকবার এড্রিয়ান লিন (১৯৯৭) ছিলেন এর পরিচালক। এবং দ্বিতীয়বার মুক্তি পাবার সময়ও ছবিটি উপন্যাসের মতোই অভিযুক্ত হয়েছে। লেডি চ্যাটার্লিজ লাভারও দুবার ইংরেজি ভাষায় ও একবার ফরাসি ভাষায় চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে।
বিংশ শতাব্দিতে পর্নোসাহিত্য বিষয়ে প্রতিষ্ঠান ও পাঠকের সহনশীলতা অনেক বেড়েছে, কিন্তু অশ্লীলতার অভিযোগ সবসময়ই উঠেছে, কখনো কখনো আইনী লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে হয়েছে লেখক-প্রকাশককে।
সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দির মতো এই শতকে পর্নোসাহিত্যের রাজনৈতিক ভূমিকা নেই, নারী-পুরুষের যথেচ্ছ যৌনজীবনকেই অবলম্বন করা হয়েছে। তবে এই শতাব্দিরে শেষের দিকে পর্নোসাহিত্যের নতুন কিছু ধারার সৃষ্টি হয়। যেমন সমকামী সাহিত্য ইউরোপ আমেরিকা জুড়ে বিকশিত হয়। গে ও লেসবিয়ানদের পৃথক সাহিত্য ও পৃথক বুকস্টোরের জন্ম নিয়েছে বিংশ শতাব্দিতে। এসব সাহিত্যের সিংহভাগজুড়ে যৌনতা বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে।
আর অশ্লীলতা সম্পর্কিত ধারণা এই শতকের মধ্যেই বেশ খানিকটা পরিবর্তিত হয়েছে। এক প্রজন্মে যা নোংরা (ডার্ট) সাহিত্য বলে নিন্দিত হয়েছে, আরেক প্রজন্মে তা নান্দনিক (আর্ট) সাহিত্য বলে নন্দিত হয়েছে। লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার কিংবা লোলিতা নিয়ে পাঠকের আর সেই অভিযোগ নেই।
পর্নোসাহিত্য নিয়ে বিংশ শতাব্দিতে পাঠকের মনোভাব পরিবর্তিত হবার একটি কারণ বোধহয় নতুন মাধ্যম চলচ্চিত্রে পর্নোগ্রাফির ব্যাপক উপস্থিতি। সাহিত্যে পর্নোগ্রাফি হলো ফিকশন, কিন্তু চলচ্চিত্রে পর্নোগ্রাফি যেন প্রায়-বাস্তব।
দৃশ্য-শ্রাব্য মাধ্যম হবার কারণে পর্নোগ্রাফি আর পর্নো চলচ্চিত্র প্রায় সমার্থক হয়ে ওঠে। পর্নোসাহিত্যে সাহিত্যের মাত্রা বেড়ে গিয়ে প্রায় মূলধারার সাহিত্য হয়ে ওঠে, আর পর্নো চলচ্চিত্র কেবলই সব ধরনের সঙ্গমদৃশ্য ক্যামেরায় ধারণ করতে থাকে।
পশ্চিমা পর্নোসাহিত্যে নারীর অবস্থান কোথায়?
পর্নো চলচ্চিত্রে নারীর অবস্থান একতরফাভাবে অবমাননামূলক হলেও, পর্নোসাহিত্যে নারীর অবমূল্যায়নই কেবল একমাত্র বিবেচ্য বিষয় নয়। বিশেষত সপ্তদশ কিংবা অষ্টাদশ শতাব্দিতে পর্নোগ্রাফির লক্ষ্য ছিল চার্চ ও রাজতন্ত্রকে আক্রমণ করা। তবে এজন্য লেখকেরা নারীর শরীরকে ব্যবহার করেছেন, নারীকে যৌনকাতর মাংসপিণ্ড হিসেবে হাজির করা হয়েছে।
কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করেন যে, সমাজ নারীকে যেরকম অক্রিয় ও পুত-পবিত্র মনে করে, নারীকে এসব সাহিত্যে কামকাতর ও আগ্রাসী হিসেবে দেখানোর মাধ্যমে সেই প্রথাগত ধারণাকেই চ্যালেঞ্জ করা হয়। সাদের সাহিত্যে নারীকে কখনও কখনও এতটাই আগ্রাসী দেখানো হয়েছে যে, পুরুষরা নারীতে গমন করতে সাহস পায়না, নিজেদের মধ্যেই তারা পায়ুপথে সঙ্গম করতে থাকে। জুলিয়েট এমনকি পোপের সঙ্গেও যৌনসম্পর্ক গড়ে তোলে। কিন্তু নারীশরীরকে যেমাত্রায় নিপীড়ন করে সাদিজম, তা চরমভাবে পুরুষতান্ত্রিক। সাদের ধর্ষকামিতা পুরুষের যৌনভাবনায় একটি দার্শনিক ভিত্তি গেড়ে দিয়েছে চিরতরে।
আর ফরাসি বিপ্লবের পরে রানিকে যে আক্রমণ করা হয়েছে তা সর্বান্তকরণে একটি পুরুষতান্ত্রিক আক্রমণ। এক্ষেত্রে মূল আক্রমণের লক্ষ্য রাজাকে সাহিত্যে হেনস্থা না করে, রানিকে বেশ্যার পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়েছে এই ভাবনা থেকে যে এতে রাজাই শেষপর্যন্ত জব্দ হবে। বিংশ শতাব্দির নন্দনমুখী অশ্লীল সাহিত্য, নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে, নারীকে নিয়ে পুরুষতান্ত্রিক যথেচ্ছাচারের প্রকাশমাত্র। লোলিতা উপন্যাসে দেখা যায় মধ্যবয়সী নায়ক হামবার্টের প্রতি লোলিতার মা আকৃষ্ট, কিন্তু হামবার্ট আকৃষ্ট বালিকা লোলিতার প্রতি। নায়ক মাকে বিয়ে করে এজন্য যে লোলিতাকে এর মাধ্যমে কাছে পাওয়া যাবে।
এই কাহিনী আসলে পুরুষ লেখকের মনস্তাত্ত্বিক পারভারশনের নান্দনিক প্রকাশমাত্র।
চিত্র: ফ্যানি হিল-এর এক সংস্করণের প্রচ্ছদ।
চলবে ...
প্রথম প্রকাশ: রবিউল করিম সম্পাদিত ব্যাস-৮, ফেব্রুয়ারি, ২০০৯।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।