বেদনার পায়ে চুমু খেয়ে বলি এই তো জীবন
শেষ পর্ব-
ট্রেন লেট করছে।
প্লাটফর্মে গিজগিজে ভীড়। বেশির ভাগই দাঁড়াতে দাঁড়াতে ক্লান্ত হয়ে যার যার বাক্স-প্যাটরার ওপর বসে পড়েছে। হাঁসফাঁস করা অস্থির যাত্রীদের অস্থিরতা কমাতে মাইকে কিছুক্ষণ পরপর উচ্চারিত হচ্ছেÑ
‘ইঞ্জিন এখন তিন নম্বর প্লাটফর্মে। চট্টগ্রাম গামী মহানগর গোধূলীর সম্মানিত যাত্রীরা, আপনারা ধের্য্য ধরে অপেক্ষা করুন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ইঞ্জিন এসে পড়বে। আপনাদের সাময়িক অসুবিধার জন্য আমরা আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। ’
মিলি ফোঁস করে ভেতরে চেপে রাখা বাতাসটা বের করে দেয়। সেই কখন থেকে কিছুক্ষণপর কিছুক্ষণপর বলে চেঁচাচ্ছে। এই কিছুক্ষণটা কতক্ষণ কে জানে?
পেপার কিনে নিয়ে পড়বে নাকি? নাহ্।
এই গাদাগাদি ভীড়ে পেপার পড়ে শান্তি পাওয়া যাবে না। সেও অস্থির চোখে এদিক ওদিক তাকায়। রং বেরঙের ফ্যাশনেবল পোশাক পরা মেয়েরা যুবকেরা শিশুরা বৃদ্ধরা সবাইকে দেখতে থাকে। ওদের ঝলমলে পোশাক মিলির চোখে ধাঁধা লাগায়।
জীবনের বায়োস্কোপে হাতল ঘোরানো ছাড়াই একে একে ভেসে ওঠে ছবি।
ঝট করে সরে যেতে যেতে ফুটে ওঠে অতীতের কিছু ধূসর স্মৃতি।
এমন ধাঁধা লাগা চোখেই সে এক সময় দেখতামÑ কেয়া সোহেল আর মুন্নীকে। আামার মামতো ভাইবোন ওরা। দারুন দারুন সব পোশাক পরে ঈদের দিন ঘুর ঘুর করছে সারা বাড়ি। আর আমি! আমি পড়ে আছি ফিনফিনে সুতির শাদা ফ্রক।
তাও বিধবা মায়ের শাড়ি কেটে অপটু হাতে বানানো। মরে যাওয়ার আগে দেয়া শেষ উপহার। এই ফ্রকটা পরেই তো দু বছর আগে মামা বাড়িতে আসা।
“তাই তাই তাই মামা বাড়ি যাই,
মামা দিল দুধ ভাত পেট ভরে খাই,
ছড়াটা তখন ঝরঝরে মুখস্থ। মামা বাড়ি আসার পরেও বুঝতে পারিনি ছড়া আর বাস্তবতা কেমন অসীম তফাৎ!
রমজান তখন কাঠ ফাটা গ্রীষ্মে।
রোজা রেখে আমাকে নিয়ে ধুকতে ধুকতে মামা বাড়িতে পা দেন আমার মা। চট্টগ্রামের কর্ণফুলীর পাড়েই মামা বাড়ি। মামী র্ভৎসনার সুরে মাকে অভ্যর্থনা জানান।
পিড়িতে বসে ক্লান্ত বিধ্বস্ত মা আমার প্রথম যে কথাটি বলেন তা হলÑ আমার দ্বায়িত্ব নিতে হবে মামাকে। তিনি আর পারছেন না।
মায়ের এমন প্রস্তাব শুনে স্বয়ং মামার উলম্ফন শুরু হয় যায়। চট্টগ্রামের স্থানীয় ভাষায় চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দেন। যার ভাষান্তর করলে দাঁড়ায়Ñ
‘পাগলা কুত্তা কামড়েছে নাকি আমাকে! মিলিকে এখানে রাখবো ওর পড়াশুনার দায়িত্ব নেব, এত টাকা কোথায় আমার? তিনটা নিয়ে বাঁচিনা। ব্যবসা পাতির অবস্থাও ভাল না। হাসিনা? তুই কী বুঝতে পারছিস কী অসম্ভব কথা বলছিস তুই?’
হাসিনা ডুকরে কেঁদে ওঠে।
‘দেখ না ভাইজান! বাপ মরা মেয়ে। তুমি ছাড়া ওর কে আছে?’
মায়ের চোখের পানি টপাটপ করে ছোট্ট মিলির গালে পড়ে। শাদা ফ্রকের কোণা তুলে পানি মুছে সে অবাক হয়ে ভাবে, তাই-তাই মামা বাড়ি এসেছে। মামা বাড়ি আসলে তো হাসতে হয়। মা তবে কাঁদছে কেন?
‘ভাইজান? এই যে...’ বলতে বলতে হাসিনা আঁচলের গিট খুলে কিছু বের করে আনে।
‘এইগুলি রাখ ভাইজান। ’
তার শেষ অবলম্বন। ক ভরি গহনা। পায়ের কাছে পড়ে থাকা চটের ব্যাগটা থেকে একটা দলিলও বের করে। মিলির বাবার এক টুকরো জমি আর ভিটে বাড়ি।
মামা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে তার বোনের দিকে। আসলে সে করতে চাচ্ছেটা কী?
‘এইগুলা দিয়ে অন্তত আমার মেয়েটাকে রাখ! আমার শরীরটা ভাল যাচ্ছে না। কখন কী হয়ে যায়!’
মামীর গোপন চিমটির চোটে ভ্যাবাচেকা খেয়ে যান মামা। এই চিমটির মানে তিনি জানেন। বুঝে নিলেন পরিস্থিতি হ্যাঁ বোধক করতে হবে।
বিড় বিড় করে কি বললেন বোঝা গেল না।
মামীই চড়া গলায় বললেনÑ মিলিকে আমরা রাখবো, অনেক খরচ হবে। ওর খরচ বাবদ এখন যা দিচ্ছেন পরে কিন্তু সেগুলো নির্লজ্জের মত চাইতে পারবেন না। আর চাইলেও আমরা দেব না। মনে থাকে যেন!’
হাসিনা চোখে পানি নিয়ে অদ্ভুতভাবে হেসে ওঠে।
কিছু বলে না।
‘সবই তো দিয়ে যাচ্ছিস। তুই থাকবি কোথায়? খাবি কী?’ মামার গলায় সে প্রশ্নগুলোর জোর নেই। তবু রক্তের সম্পর্ক বলে একটা কথা থাকে সে জন্য বলা।
তখন মা আবারও হেসে উঠেছিলেন কিছু না বলে।
কেন হেসেছিলেন সেটা বোঝা গেল পরদিন রাতে।
মায়ের জ্বর বেড়ে খিঁচুনি উঠে গেছে। দাঁতে দাঁত লেগে ঠকাঠক করছে। বাবার মৃত্যুর পর আমার অভিভাবক হওয়ার জন্যই এতদিন মরণ অসুখ পুষে বেঁচে ছিলেন। আজ আমার নতুন অভিভাবক হয়েছে।
তাই এখন মা মুক্তি চাইছেন। অসুস্থতা, দারিদ্রতা আর দায়বধ্যতা থেকেও মুক্তি।
টানটান হাত পা নিয়ে মা অতি কষ্টে বললেনÑ ‘দাঁত লেগে যাচ্ছে ভাইজান! দাঁত লেগে যায় তো!’
মামা বিরক্ত হয়ে বললেন ‘অবস্থা তো বেশি সুবিধার না। যাই ডাক্তার ডেকে আনি। ’
মামী শার্ট খামচে ধরেন।
চাপা গলায় ফিসফিসিয়ে ওঠেনÑ
‘কোথায় যাচ্ছ? এমনিতেই মরবে। শুধু শুধু ডাক্তারের ভিজিট খরচ কেন?’
মামার প্রথম দিনের প্রশ্নগুলোর উত্তর মা শেষ রাতে দিয়ে গেলেন।
‘সবই তো দিয়ে যাচ্ছিস। তুই থাকবি কোথায়?’
মা তার থাকার আশ্রয় পেল আকাশের বুকে। আকাশের তারা হয়েই তো গেল! ঝলমলে তারা।
...আর ঝলমলে পোশাক। সে বছরই ঈদে দামী পোশাকে সজ্জিত মামতো ভাইবোনেরা আমাকে কেবলই অবাক করছিল। অবাক হয়েছিল আমি বারবার। অত অল্প বয়সে ছড়ার বইয়ের মিষ্টিমধুর ‘তাই তাই মামা বাড়ি’র এমন রূঢ়তা দেখে কে না অবাক হবে?
অবাক হয়েছিলাম আরও অনেক কিছুতেই। বাড়ির আর সব লোকজনের আড়ালে মামা নামের লোকটা যখন আদরের ছলে অস্থির আঙুল চালাতো দেহের আনাচে কানাচেÑ শৈশব আমিÑ তখনও অবাক হয়েছি।
খেতে বসে মামতো ভাইবোনদের পাতে দুই তিন টুকরো মাছ পড়তো আর আমার পাতে পড়তো সবচেয়ে ছোট, একটাই টুকরোÑ কৈশর আমি তখনও অবাক হয়েছি।
হয়তো পড়াশুনাটা শেখা হতো না। মামার শ্যালকের অত্যুৎসাহে পড়াশুনাটা কেমন করে যেন হয়েই গেল। পরে পড়ার খোঁজ খবর নেয়ার ছলে সদ্যবিকশিত আনকোরা যৌবনের এখানে সেখানে অস্থির একটা হাতের উপস্থিতি বুঝিয়ে দিল তার এত উৎসাহ কেন? যৌবন আমিÑ কোন প্রতিবাদ করতে পারতাম না।
আমার শৈশব, কৈশোর প্রথম যৌবন নামক দিনগুলো আমি কখনোই ফিরে পেতে চাই না।
ওগুলো জীবনের পদাঘাতে এতটাই ক্ষত বিক্ষত হয়ে গেছে, ফিরে আসলে হয়তো চিনতেই পারব না!
বিধির জোরে সেই নিষ্ঠুর মামা বাড়িতেই ফিরে যেতে হচ্ছে এখন। ওরা আমাকে ঘরে ঢুকতে দেবে তো? নাকি শফিকের সাথে পালিয়ে যাওয়ার কারণে আক্রোশ ঝাড়তে ঘরেই ঢুকতে দেবে না। কিন্তু আমার যে যাওয়ার আর কোন যায়গা নেই!
আর কিছু ভাবতে পারে না মিলি। বায়েস্কোপের পর্দাটা ধুপ করে অন্ধকার হয়ে যায়। ছলছল করে ওঠে ওর চোখজোড়া ।
স্টেশনের অস্থির লোকজন সব একে একে ঝাপসা হয়ে আসে। হৈ চৈ মিলিয়ে যায়। একটা চাপা ব্যথা গুমরে ওঠে বুকের ভেতর। পাজরের হাড় ছিঁড়ে থেকে বলকে বলকে উঠে আসে বহুদিনের জমে থাকা শূন্যতা। দীর্ঘশ্বাস হয়ে সেগুলো মিলিয়ে যায় দূরে কোথাও।
এক জীবনে সে কী কেবলই শূন্যতা পেল!
‘এক্সকিউজ মি? আপনি কী অসুস্থ?’
একটা পুরুষ কণ্ঠ কানে আসতেই ঝট করে মাথা তুলে তাকায় মিলি। ঝাপসা চোখে অবয়বটাই চোখে পড়ে কেবল।
‘জ্বী না। মাথাটা একটু ধরেছে কেবল। ’ কথা কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।
মাথায় চেপে ধরে রাখা হাতটা নামিয়ে সুস্থির হয়ে বসার চেষ্টা করে।
‘কোন হেল্প লাগবে? যদি বলেন তো... আরে আপনি তো ঢলে পড়ছেন!’
নিজেকে সামলে নিতে নিতে কোন মতে বলে মিলা ‘অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। একটু পরেই ট্রেন এসে পড়বে। তখন তো ট্রেনেই....’ মিলি কথা শেষ করতে পারে না। নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে তার দিকেই চেয়ে থাকা এক জোড়া বিস্ফোরিত চোখের দিকে।
‘মিলি! তুমি?’
মিলি কাঁপাকাঁপা হাতে ঝাপসা চোখ ডলে পরিষ্কার করার চেষ্টা করে। শুধু হাত কেন সমস্ত সস্ত¡া ওর তিরতির করে কাঁপছে। এমন পরিচিত স্বরে তো একজনই ডাকতো তাকে!
দৃষ্টি স্বচ্ছ হতেই প্রথম যে কথাটা তার মনে হল, তা হলো তার অন্ধ হয়ে যাওয়াই ভালো ছিলো। এ কাকে দেখছে সে! স্টেশনের শত শত লোকের ভীড়ে তার সাথেই দেখা না হলে এমন তো কোন ক্ষতি ছিল না!
চুপ করে থাকে মিলি।
আসলে তার বলার কোন মুখই নেই।
কী বলবে সে? পাড়ার একটা উঠতি মাস্তান এক সময় তাকে প্রেম নিবেদন করেছিল। ভয়ে হোক কিংবা নিজেকে বাঁচাতে তার সাথে প্রেমের অভিনয় করে যেতে হয়েছিল।
পাড়ার ছিচকে মাস্তানের কোন ভবিষৎ থাকে না। এরও ছিল না। এ সময় বড় খুনী হতো।
একে বিয়ে করলে খুনের টাকার সংসার চালাতে হত। সে সময় ব্যাপারগুলো ঠিকই বুঝতে পেরেছিল মিলি। আর বুঝতে পেরেছিল বলেই চমৎকার ভাবে সব ম্যানেজ করে দিব্যি অভিনয় চালিয়ে গিয়েছিল। মামারাও জানতো না। একবার অতি গোপনে ঠোঁটে ঠোঁট রেখে চুমুর ব্রেকেটে বন্দী হওয়া ছাড়া আর কোন ঝামেলা তাকে পোহাতে হয় নি।
শফিককে নিয়ে যেদিন পালিয়ে আসছিল সেদিনও রাস্তায় মিহি গলায় কত কথকতা!
ট্রেনের হৈ চৈ ছাপিয়ে ভেসে আসে চির চেনা কণ্ঠÑ ‘ভালো আছ মিলি!’
উত্তরটা নিঃসন্দেহে মিলির জানা। তাও বলে, ‘আছি ভালোই। তুমি?’
‘ভালো। শুনলাম বিয়ে করেছ। ’
মিলির ভেতরটা আবারও কেঁপে উঠলো যেন।
বিয়ের ব্যাপারটা জানে তাহলে! মামা বাড়ি থেকে খবরটা জেনে নেয়া বিচিত্র নয়।
মিলির খুব ইচ্ছে হল একবার ওকে সত্যি কথাটা বলেÑ শফিকের সাথে তার আসন্ন ডিভোর্সের কথা। পরক্ষণে কী মনে করে চেপে যায়।
‘বিয়ে করনি?’ প্রশ্ন করে মিলি।
‘তোমার মত আরেকজনকে পেলাম কই?’ হা হা করে হাসে ছেলেটা।
‘আমার মত আরেকজনকে! সেও যদি তোমাকে ধোঁকা দিয়ে যেত! যেমন আমি দিয়েছিলাম?’
‘তাহলে সে তোমার মতই অসুখী হত। ’
ছ্যাৎ করে ওঠে। কথাগুলো তীরের ফলার মতই বুকে বেঁধে যেন। কী বলবে মিলা ভেবে পায় না। মুচকি হেসে বলে, ‘তুমি কীভাবে জান যে আমি অসুখী? টাকার বিছানায় শুই জান?’
‘ওটাকে শান্তি বলে না।
টাকার বিছানায় শান্তি ঘুমাতে না পারলে, ওই বিছানাটাই বৃথা। সত্যি করে বলতো তোমার হাসবেণ্ডের সাথে কিছু হয়েছে? তোমার চেহারায় কেমন যেন ক্লান্তি আর হতাশার ছাপ। বছর তিন আগের মিলির কিন্তু এমন চেহারা ছিল না। ’
এক পলক সুমনের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবে ও।
‘তিন বছর আগের মিলি কেমন ছিল?’
‘সে মিলা খুব হাসতে জানত।
আর...’ খাণিক্ষণ চুপ করে থেকে মাথা নাড়ায় সেÑ
‘আর খুব ভালোবাসতে জানত। ’
প্ল্যাটফর্মের ব্যস্ত কোলাহলের ভেতরও একটা নিস্তরঙ্গ শূণ্যতা, নিস্তব্দতা গ্রাস করে ওদের। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর আবেগে আতিশয্যে অবশেষে কথাগুলো বলেই ফেলে মিলি। শফিকের মেয়ে মানুষ জনিত দূর্ঘটনার কথা, শ্বাশুড়ির অপমান। দম বন্ধ করা অবৈধ বিলাসভোগ।
আর দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে সংসারে আসন্ন শফিকের বর্তমান পি.এর কথা। সব। ভালাই হল। বলতে পেরে নিজেকে কেমন যেন হালকা হালকা মনে হয়। সুমনের চোখেমুখেও বিষন্নতা।
‘স্যরি মিলি। ’
‘আমার সামনে এটিকেট দেখাতে হবে না। জানো তো, জীবন কারও নিরবিচ্ছিন্ন আনন্দে যায় না। ভাল কথা। তুমি কী এই ট্রেনেই যাবে? নাকি কাউকে পৌঁছে দিতে এসেছ?’
‘কুমিল্লা যাব।
এই ট্রেনেই। সেখানে কাল একটা সংবর্ধনা আছে। কী আর বলব? তোমার দেওয়া ছেকা খেয়ে লেখক হয়ে গেছি। ’ ম্লান হাসে সুমনÑ ‘রাগে দুঃখে মাস্তানি ছেড়ে দিয়ে বিএ কমপ্লিট করেছি। ভাবে পড়ে লেখালেখিও শুরু করেছি।
বলতে পারো, আমি এখন এসময়ে কজন ব্যস্ত লেখকদের একজন। ’
‘তাই? দারুণ তো?’
‘তা তুমি এখন যাচ্ছ কোথায়?’
‘মামা..বাড়ি। ’
‘মামা বাড়ি! যা আশা করে যাচ্ছ তা না মেলার সম্ভাবনাই বেশি। শুনেছি ওরা খুব রেগে আছে তোমার উপর। ’
মিলি চুপ করে থাকে।
এ কথা সে ভালো করে জানে। এ মুহূর্তে তার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। তাও সে যায়গায় কেন যাচ্ছে সে নিজও জানে না।
‘কী ঠিক করলে? স্বামীর কাছে ফিরে যাবে?’
‘উহু! তোমার সাথে যাব। ’
মিলির ঠান্ডা স্বর সুমনকে আপাদমস্তক জমিয়ে দিল যেনÑ ‘আমার সাথে! আমার...! মানে আমি ঠিক...
‘বুঝতে পারছ না তাই তো? আমি তোমার সাথে থাকব আজীবনের জন্য।
তুমি বিয়ে করবে আমাকে? সেই মেয়েকে। যাকে ছাড়া তুমি বিয়ে করবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছ। বিশ্বাস কর! আমি এখনও সেই মিলি আছি! আমি হাসতে পারি। গাইতে পারি। এখন হয়তো পারছি না।
তুমি আমাকে সাহায্য কর। ঠিক পারব।
পুরোনো প্রেমিকার নূতন আহবান যেন আমূল নাড়িয়ে দেয় সুমনকেÑ ‘তুমি পারবে পুরোনো সব স্মৃতি ভুলে যেতে?’
‘পারব। ’
‘ওই যে! ট্রেন এসে এসে গেল। তুমি একটু দাঁড়াও।
ওয়েটিং রুমে আমার এক বন্ধু আছে। ও-ও যাবে আমাদের সাথে। মালপত্র ওর কাছে। নিয়ে আসি। তুমি এ যায়গা থেকে আর এক পাও নড়বে না।
ঠিক আছে?
ভেতরের কাঁপুনি সামলে কোনমতে মিলি বলেÑ ‘হু। ঠিক আছে। ’
এই শীতকালেই ঘাম ঝরে মিলির। ট্রেন ছাড়ার হুইসেল দিয়ে দিয়েছে। কী করবে সে! সুমন এখনও আসছে না কেন? দৌড়ে ট্রেনে উঠবে?
ছিঃ এসব কী ভাবছে সে! সুমন নিশ্চয়ই তাকে ছাড়া একা ট্রেন উঠবে না? কিন্তু ওয়েটিং রুম থেকে এখানে আসতে তো এতক্ষণ সময় লাগার কথা না।
নাকি আরেকটু অপেক্ষা করবে।
এই দুরবস্থার ভেতরও মিলি ম্লান হাসে। বুঝতে পারেÑ আকস্মিকভাবে তাকে পেয়ে কী করবে বুঝে উঠতে পারছিল না সুমন। মালপত্র আনার ছলে আড়ালে গিয়ে হয়তো হিসেব কষেছে। লাভ-ক্ষতির হিসেব।
বুঝেছেÑ এই হঠাৎ দর্শন থেকে কিছু পাক বা না পাক, মূল্যহীন এই আপদটাকে এড়িয়ে যাওয়াই হবে নীট লাভ!
গন্তব্য যাত্রার ঘোষণা দেয় ট্রেনের তলার চাকাগুলো। ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে শব্দে আর্তনাদ তোলে। চলতে শুরু করে। মন্থর থেকে গতিতে... গতি থেকে... দ্রুত গতিতে চলতে শুরু করে। বগিগুলো বায়োস্কোপের দৃশ্যের মতই ওর চোখের সামনে থেকে সরে সরে যায়।
দেখিয়ে যায় মিলির জীবনের চিরন্তন দৃশ্যÑ এই তো জীবন! পাওয়া আর হারানোরÑ তবু হাত বাড়ানোর। ভুল আশা নিরাশার কাঁটার দহন।
প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে ছুটে চলে যায় ট্রেন। চলে যায় সুমন। চলে যায় মুহূর্তের বোনা কিছু স্বপ্ন।
চলে যায় বায়োস্কোপ। শুধু রয়ে যায় মিলি।
একা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।