সঙ্গে সাহিত্যের সুবাস ...
প্রথম পর্ব: Click This Link
একসময় মনে করা হতো পর্নোগ্রাফি কেবলই যৌনকর্মের খোলামেলা উপস্থাপন, এমনকি নারীরাও পর্নোগ্রাফি থেকে যৌনতাকে আস্বাদন করতে পারেন, তাকে কেবল পুরুষ-ভয়ারের জায়গায় নিজেকে স্থাপন করতে হবে। রেপ্রিজেন্টেশনের আলোচনায় মিশেল ফুকো বলেন:
"পুরুষদের-জন্য-তৈরী পর্নোগ্রাফি নারীদের জন্য 'কাজ' করবে তখনই, যখন নারী কোনো-না-কোনো ভাবে নিজেকে 'কাঙ্ক্ষিত পুরুষ ভয়ার'-এর [যে কারও অগোচরে লুকিয়ে কাউকে দেখে তাকে 'ভয়ার' বলে] আসনে বসাতে পারবে; পুরুষ-পর্নোগ্রাফির ডিসকোর্স যে-আদর্শ-কর্তা-আসন তৈরি করে তা আসলে একটি 'কাঙ্ক্ষিত পুরুষ ভয়ার'-এর আসন, যার মাধ্যমে পুরুষতান্ত্রিক পুরুষ-আসন থেকে পর্নোগ্রাফির পাত্র-পাত্রীদের দেখা হয়ে থাকে (হল উদ্ধৃত, ১৯৯৭: ৫৬)"।
অনেক নারীবাদী তাত্ত্বিক মনে করেন, পর্নোগ্রাফি কেবলই পুরুষদর্শকের জন্য নির্মিত যৌনকর্মের প্রদর্শনী নয়। এর সঙ্গে লৈঙ্গিক সম্পর্কের বিষয় জড়িত রয়েছে, রয়েছে ক্ষমতা-প্রশ্নও, ফুকোও যেদিকটার কথা উল্লেখ করেছেন। লরা কিপনিস-এর মতে পর্নোগ্রাফি প্রতিষ্ঠা করে, 'পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতা এবং নারীর অধস্তনতা ও পীড়নের ধারাবাহিকতা' (কিপনিস, ১৯৯৮: ১৫৩)।
তবে তৃতীয় তরঙ্গের ও উত্তরাধুনিক নারীবাদীদের একটি অংশ পর্নোগ্রাফিবিরোধী নন; তারা মনে করেন, পর্নোগ্রাফি দেখা ও তাতে অংশ নেয়া একজন নারীর ব্যক্তিগত রুচি ও অধিকারের মধ্যে পড়ে, পুরুষতান্ত্রিক ও পুঁজিতান্ত্রিক বিধিনিষেধ বা নৈতিকতা দিয়ে তাকে আটকানো যাবে না। পর্নোগ্রাফির পক্ষের অনেকে হার্ড ও সফট পর্নোগ্রাফিকে অনুমোদন করলেও, চাইল্ড পর্নোগ্রাফিকে অনুমোদন করেননা। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের হাইকোর্ট চাইল্ড পর্নোগ্রাফির বিরুদ্ধে একটি রায় দিয়েছে।
কিন্তু এখন পর্যন্ত পর্নোবিরোধী নারীবাদীদের দাবিই শক্তিশালী। পর্নোবিরোধী নারীবাদীদের মধ্যে আবার দুটি ধারা আছে।
একপক্ষ মনে করেন পর্নোগ্রাফি পারিবারিক মূল্যবোধ ও বৈবাহিক যৌনতার ধারণার ওপরে আঘাত। আরেক পক্ষ পর্নোগ্রাফিকে নারীর অবমূল্যায়ন ও পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধ পুনঃপ্রতিষ্ঠার আখড়া হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এই প্রবন্ধ দ্বিতীয় পক্ষের অবস্থানের আলোকে পর্নোগ্রাফিকে বিশ্লেষণ করতে চেয়েছে। অর্থাৎ নৈতিক মূল্যবোধের চাইতে এর জেন্ডারপ্রসঙ্গকে এই প্রবন্ধের বিষয়বস্তু হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছে।
ক. সাহিত্যের পর্নোগ্রাফি
পশ্চিমা সাহিত্যে পর্নোগ্রাফির বিশ্লেষণ অংশটির আলোচনার জন্য আমি ব্যাপকভাবে নির্ভর করেছি মারিয়ানা বেকের 'দ রুটস্ অব ওয়েস্টার্ন পর্নোগ্রাফি' শীর্ষক গবেষণা-প্রবন্ধের ওপর (বেক, ২০০৩)।
বেক পশ্চিমা সহিত্যে পর্নোগ্রাফির বিকাশের জন্য মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার, উপন্যাসের আবির্ভাব, ইউরোপে মধ্যবিত্ত-শ্রেণীর উদ্ভব, ভিক্টোরীয় এনলাইটেনমেন্ট, ফরাসি বিপ্লব ইত্যাদিকে দায়ী করেছেন। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দিতে, সাহিত্যের পর্নোগ্রাফির ভূমিকা ছিল 'সীমালঙ্ঘনকারী'র। বিশেষত রাজতন্ত্র ও চার্চের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঐ প্রতিষ্ঠানগুলোকে আঘাত করার জন্য পর্নোগ্রাফির আশ্রয় নেয়া হতো। দেখা যেত চার্চের ফাদার ও নানের মধ্যকার যৌনসম্পর্কের বিস্তারিত বিবরণ হাজির করা হচ্ছে। কিংবা ফরাসি বিপ্লবের পরে দেখা গেছে রানি মেরি-আন্তোনিওকে নিয়ে বহু পাম্ফলেট রচিত হয়েছে, যেখানে অঙ্কিত চিত্রে রানিকে হাজির করা হয়েছে নানা যৌনকর্মের আসনে, নানা পুরুষের সঙ্গে।
রানিকে উলঙ্গ করার মাধ্যমে বিপ্লবীরা প্রকারান্তরে পুরো রাজতন্ত্রকেই উলঙ্গ করতে চেয়েছে, অবমাননা করতে চেয়েছে। বিংশ শতকে এসে পশ্চিমা পর্নোগ্রাফিতে সাহিত্যিক ও শৈল্পিক উপাদানের অনুপ্রবেশ ঘটেছে, এর রাজনৈতিক ভূমিকা অপসৃত হয়েছে এবং কেবলই যৌনতার নানা অনুষঙ্গকে নিয়ে রচিত হয়েছে।
আই মোদি
পশ্চিমা সাহিত্যে পর্নোগ্রাফির শেকড় খুঁজতে গেলে আদি নিদর্শন হিসেবে পাওয়া যাবে পিয়েত্রো আরেতিনোর আই মোদি (I Modi) নামক কাব্যগ্রন্থকে, যার অর্থ 'পন্থাসমূহ'। এটি ছিল কামকাব্যবিশেষ, বা আরও স্পষ্টভাবে বললে কামসনেটগুচ্ছ যার সঙ্গে তৎকালীন বিখ্যাত শিল্পীদের আঁকা ১৬টি চিত্র ছিল, ১৬টি সনেটের সঙ্গে। চিত্রগুলোতে দেখা যায় নানা আসনে মৈথুনরত নারী ও পুরুষযুগলকে।
আরেতিনো ভেনিসে ১৪৯২ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৫৫৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন। কবিতা লেখার পাশাপাশি তিনি রাজনৈতিক প্রবন্ধও লিখতেন। তিনি সাংবাদিক ও পুস্তক প্রকাশকও ছিলেন। আই মোদি অন্তঃত দু’টি উদ্দেশে রচিত হয়েছিল: এক, লাগামহীন যৌনতার চিত্রায়ণ, যেজন্য আরেতিনো সুশীল যৌনতাসম্পর্কিত শব্দ বাদ দিয়ে একেবারে আঞ্চলিক ও অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করেন; দুই, রোমান ক্যাথলিক চার্চের দুর্নীতিকে নিয়ে ব্যঙ্গ করা।
এছাড়া কাব্যগ্রন্থটির আরও একটি দিক ছিল যে, নারীচরিত্রদের এখানে ব্যাপকমাত্রায় যৌনক্ষুধার্ত হিসেবে হাজির করা হয়েছে, যা প্রকারন্তরে যুগ যুগ ধরে চাপিয়ে-দেয়া চার্চীয় নৈতিকতাকে ব্যঙ্গ করে।
সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দির ‘ইউরোপর্ন’গুলোতে নারীকে সক্রিয় ও ক্ষুধার্ত ভূমিকাতেই দেখা যায়। ল'একল দেস ফিলেস (১৬৫৫) ও ল'একল একাদেমিয়া দেস দেমস (১৬৮০) নামক দু'টি প্রাথমিক ফরাসি পর্নোসাহিত্য নারীচরিত্রের সংলাপের ভিত্তিতেই রচিত। পর্নোসাহিত্যের এটাই একটা শক্ত রীতি হিসেবে দাঁড়িয়ে যায় যা পরবর্তী সময়ে জন ক্লেল্যান্ডের মেমোয়ার্স অব এ ওম্যান অব প্লেজার কিংবা মার্কুয়িস দি সাদ-এর জুলিয়েটসহ অনেক পর্নোসাহিত্যে বারবার ব্যবহৃত হয়েছে। আরেতিনো একাই ইউরোপে যৌনসাহিত্যের একটি বাজার সৃষ্টি করেন এবং পরবর্তী পর্নোগ্রাফি-লেখকেরা আরেতিনোর দেখানো পথ ধরেই এগিয়েছেন। ফ্রান্সে ফরাসি বিপ্লবের পূর্বে ও পরে পর্নোসাহিত্যের ব্যাপক বিকাশ ঘটে।
চার্চ ও রাজতন্ত্রকে আঘাত করা ও নারীচরিত্রের সক্রিয় ভূমিকা -- এই দুইটি বড়ো বৈশিষ্ট্য এসব সাহিত্যে লক্ষ করা যায়।
ফ্রান্স: রাজনৈতিক পর্নোসাহিত্য ও সাদ
ল'একল দেস ফিলেসকেই ফ্রান্সে পর্নোসাহিত্যের শুরু বলে গবেষকরা চিহ্নিত করেছেন। গ্রন্থটি ১৬ বছর-বয়েসী ফ্যানি এবং তার বয়সে বড়ো ও অভিজ্ঞ কাজিন সুজানের মধ্যকার আলাপচারিতাবিশেষ। গ্রন্থটি ধর্ম বা পিতা-মাতার শেখানো সব নৈতিক শিক্ষাকে চ্যালেঞ্জ করে। এর নারীচরিত্রগুলো আলাপে খুবই খোলামেলা ও যৌনতাবিষয়ে উৎসাহের সঙ্গে এরা আলাপ করে।
গ্রন্থের লেখক মিচেল মিলত ও জাঁ ল'আনে গ্রন্থটির জন্য অল্প কিছুদিনের জেলভোগ করেন। ধারণা করা হয়, গ্রন্থটির সত্যিকারের লেখক অন্য কেউ এবং রাজনৈতিক কোনো হোমরাচোমরা হবেন। গ্রন্থটির সঙ্গে অনেক লেখকই নাকি জড়িত ছিলেন -- এরকম একজন হলেন রাজা চতুর্দশ লুইয়ের রক্ষিতা মাদাম দি মেইন্তেনন ও রাজার অর্থমন্ত্রি নিকোলাস ফুকেত। চতুর্দশ লুইয়ের স্বৈরাচারিতার সময়ে ল'একল দেস ফিলেস যৌনতা ও রাজনৈতিক বিদ্রোহের মধ্যে একধরনের ফিউশন তৈরি করে যার প্রভাব ও রীতি সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দির সাহিত্যে ব্যাপকমাত্রায় দেখা যায় এবং ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব পর্যন্ত যা একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
তবে ফরাসি বিপ্লবের পরেও পর্নোসাহিত্যের আয়তন ও মাত্রা আরও বেড়ে যায়, এবং এক্ষেত্রেও রাজনৈতিক আঘাতের হাতিয়ার হিসেবে পর্নোকে ব্যবহার করা হয়।
তবে এই জায়গায় এসে নারীচরিত্রের যে সক্রিয় ও প্রাধান্যশীল ভূমিকা ছিল, তা চলে গিয়ে আক্রান্তের ভূমিকায় তাকে দেখা যায়। অবশ্য আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে রাজা ষোড়শ লুইসহ কোনো অভিজাতই বাদ যাননি। ষোড়শ লুইয়ের রানি মারি-আন্তিনিওতের ওপর আক্রমণ হয় সবচেয়ে বেশি। তাকে দেখানো হয় রীতিমতো বেশ্যার ভূমিকায়, সমকামিতায় এবং চিত্রমালায় তাকে নিম্নবিত্তের লোকজনের সঙ্গে সঙ্গমরত দেখানো হয়েছে। এমনকি তার সঙ্গম-সাথী হিসেবে তার ছোট ছেলেকেও দেখানো হয়েছে।
১৭৯৩ সালে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবার আগ পর্যন্ত এই আক্রমণ চলতে থাকে। এইসব কষ্টকল্পিত আক্রমণের মাধ্যমে লেখক-চিত্রকররা এটাই বোঝাতে চেয়েছেন যে রাজা যদি তার স্ত্রীকেই নিয়ন্ত্রণ করতে না পারেন, তবে তিনি প্রজাদের কাছ থেকে কীভাবে আনুগত্য প্রত্যাশা করেন?
ফরাসি বিপ্লবের কিছুকাল পরে পর্নোসাহিত্যের উচ্চকিত রাজনৈতিক বক্তব্যের দিকটি ক্রমশ দূরীভূত হয় এবং বিশেষত মার্কুইজ দি সাদের সাহিত্যের মাধ্যমে সাধারণ সামাজিক বিধিনিষেধ অতিক্রম করার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। সাদ রাজনৈতিক ব্যক্তিদের লক্ষ্য না করে প্রথাগত সব সামাজিক নৈতিকতাকে আক্রমণ করতে পর্নোসাহিত্য অবলম্বন করেন। যৌনতৃপ্তির জন্য শরীরে সর্বোচ্চ পীড়ন বা বিনাশ -- সাদের সাহিত্যে এই ভাবনার প্রয়োগ দেখা যায়। এজন্য তিনি নানা ধরনের চরিত্র সৃষ্টি করেন -- বেপরোয়া কামুক, উন্মত্ত লম্পট, মেধাবি দার্শনিক এরকম নানা চরিত্রের মধ্য দিয়ে সাদ তার যৌনদর্শন সৃষ্টি করেন।
বুর্জোয়া সংবেদনশীলতায় আস্থাবান থাকা এবং সামাজিক কিংবা যৌন নৈতিকতার সম্পূর্ণ ধ্বংস করাই সাদের লক্ষ্য ছিল। জাস্টিন ও জুলিয়েট নামক দু’টি উপন্যাসে সাদের সব জগত-ওল্টানো ভাবনা বেশিমাত্রায় বিধৃত ছিল। পর্যবেক্ষকরা বলেন বিংশ শতাব্দির অস্তিত্ববাদ (এক্সিস্টেন্সিয়ালিজম) ও নাস্তিবাদ (নিহিলজিম) দর্শন সৃষ্টিতে সাদের ঐ দুইটি উপন্যাসের অবদান রয়েছে। ১৭৪০ সালে অভিজাত পরিবারে জন্ম নেয়া সাদ ফরাসি বিপ্লবের পূর্বের রাজা ও বিপ্লবী, উভয় শাসক দ্বারাই টানা ২৭ বছর কারাভোগ করেন। তার সাহিত্য এতটাই বিধ্বংসী ছিল যে বিংশ শতাব্দির আগ পর্যন্ত তার বেশিরভাগ সাহিত্যকর্মই পাঠসুলভ ছিলনা।
কেউ কেউ মনে করেন সাদের ম্যানিয়া ছিল যৌনতা নয়, ধর্ম নিয়ে -- ধর্মকেই তিনি আঘাত করেছেন বেশি। তবে বিষমকাম, সমকাম, বিকৃতকাম -- যৌনতার এমন কোনো ধরন নাই যার চর্চা তিনি তার সাহিত্যে করেননি। বরং বলা যায় তার পরের সময়কার পর্নোসাহিত্য তার নির্দেশিত পন্থাই ঘুরেফিরে ব্যবহার করেছে।
চিত্র: মার্কুইস দি সাদ
চলবে ..
প্রথম প্রকাশ: রবিউল করিম সম্পাদিত 'ব্যাস'-৮, ফেব্রুয়ারি ২০০৯
প্রথম পর্ব: Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।