বেদনার পায়ে চুমু খেয়ে বলি এই তো জীবন
অমরত্বের প্রত্যাশা নেই নেই কোন দাবী দাওয়া, এই নশ্বর জীবনের মানে শুধু তোমাকে চাওয়া। মুহুর্ত যায় জন্মের মত অন্ধ জাতিস্বর, গত জন্মের ভুলে যাওয়া স্মৃতি বিস্মৃতি তৎপর...
গান শুনতে শুনতে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছির মিলি। সম্বিত ফিরে পেল গানটার কারণেই। কারণ সুমন তখন তার ভয়ানক আবেগী কণ্ঠে গেয়ে চলেছেÑ
আগেও মরেছি, আবার মরব প্রেমের দিব্যি দিয়ে!!
ভেতরে ভেতরে কেমন যেন কাঁপুনি টের পায় সে। সত্যি কী সে আবার মরছে না!
শফিককে প্রেমের দিব্যি নয়, তার দু বছরের সংসার আর তার সাথে মিশে থাকা যা কিছু আবেগ, ভালবাসা, তিক্ততা, মুধুরতা, অম্লতা, একে অপরের কাছে আসা, দূরে যাওয়া, ভুল করে ভুল বোঝা, সত্যি মিথ্যে খোঁজা... সব... সবকিছুর দিব্যি দিয়েই কী এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে না সে? চিরকালের মত!
তারূণ্যের উত্তেজনায় দিগি¦দিকজ্ঞানশূন্য হয়ে কখন যে ওরা এক হয়ে গিয়েছিল, বিলীন হয়েছিল মমতায়, মধুরতায়, কামুকতায়, উত্তেজনায়।
মেঘের পদ্য আর প্রজাপতির ডানায় সে কথা হয়ত লেখা ছিল না। কিন্তু ওরা জানত। আত্মীয়-স্বজন সব হারিয়ে ওরা তখন একটি মাত্র জিনিসকে আকড়ে ধরে স্বপ্ন দেখছিলÑ তা হচ্ছে বিশ্বাস। তখনও কে জানত? ভালোবাসার অলি গলিতে একদিন পূতি গন্ধ ছড়াবে অবিশ্বাসের হাওয়া।
এই চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিত গিয়ে আরও একটা ভাবনা পেয়ে বসেছে তাকে।
সব ছেড়ে, সব পিছুটান ফেলে যেখানে যাচ্ছে সেখানে সে ঠায় পাবে তো?
আপনা আপনি ওর চোখজোড়া চলে যায় দেয়াল ঘড়ির দিকে। টিক টিক টিক। বিবর্ণ কিছু সময় পেছনে ছুঁড়ে ফেলে এগিয়ে চলেÑ নৃত্যরত অহংকারী সেকেন্ডের কাঁটা। সুমনের গান অস্পষ্ট হয়ে আসে। ঘোর ঘোর লাগে সব কিছু।
এখনো গোছানোর অনেকটাই বাকী। কী কী নেবে সঙ্গে ভেবে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। এই হাত আয়নাটা, কিছু কাপড়, পুরোনো বই, লেখালেখির জন্য কিছু প্যাড, কলম, কিছু টুকটাক মেয়েলি জিনিসপত্র। এই সেই নিয়েও ব্যাগটা কেমন যেন নেতিয়ে আছে। ঠিক যেন তার নিজের মতই! একেবারের জন্য তো চলে যাচ্ছে।
খুব প্রয়োজনীয় কিছু রেখে গেলে নিতে আসা সম্ভব হবে না। মাথা খাটিয়ে বের করার চেষ্টা করে মিলি। আর কী কী নেয়া বাকী।
‘মিলি! মিলি!’
শাশুড়ির আওয়াজ শুনে কেমন যেন অস্বস্তি লাগে ওর। ডাকের উত্তর দেয় না।
চুপচাপ বসে থাকে। সে ভালো করেই জানে, এই ঘরেই আসবেন মহিলা। এমনিতে কখনও ডাকেন না। যখনই কোন কাজে ভুল হয় কিংবা কটু কথা শোনানোর দরকার হয় তখনই ডাক পড়ে। মিলিও উত্তর দেয় না।
তাছাড়া বিয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত ওই মহিলা তাকে বৌমা বলে ডাকে নি কখনও। সামনে পড়লে বা কিছু জিজ্ঞাসা করার থাকলে প্যাসিভ ভাবেই বলে। নিতান্ত প্রয়োজন না পড়লে মিলি নামটাও ধরে ডাকেন না। সে ডাকের উত্তরই বা দেবে কেন?
খট করে নব ঘুরিয়ে শাশুড়ি এসে ঢোকেন রুমে।
‘কানে কম শোনা শুরু করেছ না কি? এ্যাঁ? এতক্ষণ ডাকছি!’
‘এখন শুনতে পাচ্ছি।
বলুন। ’
‘আজও শফিক না খেয়ে অফিসে গেছে। কদিন ধরেই দেখছি ঠিক মত খাচ্ছে না, সময় মত ফিরছে না। সব মুখ হাড়ির মত করে রাখে। বলি হচ্ছেটা কী?’
‘সেটা আপনার ছেলেকেই জিজ্ঞেস করুন।
সে তো আমার মত কানে কম শোনে না। ’
মেঝেতে রাখা ব্যাগটা এখনও খেয়াল করেন নি মিসেস মনোয়ার। তাহলে কথা আরো অনেক আগেই থেমে যেত।
‘তুমি কী ইয়ার্কি মারছ আমার সাথে?’
‘আপনার সাথে আমার সে সম্পর্ক নেই নিশ্চয়?’
আজ বড় শক্ত কথা শোনাচ্ছে মিলি। ভালো লাগছে।
শোনাবে। আরও কড়া কড়া কথা শোনাবে। এতদিন শুধু শুনেই গেছে। আজ বলবে। অনেক কঠিন কথা বলবে আজ।
দ্বিগুন তেজে জ্বলে ওঠেন মিসেস মনোয়ার ‘ভালো করে শুনে রাখ মেয়ে। তোমরা নিজেরাই নিজেদের বুদ্ধিতে সংসার পেতেছ। যা খুশি কর। কিন্তু খবরদার! তোমাদের সংসারের বিষ আমার সংসারে যেন না আসে। আমার ছেলেকে নিয়ে আমার সংসার।
ওর যদি কিছু হয় তো তোমাকে ছাড়বো না বলে দিলাম?’
‘ছেলে কী আপনার একটা? বড় মেজ ছোট ছেলেদের চোখে পড়ে না। সেজটাকে নিয়ে এত বাড়াবাড়ি কেন? সেজ ছেলে কী এমন মধু?’
শাশুড়ি চোখ বড় বড় করে তাকায়। আজ এত স্পর্ধা পেল কোথায় মেয়েটা?
‘ছোটটাকে তো টাকা গিলিয়ে বড় করছেন। বান্ধবী নিয়ে ঘুরে বেড়ায় আর টাকা ওড়ায়। তাকে নিয়ে চিন্তা হয় না?
আলমিরা থেকে কসমেটিক্সের বাক্সটা নামায় মিলি।
ব্যাগে ঢোকাতে ঢোকাতে বলে,
‘বড় আর মেজ ছ মাসেই নতুন নতুন বেশ কটা ফ্ল্যাট আর জমি কিনেছে। এত টাকা হঠাৎ করে ওরা পেল কোথায়? কালো টাকায় কেনা কিনা তা নিয়ে চিন্তা হয় না? শুধু সেজটাকে নিয়েই যত চিন্তা!’
শাশুড়িকে কথাগুলো হজম করতে বেগ পেতে হয়। ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলেন তিনি। মিলিও কথা থামায় না। চলে যাওয়ার আগে সমস্ত বিষ উগলে দিতে চায়।
‘কান খুলে শুনুন। সেজ ছেলেকে নিয়ে আপনার এতই যখন চিন্তা তখন সে এলে তাকে জিজ্ঞেস করবেন তোÑ রোজ রাতে নাইট ক্লাব গুলোয় গিয়ে ড্রিঙ্কস করে কেন? ওর পি এ কে বউ করে ঘরে তুলবে নাকি বিগত এক বছর যেমন রক্ষিতা করে রেখেছিল তেমন রাখবে? পারবেন না জিজ্ঞেস করতে?
প্রশ্নের আকস্মিকতায় হকচকিয়ে যান মহিলা। ছেলের স্বপক্ষে আরও কিছু কথা শোনাবেন নাকি বেরিয়ে যাবেন বুঝতে পারছিলেন না। তখনই তার চোখ পড়ে নিচে রাখা ব্যাগটার দিকে।
‘ব্যাগ? ব্যাগ কেন? কোথায় যাচ্ছ তুমি?’
সে কথার উত্তর দেয় না মিলি।
গলার স্বর উচ্চগ্রামে চড়িয়ে বলে,
‘চিন্তা করবেন না। আপনার মূল্যবান কিছু চুরি করে নিয়ে যাচ্ছি না। সন্দেহ হলে ব্যাগ চেক করে দেখতে পারেন?’
শাশুড়ি কেবল দাঁত কিড়মিড়ই করেন, রাগে কিছু বলতে পারেন না। আর কিছু না বলা উচিত ভেবেই হয়তো মুখ ঘুরিয়ে ঝট করে বেরিয়ে যান। মিলি হাসে।
নিজের অজান্তেই হা হা করে হেসে ওঠে। বিদ্রুপের হাসি। নিজের প্রতিই কী নিজের বিদ্রুপ?
এখন কেন যেন তার মনে হচ্ছে সত্যি সত্যি সে সব ছেড়ে চলে যাচ্ছে। এই কান ঝালাপালা করা অসহ্য মহিলাটাকে আর দেখতে হবে না। তার প্যানপ্যানিও শুনতে হবে না।
এটা ভাবতেই কেমন যেন একটা অন্য রকম স্বস্তি লাগছে।
খাটের ওপর ফেলে রাখা এলোমেলো জিনিসপত্র আলগোছে একে একে তুলে নেয় ও। ভরতে থাকে বহুদিনের পুরোনো পীত রঙ্গের কাপড়ের ব্যাগটায়। চাকা ওয়ালা সুটকেস একটা অবশ্য আছে তার । শফিক কিনে দিয়েছে।
বেশ দামী। অনেকগুলো চেম্বার। অনেক কিছু রাখা যায়। কিন্তু সেটা সে নিচ্ছে না। শফিকের দাম্ভিকতা আর এক ঘেয়ে বড়লোকি হালচাল পুরে আছে ওই ব্যাগের প্রতিটা চেম্বারে।
এখন আর ওটার মূল্য নেই তার কাছে। এর চেয়ে বরং কাপড়ের ব্যাগটাই ভালো। জরাজীর্ণ বোধহীন সংসারের মতই নেতিয়ে পড়া পুঁতি গন্ধময় ব্যাগটা।
একটা দীঘশ্বাস ফেলে মিলি। দুপুর তিনটায় ট্রেন।
তার আগেই সব গুছিয়ে নিতে হবে। মোবাইলের চার্জারটা মনে করে ঢোকায় সাইড পকেটে।
বাকিটা আগামী পর্বে
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।